Wednesday, June 29, 2016

পরিবেশ: বাযু দূষণ ও আমরা

পরিবেশ: বাযু দূষণ ও আমরা
আলী ফোরকান
ঢাকার বায়ু দূষণের মাত্রা বিশ্ব সংস্থার নির্ধারিত মান অতিক্রম করে গেছে। পাঁচটি বড়ো শহর চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, সিলেট, বরিশালের বাতাসও মারাত্মকভাবে দূষিত। এ শহরগুলোতে বাতাসে ভাসমান দূষিত কণিকার পরিমাণ বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারিত মানের তিনগুণ বেশি। বিশ্ব ব্যাংক পরিচালিত সাম্প্রতিক ‘বায়ুদূষণ ও স্বাস্থ্য ঝুঁকি’- এর সমীক্ষা অনুসারে দেখা গেছেÑ বছরে বায়ুদূষণের ফলে প্রায় ৫ হাজার গর্ভপাত ও অকালমৃত্যু হয়। আমাদের পল্লী অঞ্চলের আবাসিক এলাকাগুলোতে গড়ে উঠেছে ঘন ঘন ইট ভাটা ও চিমনি ভাটা। যা গ্রামের বিশুদ্ধ বাতাসকেও করছে দূষিত-কলুষিত। এখন থেকে আমাদের এ ব্যাপারে সচেতনতা গড়ে তুলতে হবে। কল-কারখানা-শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো এমন স্থানে স্থাপন করতে হবে যাতে তার চারদিকে প্রচুর উন্মুক্ত জায়গা থাকে। কল-কারখানা চিমনি, নিঃসৃত ধোঁয়া, জঞ্জাল ইত্যাদি। এ গুলো নিয়ন্ত্রণের জন্য যেসব শিল্প আইন আছেÑ তার অনুপুঙ্খ বাস্তবায়ন করতে হবে। আমাদের দেশে বায়ুদূষণ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। উন্নত দেশগুলোতে বায়ুদূষণ প্রতিকার ও নিয়ন্ত্রণের জন্য নানা রকম বুরুশ ও ফিলটার ব্যবহার করা হয়। শোষণ ও নিষ্কাশন প্রক্রিয়ায় বায়ুদূষণ রোধ করা অনেকটা সহজতর। দূষিত বস্তুগুলোকে একত্র করে বিভিন্ন পদার্থের একটা বড়ো অংশ একটু চেষ্টা করলেই বাদ দেয়া মোটেই কঠিন কাজ নয়। সবচেয়ে সহজসাধ্য ও কার্যকর ব্যবস্থা হলো গাছ লাগানো। এ গাছগুলোতেই দূষিত বায়ুর পরিশোধক। পরিবেশ দূষণের প্রতিকার মোটেই দুঃসাধ্য নয়। আসলে যা প্রয়োজন- তা হলো এ ব্যাপারে প্রণিত আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগ। সচেতনতা ও সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা। পরিবেশ দূষণ মানুষের গড়া সভ্যতার অন্যতম কুফল। যান্ত্রিক সভ্যতার যেসব বিষধর ফনী চারদিকে বিষাক্ত নিঃশ্বাস ফেলছে। তাদের মধ্যে পরিবেশ দূষণ অন্যতম। বর্তমানে সামান্য সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের প্রলোভনে চিরকালের জন্য স্রষ্টার সাজানো-গোছানো নৈসর্গিক সংসার বিনষ্ট করে আমরা আত্মঘাতী নীতিই গ্রহণ করছি। আমাদের এক আত্মঘাতী নীতির প্রতিফলন শুধু বর্তমান মানব জাতিই ভোগ করছে না, ভাবী প্রজন্মকেও বিপন্ন করে তুলছে। সুস্থ পরিবেশের অপর নামই জীবন। সেই জীবনকে যথাসময়ে রক্ষা করতে এগিয়ে না এলে সভ্যতার গোরস্থানে পড়ে থাকবে আমাদের পচাগলা লাশ। এরপর প্রতিকারের হয়তো কেউ থাকবে না। কারন,প্রকৃতির আশ্চর্য ঐক্যতান আজ এই ধরিত্রীতে মানুষের অবিরাম মিথস্ক্রিয়ায় বিলীন হয়ে যাচ্ছে। এই মিথস্ক্রিয়াও সম্ভব হয়েছে আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে। যার দ্বারা মানুষ কখনো পরিচালিত হয়েছে তার প্রয়োজনের তাগিদে। কখনো বা নিছক লোভে। শিল্প বিপ্লবের সময় প্রকৃতির ভারসাম্য বিধ্বংসী অনেক প্রযুক্তি অস্তিত্বে এসেছিল ইউরোপ এবং আমেরিকায়। অতঃপর পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর দায়িত্বহীন প্রযুক্তির উদ্ভব ঘটে পৃথিবী নামক সমগ্র গ্রহে। এতে লাখ লাখ বছরের পরিবেশ এবং পরিবেশগত ভারসাম্যে যে বিঘœ ঘটেছে তা সামষ্টিকভাবে পৃথিবীতে। বসবাসরত মানুষের জন্য সংকট এবং তার বহুমাত্রিকতাই আজ সবচেয়ে দুর্ভাবনার কারণ।পরিবেশের অবনতি বুঝতে এখন আর কোনো গবেষণার প্রয়োজন হয় না। প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের ক্রমবর্ধমান সাংঘর্ষিক সম্পর্কের ফলে বৈচিত্র্যপূর্ণ কত প্রাণীর আবাসন বিনষ্ট হয়েছে। তা এখন কিছু কিছু অনুভূত হলেও এর সামগ্রিক চিত্র এখনো হয়তো আমাদের কাছে পৌঁছায়নি। শুধু জলবায়ু পরিবর্তনের ধারাকে লক্ষ্য করলেই বোঝা যায় দূষণের মাত্রা এবং জীববৈচিত্র্য ধ্বংসে এর ভূমিকা। জৈব রসায়নের এ বৈচিত্র্য বিনাশে বিধ্বংসী ক্ষমতা। মানব জীবনের জন্যও আমরা যে বায়ুতে নিঃশ্বাস নিই, যে খাদ্য গ্রহণ করি বা যে পানি পান করি তার বিশুদ্ধতা পূর্বশর্ত। কিন্তু সে শর্ত পূরণের আশ্বাস কোনো মহল থেকেই নেই। আমরা তবু প্রযুক্তির সাহায্য নিয়ে এর মোকাবিলা করতে পারলেও প্রাণিজগৎ তা থেকেও বঞ্চিত। সব ধরনের ক্যান্সার রোগের সঙ্গে যেসব রাসায়নিক আমাদের পরিবেশকে দূষিত করে তাদের একটি পরীক্ষিত যোগসূত্র আছে। কিছু লোক এখন এ কথা স্বীকার করে যে, সদ্য ব্যবহারে এসেছে এমন বায়ো-এগ্রিকালচার ও বায়ো-ইঞ্জিনিয়ারিং পণ্য বিভিন্ন মেয়াদে আদৌ ক্ষতিকর কি না অথবা শেষ পরিণতিতে তা আমাদের শরীরে কোনো প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করবে কি না তা অজ্ঞাতÑ তাই আমরা নির্ভাবনায় এগুলো ব্যবহার করি এবং এর উদ্ভাবকরাও এগুলোর উৎপাদন অব্যাহত রেখেছে। এগুলোর ব্যবহারে কিছু কিছু লোকের অস্বস্তিকে এরা আমলই দেয় না। এই দূষণ-বিতর্কের দুর্ভাগ্যজনক দিক হচ্ছে এর দায়সারা আবহ। সবাই মনে করে এ সমস্যার কিছু একটা করা দরকার; কিন্তু কেউ এর গভীরে যেতে চায় না। তাই পরিবেশ দূষণমুক্ত করতে যা সভা-সমিতিতে প্রস্তাব করা হয় তা আসলে ক্যান্সার রোগীকে এসপিরিন দিয়ে সারানোর প্রস্তাবেরই শামিল। হাইপ্রোফাইল পরিবেশ বিতর্কের পরিবর্তে বিষাক্ত গ্রিন হাউস গ্যাস নির্গমন রোধে পদক্ষেপ অধিক জরুরি। আরো জরুরি পরিবেশ সম্পর্কিত মৌলিক জ্ঞান আহরণ। পরিবেশ সম্বন্ধে আমাদের যেটুকুই ধারণা আছে তাও সেক্যুলার ধারণা। আমরা ভাবি যে পরিবেশ বা প্রকৃতি জড় এবং মৃত। স্বভাবতই আমাদের ধারণায় তা অনুভূতি ও প্রতিক্রিয়াহীন। কিন্তু আসলে কি তাই? পরিবেশ সংকটের অন্তত আংশিক সমাধান তো আছে এই উপলব্ধিতে : সে সত্তা আমাদের এবং আমাদের আচরণ সাপেক্ষে প্রকৃতিকে একটি মিল রেখে সমগ্র সৃষ্টিকে অস্তিত্বে এনেছেন তার মহান উদ্দেশ্যকে অনুধাবন করার ক্ষমতা অর্জন। সেই উপলব্ধির আলোকে আমাদের সংশোধনী পদক্ষেপ নিতে হবে। শুধু তাহলেই প্রকৃতি আমাদের সংশোধিত আচরণে সাড়া দেবে। তবেই শুধু সামগ্রিক সৃষ্টি সম্বন্ধে আমরা একটি দর্শন আয়ত্তে আনতে পারবো এবং সেটাই আমাদের বিরুদ্ধে প্রকৃতির প্রতিশোধ স্পৃহাকে অবদমিত করবে।
আমাদের জীবন দর্শনের এই মৌলিক পরিবর্তনই আমাদের বুঝতে সাহায্য করবে যে, আমরা কে এবং কে সৃষ্টির অন্য সবকিছুকে অস্তিত্বে এনেছেন। কোনো সেক্যুলার দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন মানুষ এই দর্শনকে আয়ত্ত করতে পারবে না। কেননা তাদের কাছে সব সৃষ্টিই ইট, কাঠ, পাথরতুল্য জড় পদার্থ। তবু এখন সেক্যুলার পাশ্চাত্যেও প্রকৃতির প্রতি আমাদের আচরণের যেটুকুই উপলব্ধি এসেছে তা মন্দের ভালো হিসেবে পরিবেশের ক্রমাবনতি থেকে আমাদের বাঁচাবে। বছরের পর বছর ধরে পরিবেশবাদীদের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা এবং তাদেরই উদ্যোগ ও প্রচেষ্টায় আমরা যে মহাবিপর্যয়ের প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছি সেই উপলব্ধির কিয়দংশ আজ সর্বজনীনতা লাভ করেছে। বৈশ্বিক পর্যায়ে পরিবেশ সংকটের সঙ্গে এক ধরনের রাজনীতিও জড়িয়ে আছে। তবে আমার কথা এই যে, এই রাজনীতিও সে তো এক সময়ে বিশ্ব রাজনীতির অনেক ইস্যুর মতোই সমাধান খুঁজে পাবে। তবে এই নোংরা রাজনীতির ধারাকে শীর্ষ পর্যায়ে উপেক্ষা করার দিন ফুরিয়ে এসেছে। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, রাজধানীতে ‘ড্যাপ’ চিহ্নিতকরণও একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ। তবে এমন উদ্যোগকে আরো অর্থবহ করতে সারাদেশকেই এই চিহ্নিতকরণের আওতায় আসা দরকার। 

0 comments:

Post a Comment