Friday, June 24, 2016

জেন্ডার বৈষম্য ও শিশুদের অধিকার

জেন্ডার বৈষম্য ও শিশুদের অধিকার
আলী ফোরকান
একজন চিত্রশিল্পী শিশুদের নাম দিয়েছেন ‘টোকাই’। একজন রাষ্ট্রপতি শিশুদের ‘পথকলি’ নামে ভূষিত করেন। সুশীল সমাজ তাদের নাম দিয়েছে ‘পথশিশু’। গালভরা নাম দিলেও সেই শিশুরা কিন্তু অবহেলিতই থেকে যাচ্ছে। বসনে-ভূষণে কোনো পরিবর্তন নেই। অথচ বলা হয়ে থাকে, আজকের শিশু আগামীদিনের ভবিষ্যৎ। এটা একটা প্রবাদপ্রতীম বাক্য হিসেবেই প্রচলিত। তাতেও কিন্তু তাদের ভাগ্যের অদলবদল নেই। উপেক্ষিত, নির্যাতীত ও নিপীড়িতই থেকে যাচ্ছে। কেননা গালভরা বুলি দিয়ে এদের ভাগ্য পরিবর্তন সম্ভব নয়। ‘শিশু’ শব্দের অর্থ কিন্তু দ্বিত্ববাচক। অর্থাৎ ছেলে শিশু ও মেয়ে শিশু। সমাজে মেয়ে শিশু এবং ছেলে শিশুর মধ্যে অসমতা বিদ্যমান। দু’য়ের মধ্যে মেয়ে শিশু অবহেলিত ও উপেক্ষিত। মেয়ে শিশু জন্মালে তাদের বোঝা হিসেবে গণ্য করা হয়। পরিবারের অভিশাপ হিসেবে ধারণা করা হয়। যত তাড়াতাড়ি তাকে বাড়ি থেকে তাড়ানো যায়, সে চিন্তাই কাজ করতে থাকে। ফলে বাল্যবিবাহ। অথচ বাল্যবিবাহের পরিণতি যে কি ভয়াবহ তা কেউ চিন্তা করে না। এবার অন্য অর্থটি বিবেচনায় আনা যেতে পারে। পরিবারে ছেলে শিশু জন্মালে তাকে সংসারের পুঁজি হিসেবে গণ্য করা হয়। বাল্যকাল থেকে ছেলে শিশু অর্জনের হাতিয়ার। আর এভাবেই শৈশবকাল থেকেই সৃষ্টি হয় নারী-পুরুষের বিভেদ। অথচ নেপোলিয়ান বলেছেন, তোমরা আমাকে একজন ভালো ‘মা’ দাও, আমি তোমাদের একটি ভালো দেশ দেবো। এই ‘মা’ কে? সেই মেয়ে শিশুটি, যে নাকি বড় হয়ে বিয়ে থা’ করে মা হবে। অন্যদিকে জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদে শিশু-অধিকারের সংজ্ঞায় কোনো পার্থক্য রাখা হয়নি। শিশু সে মেয়ে শিশুই হোক কি ছেলে শিশু সমান অধিকার নিয়েই জন্মগ্রহণ করে এবং সমাজে ছেলে শিশুর মতোই মেয়ে শিশুও সমান অধিকার প্রয়োগ করার অধিকারী। শিশু বয়স নিয়েও একটা অসঙ্গতি রয়েছে। তারও নিরসন প্রয়োজন। যেমন শিশু আইন ১৯৭৪ অনুযায়ী ১৬ (ষোল) বছরের বয়স্ক মানবসন্তানকে ‘শিশু’ বলা হয়েছে। আবার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০১ অনুযায়ী শিশু অর্থ অনধিক ১৬ (ষোল) বছর বয়সের কোনো মানবসন্তান। অন্যদিকে জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদ অনুযায়ী ১৮ (আঠারো) বছর এবং তার নিচের বয়সের মানবসন্তানকে শিশু বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। আবার এভিডেন্ট এ্যাক্ট -এর  ১১৮ নম্বর ধারায় একটি ১৩ (তের) বছরের শিশু আদালতে সাক্ষ্য দিতে চাইলে তা গ্রহণ করতে বিচারক বাধ্য বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এই সংজ্ঞাগুলোর সমন্বিত ব্যাখ্যা বাস্তবসঙ্গত হওয়া দরকার। প্রসঙ্গক্রমে শিশুশ্রম ও শিশু-অধিকারের কথা এসে যায়। এক্ষেত্রে আবার মেয়ে-ছেলে ও পুরুষ প্রশ্ন উঠে আসে। আগে শিশুশ্রমের কথা বলে নিই। শিশুদের বলা হয় শিশু শ্রমিক। বিশেষজ্ঞদের মতে তিনটি কারণে শিশুদের কাজে পাঠানো হয়। ১) দারিদ্র্য, ২) বাস্তবসম্মত শিক্ষার অভাব, ৩) প্রথাগত চাহিদা। দরিদ্র পরিবারের ছেলে-শিশুদের বেঁচে থাকার জন্যেই কাজে নামতে হয়। শিশুরা, ছেলেই হোক কি মেয়ে, সহজে কাজ পেয়ে যায়। কারণ অল্প পারিশ্রমিকের বিনিময়েই তাদের কাজ করানো যায়। বাস্তবসম্মত শিক্ষাদানের ব্যবস্থা দেশে নেই। ফলে স্কুলে যাওয়ার চেয়ে শিশুশ্রমের প্রতিই শিশুরা নিয়োজিত থাকতে ভালবাসে। প্রথাগত চাহিদায় দেখা যায়, কৃষকের ছেলে ক্ষেতের কাজই পছন্দ করে, কামারের ছেলে কামার হয়।এবার শিশু অধিকারের কথা। বাঁচার অধিকার প্রতি শিশুর জন্মগত। এই অধিকার নিশ্চিত করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। শিশুকে সুষ্ঠু বিকাশের ভেতর দিয়ে বেঁচে থাকার জন্যে সুষম খাদ্য ও পুষ্টি, স্বাস্থ্যপ্রদ আবাসস্থল, চিকিৎসা, শিক্ষা, বিনোদন, খেলাধুলার সুযোগ-সুবিধা এবং সুস্থ ও সুন্দর সামাজিক পরিবেশ নিশ্চিত হওয়া দরকার। প্রসঙ্গত, জেনেভা কনভেনশনে ঘোষিত হয়েছে, মানবজাতির সর্বোত্তম যা কিছু দেওয়ার আছে, শিশুরাই তা পাওয়ার যোগ্য। শিশুদের অধিকার ও ন্যায় বিচার নিশ্চিত করে তাদের সুনাগরিক হিসেবে গড়ে ওঠার সুযোগ দিতে পারলেই জোর গলায় বলা যাবে শিশুরাই জাতির ভবিষ্যৎ সুনাগরিক। সেই শুভদিনটির জন্যে প্রতীক্ষা কি ব্যর্থ হবে? 

0 comments:

Post a Comment