Wednesday, June 29, 2016

পরিবেশ ও সাদা সোনা

পরিবেশ ও সাদা সোনা  
আলী ফোরকান
আমার দেশের সাদা সোনা। পৃথিবীতে এমন কোনো দেশ নেই। যেখানে (সাদা সোনা) চিংড়ির জনপ্রিয়তা নেই। বাংলাদেশে প্রচুর চিংড়ি পাওয়া যায় বা চাষ হয় বলে বিদেশে রপ্তানি করা হয়। তবে চিংড়ি চাষ করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব হলেও ইদানীং কিছু কিছু সমস্যা দেখা যায়। বাংলাদেশে আগে চিংড়ি চাষ হতো না। তখন চাষিরা চিংড়ি ধরতো অন্যভাবে। সাগরে জোয়ার এলে জোয়ারের পানি যখন আশেপাশের পুকুরে ঢুকে যেতো তখন চিংড়ি, কাঁকড়া ও নানারকম সামুদ্রিক মাছও পুকুরে চলে আসতো এবং চাষিরা সেই পুকুর থেকেই চিংড়ি ধরে বিক্রি করতো। বাংলাদেশের দক্ষিণে কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, পটুয়াখালী, খুলনা, বাগরহাট, সাতক্ষীরা এসব এলাকায় এভাবেই চিংড়ি চাষ হতো। কিন্তু সময় বদলে গেছে। বিশ্বব্যাপী এখন চিংড়ি মাছের চাহিদা প্রচুর বৃদ্ধি পাওয়ায় অল্প জায়গায় বেশি চিংড়ি চাষের পদ্ধতি আবিষ্কার হয়েছে। কিন্তু উন্নত এসব প্রযুক্তি কাজে লাগানোর ফলে সুবিধার পাশাপাশি ক্ষতিকর কিছু দিকও রয়েছে। এর ফলে মাছ ও মানুষের নানা ধরনের রোগ হয়, পরিবেশ নষ্ট হয়ে যায়। আর সবচেয়ে বড় ক্ষতিকর দিকটি হচ্ছে, চিংড়ি চাষ এলাকার মানুষের জীবনে বিভিন্ন সমস্যা সৃষ্টি হয়। বাংলাদেশের কক্সবাজারের টেকনাফ, উখিয়া, মহেশখালী, কুতুবদিয়া, চকোরিয়া অল্প জায়গায় বেশি চিংড়ি পদ্ধতিতে চিংড়ি চাষ হয়। এখানকার পুকুরগুলোতে প্রতি বর্গমিটারে ১০টিরও বেশি পুকুরে চিংড়ি চাষ করা হয়। এসব পুকুরে চিংড়িকে মাছের সাধারণ খাবার দেয়া হয় না। অল্প সময়ে মোটা ও বড় করার জন্য এদেরকে বিশেষভাবে তৈরি করা খাবার, অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ খাওয়ানো হয়। তাছাড়া পুকুরে বাইরে থেকে বেশি অক্সিজেন সরবরাহ করা হয়, যাতে মাছের নিঃশ্বাসের অসুবিধা না হয়। কিন্তু এসবের ফলে চিংড়ি তাড়াতাড়ি মোটা ও বড় হলেও সমুদ্রের চিংড়ির মতো শক্তিশালী হয় না। ফলে সামান্য অসুখেই এরা মারা যেতে থাকে। জানা যায়, ১৯৯৫ সালে চিংড়ি ঘেরগুলোতে ‘হোয়াইট স্পট’ নামে এক ধরনের ভাইরাসে কক্সবাজার জেলায় প্রায় সব চিংড়ি কিছুদিনের মধ্যেই মরে শেষ হয়ে যায়। পরবর্তী সময়ে এ পরিণতি পর্যবেক্ষণ করে ১৯৯৬ সালে এ ধরনের সবগুলো চিংড়ির ঘের বন্ধ করে দেয়া হয়। খুলনা বিভাগেও এরকম অল্প জায়গায় বেশি চিংড়ি পদ্ধতিতে চাষ হয়ে থাকে। সেখানে প্রায় ১ লাখ হেক্টর জমিতে চিংড়ি চাষ করা হয়। এখানেও ১৯৯৫ সালে ‘হোয়াইট স্পট’ ভাইরাসে অধিকাংশ চিংড়ি মারা যায় এবং বন্ধ হয়ে যায় ছোট-বড় বহু ঘের। বিজ্ঞানীদের মতে, বিশেষ খাবার আর ওষুধ দেয়া ছাড়াও অন্য একটি উপায়ে অল্প জায়গায় বেশি চিংড়ি চাষ করা যায়। আর তা হলো, স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি সময় ধরে চিংড়ি বড় করা। কিন্তু এর ফলে আমন চাষের ক্ষতি হয়। কারণ বহু চিংড়ি ঘেরেই মাছ চাষ হয়ে গেলে আমন ধান চাষ করা হয়ে থাকে । বেশি সময় ধরে চিংড়ি চাষ করলে ঘেরে চিংড়ি থাকায় আমন ধান লাগানো যায় না। চিংড়ি চাষ বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের জীবনে তৈরি করছে হাজারো সমস্যা। শুকনো মৌসুমেও চিংড়ি ঘেরে লবণ পানি ধরে রাখার কারণে সেখানে কোনো ঘাস জš§াতে পারে না। ফলে গবাদিপশুর খাদ্যের সমস্যা হয়। তাছাড়া ঘেরে দীর্ঘদিন লবণ পানি থাকার কারণে মাটির ওপর লবণের পুরু আবরণ পড়ে। লবণ মাটির ক্ষতি করে এবং উর্বরতা কমায়। এর ফলে ঘের এলাকায় গাছের সংখ্যা অনেক কমে গেছে এবং এলাকার অধিবাসীরা জ্বালানি কাঠও পাচ্ছে না। শুধু মাটির ওপরেই নয়, পানির সঙ্গে সঙ্গে লবণ মাটির একেবারে নিচে প্রবেশ করায় আশেপাশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ে। তাছাড়া মাটির নিচের যে জায়গাটিতে বৃষ্টি, নদী ইত্যাদির পানি গিয়ে জমা হয়, সেখানেও লবণ চলে যাওয়ার ফলে নলকূপ দিয়ে খাবার পানি ওঠালে স্বাভাবিকভাবেই লবণ চলে আসে। আর এভাবে মানুষের শরীরে দরকারের চেয়ে অনেক বেশি লবণ যাওয়াতে ঘের এলাকার মানুষের মধ্যে বিভিন্ন রোগও দেখা দেয়। অন্যদিকে রয়েছে সামাজিক সমস্যা। বড় মাপে চিংড়ি চাষ করতে অনেক টাকা লাগে। কিন্তু চিংড়ি চাষ এলাকার বেশিরভাগই গরিব চাষি অথবা ছোট ব্যবসায়ী বা চাকুরে। তাদের অনেকের হয়তো ৫-১০ বিঘার বেশি জমিও নেই। বেশি লাভের সুবিধায় অনেক ধনী লোক বাইরে থেকে সেখানে আসে। প্রশাসন, থানা-পুলিশ ও স্থানীয় ধনীদের সহযোগিতা পেয়ে তারা সেখানকার দরিদ্র বা সাধারণ মানুষদের মতের বিরুদ্ধে চিংড়ি চাষ শুরু করে। ক্ষুদ্র চাষিদের ঘেরের জন্য জমি দিতে বাধ্য করে। এভাবে ঘের এলাকার অধিবাসীরা নানা ধরনের সমস্যায় ভোগে। চিংড়ি ঘেরকে ঘিরে এত সমস্যা এবং হোয়াইট স্পট ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে এত চিংড়ির একত্রে মরে যাওয়ায় অনেকেই বাংলাদেশে চিংড়ি চাষ বন্ধ করে দেয়ার কথা বলেন। কিন্তু এটিও ঠিক যে, চিংড়ি চাষ বন্ধ করে দিলে আমরা প্রতি বছর প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা হারাবো। অভিজ্ঞ মহলের মতে, দেশে চিংড়ি চাষ বন্ধ না করে আমাদেরকে এ দেশের উপযোগী করে চিংড়ি চাষ করার উপায় বের করতে হবে। কারণ বিদেশি পদ্ধতিতে চিংড়ি চাষ করার ফলে বিগত বছরগুলোতে প্রচুর সমস্যা তৈরি হয়েছে। তাই আমাদেরকে এমন প্রযুক্তি বের করতে হবে, যাতে আমরা সমস্যাহীনভাবে চিংড়ি চাষ করতে পারি।




0 comments:

Post a Comment