পরিবেশ: বিপর্যয় থেকে সুন্দরবনকে রক্ষা করতে হবে
আলী ফোরকান
এশিয়া মহাদেশের মধ্যে সবচেয়ে বৃহত্তম সুন্দরবন। যাকে আমরা ম্যানগ্রোভ বলেও চিনি। পৃথিবীর সেই বিখ্যাত আমাজান জংঙ্গলের পরই সম্ভবত এই সুন্দরবন দ্বিতীয় বৃহত্তম। যা আমাদের পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারতের মধ্যেও কিছু অংশ পড়েছে। পরিবেশ বিজ্ঞানীরা এটাকে বলে থাকেন ম্যানগ্রোভ ফরেষ্ট। যা বিশ্বে দ্বিতীয়টি আর নেই। তাই সুন্দরবন আমাদের অহংকার। ইদানিং সুন্দরবনের বিভিন্ন খাল ও নদীতে বিষ প্রয়োগ করে মৎস্য নিধন করে চলেছেন। এ যেন মৎস্য শিকারের এক নতুন বিবর্তন। এতে বনের গভীরে থাকা বিভিন্ন প্রজাতির মাছ ও জলজ সম্পদ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এছাড়া সুন্দরবনের বন্যপ্রাণী এ বিষাক্ত পানি পান করে মারা যাচ্ছে। কিছুদিন আগে সুন্দরবনের উপর দিয়ে বয়ে গেল ‘সিডর’ নামের এক প্রলয়ংকারী সর্বনাশা ঝড়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন সুন্দরবন সিডরের ক্ষতি থেকে অনেকখানি রক্ষা করেছে। না হয় ক্ষতির পরিমাণ অরো বেডে যেতো। সুন্দরবন অদ্ভুদ নদী জলজ ও মৎস্য সম্পদে ভরপুর। এই সুন্দরবন আমাদের বাংলাদেশের অহংকার। যার উপর জীবিকা নির্বাহ করে আছে খুলনার আপামর জনগোষ্ঠী, যারা খুবই দরিদ্র। তাহলে কি আমরা সুন্দরবনকে এভাবে দিন দিন ধ্বংসের পথে ঠেলে দেবো। সিডরে সুন্দরবনে প্রচন্ড ক্ষতি হয়। গাছপালা ও পশু-পাখি এখন জলজ ও মৎস্য সম্পদ নিয়ে চলছে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম জঘন্য ঘটনা। পার্শ্ববর্তী ভারতের ভাগে যেটুকু সুন্দরবনের অংশ পড়েছে তারা তা স্বযতেœ লালন পালন করছেন। আর আমরা দিন দিন সুন্দরবনকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাচ্ছি। সম্প্রতি বাঘ সংরক্ষণে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের একটা সমঝোতা চুক্তি হয়েছে।কিন্তু আমাদের কথা হল বাঘ যখন বিষ মিশ্রিত পানি পান করবে তখন বাঘ অসুস্থ হয় পড়বে। এবং মারা যাবে। বাঘ ছাড়াও সুন্দরবনে আরও অসংখ্য প্রাণী রয়েছে। তারাও সেই বিষাক্ত পানি পান করবে। এখন সুন্দরবনের সবগুলো রেঞ্জের নদীর পানিতে ডায়াজিন, রিপকিউ, ফাইটার, মার্শাল, কারেট, এনড্রিন ইত্যাদি কীটনাশক ব্যবহার করা হচ্ছে অবাদে। এই অদ্ভুত হৃদয়হীন নিয়মে মৎস্য শিকার করে। ভাত ও চিড়ার সাথে সেই কীটনাশক ও বিষ মিশ্রিত করে, জোয়ারের সময়ে তা নদীতে ফেলা হয়। মাছ সেগুলো খায় এবং নির্দিষ্ট সময় পর মরে ভেসে ওঠে। পরে জেলেরা তা সংগ্রহ করে। হীরণ পয়েন্ট, সুন্দরবনের বন্যপ্রাণীর বিরাট একটা অংশ হীরণ পয়েন্ট। হীরণ পয়েন্ট মূলত তৃণভোজী প্রাণীদের এলাকা । তৃণভোজের পর ঝাঁকে ঝাঁকে আসে নদীতে পানি পান করতে। আর এ পানি পান করে রোগাক্রান্ত হয়ে মারা যায়। জোয়ারের সময় সাধারণত জেলেরা নদীর পানিতে বিষ জাতীয় কীটনাশক মেশায়। জোয়ারের ফলে নদীর পানি দু’-কূল উপচে বনে গহীন পর্যন্ত প্লাবিত হয়। এতে ম্যানগ্রোভ এই বনে গাছপালার গাছের গোড়ায় সেই বিষ ঢুকে মাটিকেও করে তোলে বিষাক্ত। সুন্দরবনের সেই সুন্দরী গাছ কি ভবিষৎ প্রজন্ম বিলুপ্ত প্রজাতির গাছ ভাববে না। সুন্দর বনের উপকূল জুড়ে যে সব উদ্ভিত রয়েছে তাও ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হয়ে যাবে। এখন যেটা উদ্বেগের বিষয় তা হচ্ছে, সুন্দরবনের খাল ও নদ-নদীতে বিষ প্রয়োগ করে এক শ্রেণীর জেলে অবাধে মৎস্য নিধন করে যাচ্ছে। সেই বিষাক্ত মাছ বাজারে বিক্রি করছে । আর জনসাধারণ তা ক্রয় করছেন এবং খাচ্ছেন। বাংলার ইতিহাসে এর আগে কখনো কীটনাশকের সাহায্যে মৎস্য শিকার করা হয়নি। যা বর্তমানে সুন্দরবনে চলছে। সুন্দরবনে বিষ প্রয়োগকৃত মাছ প্রকাশ্যে বাজারে বিক্রি হচ্ছে এবং খোদ রাজধানীর মাছের বাজারে। মৎস্য কর্মকর্তারা বলেন, এ ব্যাপারে তাদের কিছু করার নেই। ওদিকে স্থানীয় চিকিৎসকরা বলছেন যে, বিষ প্রয়োগকৃত মাছ খেয়ে জনসাধারণ রোগাক্রান্ত হচ্ছেন। স্থানীয় পুলিশ, র্যাব, কোষ্টর্গাড বিক্ষিপ্তভাবে কিছু কিছু রেঞ্জে অভিযান চালিয়ে কীটনাশক ও বিষপ্রয়োগকৃত মাছ আটক করেছেন। কিন্তু বিক্ষিপ্ত অভিযান চালিয়ে তেমন কাজ হচ্ছে না। কীটনাশক পুরো সুন্দরবনকে ধীরে ধীরে বিষাক্ত পানির আরেকটি বুড়িগঙ্গা বানাতে যাচ্ছে। সুন্দরবনকে রক্ষা করতে হবে সর্বনাশা কীটনাশকের ছোবল থেকে। সবাই বলছেন, এখনই প্রতিরোধ করার উৎকৃষ্ট সময়। পরিবেশবাদীরা রীতিমত শংকিত। এভাবে কীটনাশক ও বিষ প্রয়োগে মৎস্য শিকার করলে এর বিরূপ প্রভাব পড়বে সুন্দরবনের উপর। পানি বিষাক্ত হবে, মৎস শূন্য হয়ে যাবে। বিষাক্ত পানি বনের গভীরে প্রবেশ করে গাছ পালা ধ্বংস হয়ে যাবে। বিষাক্ত পানি পান করে পশু পাখির মৃত্যু হবে। এভাবে চলতে থাকলে অবিশ্বাস্য এক মহাবিপর্যয় আসন্ন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন,এ বিপর্যয় আগামী মাত্র পাঁচ -দশ বছরের মধ্যে ঘটতে পারে। প্রকাশিত খবরে চাঁদপাই রেঞ্জের এক জেলের উদ্ধৃতি দিয়ে জানায়, কীটনাশক প্রয়োগের ফলে ইতিমধ্যে সুন্দরবনের বিভিন্ন নদীর পানি বিষাক্ত ও ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। বনের আশপাশ এলাকার বিভিন্ন খাল ও নদী এলাকায় কীটনাশক ও বিষ মিশ্রিত করে অবাধে মৎস্য নিধন চলছে। একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, এর অন্তরালে রয়েছে একটি স্থানীয় গডফাদার চক্র এবং স্থানীয় কিছু আড়ৎদার ও দাদনদাতা। এ অশুভ চক্রটির মাধ্যমেই মূলত জেলেদের মোটা অংকের অর্থ দিয়ে- এই মহাবিপর্যয়ের কান্ড-কারখানা চলছে। এ চক্রের হাত থেকে সুন্দরবনকে রক্ষা করতে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। আশাকরি সংশ্লিষ্ট কতৃপক্ষ পরিবেশ বিপর্যয় টেকাতে সুন্দরবনকে রক্ষায় এগিয়ে আসবে।
0 comments:
Post a Comment