দেশের বিস্তীর্ণ এলাকা মিনি মরুভূমি
আলী ফোরকান
বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ এলাকা এখন মিনি মরুভূমি। পানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ও এশীয়-প্রশান্ত পানি ফোরাম এ দেশের পানি ব্যবস্থাপনা নিয়ে যে চিত্র তুলে ধরেছে-বাস্তবতা তার চেয়েও করুণ। ব্রক্ষপুত্র, যমুনা, পদ্মা, মেঘনা, তিস্তা, সুরমা, কুশিয়ারা, ধলেশ্বরী, গোড়াইসহ দেশের সকল নদ-নদীর যেদিকেই দু’চোখ যায় ধু-ধু বালুচর। এই ভয়াবহ দুরবস্থার জন্য প্রকৃতি যতটা না দায়ী। তার চেয়ে অনেক অনেক বেশি দায়ভার বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্র ভারতের। দেশটির পানি কূটনীতির কবলে পড়েই বাংলাদেশের জলবায়ুতে এই বিরূপ প্রভাব দেখা দিয়েছে। যার ফলশশ্রুতিতে শত শত নদী হারিয়ে গেছে। আর শুষ্ক মৌসুম এলেই অসংখ্য নদী মরা গাঙে পরিণত হয়। ক্রমান্বয়েই ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর নেমে যাচ্ছে নিচের দিকে। ভয়াবহ ক্ষতির মুখে পড়েছে দেশের কৃষিনির্ভর অর্থনীতি। বনজ সম্পদ হুমকির মুখে। সেই সাথে পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণে নদী অববাহিকার মানুষ আর্সেনিকসহ নানা ধরনের রোগে আক্রান্ত হচ্ছে।
এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ও এশীয়-প্রশান্ত পানি ফোরামের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশে পানি সঙ্কট ভয়াবহ। ‘দ্য এশিয়ান ওয়াটার ডেভেলপমেন্ট আউটলুক শীর্ষক প্রতিবেদনে এই উদ্বেগজনক তথ্য প্রকাশ করা হয়। এই অঞ্চলের প্রতিটি দেশের পানি সঙ্কট নিয়ে এটাই প্রথম রিপোর্ট। রিপোর্টে বলা হয়, এশিয়া ও প্রশান্ত অঞ্চলের ৪৯টি দেশের মধ্যে ৩৭টি দেশে পানি সঙ্কট রয়েছে। এডিবির বিবৃতিতে বলা হয়, ‘দক্ষিণ এশিয়া এবং মধ্য ও পশ্চিম এশিয়ার নদীগুলোর ওপর প্রচন্ড চাপ থাকায় পানি সঙ্কট ভয়াবহ রূপ নিয়েছে।’ অন্যদিকে রয়টার্সের এক রিপোর্টে বলা হয়, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পানি নিরাপত্তা বিশ্বের ক্রমবর্ধমান উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এশিয়া-প্রশান্ত অঞ্চলে ভয়াবহ পানি সঙ্কটের কারণে প্রায়ই বন্যা, খরা, জলবায়ু পরিবর্তন, নদী ও হ্রদের দূষণ, নগরায়ন এবং ভূ-উপরিস্থ পানির মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার হচ্ছে। উপরন্তু ভারতের মতো দেশ জলবিদ্যুতের দিকে ঝুঁকে পড়ায় পানি সঙ্কট তীব্র আকার ধারণ করেছে। শুষ্ক মৌসুমে পানির জন্য এদেশের মানুষের হাহাকারের মূল কারণ-ভারত থেকে পানি আসতে না পারা। বন্ধুপ্রতিম এই রাষ্ট্র উজানের পানি প্রত্যাহার করে নিতে স্থায়ীভাবে গঙ্গা নদীতে ফারাক্কা বাঁধ, তিস্তায় গজলডোবা বাঁধ, মনু নদীতে নলকাথা বাঁধ, যশোরে কোদলা নদীর উপর বাঁধ, খোয়াই নদীর উপর চাকমা ঘাট বাঁধ, বাংলাবন্ধে মহানন্দা নদীর উপর বাঁধ, গোমতি নদীর উপর মহারানি বাঁধ, মহুরি নদীর উপর কলসী বাঁধ, উমিয়াম ও ধালা নদীর উপর মাওপু ড্যাম এবং সারী ও গোয়াইন নদীর উপর মাইন্ডু ড্যাম নির্মাণ করেছে। মাওপু ও মাইন্ডু ড্যাম নিয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে কড়া প্রতিবাদ জানানো হয়। ওই প্রতিবাদে বলা হয়েছে, উমইউ এবং মাইন্ডু ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে অভিন্ন নদী। এই নদীর উপর ড্যাম নির্মাণের ফলে বাংলাদেশে কি ধরনের বিরূপ প্রভাব পড়বে তা নিরূপণ করা প্রয়োজন। এটা নিরূপণ না হওয়া পর্যন্ত ভারতের মেঘালয় রাজ্য সরকারকে ড্যাম নির্মাণ কাজ বন্ধ রাখার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতেও বলা হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের এই আহ্বানে সারা দেয়নি ভারত। এছাড়াও বরাক নদীর উপরেও ভারত নির্মাণ করছে শক্তিশালী স্থাপনা। দ্রুততার সাথে এই কাজ এগিয়ে চলছে। যা টিপাই ড্যাম নামে পরিচিত। এখান থেকে ভারত ১৫শ’ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করবে। ভারতের এই উচ্চভিলাষী পরিকল্পনা বাংলাদেশের জন্য ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে-এমন শঙ্কা থেকেই বাংলাদেশের সর্বস্তরের মানুষ এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছে। ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য জুড়েও এই প্রকল্পের বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন হচ্ছে। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকেও জানানো হয়েছে জোড়ালো প্রতিবাদ। কিন্তু ভারত তার কাজ ঠিকই চালিয়ে যাচ্ছে। এছাড়াও আরও ১৫টি নদীর উপর ভারত অস্থায়ী ভিত্তিতে কাঁচা বাঁধ নির্মাণ করেছে। বর্ষা মৌসুমে এসব স্থায়ী ও অস্থায়ী বাঁধ খুলে দেয়া হয় এবং শুষ্ক মৌসুম শুরু হলেই এসব কাঁচা বাঁধ পুনরায় নির্মাণ করে পানি প্রত্যাহারের কাজে লাগানো হয়। ভারতের এরকম পানি প্রত্যাহারের ফলে চলতি শুষ্ক মৌসুমের শুরুতেই দেশের নদ-নদীগুলোর অবস্থা আরও করুণ হয়েছে। দেশের নদ-নদীগুলোতে তীব্র পানি সঙ্কট দেখা দিয়েছে। ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তরেও পড়েছে এর বিরূপ প্রভাব।
যমুনাবিধৌত এলাকায় ভারতের পানি আগ্রাসন নীতির বিরূপ প্রভাব নিয়ে গবেষণা করতে যেয়ে দেশের পানি বিশেষজ্ঞরা দেখেছেন, নয়-দশ বছর ধরে যমুনা নদীর পানির স্তর ভূগর্ভস্থ পানির স্তরেরও অনেক নিচে নেমে গেছে। আগে শুষ্ক মৌসুমে ভূখন্ড থেকে ৩০ ফুট গভীরে পানির স্তর পাওয়া গেলেও বর্তমানে পানির স্তর নেমে গেছে ৬০/৬৫ ফুট গভীরে। সরাসরি এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে যমুনার শাখা নদী ও নালাগুলোতে। পানির স্বাভাবিক প্রবাহ বাঁধাগস্ত হওয়ায় বাংলাদেশের প্রধান প্রধান নদ-নদীগুলো বর্ষা মৌসুমেও পানিশূন্যতা দেখা দেয়। পানি প্রবাহ কমে যাওয়ায় এই শুষ্ক মৌসুমে সাড়ে ৫ হাজার কিলোমিটার নৌপথের মধ্যে সাড়ে ৩ হাজার কিলোমিটার নৌপথই এখন সমস্যা সঙ্কুল। ফলে অধিকাংশ নৌপথেই স্বাভাবিকভাবে জাহাজ চলাচল করতে পারছে না। এমনকি পাটুরিয়া নৌপথ সচল রাখা হচ্ছে ড্রেজিং করে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশে এক সময় ১ হাজারের অধিক নদীর অস্তিত্ব ছিল। বর্তমানে ছোট-বড় শাখা নদী, নদী-উপনদী মিলিয়ে নদীর সংখ্যা এসে দাঁড়িয়েছে ৩১০টি।
গত চারটি বছর ধরে সরকার তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে ভারতের সাথে একটি চুক্তিতে উপনীত হতে প্রাণান্ত প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। কিন্তু কোন সুফলই আসেনি। মেনে চলা হচ্ছে না ত্রিশ বছর মেয়াদি গঙ্গা চুক্তির শর্তসমূহ। ফলে পদ্মায় অথৈ জলরাশি আর জলোচ্ছ্বল ঢেউয়ের জায়গাজুড়ে এখন শুধু বালি আর বালি। চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ (পদ্মার উৎস মুখ) থেকে পাবনার ঈশ্বরদির হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পর্যন্ত প্রায় দুশো কিলোমিটার জুড়ে এই বালির চর। যেন মিনি মরুভূমি। ত্রিশ বছর মেয়াদি গঙ্গা চুক্তি হলেও ভারত এই চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশকে তার হিস্যা দেয় না। শুধু ফারাক্কা বাঁধের মাধ্যমে ভারত গঙ্গার পানি নিয়ন্ত্রণ করায় বাংলাদেশের ৩৬টি নদী এখন মরা গাঙে পরিণত হয়েছে। শুষ্ক মৌসুমে পদ্মার বুকে চলে ট্রাক। প্রাকৃতিক ভারসাম্য নির্ভর মাথাভাঙ্গা, গড়াই, ইছামতি, আপার ভৈরব, কুমার, মধুমতি, ফটকি, বেতাই, চিত্রা, কপোতাক্ষ ও নবগঙ্গাসহ পদ্মার সকল শাখা নদী এখন পানিশূন্য।
অপরদিকে পানি উন্নয়ন বোর্ডের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, খুলনা অঞ্চলে সুন্দরবনের নদী বাদে শিবসা, পেসা, বলেশ্বর, পশুর, আড়পাঙ্গাসিয়া, খোলপেটুয়া, আগুনমুখা, ভদ্রা, আঠারোবাকী, আলাইপুর, গাসিয়াখালী, দড়াটানা, ইছামমতী, খোলপটুয়া, রায়মঙ্গল, নমুদ সমুদ্র সোনাগাঙ্গ, ভাঙ্গরাকুঙ্গ, মালঞ্চ, সাতক্ষীরা, সুতেরখালী, মারজাতী, হারিণভাঙ্গা, মহাগঙ্গা, গলাঙ্গী, হরিপুর, সোনাই বুধহাটার গাঙ্গ, ঢাকি, গলাঘেমিয়া, উজীরপুর, কাটাখাল, গুচিয়াখালী, খাল আকরার, খাল মংলা, সোলপায়ারা আগুরমুখ মহুরী মোদলাম হাডুয়াভাঙ্গা পানগুছি, মেয়ার গাং, কাজিবাছা, কাকশিয়ালি, বলেশ্বর ও মরাভোলা নদীর নাব্যতা এতটাই কমে গেছে যে-এসব নদীর ৮০ শতাংশই এখন অস্তিত্বের সংকটে কাতর।
এ ব্যাপারে পানি বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, এই দুরবস্থার জন্য ভারতের পানি প্রত্যাহার নীতিই দায়ী। তাঁরা জানান, ফারাক্কার বিরূপ প্রভাব ঠেকাতে আমরা বিকল্প গঙ্গা ব্যারেজ নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এ নিয়ে সমীক্ষার কাজ শেষ হয়েছে। ডিপিপি তৈরি হচ্ছে। এরপর আমরা এটি একনেকে তুলার সুপারিশ করবো। অন্যান্য নদীর পানির হিস্যা আদায় নিয়েও আমরা ভারতের সাথে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছি। তিস্তা নদীর পানি ভাগাভাগি নিয়ে একটি চুক্তিতে উপনীত হতে সরকার এখনও হাল ছাড়েনি। তাদের মতে, সমীক্ষার নামে যাই হোক না কেন-টিপাইমুখ ড্যাম নির্মাণ করাটা ভারতের জন্য অনেক কঠিন কাজ। তবে পানি উন্নয়ন বোর্ডের সাবেক মহাপরিচালক মো. হাবিবুর রহমান জানান, ভারতের পানি আগ্রাসী নীতির কারণে দেশের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যে বড় ধরনের পরিবর্তন দেখা দিয়েছে। শুরু হয়েছে মরুকরণ। তাপমাত্রা বেড়ে যাচ্ছে। আর নাব্যতা সঙ্কটে ভুগছে দেশের সকল নদ-নদীই। বিশেষজ্ঞরা বলছেন,এডিবি যে চিত্র তুলে ধরেছে-দেশের নদীগুলোর অবস্থা তার চেয়েও করুণ।
0 comments:
Post a Comment