Sunday, June 26, 2016

আউটসোর্সিং খাত:অপার সম্ভাবনা

আউটসোর্সিং খাত:অপার সম্ভাবনা
আলী ফোরকান
তথ্যপ্রযুক্তি নিয়ে আমাদের অনেক দুঃসংবাদ রয়েছে। তথ্যপ্রযুক্তিই আমাদের দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ক্লেংকারি হয়েছে। এরপর তথ্যপ্র্রযুক্তি বিষয়ক পরামর্শক প্র্রতিষ্ঠান গার্টনারের দেয়া সুসংবাদটি অপ্র্রত্যাশিত বটে। প্র্রতিষ্ঠানটির সর্বশেষ তালিকা অনুসারে ইন্টারনেটভিত্তিক আউটসোর্সিংয়ে বাংলাদেশ শীর্ষ ৩০টি দেশের মধ্যে রয়েছে। ভারত ও শ্রীলংকাসহ এশিয়ার নয়টি দেশ রয়েছে তালিকায়। মূলত ইন্টারনেট প্রযুক্তি ব্যবহার করে প্রোগ্রামিং, সফটওয়্যার তৈরি, কল সেন্টার, ডাটা এন্ট্রি, কাস্টমার কেয়ার, ডাটাবেজ তৈরি ও রক্ষণাবেক্ষণ, ওয়েবসাইট তৈরি ইত্যাদি বিষয়ে আউটসোর্সিং হয়ে থাকে। ভারত অনেক আগে থেকেই আউটসোর্সিংয়ের বড় বাজার দখল করে থাকলেও বাংলাদেশের উদ্যমী তরুণরা এ সেক্টরে বেশ ভালো করছে। গার্টনারের তালিকায় বাংলাদেশের নাম তাই তথ্যপ্রযুক্তি সেক্টর নিয়ে নতুন স্বপ্ন দেখার সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছে। এ সাফল্যের মূল দাবিদার যে তরুণরা, তা নিয়ে কোন সন্দেহ নেই। নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও মূলত ব্যক্তি উদ্যোগেই আউটসোর্সিং হচ্ছে বাংলাদেশে। সময়মতো ও মানসম্মত পণ্য সরবরাহ করা আউটসোর্সিংয়ের প্রধান শর্ত এবং এ শর্ত ঠিকমতো পালন করছে বলেই আজকে বাংলাদেশ এ অবস্থানে আসতে পেরেছে। মানসম্মত পণ্য সরবরাহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের ওপর নির্ভর করে এবং বাংলাদেশ এক্ষেত্রে আস্থা তৈরি করতে পেরেছে। কিন্তু সময়মতো সরবরাহের বিষয়টি শুধু ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের ওপর নির্ভর করে না; এর সঙ্গে আরও অনেককিছু জড়িত। আউটসোর্সিংয়ে বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থান ধরে রাখা বা উন্নতির জন্য আরও কিছু করা দরকার। যে সীমাবদ্ধতাগুলো প্রকাশ্য ও আলোচিত। অন্তত সেগুলোর দিকে নজর দেয়া বিশেষভাবে জরুরি। এতে আউটসোর্সিংয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান থেকেও বাংলাদেশ ব্যাংক ও সরকারের দায়িত্ব অনেক বেশি। মাত্র কয়েকটি সীমাবদ্ধতা দূর করতে পারলে আউটসোর্সিং খাত থেকেই বাংলাদেশ প্রতি বছর বড় অংকের আয় করতে পারে। অদূরভবিষ্যতে এ আয় ছাড়িয়ে যেতে পারে গার্মেন্টস সেক্টরকেও। নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ সফল আউটসোর্সিংয়ের একটি প্রধান শর্ত। বাংলাদেশে বিদ্যুতের অবস্থা নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই। বিদ্যুতের কারণে অনেকে সময়মতো পণ্য সরবরাহ করতে পারে না। আউটসোর্সিংয়ের পুরো কাজটি যেহেতু ইন্টারনেটভিত্তিক। তাই কোন প্রতিষ্ঠান বিদ্যুতের কারণে একাধিকবার পণ্য সরবরাহে ব্যর্থ হলে ক্রেতা তার কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। সীমিত ইন্টারনেট ব্যবস্থাও সময়মতো পণ্য সরবরাহ করতে না পারার একটি কারণ। ভি-স্যাটের মাধ্যমে ইন্টারনেট যোগাযোগ বন্ধ। সারাদেশ এখন একটিমাত্র সাবমেরিন ক্যাবলের সঙ্গে যুক্ত। কোন কারণে এ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হলে বিকল্প কোন ব্যবস্থা নেই। ইন্টারনেটের গতিও ধীর। সব জায়গায় ইন্টারনেট নেই। মূলত এ দুটো কারণে পণ্য সরবরাহের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সরবরাহকারীদের বেশ সমস্যা পোহাতে হয়। দিনের একটি নির্দিষ্ট সময় নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে পারলে এক বছরের মধ্যেই বাংলাদেশের অবস্থান আরও উন্নত করা সম্ভব। ক্রেডিট কার্ডের সীমিত ব্যবহার আউটসোর্সিংয়ের আরেকটি বড় সমস্যা। বাংলাদেশ থেকে ইন্টারনেটে ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে অর্থ আদান-প্রদান বা বিদেশে কেনাকাটা করা যায় না। অথচ আউটসোর্সিংয়ের অধিকাংশ লেনদেনই হয় ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে। এর বিকল্প পেপল নামক ইন্টারনেটভিত্তিক সেবাটিও বাংলাদেশে নেই। বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়, স্বীকৃত ও নিরাপদ এই অর্থ আদান-প্রদানকারী ব্যবস্থাটি বাংলাদেশে এখনও কেন অনুমতি পাচ্ছে না, বোধগম্য নয়। পেপলের ওয়েবসাইটে যেসব দেশের নাম রয়েছে, সেখানে স্বল্পপরিচিত অনেক দেশের নাম থাকলেও বাংলাদেশের নাম না থাকাটা পীড়াদায়ক। যারা আউটসোর্সিং বা ইন্টারনেটে লেনদেনের সঙ্গে যুক্ত। তারা সবাই বুঝতে পারেন এ সেক্টরে পেপলের প্রয়োজনীয়তা কতটুকু। শুধু পেপলের অনুপস্থিতির কারণে আরও অনেকের আউটসোর্সিংয়ে দক্ষতা থাকলেও তারা তা করতে পারে না। হিসাব করলে দেখা যাবে যারা আউটসোর্সিংয়ের সঙ্গে জড়িত, এ সংখ্যাটা তাদের থেকে বেশিই হবে। পেপলের নিরাপত্তা সিস্টেম এতটাই সুরক্ষিত। বিদেশে অবস্থানকারী কারও ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করে বাংলাদেশ থেকে পেপল অ্যাকাউন্ট ব্যবহারের চেষ্টা হলেও পেপল কর্তৃপক্ষ সেটি বন্ধ করে দেয়। তাছাড়া প্রতিটি লেনদেনের হিসাব তো সংশ্লিষ্ট ব্যাংকে থাকছেই। বিএনপি সরকার তথ্য পাচারের আশংকায় বিনামূল্যে সাবমেরিন কেবল লাইন নেয়া থেকে বিরত ছিল। সম্ভবত সে একই ধরনের অর্থাৎ অর্থ পাচারের আশংকায় পেপলকে অনুমতি দেয়া হচ্ছে না। কিন্তু ব্যাংকের নিয়ম-কানুন মেনে ক্রেডিট কার্ডের বিপরীতে লেনদেন করলে অর্থ পাচার বা এ ধরনের আশংকা পুরোপুরি অমূলক। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর বেশকিছু ভালো কাজ করেছেন। দেশে এখন ইন্টারনেটে কেনাকাটা করা যাচ্ছে। সীমিত পর্যায়ে হলেও আন্তঃব্যাংক লেনদেন হচ্ছে। তিন মাসের মধ্যে মোবাইল ব্যাংকিং চালু হয়েছে। বর্তমান গভর্নর যদি আর্ন্তজাতিক ক্রেডিট কার্ড ও পেপল ব্যবহারের সুযোগটি খুব তাড়াতাড়ি চালু করেনÑ আউটসোর্সিং খাতে দেশের উপার্জন বহুগুণে বেড়ে যাবে। আউটসোর্সিংয়ের ক্ষেত্রে ডাক বিভাগও কিছুটা যুক্ত। প্রথাগত অর্থে আউটসোর্সিং না করে অনেকে নিজস্ব ওয়েবসাইটে নানা প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন ব্যবহার করে বেশ ভালো আয় করে থাকেন। উদাহরণস্বরূপ কেউ তার ওয়েবসাইটে গুগলের বিজ্ঞাপন ব্যবহার করলে গুগল ওই ব্যবহারকারীকে নিজস্ব আয়ের একটি অংশ প্রদান করে থাকে। শুধু গুগলের বিজ্ঞাপন ব্যবহার করে প্রতি মাসে প্রচুর আয় করছেন। দেশে এমন মানুষের সংখ্যা কম নয়। কিন্তু এ আয় তুলতে গিয়েও নানা সমস্যায় পড়তে হয়। গুগল অনলাইনে টাকা না পাঠিয়ে সরাসরি চেক পাঠায়। যা প্রায়ই ডাক বিভাগ থেকে হারিয়ে যায় বলে অভিযোগ আছে। কিছু টাকা খরচ করলে সেটা ফেরতও পাওয়া যায়। ডাক বিভাগের ভোগান্তি থেকে রেহাই পেতে অনেকেই ২৮ ডলার খরচ করে ডিএইচএলে চেক আনান। চেক ছাড়াও বিদেশ থেকে আসা নানা ডকুমেন্টস ডাক বিভাগ থেকে হারায়। আউটসোর্সিংয়ের সঙ্গে জড়িতরা তাই ডাক বিভাগের সেবা না নিয়ে বেশি টাকা খরচ করে কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে এসব আনার ব্যবস্থা করেন। অথচ ডাক বিভাগের সেবাকে মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য করলে প্রচুর বিদেশী মুদ্রা দেশেই রাখা যেত। গার্টনারের প্রতিবেদন প্রকাশের পর অনেকে নবউদ্যমে এ সেক্টরে কাজ করার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়বেন সন্দেহ নেই। সবাই যে বুঝেশুনে ঝাঁপ দেবেন তা নয়; বরং না বুঝেই অনেকে কিছু একটা করার চেষ্টা করবেন। সেক্ষেত্রে বিফল হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। আউটসোর্সিংয়ে বাংলাদেশের ভালো করার মানে এটা নয় যে, কেউ চাইলে কাল থেকেই কাজ শুরু করে দিতে পারে। আউটসোর্সিং অনেক বড় একটা প্রতিযোগিতার ক্ষেত্র এবং এখানে নিজের যোগ্যতা দিয়েই টিকে থাকতে হয়। টেকনিক্যাল বিষয় জানা না থাকলে আউটসোর্সিং থেকে হতাশাও আসতে পারে। এটা এমন নয় যে, একবার টাকা বা শ্রম বিনিয়োগ করলে আস্তে আস্তে রিটার্ন আসতে থাকবে। বরং নিজেকে যথাযথভাবে উপস্থাপন করা। যারা কাজ দেয় তাদের কাছে নিজের যোগ্যতা যথাযথভাবে তুলে ধরা ও সুনাম বজায় রাখা অনেক জরুরি। এগুলো সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান অর্জন না করে আউটসোর্সিংয়ের কাজ শুরু করলে হিতে বিপরীত হতে পারে। আর এর জন্য দরকার প্রশিক্ষণ। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় সর্বোচ্চ ডিগ্রি না নিয়েও আউটসোর্সিংয়ে ভালো করা সম্ভব। এক্ষেত্রে ইংরেজি ভাষাটা জানতে হবে ভালোভাবে; জানতে হবে কম্পিউটারের বেশকিছু বিষয়ও। ওয়েবসাইট ডিজাইন, প্রোগ্রামিং, সফটওয়্যার তৈরি, কল সেন্টার ইত্যাদি থেকে ডাটা এন্ট্রি বা অনুবাদের কাজও বিদ্যমান। কিন্তু সব ক্ষেত্রেই ইংরেজির কোন বিকল্প নেই। কম্পিউটারে যে যেদিকে আগ্রহী, তাকে সেদিকেই নিজের জ্ঞান ও দক্ষতা বাড়াতে হবে। আউটসোর্সিং বিষয়ে দেশে প্রশিক্ষক বা প্রশিক্ষণ সেন্টারের অভাব রয়েছে। যারা এ বিষয়গুলো ভালো জানেন, তারা সম্ভবত প্রশিক্ষণ বা এ ধরনের কাজে আগ্রহী নন। পত্রপত্রিকায় মাঝে মাঝে আউটসোর্সিংয়ের বিজ্ঞাপন দেখা গেলেও সেগুলোর মান খুব একটা ভালো নয়। যেসব প্রতিষ্ঠান ইতিমধ্যে আউটসোর্সিংয়ের কাজ করছে। তারা সীমিত জনসম্পদ ব্যবহার করে হলেও যদি কিছু মানুষকে প্রশিক্ষিত করতে পারে। তাহলে এ প্রশিক্ষণার্থীরাই পরবর্তী সময়ে অন্যদের প্রশিক্ষণ দিয়ে গড়ে তুলতে পারে। এক্ষেত্রে অভিজ্ঞ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের এগিয়ে আসাটা জরুরি। কিছুদিন আগে যখন দেশে কল সেন্টার স্থাপনের হিড়িক উঠল, তখন ভারতের বেশকিছু প্রতিষ্ঠান প্রশিক্ষণের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ল। এর আগেও আইটি প্রশিক্ষণে বেশকিছু ভারতীয় প্রতিষ্ঠান এদেশে রাজত্ব করে গেছে। তাদের সিলেবাস ও প্রশিক্ষণের মান নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও একদল মানুষের কাছ থেকে তারা প্রচুর অর্থ উপার্জন করে গেছে। আউটসোর্সিং প্রশিক্ষণেও এমনটি হতে পারে বলে অনুমান করি। গার্টনারের দেয়া এই সুসংবাদে যথারীতি সরকার ভাগ বসিয়েছে। বিজ্ঞান এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, ‘তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রে সরকারের ইতিবাচক পদক্ষেপের কারণে এ অর্জন সম্ভব হয়েছে।’ দেশের যে কোন অর্জন বা কৃতিত্বে সরকারের ভাগ বসানোটা স্বাভাবিক; কিন্তু আউটসোর্সিংয়ে সরকার রুটিন কাজের বাইরে কিছু করেছে কিনা জানা নেই। সরকারের নীতি বা কর্মপন্থার কারণে অনেক সাফল্য আসতে পারে। কিন্তু রুটিন কাজের বাইরে উল্লেখযোগ্য কিছু না করলে সরকার সেখানে কৃতিত্ব দাবি করতে পারে কি? দাবি করলে প্রচলিত সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে ওঠার জন্য প্রধান দায়দায়িত্বও সরকারকে বহন করতে হয়। আশা করব, সরকার আউটসোর্সিংয়ের অসুবিধাগুলো যত দ্রুত সম্ভব দূর করার ক্ষেত্রে নিজের দায়িত্বটুকু পালন করবে। এক সময় গার্মেন্টস শিল্প আমাদের সামনে আশার আলো দেখিয়েছিল। সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগের ফলে সেই শিল্প এখন দেশের সবচেয়ে বড় বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের মাধ্যম। আউটসোর্সিংয়ের যে অপার সম্ভাবনা আমাদের সামনে। তাতে সামান্য পৃষ্ঠপোষকতা জোগালে অদূরভবিষ্যতে এটি গার্মেন্টস শিল্পের থেকেও বেশি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে সক্ষম হবে। ২০১৬ সাল হোক আউটসোর্সিংয়ে পৃষ্ঠপোষকতার বছর।

0 comments:

Post a Comment