Tuesday, June 28, 2016

বাংলাদেশের পরিবেশ ঃ কিছুকথা

বাংলাদেশের পরিবেশ ঃ কিছুকথা
আলী ফোরকান 
৫৫ হাজার ৫৯৮ বর্গমাইল আয়তনের ছোট একটি দেশ, বাংলাদেশ। এর পূর্ব, পশ্চিম ও উত্তর দিকে ভারত, দক্ষিণ-পূর্ব মিয়ানমার (বার্মা) এবং দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর। আয়তনের তুলনায় দেশটির জনসংখ্যা অত্যন্ত বেশি। জনসংখ্যার ভারে এর আর্থ সামাজিক অবস্থা নাজুক হয়ে পড়েছে। বর্তমানে দেশটির মোট জনসংখ্যা প্রায় সাড়ে ১৬ কোটির বেশি। বার্ষিক প্রবৃদ্ধির হার তুলনামূলক হতাশাবদ্ধ। মোট আয়তনের ৬.৭ শতাংশ নদ-নদী ও জলাভূমি। জনসংখ্যার ঘনত্ব প্রতি বর্গমাইলে ১৬০০ জনের বেশি। জনসংখ্যার এই ঘনত্ব পৃথিবীর গুটিকয়েক দেশেই বিদ্যমান রয়েছে। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে সরকারের সর্বাত্মক চেষ্টা অব্যাহত থাকলেও এর বৃদ্ধির হার সত্যিই হতাশা ব্যঞ্জক। এই হারে জনসংখ্যা বাড়তে থাকলে ২০৫০ সালে দেশের জনসংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ হবে। জনসংখ্যার এই আধিক্য পরিবেশের জন্যও ভয়াবহ হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এছাড়া প্রতি বছরই দেশের উপকূলীয় এলাকায় সর্বগ্রাসী বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, টর্নেডোর ছোবলে ক্ষত-বিক্ষত হচ্ছে জীবন ও জীবিকা। প্রতি বছরের এই সীমাহীন ক্ষতি যেমন দেশের সার্বিক অর্থনীতির ওপর মারাত্মক প্রভাব পড়ছে। তেমনি দেশের পরিবেশের জন্যও খুবই ঝকিপূর্ণ।
বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল বাদে পুরোটাই সমতল ভূমি। এই সমতল ভূমি আমার এই উপমহাদেশের অন্যান্য অঞ্চল থেকে অপেক্ষাকৃত নীচু। এক সমীক্ষায় দেখা যায়, দেশের প্রায় ৫০ শতাংশ এলাকা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১০ মিটারের কম উঁচু। আবার দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের কিছু এলাকা ৩০০ মিটারের বেশি উঁচু।
বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে কর্কটক্রান্তি রেখা চলে গেছে। এর ফলে পুরো দেশটিই মরুভূমি হতে পারতো। এক্ষেত্রে বঙ্গোপসাগর এবং হিমালয় দেশটিকে রক্ষা করেছে। ফলে দেশটিতে নাতিশীতোষ্ণ আবাহওয়া বিরাজমান। আর জলবায়ু  হচ্ছে গ্রীস্মমন্ডলীয়। আবাহওয়ার দিক দিয়ে গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত ও বসন্ত এই ৬টি ঋতুতে ভাগ করা হলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশটির আবাহওয়া ও জলবায়ুর পরিবর্তন লক্ষনীয়। এখন শরৎ, হেমন্ত কিংবা বসন্ত তেমন ভাবে মানুষকে নাড়া দেয় না। যেমনি ভাবে নাড়া দিয়েছিল বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে। তবে  পকৃতির পরিবর্তন রবীঠাকুরও বোধ হয় লক্ষ্য করেছিলেন। তা না হলে তিনি ফুল ফুটক আর না ফুটুক আজ বসন্ত এ কথা লিখবেন কেন।
যাহোক ইদানিংকালে লক্ষ্য করা যাচ্ছে, আগেকার বছরগুলোর তুলনায় গত দুতিন বছর তাপমাত্রা তুলনামূলকভাবে বেশি। গ্রীষ্ম কালে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩৮ ডিগ্রি সেন্ডিগ্রেড ছাড়িয়ে যায়। এ সময় কালবৈশাখী ঝড় হয়। আবার বর্ষাকালে বৃষ্টিপাত তুলনামূলক কম হচ্ছে। তবে বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাতের ৮০ শতাংশই হচ্ছে বর্ষাকালে। এ কথা সকলেরই জানা যে, বাংলাদেশ কৃষি প্রধান দেশ। ৮০ শতাংশ লোক কৃষির ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু এই কৃষির বর্ষা এবং খরা পরিস্থিতির ওপর নির্ভরশীল। সময়মত বর্ষা না হলে যেমন কৃষক তার জমিতে ফসল ফলাতে পারে না; আবার অতি বৃষ্টি এবং খরা কৃষকদের ভাগ্যকে অনিশ্চিত করে তোলে। একইভাবে দেশের উপকূলীয় অঞ্চলের কথা উল্লেখ করা যেতে পরে। ফি বছরই ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস উপকূলীয় অঞ্চলে আঘাত হানে। এর ফলে ওই অঞ্চলের জীব ও জীবিাকর ব্যাপক ক্ষতিসাধিত হয়।
এক্ষেত্রে আবাহওয়ার পূর্বাভাস ও শতর্কীকরণ ব্যবস্থা জোরদার করার মাধ্যমে উপকূলীয় অঞ্চলকে রক্ষা করতে হবে। এছাড়া উপকূলীয় অঞ্চলে বেশি করে আশ্রয় কেন্দ্র স্থাপনও জরুরী হয়ে পড়েছে। ইতোমধ্যেই বেশকিছু বিপজ্জনক স্থানে সরকার আশ্রয় কেন্দ্র স্থাপন করেছে। কিন্তু তা যথেষ্ট নয়।
বাংলাদেশের ভূমি ব্যবস্থা ঃ বাংলাদেশ ছোট্ট হলৌ এদেশে বিভিন্ন ধরনের মাটির সন্ধান পাওয়া গেছে। কামরুল ইসলাম চৌধুরী বাংলাদেশ ঃ পরিবেশ পরিচিতি শীর্ষক নিবন্ধে লিখেছেন, এ পর্যন্ত বাংলাদেশে প্রায় ৫০০ ধরনের মাটির অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া গেছে। তবে এগুলোকে বিস্তৃত পরিসরে তিনটি গ্রুপে ভাগ করা যায়। এগুলো হচ্ছে সমতল প্লাবনভূমি, গড় এলাকা এবং পাহাড়ী এলাকা।
বাংলাদেশের ৮০ শতাংশ মানুষ কৃষি জমির ওপর নির্ভরশীল। জনসংখ্যার ক্রমবর্ধমান চাপে জমির পরিমান দিন দিনই কমে যাচ্ছে। তাছাড়া ভূমি ক্ষয়ের কারণেও আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ কমে যাচ্ছে। ১৯৮১ সালে জনপ্রতি গড়ে জমির পরিমাণ ছিল ০.১৬ হেক্টর। কিন্তু ১৯৯৭ সালে তা কমে ০.১১ হেক্টর রয়েছে। বাংলাদেশ সরকারের এক হিসেবে দেখা যায়,বর্তমানে বাংলাদেশে মোট আবাদযোগ্য জমির পরিমান ৯৫ লাখ ৬০ হাজার হেক্টর। এই জমির ১৭.৫ শতাংশ এক ফসলী, ৫৪.৭ শতাংশ দোফসলী এবং ২০.৪ শতাংশ তিন ফসলী। বাকি ৭.৮ শতাংশ পতিত জমি।
এদেশের প্রধান উৎপাদিত সম্পদ হচ্ছে ধান। আউশ, আমন, ইরি, বোরো প্রভৃতি ধান উৎপাদিত হয়ে থাকে। এছাড়া গম, ভুট্টা,পাট, তামাক, তুলা প্রভৃতির চাষ হয়ে থাকে। প্রসংগক্রমে বলা প্রয়োজন, প্রতিনিয়ত জমি চাষের কারণে জমির উর্বরতা কমে যাচ্ছে। এর ফলে জমির ফলনও হ্রাস পাচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিরি) উচ্চ ফলনশীল বীজের উদ্ভাবন করেছে এবং এক্ষেত্রে তাদের গবেষণা অব্যাহত রেখেছে।
বাংলাদেশের পানি সম্পদ ঃ নদ-নদীর দেশ বাংলাদেশ। পদ্মা, মেঘনা, যমুনা ও ব্রহ্মপুত্র প্রভৃতি প্রধান নদী ছাড়াও অসংখ্য ছোট নদী রয়েছে। এছাড়া হাওড়, বাওড় ও বিল। বাংলাদেশেল ৫৪টি নদীর উৎস স্থল হচ্ছে দেশেল সীমান্তের বাইরে অর্থাৎ ভারত থেকে এসেছে। ফলে নদীগুলোর পানি বন্টন নিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর থেকেই ভারতের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা চলছে। এই নদীগুলোর পানির সুষ্ঠু বন্টন এবং পানি সম্পদের উন্নয়নে যৌথ প্রকল্প প্রণয়ন করার মাধ্যমে ব্যাপক উন্নয়ন কর্মকান্ড তরান্বিত করা যায়। ১৯৯৬ সালে ভারতের সঙ্গে গঙ্গা নদীর পানি বন্টনে ৩০ বছর মেয়াদি চুক্তি হয়েছে। বাকি ৫৩টি নদীর পানি বন্টন এখনো অমীমাংশিতই রয়ে গেছে। এ বিষয়ে সরকারের সুষ্ঠু নীতিমালা যেমন প্রয়োজন, তেমনি পনি সম্পদ উন্নয়নে সুনির্দিষ্ট কর্মপন্থা নির্ধারণ। যাতে করে দেশের উন্নয়নে পানি সম্পদ অবদান রাখতে পারে।
বন্যা, ঘূর্ণিঝড় ও নদীভাঙন ঃ প্রতি ভছরই বন্যা-ঘূর্ণিঝড় বাংলাদেশের ওপর আঘাত হানছে। এরফরে প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ সম্পদ বিনষ্ট হচ্ছে এবং বিপুল প্রাণহানি ঘটছে। প্রতি বছর এই বন্যা ও ঘূর্ণিঝড়ের কারণে নদী ভাঙনও ব্যাপকতর হচ্ছে। এক হিসেবে দেখা যায়, নদী ভাঙনে প্রতি বছর দুশো থেকে সাড়ে তিনশ হেক্টর জমি হারিয়ে যায়। নদী ভাঙনের শিকার হয়ে প্রতি বছরই অসংখ্য পরিবার ভূমিহীন ও গৃহহারা হচ্ছে। এই মানুষগুলোই জীবন ও জীবিাকর তাগিদে শহরে আসতে বাধ্য হচ্ছে। এতে করে শহরের আনাচে কানাচে গড়ে উঠছে বস্তি। রাজধানী ঢাকা শহরের একটা বড় অংশ দখল করে আছে বস্তিবাসী মানুষগুলো। নদী ভাঙন রোধ কল্পে সরকার বিভিণœ সময় বেশকিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। কিন্তু ফি বছর প্রবল বন্যার কারণে অর্থ ব্যয় কোনো কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না।
প্রাকৃতিক সম্পদ ঃ প্রাকৃতকি সম্পদের মধ্যে প্রাকৃতিক গ্যাসে বাংলাদেশ সমৃদ্ধ। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিদেশী তেল কোম্পানিগুলো বাংলাদেশে বিপুল পরিমান গ্যাসের মজুত আবিস্কার করেছে। এই প্রাকৃতিক সম্পদের পাশাপাশি বাংলাদেশের রয়েছে নবায়নযোগ্য সম্পদ বিশাল বনভূমি। বাংলাদেশের এই বনজসম্পদ দেশের অর্থনীতিতে যেমন ভূমিকা রাখছে তেমনি দেশেল পরিবেশ ও প্রতিবেশের স্থিতিশীলতা ও ভারসাম্য রক্ষা করার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
সরকারি এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, বর্তমানে দেশে বনভূমির পরিমাণ ১০ লাখ হেক্টর। কিন্তু ক্রমাগাতভাবে বনভূমি উজাড় করার কারণে পরিবেশ ও প্রতিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। এ ব্যাপারে সরকারের এবং আপামর জনগোষ্টীর সচেতন হতে হবে। বেশি বেশি করে গাছ লাগানের অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে।

0 comments:

Post a Comment