বাংলাদেশের সঙ্গে ভারত ও চীনের সম্পর্ক
আলী ফোরকান
এশিয়া মহাদেশের তিনটি দেশ। অপ্রতিরোধ্য গতিতে বিরাট অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত। দেশ তিনটি হচ্ছে চীন, জাপান এবং ভারত। এ তিনটি দেশের রয়েছে দীর্ঘদিনের ইতিহাস। দর্শন, ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতি। এক অর্থে বলা যায়, আজকের পৃথিবীর মূল অর্থনৈতিক চালিকাশক্তি আমাদের এই মহাদেশে অবস্থিত। একই সঙ্গে অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের ভিতর দিয়ে আসিয়ান দেশগুলো বিশেষ করে মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর এবং ইন্দোনেশিয়া এক আলোড়নকারী দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। খুব শিগগিরই ভিয়েতনাম এবং কম্বোডিয়াও এই ধারায় সম্পৃক্ত হবে বলে আশা করা হচ্ছে। কয়েকটি বিশেষ দেশের দিকে তাকাবার আগে আমাদের এ যুগান্তকারী ক্ষেত্র সম্বন্ধেও সচেতন হওয়া প্রয়োজন। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে হেরে যাওয়ার পরও জাপান অল্প সময়ের মধ্যে তার হারিয়ে যাওয়া অর্থনৈতিক শক্তি পুনরুদ্ধার করতে সমর্থ হয়। প্রমাণিত হয়, শিকড় যদি শক্ত হয়। তবে প্রবল সঙ্কট অথবা অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক সুনামির পরও অল্প সময়ের ভিতরেই আবারো মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো সঃম্ভব হয়। এ প্রসঙ্গে জার্মানির উদাহরণও আমরা টেনে আনতে পারি। অনস্বীকার্যভাবে চীন আমাদের বিশ্বের শুধুমাত্র দ্বিতীয় বৃহৎ অর্থনৈতিক শক্তিই নয়। একটি অত্যন্ত ক্ষমতাধর সামরিক শক্তি। ১৯৪৯ সালে লংমার্চের অবসানের পর মাও সেতুংয়ের উক্তি কে সামনে রেখে ধূমকেতুর গতিতে চীন অগ্রগতি সাধন করে। ১৯৪৭-এ ভারত স্বাধীনতা অর্জন করার পরও উন্নয়নের গতি অত্যন্ত মন্থর ছিল। একটি বৈপ্লবিক সরকারের যে সুবিধা এবং গতি সেটা গণতান্ত্রিক কাঠামোয় অনুপস্থিত থাকে। কোন পথ অনুকরণীয় সেটা ভিন্ন প্রসঙ্গ। আশির দশক থেকে ভারত খোলাবাজার অর্থনীতির পথ বেছে নেয়। ফলশ্রুতিতে উন্নয়নের গতি লক্ষণীয়ভাবে বেড়ে যায়। ভারত এবং চীন দু’টি বিশাল দেশ। এই মুহূর্তে চীন ও ভারত একে অপরের সবচেয়ে বড় ব্যবসায়িক সহযোগী।
আজকের পৃথিবীতে কোনো দেশের পক্ষে একলা চলো নীতি গ্রহণ করা সম্ভব নয়। আপাতদৃষ্টিতে দুই প্রতিবেশী দেশ ভারত এবং চীনের মধ্যে বিরোধ এবং দৃষ্টিভঙ্গির অনেক পার্থক্য বিরাজমান। ১৯৬২ সালে চীন-ভারত যুদ্ধ দু’দেশেরই স্মৃতি থেকে মুছে যায়নি। দু’টি দেশের অর্থনৈতিক শক্তিই শুধু বিশাল নয়, সামরিক দিক থেকেও তারা পারমাণবিক শক্তিধর দেশ। দৃশ্যমান প্রতিযোগিতা সত্ত্বেও দু’টি দেশই অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে এগিয়ে যাওয়ার জন্য অত্যন্ত বলিষ্ঠ পদক্ষেপ নিচ্ছে। বিরোধ থাকা সত্ত্বেও এই দুই দেশ তাদের নিজেদের স্বার্থেই বৈরিতাকে নিয়ন্ত্রণের বাইরে যেতে দিতে রাজি নয়। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গেও তারা গড়ে তুলেছে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। অদূর ভবিষ্যতে কি হবে সেটা নিয়ে অনুমান করা দুরূহ ব্যাপার। কিন্তু দুই দেশই নিজেদের বিকাশের ক্ষেত্রে তাদের স্বকীয় অবস্থান সমুন্নত রেখে সম্পর্কের স্থিতিশীলতা বজায় রাখবে বলে আমি আশা রাখি। এর মূল কারণ হচ্ছে বাণিজ্য এবং অর্থনীতি। চীনের সঙ্গে পাকিস্তানের গভীর বন্ধুত্বের সূত্রপাত হয় প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর আমলে। ১৯৫৭ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান চীন সফর করেন এবং চতুর্থ ন্যাশনাল কংগ্রেসে ভাষণ দেন। এ সময় চেয়ারম্যান মাওয়ের সঙ্গেও তার সাক্ষাৎ হয়। এছাড়া স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান চীনের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের ব্যাপারে সৃজনশীল পদক্ষেপ নেন। তিনি বিখ্যাত ফরাসী চিন্তাবিদ আন্দ্রে ম্যালরক্স এবং মিসরের খ্যাতনামা সাংবাদিক হাসান হেইকেলকে চীন এবং বাংলাদেশের সম্পর্কোন্নয়নের উদ্যোগ নেওয়ার অনুরোধ করেন। এছাড়াও পাকিস্তানের সাবেক রাষ্ট্রদূত কেএম কায়সারকে বঙ্গবন্ধু মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূত করেন ওই দেশের মাধ্যমে চীনের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য। এক অর্থে বলা যায়, চীনের সঙ্গে সম্পর্কের মূল দিকনির্দেশনা বঙ্গবন্ধুর সময়ই নির্ধারিত হয়। ১৯৯৩ সালে বিরোধী দলের নেতা হিসেবে শেখ হাসিনা এক ঐতিহাসিক সফরে চীন যান। নিজ দলের একাংশের বিরূপ ভাবনাকে অগ্রাহ্য করে তিনি এ সফরের উদ্যোগ নেন। চীনা কমিউনিস্ট পার্টির পলিট ব্যুরোর একজন সদস্য গ্রেট হলে শেখ হাসিনাকে অভ্যর্থনা জানান। পলিট ব্যুরোর সেই সদস্য বর্তমানে চীনের রাষ্ট্রপতি হু জিনতাউ। সেই সফরে শেখ হাসিনার সফরসঙ্গী ছিলেন মরহুম আব্দুস সামাদ আজাদ, মরহুম শাহ এমএস কিবরিয়া, সায়মা ওয়াজেদ পুতুল এবং আরো অনেকে। ১৯৯৬-এ ক্ষমতায় আসার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রথমে মক্কা শরীফে উমরাহ্ এবং পরে মদিনা মনোয়ারা জিয়ারত করেন। কিন্তু তার প্রথম সফর হয় চীনে। এছাড়াও আমরা জানি তার অনুরোধে অত্যন্ত অল্প সময়ের মধ্যে চীন ঢাকায় একটি কনভেনশন সেন্টার নির্মাণ করে। বর্তমানে তা বঙ্গবন্ধু কনভেনশন সেন্টার হিসেবে পরিচিত। এসব তৎপরতা সত্ত্বেও ১৯৯৬ সালের ১২ ডিসেম্বর ক্ষমতায় আসার পর মাত্র ৬ মাসের মধ্যে ভারতের সঙ্গে ৩০ বছর মেয়াদি গঙ্গা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ভারতের প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ী ওই সময় ঢাকা সফরে আসেন। পাকিস্তান ও ভারত পারমাণবিক শক্তি পরীক্ষা করার পর শেখ হাসিনাই একমাত্র সরকারপ্রধান যিনি এই দুই দেশ সফর করেন এবং এই অঞ্চলের স্থিতিশীলতা বজায় রাখার আহ্বান জানান। এ ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ক্লিনটন তাকে বিশেষভাবে অভিনন্দন জানান। আমরা আমাদের অতীতকে কোনোদিনই ভুলতে পারি না। ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতের বিরাট অবদান এবং সহায়তা প্রতিটি দেশপ্রেমিক বাঙালির কাছে স্মরণীয়। একই সঙ্গে বিশ্বের অন্যতম অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তি চীনের কাছ থেকে দূরত্ব বজায় রাখা একটি দায়িত্বশীল সরকারের পক্ষে সম্ভব নয়। দু’দেশের দ্বিপক্ষীয় বেড়াজালে আটকে না যেয়ে আমরা খুব সাবলীলভাবে আমাদের বন্ধুত্ব স্থাপন করতে পেরেছি। এটা একটি প্রতিষ্ঠিত সত্য। ১৯৯০ সাল থেকে আজ পর্যন্ত আমাদের পররাষ্টনীতি একই ধারায় এগিয়ে গেছে। এ নিয়ে ভারতের কিছু রক্ষণশীলতা যদি থেকেও থাকে সেটা অলংঘনীয় নয়। আমাদের গৃহীত পদক্ষেপের ভিতর দিয়ে দুই বৃহৎ প্রতিবেশীকেই আমরা নিশ্চিত করতে পেরেছি যে, আমাদের অবস্থান কোনোভাবেই মেরুকরণের ভিতর আটকে যাবে না। আমি মনে করি এটা সক্রিয় পররাষ্ট্র নীতির একটা বলিষ্ঠ প্রতিচ্ছবি। বহুক্ষেত্রে চীনের সঙ্গে ভারতের বিরোধ সেটা সীমানা নিয়েই হোক অথবা কৌশলগত চিন্তা-ভাবনার কারণেই হোক থাকলেও সবকিছুকে ছাপিয়ে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সম্পর্ক জোরদার হয়েছে। আশা করা যায়, বৈরিতাকে আয়ত্তে রাখার ক্ষেত্রে তা ইতিবাচক ভূমিকা পালন করবে। খবরের কাগজ খুললেই আমরা দেখতে পাই যে, মাঝে মাঝে পুরনো বিরোধ এবং বর্তমান চিন্তা-ভাবনার পার্থক্য যেমন দৃষ্টিতে আসে তেমনি দু’দেশের মধ্যে অর্থনৈতিক সম্পর্কোন্নয়নের ক্ষেত্রেও নানা পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, চীনের প্রায় প্রতিটি শহরেই ভারত কনস্যুলেট বা বাণিজ্য মিশন প্রতিষ্ঠা করেছে। যেটা কয়েক বছর আগেও চিন্তা করা যেত না। অর্থাৎ অর্থনৈতিক ক্ষেত্রের শিকড়টাকে গভীর থেকে গভীরতর করার প্রয়াস চলছে। একই সঙ্গে যে ভূ-রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির ফারাক সেটা কমিয়ে আনতে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে দুই দেশ পদক্ষেপ নিচ্ছে। ¯œায়ু যুদ্ধের সময় দুই পারমাণবিক শক্তিধর দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে আমরা যেমন একটা ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থান দেখতে পেয়েছি সেটা ভারত এবং চীনের মধ্যেও উপস্থিত। তীক্ষèভাবে এটাও সত্য যে, এই দুই বিরাট প্রতিবেশী সম্পূর্ণ সচেতন যে, ভারসাম্যকে বিনষ্ট করা তাদের মূল গন্তব্য অর্থাৎ অর্থনৈতিক উন্নতির ব্যাপারে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করতে পারে। মিয়ানমারের সঙ্গে চীনের রয়েছে দীর্ঘদিনের ঐতিহাসিক সম্পর্ক। সে দেশের নানা উন্নয়ন প্রক্রিয়ায়ও চীনের বিরাট অবদান রয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই আমরা আশা করতে পারি, মায়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কোন্নয়ন এবং দ্বিপাক্ষিক অর্থনৈতিক সহযোগিতার প্রয়াসে চীনের সমর্থন পাওয়া যাবে। সমুদ্রসীমার বিরোধ নিস্পত্তিতে দু’দেশ যে পথে চলছে তা সুস্থতারই লক্ষণ। মিয়ানমারের সঙ্গে ভারতের এক সময় বিরোধপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। কিন্তু ভারত তার নীতি সম্পূর্ণ পাল্টে এখন সুসম্পর্ক গড়ে তুলেছে এবং সড়কসহ বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণের ক্ষেত্রে মিয়ানমারকে সহযোগিতা প্রদান করছে। এ বাস্তবতাকে সামনে রেখে সমুদ্রসীমার বিরোধ নিস্পত্তিতে যেমন জাতিসংঘের সালিসীর জন্য আমাদের প্রস্তু থাকতে হয়েছিল তেমনি দ্বিপক্ষীয় আলোচনার দ্বারও খোলা রাখতে হবে। এ ক্ষেত্রে দলীয় দৃষ্টিভঙ্গি থেকে কোনো কিছু দেখা সমীচীন হবে না এবং এ বিষয়ে দেশের ভিতরও ঐকমত্য গড়ে তুলতে হবে।
0 comments:
Post a Comment