‘বন্যেরা বনে সুন্দর, শিশুরা মাতৃক্রোড়ে’
আলী ফোরকান
‘বন্যেরা বনে সুন্দর, শিশুরা মাতৃক্রোড়ে’এ স্বতঃসিদ্ধ সত্যটির ব্যত্যয় ঘটে যখন বন্যপ্রাণীকে ধরে এনে খাঁচায় বন্দি করা হয় কিংবা কোনো শিশুকে মায়ের কোল থেকে তুলে এনে কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে ঠেলে দেয়া হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অবশ্য মায়ের আঁচলে মুখ লুকিয়ে নিষ্পাপ শিশুকে জেলে যেতে হয় মায়ের অপরাধে অপরাধী হয়ে। শিশুরা কোনো অপরাধ করতে পারে না। তারপরও ব্যতিক্রম হিসেবে কোনো শিশু-কিশোর যদি অপরাধ করেই ফেলে তাহলে তার জন্য আছে উন্নয়ন কেন্দ্র বা সেফ হোম। কারাগার কিছুতেই তার জন্য নয়। অথচ সারাদেশের বিভিন্ন কারাগারে মায়ের সঙ্গে বা একাকী ১৪৫টি শিশু-কিশোর আটক রয়েছে, যা একটি উদ্বেগজনক খবর।‘শিশুদের জন্য কারাগার নয়’ এ কথা বলে দেশের বিভিন্ন কারাগারে আটক শিশুদের দ্রুত স্থানান্তরের নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। হাইকোর্টের দেয়া এই স্বতঃপ্রণোদিত আদেশটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। জানা যায়, দেশের বিভিন্ন কারাগারে ১৪৫ জন শিশু আটক রয়েছে। এদের মধ্যে ৪১ জনের বয়স ১৬ বছরের নিচে। বাকিদের বয়স ১৬ থেকে ১৮ বছরের মধ্যে। উল্লেখ্য ১৯৭৪ সালের শিশু আইন অনুযায়ী অভিযুক্ত কোনো শিশুকে কারাগারে পাঠানোর বিধান নেই। এর আগেও হাইকোর্ট একাধিকবার শিশুদের কারাগারে না পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু দুঃখজনক হলো আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে ও আদালতের নির্দেশ অমান্য করে শিশুদের কারাগারে আটক রাখার প্রক্রিয়া চলছেই। হাইকোর্টের এ সংক্রান্ত সর্বশেষ আদেশে বলা হয়েছে, দেশের বিভিন্ন কারাগারে আটক শিশুদের মধ্যে যারা জামিন পাওয়ার যোগ্য তাদের দ্রুত জামিন দিতে হবে। আর যারা জামিন অযোগ্য অপরাধে আটক আছে তাদের প্রত্যেককে দ্রুত সংশোধনাগারে বা নিরাপদ আশ্রয়ে পাঠাতে হবে। এছাড়া জামিন-অযোগ্য অপরাধে অভিযুক্ত আটককৃত কন্যাশিশুদের জামিন বিবেচনা করারও আদেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। খুবই উদ্বেগজনক ব্যাপার হলো, দেশে শিশুদের অপরাধ প্রবণতা দিনদিন বেড়ে চলেছে। এ অপরাধ প্রবণতার মূলে না গিয়ে শিশুদের ধরে ধরে কারাগারে পাঠানোর মধ্য দিয়ে কোনো সমাধান নেই। প্রথমত, অপরাধ প্রবণতা দূর করতে হবে। দ্বিতীয়ত, বিপথগামী অপরাধী শিশুদের সংশোধনের ব্যবস্থা নিতে হবে। বাংলাদেশে কারাগারগুলোর যে অবস্থা সেখানে সাধারণ বন্দীদের মানবাধিকারই সংরক্ষিত হয় না। সেখানে কারাগার শিশুদের জন্য সংশোধানাগার হবে এটা কল্পনা করাও কষ্টকর। সে কারণেই শিশুদের কারাগারে না পাঠানোর ব্যাপারে আইনের কঠোর প্রয়োগ জরুরি হয়ে পড়েছে। দেশে শিশু-কিশোর অপরাধের চিত্র খতিয়ে দেখলে প্রতীয়মান হয় যে, বিশেষ করে নগরাঞ্চলের সুবিধা-বঞ্চিত শিশুরাই অপরাধ প্রবণতার দিকে বেশি ঝুঁকে। মৌলিক অধিকারের অনিশ্চয়তা এবং চারপাশের অপরাধমূলক পরিবেশ তাদের অপরাধকর্মে প্ররোচিত করে। শিশুরা মাদকাসক্তি, ছিনতাই-চাঁদাবাজি, এমনকি খুন-খারাবিতে লিপ্ত হচ্ছে। সমাজের অবহেলিত সুবিধা-বঞ্চিত শিশুদের নিরাপদে সুস্থ পরিবেশে বেড়ে ওঠা ও শিক্ষালাভের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। অপরাধ প্রবণতা লক্ষণীয় সমাজের অন্যান্য স্তরের শিশুদের মধ্যেও। আমরা নিকট অতীতে দেখেছি একটি মোবাইল সেটের জন্য ক’জন স্কুলছাত্র তাদের সহপাঠীকে খুন করেছেÑ এরকম কিছু অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা। পণ্যসভ্যতা আজকের শিশুদের মধ্যে এমন ভোগবাদিতা সংক্রমিত করেছে, তাদের মধ্যেও এমন দুর্বিনীত চাহিদা তৈরি করেছে যে চাহিদা পূরণে তারা সতীর্থ বন্ধুকে খুন করতে প্রবৃত্ত হচ্ছে। পারিবারিক ও সামাজিক পরিমন্ডলে মূল্যবোধের অবক্ষয়ও শিশুদের আক্রান্ত করছে ভীষণভাবে। একসময় দেশে প্রগতিশীল শিশু-কিশোর সংগঠনগুলো শিশু-কিশোরদের সৃজনশীল ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে সম্পৃক্ত করে তাদের মানবিকতা, সৃজনশীলতা বিকাশে অবদান রেখেছে। এখন সে ধরণের সাংগঠনিক কার্যক্রমও অনেকটাই স্তিমিত। এর বিকল্প হিসেবে শিশুরা এখন যে আত্মকেন্দ্রিক বিনোদন যেমন ঘরে বসে কম্পিউটার গেম, ভিডিও গেম ইত্যাদিতে মগ্ন হচ্ছে সেগুলোর বেশিরভাগই আসলে ‘নিধনের খেলা’। এগুলোও তাদের মধ্যে আত্মসর্বস্বভাবনা, স্বার্থপরতা ও অপরাধ প্রবণতার জন্ম দিচ্ছে। এ অবস্থা থেকে শিশুদের রক্ষার উপায় বের করতে হবে। আগামী প্রজন্মকে সুশিক্ষিত সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে তাদের সবার জন্য মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। রাখতে হবে শিশুদের মানবিক মানুষ হিসেবে বেড়ে ওঠার সকল আয়োজন, পাশাপাশি পথভ্রষ্ট শিশুদের সংশোধনের ব্যবস্থা। শুধু আর্ন্তজাতিক সনদে স্বাক্ষর বা আইন প্রণয়নই যথেষ্ট নয়, দরকার আইনের কঠোর প্রয়োগ। হাইকোর্টের বারংবার নির্দেশে সে তাগিদই দেয়া হচ্ছে। সংশ্লি¬ষ্টরা নিশ্চয় আদালতের আদেশ মান্য করে এ দেশকে শিশুদের জন্য নিরাপদ আবাস হিসেবে গড়ে তুলতে কাজ করবেন।
0 comments:
Post a Comment