পরিবেশ:মানুষের বড় বন্ধু প্রকৃতি
আলী ফোরকান
সুন্দরবন যদি সেদিন সিডরের সামনে প্রতিবন্ধক হয়ে না দাঁড়াতো তাহলে সিডরের আঘাতে প্রাণহীন এক মৃত্যুপুরীতে পরিণত হতো সমগ্র উপকূলীয় অঞ্চল। প্রকৃতি মানুষের বড় বন্ধুই নয়, কখনো কখনো শেষ রক্ষাকবচ হিসেবেও যে কাজ করে তার প্রমাণ আবারো পাওয়া গেল সাম্প্রতিক ঘূর্ণিঝড় ‘সিডর’-এর সময়। সিডরের ভয়ংকর আঘাতে বিধ্বস্ত জনপদের সম্পূর্ণ ক্ষয়ক্ষতি এখনো নিরূপণ করা সম্ভব হয়নি। প্রতিদিনই বাড়ছে মৃতের সংখ্যা। সহায়-সম্পদ, ঘর-বাড়ি, ফসল সকল কিছুই পরিণত হয়েছে ধ্বংসস্তূপে। এ পর্যন্ত ক্ষয়ক্ষতির যে চিত্র দেখা গেছে তাতেই মানুষ বাকরুদ্ধ। এ ঘূর্ণিঝড়ে প্রাণহানির আশংকা করা হচ্ছে ১০ হাজার। অথচ ঘূর্ণিঝড়টি ছিল স্মরণকালের মধ্যে অন্যতম ভয়াবহ। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ১৯৭০ সালের ঘূর্ণিঝড়ে মারা গিয়েছিল প্রায় ১০ লাখ মানুষ। গবাদি পশুসহ জীবজন্তু মারা গিয়েছিল লাখ লাখ। এরপর ভয়াবহ আরেকটি ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে ১৯৯১ সালে। তার আঘাতে ২ লাখ মানুষের করুণ মৃত্যু ঘটে। গবাদি পশু মারা যায় ১০ লাখ। সে ঘূর্ণিঝড়ের গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় প্রায় ২৫০ কিলোমিটার। এবার সিডরের গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ২৬০ থেকে ২৮০ কিলোমিটার। ’৭০ ও ’৯১-এর তুলনায় এবারের ঘূর্ণিঝড়ের গতিবেগ ও ভয়াবহতা বেশি তীব্র হলেও এতে মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে আনুমানিক ১০ হাজার, গবাদি পশুর মৃত্যুর সংখ্যায় তুলনামূলক অনেক কম। এর কারণ কি? দৈনিক ইত্তেফাকে এক খবরের শিরোনাম ছিল ‘সিডর প্রলয় : প্রকৃতিই প্রকৃতির তান্ডব ঠেকাল’। অর্থাৎ এবার সিডর মহাবিপর্যয় থেকে মানুষকে রক্ষা করেছে প্রকৃতিই। ৫০০ কিলোমিটার বৃত্তের ঘূর্ণিঝড়টি সন্ধ্যার পর থেকে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলীয় উপকূল অতিক্রম করতে শুরু করে। তীব্র ঘূর্ণিঝড় সিডরের আঘাতে যে পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা করা হয়েছিল বাস্তবে তার চেয়ে ক্ষতি কম হয়েছে। কারণ সিডরের প্রথম বাধা ছিল সুন্দরবন। ৬০৬০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের সুন্দরবন সিডর ভয়ংকর মূর্তির সামনে নিজেকে দাঁড় করিয়েছিল মহাপ্রাচীরের মতোই। যে ঘূর্ণিঝড় ১০টি পাহাড় ধ্বংস করার ক্ষমতা নিয়ে অগ্রসর হচ্ছিল সুন্দরবনের বৃক্ষরাজি তা রুখে দাঁড়ায়। নিজের অস্তিত্বকে বিপন্ন করে কয়েক ঘণ্টা সিডরের সঙ্গে সংগ্রাম করেছে প্রকৃতির অপার দান সুন্দরবন। সিডর আঘাতে নিজে ধ্বংসযজ্ঞে পরিণত হয়ে বাঁচিয়েছে উপকূলবর্তী লাখ লাখ মানুষকে। সুন্দরবনের ক্ষয়ক্ষতি এতোই ব্যাপক হয়েছে যে, তা আগের মতো অবস্থায় ফিরে আসতে সময় লাগবে কমপক্ষে ৪০ বছর। সুন্দরবন যদি সেদিন সিডরের সামনে প্রতিবন্ধক হয়ে না দাঁড়াতো তাহলে সিডরের আঘাতে প্রাণহীন এক মৃত্যুপুরীতে পরিণত হতো সমগ্র উপকূলীয় অঞ্চল। শুধু ঘূর্ণিঝড় নয়, ঝড়, ভূমিকম্প, বন্যা অতি শীত প্রভৃতি প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে আবহমানকাল থেকে মানুষকে রক্ষা করে আসছে প্রকৃতি। যে প্রকৃতি মানুষ ও প্রাণীকুলের বেঁচে থাকার অপরিহার্য উপাদানের জোগান দেয়, চরম দুর্যোগের মুহূর্তে নিজে বিপন্ন হয়ে মানুষকে রক্ষা করে সেই প্রকৃতির গুরুত্ব আমরা কতটা উপলব্ধি করি এবং তাকে রক্ষায় যতœবান হই? বরং এক্ষেত্রে আমাদের আচরণ বিপরীতমুখী। এদেশেরই একশ্রেণীর মানুষ অর্থলিপ্সা, আরাম-আয়েশের জন্য নির্বিচারে প্রকৃতিকে ধ্বংস করে চলেছে। তাদের অনাচারে একাধারে ধ্বংস হয়েছে দেশের বনজসম্পদ, পাহাড় সম্পদ, পানিসম্পদ। ফলে প্রাণীকুলের স্বাভাবিক বেঁচে থাকা এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য যে পরিমাণ বনজসম্পদ থাকা দরকার তার অর্ধেকও নেই। আজ যদি সুন্দরবনের মতো বিশাল আকৃতির বনটি না থাকতো তাহলে আমাদের অবস্থা কতটা ভয়ংকর হতো ভাবলেই গা শিউরে ওঠে। আমরা নির্বিচারে প্রকৃতি-পরিবেশের অনেক ধ্বংসসাধন করেছি। এখন সময় এসেছে প্রকৃতিকে রক্ষা করার, তার পরিচর্যার মাধ্যমে আরো সম্প্রসারিত করার। আশার বিষয় হচ্ছে সমগ্র উপকূলবর্তী অঞ্চলে সবুজ বেষ্টনি গড়ে তোলার পরিকল্পনা চলছে। সিডরের মতো প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস মোকাবিলায় সুন্দরবন থেকে টেকনাফ পর্যন্ত দীর্ঘ উপকূল জুড়ে সবুজ বেস্টনি তৈরি করার মতো একটি স্থায়ী ব্যবস্থাপনা নিতে যাচ্ছে সরকার। ঝড়-জলোছ্বাস থেকে উপকূলবাসীকে রক্ষা করতে হলে এর কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু সরকারে অনেক ভালো উদ্যোগ নানা কারণে শেষ পর্যন্ত আর বাস্তবায়িত হয় না। এক্ষেত্রে যেন তেমনটি না ঘটে। এটি করতে পারলে ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাসের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য তা হবে একটি কার্যকর ও স্থায়ী রক্ষাকবচ।
0 comments:
Post a Comment