Wednesday, June 29, 2016

পরিবেশ রক্ষায় চাই গণজাগরণ

পরিবেশ রক্ষায় চাই গণজাগরণ
আলী ফোরকান
পৃথিবী এক ভয়াবহ প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন। জীবনধারণ কিংবা জীবনকে প্রাচুর্যময় করার জন্য পৃথিবীর মানুষ নিজেদের অজান্তেই পৃথিবীকে বসবাসের অযোগ্য করে তুলছে প্রতিনিয়ত। অপরিণামদর্শী বস্তুগত উন্নয়ন উদ্যোগ। রাসায়নিক প্রতিক্রিয়া, বনাঞ্চলের ক্ষতিসাধন। প্রাণিকুলের বিলুপ্তি, জনসংখ্যার ভয়াবহ বৃদ্ধি ইত্যাদি কারণে দ্রুত পরিবেশের ভারসাম্য হারিয়ে যাচ্ছে। ফলে পৃথিবীর জলবায়ু পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছে। এতে করে একদিকে রুক্ষ ও বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেছে প্রকৃতি। অন্যদিকে আশঙ্কাজনকভাবে নানাবিধ রোগব্যাধি ছড়িয়ে পড়ছে।  পৃথিবীর সামগ্রিক পরিবেশ বিপন্নতার কয়েকটি উদাহরণ নিম্নে উল্লেখ করা যেতে পারে:
১. প্রতি দশকে পৃথিবীর নিরক্ষীয় বনাঞ্চলের পরিমাণ প্রায় ২০ কোটি হেক্টর করে কমে যাচ্ছে। অর্থাৎ প্রতি বছর পৃথিবী থেকে এক শতাংশ হারে বন ধ্বংস হয়ে যা"েছ। ২. পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে কার্বন ডাইঅক্সাইডের মাত্রা অর্থাৎ দুই শত বছর আগে শিল্পবিপ্লবের শুরুতে হার ছিল প্রতি লক্ষে মাত্র ২৮০ ভাগ। ১৯৭২ সালে প্রতি লক্ষে ৩২৭ ভাগ, ১৯৯৫ সানে ৩৬০ এবং ২০০০ সালে ৩৮০ ভাগের উপরে ওঠে এসেছে। ৩. ভূমন্ডলের ট্রপিক্যাল ফরেস্ট ধ্বংস হওয়ার কারণে প্রতি মিনিটে একটি করে জীবপ্রজাতি লুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। ৪. অনিয়ন্ত্রিতভাবে সমুদ্রে মৎস্য শিকার বৃদ্ধি এবং বর্ধিত জনসংখ্যার চাপের কারণে মাথাপিছু মাছ ধরার পরিমাণ ১১ ভাগ কমে গেছে। ৫. উত্তর ও দক্ষিণ মেরুর বরফ গলে বেড়ে যাচ্ছে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা। ৬. অনিয়ন্ত্রিত শিল্প উন্নয়নের কারণে শিল্পউন্নত দেশগুলো বছরে ৪০ কোটি টনেরও অধিক পরিমাণ বর্জ্য সাগর-মহাসাগরে নিক্ষেপ করছে। শিল্প, কলকারখানা ও যন্ত্রযান হতে উদ্গীরিত ধোঁয়ার কারণে দূষিত বায়ুর প্রভাবে শুধুমাত্র এশিয়াতেই প্রতি বছর প্রায় ১০ লক্ষ লোকের জীবনাবসান হচ্ছে। ৭. ঊায়ুমন্ডলে বিভিন্ন গ্যাসের পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে ভূ-পৃষ্ঠের উত্তাপ বিগত ১০০ বৎসরে ০.৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস থেকে ০.৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পেয়েছে। এ হার অব্যাহত থাকলে আগামী ২০৫০ সালের মধ্যে ভূ-পৃষ্ঠের গড় উত্তাপ ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস থেকে ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসে উন্নীত হবে এবং এ শতাব্দীতেই তা ৫.৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছাতে পারে। যা ভবিষ্যতে মানুষের বসবাসের পক্ষে এক মারাত্মক বিপর্যয়ের সৃষ্টি করবে।
২. বাংলাদেশের পরিবেশ পরিস্থিতি :পৃথিবীর সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ দেশ বাংলাদেশ। এখানে প্রতি বর্গকিলোমিটারে প্রায় ১০০০ লোকের বসতি। একদিকে এদেশের সীমিত সম্পদ মাত্রাতিরিক্ত আহরণ করা হচ্ছে, অন্যদিকে প্রয়োজন অনুযায়ী সম্পদের সঠিক ব্যবহার হচ্ছে না। অপরিকল্পিত ব্যবহারের ফলে এদেশের প্রাকৃতিক সম্পদ ধ্বংসপ্রাপ্ত প্রায়। বন, পাহাড়, জলাভূমি সবকিছুতেই আজ বিবেকহীন মানুষের নগ্ন হস্তক্ষেপ। রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার, যত্রতত্র শিল্প প্রতিষ্ঠান তৈরি, অপরিকল্পিত নগরায়ন, পলিথিনের ব্যবহার, গাড়ির ও কলকারখানার বিষাক্ত ধোঁয়া, বর্জ্য ও আবর্জনা এদেশের পরিবেশকে বিষিয়ে তুলেছে। অন্যদিকে প্রাকৃতিক দুর্যোগে লন্ডভন্ড হয়ে যাচ্ছে সামগ্রিক পরিবেশ ব্যবস্থাপনা। অনাবৃষ্টি, খরা, বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, অকালবৃষ্টির কারণে বিপন্ন হচ্ছে মানুষের সহায় সম্পদ। আন্তরাষ্ট্রীয় জলবায়ু পরিবর্তন প্যানেল তাদের প্রকাশিত চতুর্থ প্রকাশনায় জলবায়ুর পরিবর্তনের প্রভাব বাংলাদেশে পরিলক্ষিত বড় কয়েকটি পরিবর্তন নথিভুক্ত করেছে। ১. গত ১৪ বছরে মে মাসে ১ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড এবং নভেম্বর মাসে ০.৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রা বেড়েছে। ২. বাংলাদেশের গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে। ৩. ভয়াবহ বন্যার পুনরাবৃত্তি ঘটে গত ২০০২, ২০০৩, ২০০৪, ২০০৭ সালে। ৪. বঙ্গোপসাগরে মৌসুমী নিম্নচাপ এবং ঘূর্ণিঝড় বেড়েছে। ৫. বঙ্গোপসাগরে ঘূর্ণিঝড়ের তীব্রতা বেড়েছে। ৬. গ্রীষ্মকালে সমুদ্রের লোনাপানি দেশের অভ্যন্তরে প্রায় ১০০ কি.মি. পর্যন্ত নদীতে প্রবেশ করেছে। ৭. মাটির লবণাক্ততা বৃদ্ধি ৮৩০,০০০ হেক্টর আবাদি জমির ক্ষতি করেছে। ৮. খরার কারণে জলাভূমি শুকিয়ে যাচ্ছে। ২০৫০ সাল নাগাদ বাংলাদেশে ধানের উৎপাদন কমবে ৮৮% এবং গমের উৎপাদন কমবে ৩২%। দ্র"ত নগরায়ন এবং শিল্পায়ন, জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং অদক্ষ পানি ব্যবহারের কারণে পানির স্বল্পতা সৃষ্টি হয়েছে, যা পানির চাহিদা, জোগান ও পানির ধরনের ওপর জলবায়ু পরিবর্তন ও এর বিরূপ প্রভাব বিস্তার করছে। বিশ্ব উষ্ণতা এবং জলবায়ুর পরিবর্তনের প্রভাব বিশ্বব্যাপী। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বিপন্ন দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। ১৯৯১ সাল থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত ঘটে যাওয়া প্রায় ১১১টি বড় ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগে বাংলাদেশে মৃত্যু ঘটেছে ২,০০,০০০ জনের এবং কৃষি ও অবকাঠামোতে ক্ষতি হয়েছে ৫.৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা বাংলাদেশী টাকায় ৪১,৩০০ কোটি টাকা। বিগত ত্রিশ বছরে এদেশে সর্বাধিক পরিবেশ বিপর্যয় ঘটে গেছে। এ সময়ে বাংলাদেশে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বৃক্ষ নিধন হয়েছে, উজাড় হয়েছে বনভূমি, জীববৈচিত্র্য হয়েছে হুমকির সম্মুখীন। পানির অপব্যবহার ও দূষণ ঘটেছে মাত্রাতিরিক্ত, ভূমির গুণাগুণ হয়েছে বিনষ্ট। বায়ুতে ছড়িয়ে পড়েছে বিষাক্ত গ্যাস, জনস্বাস্থ্য হয়েছে হুমকির সম্মুখীন। প্রাকৃতিক দুর্যোগে প্রায়ই লন্ডভন্ড হয়েছে জনজীবন। এ সবই মানুষের অপরিণামদর্শী কর্মকান্ডের ফলাফল। সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হলো, বাংলাদেশে পরিবেশ ব্যবস্থার অবক্ষয় দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। কারো কারো মতে আগামী দশ বছরে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে সতের কোটি ছাড়িয়ে যাবে এবং ঐ অবস্থায় প্রতি বর্গকিলোমিটারে প্রায় বার ’শ মানুষকে বসবাস করতে হবে। তাই জাতির ভবিষ্যৎ পরিবেশ বিপর্যয়জনিত ধ্বংস এড়ানোর জন্য এখনই ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এটা ঠিক যে, পরিবেশ বিপর্যয়ে প্রধান ভূমিকা রাখছে মুনাফালোভী গোষ্ঠী। বহুজাতিক দাতা সংগঠনগুলোর অসৎ উপদেশ আশ্রয়ী উন্নয়ন কর্মকান্ড পরিবেশ বিপর্যয়ের প্রধান নিয়ামক হিসেবে ভূমিকা পালন করছে। তথাপি প্রাকৃতিক পরিবেশের ভয়াবহ বিপর্যয়ে সাধারণ মানুষের অসচেতনতাও কম দায়ী নয়। মূলত অসচেতনতাজনিত কারণেই প্রতিদিন এদেশের জলাশয়ে মিশে যায় মানুষের প্রায় ২৭ হাজার টন মল। এছাড়াও এদেশের নদ-নদী, ডোবা-নালায় প্রতিদিন ফেলা হয় শত শত টন ময়লা আবর্জনা। জীববৈচিত্র্য ধ্বংস, মাটিদূষণ, বায়ুদূষণ ইত্যাদি নানা দূষণের জন্যও অনেক ক্ষেত্রে মানুষের অসচেতনতা দায়ী। আশার কথা, এদেশের সরকার এবং নেতৃস্থানীয় জনগণ ইতিমধ্যেই বিষয়টি উপলব্ধি করেছেন এবং নানাবিধ কর্মসূচির মধ্যে দিয়ে দেশের পরিবেশ ব্যবস্থাপনার উন্নয়নে যথাযথ কার্যক্রম গ্রহণ করেছেন। ১৯৯২ সালে ব্রাজিলের রিও ডি জেনিরোতে অনুষ্ঠিত ধরিত্রী সম্মেলনে (আর্থ সামিট) এজেন্ডা ২১-এ স্বাক্ষরকারী দেশসমূহের অন্যতম হচ্ছে বাংলাদেশ। দেশের সর্বোচ্চ পর্যায়ে নীতিমালা প্রণয়ন ও সমন্বয় সাধনের মাধ্যমে টেকসই উন্নয়ন সাধন করার বিষয়টি এজেন্ডা ২১-এ উল্লেখ আছে। ন্যাশনাল কনজারভেশন স্ট্র্যাটেজি সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। জাতীয় সংরক্ষণ কৌশল ও বন পরিকল্পনা গ্রহণের মাধ্যমে এজেন্ডা ২১-এ বাংলাদেশ সরকারের অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত হয়েছে। বাংলাদেশে ১৯৯২ সালে প্রণীত পরিবেশ নীতিমালা অনুসারে ইতিমধ্যেই বেশ কিছু পরিবেশ সংক্রান্ত আইন প্রণীত হয়েছে। তবে সংশ্লিষ্ট সকলেই মনে করেনÑ আইনের বাস্তবায়ন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আইনের বাস্তবায়নের পাশাপাশি মানুষের সচেতনতা উন্নয়নের ক্ষেত্রে শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। তাই এদেশের মানুষকে পরিবেশ শিক্ষায় শিক্ষিত করা বর্তমানে খুবই জরুরি হয়ে দেখা দিয়েছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে পরিবেশ শিক্ষার স্বরূপ বা প্রক্রিয়া কী হবে? সংকীর্ণ অর্থে পরিবেশ শিক্ষা বলতে জ্ঞান, দক্ষতা এবং আচরণিক পরিবর্তন বোঝানো হয়। বৃহৎ অর্থে পরিবেশ শিক্ষা হলো শিক্ষার্থীর আপন পরিবেশের সুনির্দিষ্ট আওতার মধ্যে জৈবিক ও আধিজৈবিক অভিযোজন প্রক্রিয়া। পরিবেশ একটি বহুমাত্রাযুক্ত বিষয়, তাই পরিবেশ শিক্ষাও কেবলমাত্র একটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সম্পন্ন হতে পারে না। পরিবেশ শিক্ষা মানুষের প্রাত্যহিক জীবনাচারের সঙ্গে যুক্ত। তবে বিদ্যালয়সমূহ পরিবেশ শিক্ষার ভিত্তি প্রণয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেÑ এ বিষয়টি আমাদের পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে অনেক আগে থেকেই। যদিও এসব ক্ষেত্রে অনেক অসম্পূর্ণতা, অসামঞ্জস্যতা এবং সমন্বয়হীনতা রয়েছে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে সবকিছুতেই নতুন করে সাজাতে হবে।  মনে রাখতে হবে, বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনে বাংলাদেশ তেমন কোনো ভূমিকা রাখে না। তবে বাংলাদেশ একটি ভুক্তভোগী দেশ। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অবস্থার সঙ্গে বাংলাদেশের মানুষকে অভিযোজন কৌশল বা মানিয়ে নেওয়ার কৌশল শিক্ষা দেয়াই হবে পরিবেশ শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য। সঙ্গে সঙ্গে সীমিত সম্পদের সদ্ব্যবহার করে টেকসই উন্নয়নের দিকে গুরুত্ব আরোপ করতে হবে। প্রকৃতি ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য সমুন্নত রাখতে হবে। মানুষ, জীবজন্তু ও উদ্ভিদ মিলেমিশেই বসবাস করতে হবে। কেউ যেন কারো জন্য ক্ষতির কারণ না হয়। সে ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।

0 comments:

Post a Comment