একুশের মুক্তি সূচিত হোক
আলী ফোরকান
মহীয়ান একুশে ফেব্রুয়ারি। আর্šÍজাতিক মাতৃভাষা দিবস। আমরা যেন পুরোপুরি নিরূপণ করতে পারছি না। কতখানি মর্যাদার এই অর্জন। আমাদের পূর্বপুরুষের অতুল এই কীর্তি আমরা যথাযথ মূল্যে গ্রহণ বা অনুধাবনে সমর্থ হইনি। রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা কি সত্যই সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে আমরা ব্যবহার করতে পারছি? আজও কি ৫২ সালের মতোই প্রতি বছর ফেব্রুয়ারি মাসে বিশেষ করে এই দিনেই একই সেই দাবি করেই ান্ত হই নাÑ সর্বস্তরে রাষ্ট্রভাষা বাংলা চালু কর? এটা যে সত্যই করা উচিত বা সম্ভব তাও যেন মনে মনে সবাই ঠিক বিশ্বাস করি না। আজ নাকি সেই বাস্তবতা নেই। অথচ সত্যই কি তা নেই? সব জাতি কি মাতৃভাষা ছেড়ে দিয়ে একটি মাত্র বিদেশী ভাষা শিখেই সর্ববিষয়ে উন্নতি করছে? বিশ্ববাজারে সফল হওয়ার পূর্বশর্ত কি তাতেই নিহিত? চীন, জাপান, থাইল্যান্ডও কি তা-ই করছে? আমরা জানি তা সত্য নয়। আমাদের মনে কী করে যে এই এক ধারণা বদ্ধমূল হল! তাই কি এক কবি লিখেছেনÑ ‘মনেপ্রাণে মেরে দিয়ে ভাতে/উধাও ইংরেজি ঘোড়া/রেখে গেছে হাজার সহিস’? আজ সময় হয়েছে, চোখ-মুখ খুলে, মুক্তমনে একবার নিজেদের মুখোমুখি হওয়ার। কি আমরা করে চলেছি আর মুখে মুখে বলছি কি-ইবা; মনের মধ্যে নিজেদের অগোচরে কি ভাব, ভাবনা আসলে কাজ করছেÑ নিজেরাও আমরা যেন তা জানি না। জানতে বুঝি চাইও না। একদিন পাকিস্তানি নানা মিথ্যা ঘোরের হাত থেকে একুশ আমাদের রা করেছিল। সব ঘোর কাটিয়ে নিজেদের ভাষা ও জাতি-পরিচয় চিনিয়েছিল। আজ আমরা, আরও বহুতর ঘোরের নেশায় আচ্ছন্ন। বিশ্ব বাজারের হাতছানি আমাদের মাথা ঘুরিয়ে দিচ্ছে। স্বাভাবিক বাস্তববোধও গুলিয়ে দিচ্ছে। নিজেরাই হন্যে হয়ে আজ আমরা আপন ভাষা ও জাতিসত্তার স্বভাব ছেড়ে দেয়ার জন্য ছুটছি। তার বলি হচ্ছে কোমলমতি শিশুসন্তান আমাদের। তাদের নাজুক ঘাড়ে-মাথায় শিশুবেলায়ই চাপিয়ে দিচ্ছি আমরা বিদেশী ভাষার বোঝা। নিজের মাতৃভাষা শিা বা ভালোবাসা যাতে আর গড়ে উঠতে না পারে। মাতৃভাষায় সর্বজনীন কোন শিানীতি এতদিনে প্রণীত হওয়ার অপোয় আছে। আমরা কি কেবলি বছরের একটিমাত্র মাস বা দিবসকে উদ্যাপন করেই তুষ্ট, তৃপ্ত থাকব? একুশে ফেব্রুয়ারি আর্šÍজাতিক মাতৃভাষা দিবসের বিশ্বমর্যাদায় ভূষিত হওয়ার পরেও আমাদের হুঁশ ফিরবে না? স্বাধীনতার ৪৫ বছর পরেও শিায়, প্রশাসনে বা সমাজে মাতৃভাষার অবস্থান কোথায়, কেমন আমরা সবাই তা জানি। যেন মাতৃভাষা উপো করেই আজ বিশ্ববাজারের ভাষা আয়ত্ত করতে হবে। অথচ উন্নততর কোন দেশেই তা ঘটে না। জার্মানি কিংবা ফরাসি দেশের কথা বাদ দিয়েও চীন, জাপানের কথা বলা যায়। সার্বজনীন মাতৃভাষায় শিাই তাদের জাতীয় উন্নতির ভিত্তিস্বরূপ। তারপরে তারা ইংরেজি ও অন্য বিদেশী ভাষা আবশ্যক মতো গ্রহণ করে থাকে। ব্যবসা-বাণিজ্য, বৈদেশিক যোগাযোগ কিংবা শিা ও গবেষণার জন্য। মনে হয়, জাতি হিসেবেই আমরা ক্রমে মানসিকভাবে নিজেদের হেয়, হীন মনে করছি। এই দেশ, ভাষা নিয়ে ভেতর থেকে সত্যিকার কোন আবেগ অনুভব আগের মতো যেন জাগে না। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ব্যর্থতাই জাতিগতভাবে এহেন দশায় আমাদের নিপে করছে। তারই কার্যকারণ সূত্রে সামাজিক, মানসিক এই দৈন্যদশা সূচিত করেছে। আমরা যেন মেনে নিয়েছি, সবদিক দিয়ে আমরা পতিত, পশ্চাৎপদ। অথচ একুশ নিয়ে আমাদের মুখস্ত উচ্ছ্বাস কেবল বেড়েই চলেছে। জাতীয় এই মহাগৌরবময় কীর্তি আজ পণ্যপ্রচারণার উপাদান ও অবলম্বনে পরিণত হয়েছে। ভাষাশহীদ ও সৈনিকগণ বিজ্ঞাপনচিত্রের মোম মডেল হিসেবে পর্যবসিত। একুশের এই দিনে আমরা জাতীয় এই বাস্তব সত্যের মুখোমুখি হতে কি চাইব না? একুশ কি আমাদের সেই শিাই একদিন দেয়নি? অভ্যস্ত উচ্ছ্বাসের এই মিথ্যাচারিতার জালে আবদ্ধ একুশের মুক্তি সূচিত হোক। আমরা ফিরে পাই সত্যের অমলিন গৌরব মহিমা। এই হোক মহান একুশের অঙ্গীকার।
0 comments:
Post a Comment