জনসংখ্যা: ইউরোপ জুড়ে দুশ্চিন্তা
আলী ফোরকান
জনসংখ্যা সমস্যা না সম্ভাবনা- এ নিয়ে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে যখন চলছে জোর বিতর্ক। তখন ইউরোপ হাপিত্যেশ করছে আদম সন্তানের জন্য। মানুষ তো বাড়ছেই না, উপরন্তু কমছে। জনসংখ্যাতাত্ত্বিকরা ক্রমাগত সতর্ক ঘন্টা বাজিয়ে যাচ্ছেন যে ইউরোপে জনসংখ্যা কমার এই ধারা অব্যাহত থাকলে সামনে সমূহ বিপদ। অভিবাসন সত্ত্বেও ২০৩০ সাল নাগাদ ইউরোপ মহাদেশের লোকসংখ্যা এখনকার চেয়ে তিন কোটি (৩০ মিলিয়ন) কমে যাবে- এ রিপোর্ট প্রকাশ করেছে জাতিসংঘের জনসংখ্যা বিভাগ। জনসংখ্যা কমে যাওয়ায় তুলনামূলকভাবে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে ইতালি, স্পেন ও জার্মানি। জিডিপি কমে গিয়ে ব্যাহত হবে উন্নয়ন। তখন বাধ্য হয়ে আমেরিকার মতো ডিভি লটারি চালু করতে হবে। এ ছাড়া রাস্তা নেই। আর যদি তাই হয়, তাহলে তৃতীয় বিশ্বের বহু হতভাগার কপাল খুলবে। ইউরোপে জনসংখ্যা কমে যাওয়ার বিরূপ প্রভাব এরই মধ্যে পড়তে শুরু করেছে। বড় শহরগুলোতে টের না পাওয়া গেলেও উপশহর এবং গ্রামগুলোতে অনুভুত হচ্ছে তীব্র সমস্যা। দ্রুত সংকুচিত হয়ে যাওয়া জার্মান উপশহর হোয়েরশোয়ার্ডো গত ১৫ বছরে তার ৭০ হাজার লোকসংখ্যার ৩০ হাজারই হারিয়ে বসেছে। শুধু অস্বাভাবিক কম জš§হারই নয়, লোকজনের বড় শহরাভিমুখী হয়ে যাওয়াও এর পেছনে দায়ী। বর্তমান জনসংখ্যা বহাল রাখার জন্য প্রতিবছর যে পরিমাণ শিশুর জš§ নেয়া প্রয়োজন জš§ নিচ্ছে তার তিন-পঞ্চমাংশ। কম জš§হারের শীর্ষ ২৫টি দেশের তালিকায় ইউরোপেরই আছে ২২টি। এ ভয়াবহ অবস্থাকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন তুলনা করেছে ত্রিগুণ ক্ষমতাসম্পন্ন টাইমবোমার সঙ্গে। যতোই সময় যাচ্ছে, ততোই বাড়ছে আশংকা। বর্তমান অবস্থার বর্ণনা দিতে গিয়ে ইউনিভার্সিটি অব লিসবন-এর ডেমোগ্রাফার (জনসংখ্যাবিদ) নুনো দা কস্তা বলেছেন, ‘খুবই কম শিশু জš§াচ্ছে। যে কারণে বেশি বয়সী লোকদের অনুপাত ক্রমেই বেড়ে যাচ্ছে। শিশু ও তরুণরাও গ্রাম ছেড়ে যাচ্ছে। জনসংখ্যার অদ্ভুত বিন্যাসের প্রভাব পড়ছে পর্যটন থেকে শুরু করে অবসর এবং কৃষি নীতিমালাতেও। কর্ষিত বিস্তীর্ণ ভূমি ভবিষ্যতে ইউরোপে আর না দেখা যাওয়ার আশংকা দেখা দিয়েছে। আবাদের অভাবে ঘন জঙ্গল বা বনে ভরে যাবে বিশাল সব এলাকা। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে যে গ্রামে পড়ে থাকবে কেবল নিঃসন্তান ও অবসর গ্রহণকারীরা। অন্যরা শুধু ছুটি কাটানোর প্রয়োজনে ছুটে আসবে গ্রামে। এরই মধ্যে অনেকে কৃষিকাজ ছেড়ে দেয়ায় চাষযোগ্য জমিতে সূজিত হয়েছে বনাঞ্চল। ফলে বিস্তৃত হয়েছে বন্যপশুদের বিচরণ এলাকা। বার্লিন ইনস্টিটিউট ফর পপুলেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট-এর প্রধান রেইনার ক্লিংগোলেজ-এর অভিমত, ইউরোপে খাদ্য সমস্যার দিন ঘনিয়ে আসছে। গ্রিসের পূর্বাঞ্চলীয় পেলোপনেসাস প্রদেশের গ্রাম প্রাসটস-এর লোকসংখ্যা একসময় ছিলো এক হাজার; কমতে কমতে এখন অবশিষ্ট আছে মাত্র এক ডজন। সবারই বয়স ষাট থেকে সত্তরের কোটায়। কোনো ছাত্র না থাকায় একমাত্র স্কুলটি বন্ধ আছে প্রায় আট বছর ধরে। গির্জা থেকে আর ভেসে আসে না ঘন্টার আওয়াজ। এক সময়কার উর্বর জমির মাটি ধুয়ে নিয়ে যাচ্ছে বৃষ্টি; কেউ দেখার নেই। সাবেক অধিবাসী পেট্রোস লিটরিবিস নিজ গ্রাম পরিদর্শনে এসে বলছিলেন ‘বুড়োরা এখনো যে টিকে আছে কীভাবে বুঝতে পারি না। এরা মারা গেলে পুরো গ্রামটিই পরিত্যক্ত হয়ে যাবে। আমাদের প্রজšে§র কেউ ভুলেও এখানে আসবে না, সন্তানরা তো নয়-ই। আমরা শহরেই ভালো আছি। ক্রেতা পাচ্ছি না বলে এখানকার জমিও বিক্রি করতে পারছি না। সম্পূর্ণ নতুন এক অভিবাসন সমস্যার মুখোমুখি জার্মানি। নাইজি নদী ডিঙ্গিয়ে পোলিশ-জার্মান সীমান্তবর্তী গ্রামগুলোতে এসে দলে দলে নেকড়ে জড়ো হচ্ছে। অথচ ভূমি আগ্রাসী লোকেরা শত বছর আগে এসব গ্রামে থাকা শেষ নেকড়েটিকেও হত্যা করেছিলো। প্রকৃতির সুমধুর প্রতিশোধে নেকড়েরা এখন এসে দেখছে যে, গ্রামগুলোতে মানুষজন খুবই কম। তাদেরকে তাড়া করার সাহস পর্যন্ত কেউ করে না। মনের আনন্দে নেকড়েরা এখন ভক্ষণ করে হরিণ। এতে হরিণের সংখ্যা যাচ্ছে কমে। গ্রামীণ জনসংখ্যা কমে যাওয়াটা ইউরোপে নতুন নয়। অভিবাসন, শিল্পায়ন এবং কৃষিতে যান্ত্রিকীকরণের ফলে শতাব্দী ধরেই এ প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে। কিন্তু এই মুহূর্তে সমস্যাটাকে চরম মনে হচ্ছে। কারণ গ্রামীণ এলাকায় এতো কম জš§হার আগে কখনো ছিলো না। গ্রিসের প্রাসটসের মতো ইউরোপের অসংখ্য গ্রাম জনশূন্য হওয়ার মুখোমুখী। বন বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংখ্যাতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক কোস্টা রাকা বলেন, ‘অতীতে কৃষক তার একটি সন্তানকে অন্তত জমির দায়-দায়িত্ব বুঝিয়ে দিতে পারতেন, কিন্তু এখন তার ছেলে অথবা মেয়েই একটি। সাধারণত সে শহরে কাজ বেছে নেয়। কদাচিৎ সে গ্রামে ফেরে। ইতালির ১৯ লাখ (১.৯ মিলিয়ন) কৃষকের শতকরা ৪০ ভাগের বয়সই ন্যূনতম ৬৫। মারা গেলে এদের অনেকের জমিই যুক্ত হবে ৬০ লাখ হেক্টর পরিত্যক্ত জমির সঙ্গে। খামারের মোট জমির এক-তৃতীয়াংশ ফসল ফলানো যাচ্ছে না মানুষের অভাবে। কৃষিতে ইউরোপের মতো এত ভর্তুকি অন্য কোথাও দেয়া হয় না। মোট কৃষি খামারের এক -তৃতীয়াংশই প্রান্তিক। ইউরোপিয়ান এনভায়রনমেন্ট এজেন্সির (ইইএ) কৃষি পরিবেশ বিশেষজ্ঞ জা এরিক পিটারসনের অভিমত, ভর্তুকি ছাড়া ইউরোপের কিছু ভূদৃশ্যকে কোনক্রমেই বাঁচানো যাবে না। কিন্তু ক্রমাগত বৃদ্ধি পাওয়া অর্থনৈতিক চাপের কারণে অনেক এলাকায় ভর্তুকির পরিমাণ কমিয়ে দেয়া হয়েছে। ফ্রান্স ও ইতালির সীমান্তবর্তী গ্রামগুলো তার মধ্যে পড়ে। ফলে কৃষিতে উৎসাহ হারিয়ে ওইসব গ্রামবাসী ছুটছে শহরের দিকে। যেসব দেশে ভর্তুকি একেবারেই দেয়া হয় না সেগুলোর অবস্থা আরো খারাপ। বুলগেরিয়া, রুমাানিয়া ও ইউক্রেনের বিস্তীর্ণ জমিতে সৃষ্টি হচ্ছে ঝোপ-জঙ্গল। অথচ কিছুদিন আগেও সেসব জমিতে উৎপাদিত হতো প্রচুর ফসল। কেবল ছুটি ও অবসর কাটানোর ঠাঁই হয়ে যাচ্ছে গ্রামগুলো। শহরের বর্ধিত মধ্যবিত্ত শ্রেণী দ্বিতীয় বাড়িটি নির্মাণ করে গ্রামে। তারা কোলা হল থেকে মুক্তি পেতে মাত্র কয়েকদিনের জন্য সেখানে গিয়ে আনন্দ-ফুর্তি করে চলে আসে। বাকি সময় বাড়িগুলো ফাঁকা থাকে। ফলে জনসংখ্যার বিন্যাসে পরিবর্তন আসছে না। স্থানীয়রা পুরোপুরি নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে পর্যটনের ওপর। অস্ট্রিয়ার ‘সেন্টো স্টেফানো ডি সেসানো গ্রামে বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিক পর্যন্ত লোক ছিলো ১৫০০ আর এখন রয়েছে মাত্র ১০০। এদের সবার বয়স আশির উপরে। পর্যটকদের ওপর নির্ভর করা ছাড়া তাদের বাঁচার কোনো উপায় নেই। সুইডিশ এক বিনিয়োগকারী গ্রামটির সিংহভাগ কিনে নিয়ে ট্যুরিস্ট ও হাইকারদের জন্য নির্মাণ করেছেন হোস্টেল কমপ্লেক্স। ইতালির শূন্যগ্রাম টুসকানির মধ্যযুগীয় ইমারতগুলো সংস্কারের মাধ্যমে রূপান্তরিত করা হয়েছে বিলাসবহুল সব গেস্টহাউসে। সুইজারল্যান্ডের অসংখ্যা গ্রামে শিশুর সংখ্যা আশংকাজনকভাবে কমে গেছে। ১৯৮০-এর দশক থেকে সেসব স্থানে চালু আছে এক কক্ষ বিশিষ্ট স্কুল। এখন সেগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে ছাত্রের অভাবে। ছাত্র মাত্র দুজন, কিন্তু শিক্ষক আছে পাঁচজন, এমন স্কুলের সংখ্যা সুইজারল্যান্ডে কয়েকশ’। প্রতিদিন বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে গ্রামে ফিরে যাওয়া যাদের জন্য কষ্টকর, তাদের জন্য সুইডেনের উমিয়া বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন চালু করেছে বিশেষ কর্মসূচি। গ্রামে বসে অনলাইন শিক্ষা নিলে দেয়া হয় বিশেষ বৃত্তি। তারপরও কাজ হচ্ছে না। বৃত্তিকে তুচ্ছ মনে করে অভিভাবকরা সন্তানকে পাঠিয়ে দিচ্ছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের হোস্টেলে। সেই সন্তান পরে বাবার কাছে যাওয়ার প্রয়োজনটুকু পর্যন্ত বোধ করে না। শহরের চাকচিক্য তাকে গ্রাস করে ফেলে। বয়সী মানুষের সংখ্যা বেশি বলে অনেক স্থানে পরিসেবাগুলোও ধরে রাখা সম্ভবপর হচ্ছে না। খরচের কারণে নিয়মিত পাবলিক বাস সার্ভিস বন্ধ হয়ে গেছে। চালু হয়েছে পাবলিক ট্যাক্সি অন ডিমান্ড। প্রত্যন্ত অঞ্চলে বিশেষায়িত ডাক্তারদের যাওয়া আর সম্ভব নয় বলে ভিডিওকনফারেন্স ও ইন্টারনেটের মাধ্যমে বৃদ্ধদের চিকিৎসাসেবা দেয়া হচ্ছে। ফিনল্যান্ডের আগুয়াভিভা গ্রামের অধিবাসীর সংখ্যা মাত্র একজনে নেমে যাওয়ার পর কর্তৃপক্ষ বিমান ভাড়া ও বাড়ি নির্মাণের খরচ ফ্রি দিয়ে বিদেশি পরিবারদের আকৃষ্ট করেছিলো ঐ গ্রামে গিয়ে বসত গড়তে। এর ফল অবশ্য ভালোই হয়েছে। ওই গ্রামে এখন ১৩০ জন আর্জেন্টাইন ও রোমানিয়ান অভিবাসী বাস করে। অভিবাসীরা শহরে থাকতেই বেশি পছন্দ করে। অভিবাসনের উৎস হিসেবে পূর্ব ইউরোপের দিকে তাকিয়ে থাকে পশ্চিম ইউরোপ। কিন্তু পূর্ব ইউরোপেও জš§হার খুবই কম। ২০৫০ সাল নাগাদ ইউক্রেন ও বুলগেরিয়ার জনসংখ্যা এক-তৃতীয়াংশ কমে যাবে। শ্রমযোগ্য মানুষের বর্তমান হার ধরে রাখতে প্রতিবছর পশ্চিম ইউরোপের প্রয়োজন ১০ লাখ ১০ হাজার অভিবাসী। প্রতিবেশী ইউরোপীয় মুসলিম দেশগুলো থেকে ইচ্ছে করলে স্থানান্তরের সে াত বইয়ে দেয়া যায় পশ্চিম ইউরোপে। কিন্তু বিষয়টি রাজনৈতিকভাবে স্পর্শকাতর বলে তা করা যাচ্ছে না। রক্ষনশীলরা মনে করে যে এতে করে ধর্মীয় সংঘাত বেড়ে যাবে। বিনষ্ট হবে সমাজের শান্তি-শৃংখলা। মুখে না বললেও সাদা-কালো এবং খ্রিস্টান-মুসলিমের অনুপাত ইউরোপ জুড়েই বিবেচ্য বিষয়। যতো পার সন্তান নাও। এতে তোমারও লাভ, দেশেরও লাভ- সরকারগুলোর গৃহীত এ নীতি যেনো কোনো কাজেই আসছে না। ইউরোপে শিশু সেবা থেকে শুরু করে মাসিক বৃত্তিও পরিবারের সদস্য সংখ্যার ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু জরিপে প্রমাণিত হচ্ছে যে, দম্পতিরা বেশি সন্তান ঝামেল মনে করে। দম্পতি সন্তান নিতে সক্ষম ছিলো অথচ কোনো সন্তান নেয়নি এমন পরিবারের সংখ্যা ইউরোপে ক্রমশ বাড়ছে। এছাড়াও প্রাকৃতিক কারণে ইউরোপীয়দের সন্তান জš§দানের ক্ষমতা অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় কিছুটা কম। জনসংখ্যা কমে যাওয়ার কারণেই সেখানে জনসংখ্যাতত্ত্ব খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসাবে চিহ্নিত। ছাত্রদের বিশেষভাবে উৎসাহিত করা হয় বিষয়টি পড়তে যাতে জনসংখ্যা সম্পর্কে সমস্যা ও সম্ভাবনার কথা জেনে দেশবাসীকে সজাগ করতে পারে। ডেমোগ্রাফার গুণার মামবার্গ মনে করেন, ইউরোপ জনসংখ্যাগত পরিবর্তনের ল্যাবরেটরি।
তথ্য সুত্র ওয়েবসাইট
0 comments:
Post a Comment