সর্বস্তরে মাতৃভাষা চাই
আলী ফোরকান
ভাষা বুঝতে,যত সহজ হবে। আয়ত্ত করতে ও তত সহজ হবে। নিজের মনের ভাব নিখুঁত ও সাবলীলভাবে প্রকাশ করা ততই সহজ হবে। তাই মনের ভাব বা তথ্য আদান-প্রদানের মাধ্যম (ভাষা) সহজ থেকে সহজতর হওয়া অত্যন্ত জরুরি। বিশ্বের অসংখ্য ভাষার মধ্যে মাত্র একটি ভাষা সবচেয়ে সহজ। সারাবিশ্বের প্রতিটি মানুষ কথা বলতে পারে সে ভাষায়! এ ভাষা বিস্তারের জন্য মানুষ অন্য ভাষার ওপর হস্তপে করে। এ ভাষা রার জন্য মানুষ বুকের তাজা রক্ত দিতে পারে। জীবন উৎসর্গ করতে পারে। সে ভাষা হচ্ছে মাতৃভাষা। নিজের মায়ের ভাষা। বাংলাদেশের েেত্র শহীদ রফিক, বরকত, সালামের রক্তে কেনা বাংলা ভাষা। কিন্তু অতি দুঃখজনক হলেও সত্য যে, রক্তে কেনা সে বাংলা ভাষা আজ অবহেলিত, অরতি। ১৯৫২-তে বোবা হওয়ার হাত থেকে রা পেলেও তোতলামি ভাবটা কাটানো কোন ক্রমেই সম্ভব হচ্ছে না। জোর করে চাপানো উর্দুকে রক্ত-প্রাণ দিয়ে প্রতিরোধ করতে পারলেও ইংরেজির জবরদখলকে প্রতিরোধ করা কঠিন হয়ে পড়েছে। কারণ আমরা বিশ্বাস করি ইংরেজি ছাড়া আমাদের উন্নয়ন অসম্ভব! চীন, জাপান ইংরেজি না বুঝলেও আমাদের কাছে মাতৃভাষার চেয়েও সহজ লাগে! আর এজন্যই বুঝি উচ্চশিার েেত্র মাতৃভাষার বাংলার পরিবর্তে ইংরেজি বেছে নিয়েছি। ভাবছি দেশের উন্নয়নে ইংরেজির কোন বিকল্প নেই। আর তাই মাতৃভাষায় না পড়িয়ে সহজ বিষয়টি জটিল প্রক্রিয়ায় উপস্থাপন করে জ্ঞান আহরণের নিষ্ফল প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে। অথচ পবিত্র কোরআনের সুরা ইবরাহিমের ৪র্থ আয়াতে বলা হয়েছে ‘হে নবী! আমি আপনাকে নিজ ভাষাভাষীর ওপর এজন্য প্রেরণ করেছি যাতে আপনি তাদের সহজে বোঝাতে পারেন।’ অর্থাৎ কোন বিষয়কে সুন্দরভাবে বোঝানোর জন্য মাতৃভাষার বিকল্প নেই। অতএব দেশের প্রকৃত উন্নয়ন চাইলে নিজ মাতৃভাষায়ই গবেষণা ও জ্ঞানার্জন করা উচিত।
১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলন এবং স্বাধীনতা অর্জনের দীর্ঘ সময় পর আমরা আজও উপলব্ধি করতে পারছি না যে বর্তমান প্রোপটে ব্রিটিশদের উপনিবেশবাদী শিানীতি বাংলাদেশের মতো উজ্জ্বল সম্ভাবনাময় দেশে একেবারেই অচল। গৎবাঁধা পুঁথিগত কিছু মুখস্থ বিদ্যার এ শিাব্যবস্থা মেধা বিকাশে পর্বতসম অন্তরায় হিসাবে কাজ করছে। এ কারণেই ওই সব শিার মাধ্যমে শিেিতর সংখ্যা বৃদ্ধি হলেও বাস্তবে কোন সফলতাই আসছে না। বর্তমান অবস্থায় প্রগতির জন্য পরিবর্তন অতীব জরুরি হলেও সনাতনী সেই শিাব্যবস্থার জাল ছিঁড়ে বের হয়ে আসা আজও সম্ভব হয়নি। উপরন্তু স্বাপ্নিক উন্নয়নের আশায় নিজেদের ওপর চাপিয়ে নিয়েছি মাতৃভাষা বাংলার বিপরীতে ইংরেজি ভাষা।
অনুসন্ধান করলে দেখা যাবে, দেশের অধিকাংশ মানুষ এখনও নিজ মাতৃভাষার বর্ণমালাগুলো সঠিকভাবে বলতে পারবে না; আর একটা পরদেশী ভাষা (কখনও ব্রিটিশ-আমেরিকায় অমিল) আয়ত্ত করা এত সহজ! সহজ না বিধায় উচ্চশিায় (ইংরেজিতে পড়ানোর কারণে) কোন বিষয় স¤পর্কে সুশিতি ছাত্র পাওয়াও সহজ নয়। কারণ তার মেধা এবং সময়ের অধিকাংশই ব্যয় হয় পরভাষা চর্চায় শুধু ভাষা বুঝতে। যদি বুঝতে ব্যর্থ হয় তবে মুখস্থ করা ছাড়া কোন পথ থাকে না। ফলে একজন ছাত্রের কোনক্রমে একটা সার্টিফিকেট নিয়ে শিাজীবন শেষ হলেও জাতি তার কাছ থেকে গুরুত্বপূর্ণ কোন অবদান পাচ্ছে না। দেশও উন্নয়নের মুখ দেখছে না। অথচ নিজ মাতৃভাষায় জ্ঞান চর্চা হলে এদেশের মানুষও হয়তো অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের জনক হতে পারত।
স্মরণকাল থেকে এ পর্যন্ত তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে গুরুত্বপূর্ণ অধিকাংশ মতবাদ ও আবিষ্কারের জনক ব্রিটিশ ও আমেরিকানরা এবং তারা যারা নিজ মাতৃভাষায় জ্ঞান চর্চা করে। যে কোন বিষয় অতি অল্প সময়ে বোঝে বাকি সময় গবেষণা বা অন্য কোন উন্নয়নমূলক কাজে ব্যয় করে যার ফলে তারা আজ এত উন্নত। মূর্খের মতো অবুঝ না হলে অবশ্যই স্বীকার করে নিতে হবে যে, নিশ্চয় তারা উন্নত মেধা নিয়ে জš§ গ্রহণ করে না বরং মাতৃভাষায় জ্ঞান চর্চার ফলেই তাদের মেধা এত উন্নত। আমাদের দেশের ছাত্রদের প্রতি বছর নতুন সিলেবাসের নতুন নতুন শব্দার্থ মুখস্থ করতেই শিাজীবন শেষ হয়। পরবর্তী সময়ে সংসার জীবন। নতুন বিষয় নিয়ে ভাবার সময়ই হয় না। অথচ ইংরেজির পরিবর্তে নিজ মাতৃভাষা হলে কতই না সহজ হতো! প্রয়োজনে গুরুত্বপূর্ণ টার্মগুলোর ইংরেজি শর্টনোট থাকত। এতে করে যে কোন বিষয় অতি অল্প সময়ে বুঝে বাকি সময় গবেষণা বা অন্য কোন উন্নয়নমূলক কাজে ব্যয় করলে আজ আমাদের দেশও উন্নত দেশের দলভুক্ত হতে পারত। কিন্তু আফসোস! সেই অলীক উন্নয়নের আশায় আমরা আজও প্রচলিত পদ্ধতি আঁকড়ে ধরে পড়ে আছি। যা ‘গাধার সামনে মুলা বেঁধে দেয়া’ ছাড়া আর কিছুই নয়।
এটা সত্য এবং অনেকের মতো আমিও বলব আর্ন্তর্জাতিক ভাষা হিসেবে ইংরেজি অবশ্যই প্রয়োজন। অবশ্য এখানে একটা কথা বলে রাখা দরকার : আমরা যদি প্রকৃতই আমাদের বাংলা ভাষাকে ভালোবেসে থাকি তবে ইংরেজির মতো বাংলাকেও আর্ন্তজাতিক স্থান দখল করাতে কেন চেষ্টা করি না? ৫২-এর দাবি কি শুধু উর্দু ভাষা প্রতিরোধের জন্যই হয়েছিল নাকি মাতৃভাষা রার জন্য হয়েছিল? উর্দুর পরিবর্তে মাতৃভাষা বাংলার স্থলে ইংরেজির অনুপ্রবেশের জন্য হয়েছিল নাকি বাংলাকে বলিষ্ঠ করার জন্য হয়েছিল? তর্কের খাতিরে মেনে নিলাম ইংরেজি অবশ্যই প্রয়োজন তবে সেই ইংরেজি শেখার জন্য ইংরেজি বিষয়ের মতো অন্য বিষয়কেও ইংরেজিতেই পড়তে হবে এমন বাধ্যতামূলক হওয়া উচিত না। এতে একদিকে যেমন ওই বিষয়ে যথাযথ জ্ঞানার্জন করা যাবে না (মাতৃভাষায় না পড়ানোর কারণে) অন্যদিকে ইংরেজিতেও খুব একটা দতা হাসিল হবে না। অর্থাৎ তোতলামি ভাবটা রয়েই যাবে।
আমাদের দেশের প্রোপটে অনেক শিার্থীকে দেখা যায় এক বিষয়ে গ্রাজুয়েশন (অনার্স) করলেও পরবর্তী সময়ে অন্য বিষয়ে মাস্টার্স/এমবিএ বিশেষ করে অন্য ফিল্ডে চাকরি করায় সাবজেক্টওয়ারি ইংরেজি খুব একটা কাজে লাগে না। অতএব কষ্ট ও সময় নষ্ট করে বিভিন্ন বিষয় ইংরেজিতে পড়ার কোন প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি না। কারণ মাতৃভাষায় সহজে কোন বিষয় বুঝতে পারলে সঙ্গে ইংরেজি কেন যে কোন ভাষার ওপর দতা থাকলে ওই ভাষার মাধ্যমে তা সহজে ব্যক্ত করা যাবে। অথচ উচ্চশিার মাধ্যম ইংরেজি হওয়ার কারণে অশিতি একজন অপরাধীর রায়ও ইংরেজিতে দেয়া হয়! অলৌকিক ঘটনার মতো তা আবার পেপারগুলোতে ফলাও করে ছাপানো হয়। রোগী বুঝতে পারুক বা না পারুক ডাক্তাররা কিন্তু প্রেসক্রিপশনটা ইংরেজিতেই লিখেন। ব্যাংক-বীমা, অফিস-আদালতের অভ্যন্তরীণ কাজের ফর্মগুলোও বাংলার পরিবর্তে ইংরেজিতে। আমরা যদি বলি উচ্চশিার বইগুলো বাংলাতে পাওয়া যায় না, সবই ইংরেজিতে, তবে বলতে বাধ্য হব ইংরেজি খুবই কঠিন আর আমাদের ইংরেজ ভক্তরা তা অনুধাবন করতে না পারার কারণে ৫২-এর পর থেকে এ পর্যন্ত নিজ মাতৃভাষায় ওই সব বই তরজমাও করতে পারেননি। ভাষা শিখতে উচ্চশিায় যেখানে একজন ইংরেজিতে অনার্স করছে সেখানে অন্যকেও নিজের বিষয়টি মাতৃভাষার পরিবর্তে ইংরেজি ভাষায় পড়িয়ে (ডাবল অনার্স) প্রকৃত জ্ঞানার্জনে বিঘœ সৃষ্টি করা হচ্ছে।
যা হোক, যথাযথভাবে জ্ঞানার্জনের জন্য আমাদের শিাব্যবস্থায় কৌশলগত কিছু পরিবর্তন প্রয়োজন; যেখানে মাতৃভাষায় জ্ঞানার্জন করার পাশাপাশি সহজ পদ্ধতিতে ইংরেজি শেখার সুযোগ রাখা উচিত। যাতে আমাদের বাংলা ভাষাভাষীদের পে জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় অবদান রাখা আরও সহজ হয়। এেেত্র বাংলা ভাষায় যে কাঠিন্যতা রয়েছে তা দূর করতে হবে। কারণ ভাষা যত সহজ হবে তা গ্রহণ ও ব্যবহারের মাত্রাও তত বেড়ে যাবে। যুক্তারগুলোকে মুক্তারে লেখার ব্যবস্থা করতে হবে। অনেকের পইে বলা কঠিন হবে জ্ঞ, ঞ্জ, , ঙ্গ ইত্যাদি আলামতবিহীন বর্ণগুলো কোন কোন বর্ণের সমন্বয়ে গঠিত। কম্পিউটার, ক্যালকুলেটর, মোবাইল ইত্যাদিসহ বিভিন্ন ইলেক্ট্রনিক যন্ত্র ও মিডিয়াগুলোর সফ্টওয়্যারগুলো ইদানিং বাংলায় করা হয়েছে। আমরা চাই আদালতের রায়সহ সর্বস্তরে বাংলার ব্যবহার আবশ্যিক করতে হবে। একুশের চেতনা শুধু দিবস পালনের জন্য নয়। সারা বছরই জাগ্রত রাখতে হবে। তবেই না ৫২-এর দাবি আদায় হবে।
0 comments:
Post a Comment