Wednesday, February 15, 2017

রক্তে অর্জিত ভাষা

রক্তে অর্জিত ভাষা 
ড. ফোরকান আলী 
অমর একুশে। ভাষার জন্যে আত্মত্যাগের এক অনন্য নজীর। পৃথিবীর অন্য কোন দেশে ভাষার জন্য আত্মত্যাগের নজীরবিহীন। শুধু আমারদেশেরই দামাল ছেলেদের এ অর্জন। রক্তে অর্জিত মাতৃভাষা।   এ মহান একুশকে ভোলে কার সাধ্য? জাতির জীবনে বায়ান্নের একুশে ফেব্রুয়ারী এক গৌরবময় দিন। যেমন গৌরব উজ্জ্বল দিন একাত্তরের ষোলই ডিসেম্বর। ফেব্রুয়ারী -ডিসেম্বর এ দু’মাসের দুটি দিন এ জাতি কোনদিন ভুলবে না। একটিতে এ জাতির সূচনা অন্যটিতে জাতির পূর্ণতা। একুশে ফেব্রুয়ারীতে প্রতিবাদের কৃষ্ণচূড়ার যে চারাটি রোপিত হয়েছিল। একাত্তরের ষোলই ডিসেম্বরে তা পূর্ণতা লাভ করে। রক্ত রঞ্জিত লাল জাতীয় পাতাকায়।
বায়ান্নর একুশে সচেতন জনতার সরব প্রতিবাদ। অদম্য এক প্রাণশক্তিতে রূপান্তরিত হয় মুক্তিযুদ্ধের মহাপ্লাবনে। একাত্তরের ষোলই ডিসেম্বর তারই স্বার্থক রূপ। এ জাতি জানে একুশের শহীদরাই এ অগ্রযাত্রার প্রথম অগ্রপথিক। জাতীয়তাবাদী চেতনার বীর সেনানী। শহীদ বরকত, জব্বার, সালাম এবং রফিক এ জাতির শ্রেষ্ঠতম সন্তনদের অন্যতম।
বাংলাদেশে ভাষা আন্দোলনের রয়েছে এক স্বতন্ত্রধারা। এ ধারাটি এ উপমহাদেশের একটি বৈশিষ্টপূর্ণ স্বাতন্ত্রের অধিকারী। অল ইনডিয়ায় ভাষার সমস্যাটিকে দেখা হয়েছিল ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে। বাংলাদেশে কিন্তু তার বিকাশ ঘটে মাতৃকার টানে। অলইনডিয়ায় ভাষা ধর্মভিত্তিক বিভেদের সৃষ্টি করে। ১৯২১ সালে চূড়ান্ত পর্যায়ে ভারত বিভক্তির পথ প্রশস্ত হয়। আর বাংলাদেশে বাংলা ভাষার দাবিতে জাতীয়তাবাদী চেতনার জনগণ একত্রিত হয়।
১৯২৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর প্রকাশিত নেহরু রিপোর্টে স্বাধীন ইনডিয়ার রাষ্ট্রভাষা রূপে সুপারিশ করা হয় হিন্দিকে। সেই সুপারিশের ভিত্তি ছিল ইনডিয়ান সংখ্যাগরিষ্ট হিন্দু সম্প্রদায়ের শিা সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের ভিত্তি যে হিন্দু ধর্ম। তার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ ভাষা হিন্দি। হিন্দিকেই স্বাধীন ইনডিয়ার রাষ্ট্রভাষা রূপে সুপারিশ করে নেহরু কমিশন। (এই কমিশনের সভাপতি ছিলেন কংগ্রেস নেতা মতিলাল-নেহরু এবং সম্পাদক ছিলেন তারই সুযোগ্য পুত্র জওহরলাল নেহরু) কমিশনের এ সুপারিশ তখন তুমুল ঝড়ের মুখে পড়ে। ইনডিয়ার উত্তর, দণি, পূর্ব অ-হিন্দি এলাকায় এ ঝড় আরো প্রবল আকার ধারণ করে। ইনডিয়ার জনসংখ্যার এক চতুর্থাংশ মুসলমানদের কাছেও তা অগ্রহণযোগ্য হয়ে উঠে। হিন্দু সম্প্রদায়ের শিা সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের ধারক যদি হিন্দি হয়। তাহলে ইনডিয়ার বিপুল সংখ্যক মুসলমানদের শিা সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের মাধ্যম কি হবে।
১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার আগ পর্যন্ত এ বিষয়ে সংঘটিত হয়েছে অসংখ্য বিতর্ক। মুসলমানদের তীব্র প্রতিবাদের মুখে মোহন দাস করমচাঁদ গান্ধী হিন্দুস্থানী রাষ্ট্রভাষার প্রস্তাব দেন। দেবনগরী বর্ণমালায় লিখিত হলে তা হবে হিন্দি আর আরবি হরফে লেখা হলে তা হবে উর্দূ। এতেও বিতর্কের অবসান না হলে শেষ পর্যন্ত তিনি হিন্দি-হিন্দুস্থানী রাষ্ট্র ভাষার ঘোষণা দেন।
হিন্দিকে ইনড়িয়ান রাষ্ট্রভাষা করার মুসলমানদের প থেকে দাবি উঠে উর্দূকে রাষ্ট্রভাষা করার। লাহোর প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার পর এ দাবি আরো জোরদার হয়। পূর্ব বাংলার মুসলীম লীগের সদস্যরাও এ দাবিতে সোচ্চার হয়ে উঠে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আগ পর্যন্ত এ ধারা অব্যাহত থাকে। এরই প্রোপটে ১৯৪৭ সালের জুলাই মাসে আলীগড় বিশ্ব বিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক জিয়া উদ্দিন আহমেদ ইনডিয়ার রাষ্ট্রভাষা হিন্দি হলে পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা উর্দূ হবে এ যুক্তি তুলে ধরেন।
এভাবে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে অল ইনডিয়ার ভাষা সমস্যা নতুন পাকিস্তানে জট পাকাতে থাকে। নেহরু গান্ধী-জিন্নাহর বিতর্ক পূর্ব বাংলায় ঝড় তোলে। হিন্দু ইনডিয়ায় নেহরু গান্ধীর শিা সংস্কৃতি মাধ্যম হিন্দি আর জিন্নাহর পাকিস্তানে ইসলামী জীবন ব্যবস্থার মাধ্যম উর্দূর স্থান পাকাপোক্ত করার প্রয়াস দৃঢ়তর হতে থাকে।
১৯৪৭ সালের ১৭ আগষ্টের পর হিন্দি-হিন্দুস্থানী ফর্মূলা থেকে হিন্দুস্থানী বাদ দিয়ে রাষ্ট্রভাষা হিন্দি হয়। আর পাকিস্তানের নেতৃবৃন্দরা অতীত স্মৃতিকে মুলধন করে পাকিস্তানের উভয় অংশে উর্দূ ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দেয়। পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ রাষ্ট্রভাষা উর্দূ হলে শিা সংস্কৃতি সবদিক দিয়ে পিছিয়ে পড়বে। এ জেনেও এ সিদ্ধান্তে অটল থাকে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ। পাকিস্তানের নেতৃবৃন্দের এই উদ্ধত্যপূর্ণ সিদ্ধান্তের চূড়ান্ত প্রতিবাদ মহান একুশে। একুশে ফেব্রুয়ারী পূর্ব বাংলার জনগণের সর্ব প্রথম সুসংগঠিত আন্দোলনের পরিপূর্ণ রূপ। রাজপথে অঝোরে রক্ত ঝরিয়ে বিজয় অর্জনের অপর নাম হয়ে উঠে মহান একুশে ফেব্রুয়ারী। পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলনের গতিধারা কিন্তু প্রথম থেকেই স্বতন্ত্র ধারায় প্রবাহিত হয়েছে। অল ইনডিয়ায় যেসব প্রশ্ন ধর্মের আবরণে উত্থাপিত হয়েছে, পূর্ব বাংলায় তা হয়নি। এখানে মুসলিম হিন্দু বৌদ্ধ খ্রীষ্টান ধর্ম নির্বিশেষে পূর্ববাংলার সচেতন মানুষ পূর্ব বাংলার রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবি তোলে জোরেশোরে।
প্রথমে তমদ্দুন মজলিস এই বক্তব্যের সূচনা করলেও পরে দেশের বুদ্ধিজীবী। সংস্কৃতিসেবী লেখক সাহিত্যিকদের অবদানে ক্রমে ক্রমে সমৃদ্ধ হয়ে পূর্ব বাংলার সমাজিক উপত্যকা প্লাবিত করে। একুশে ফেব্রুয়ারী পূর্ব বাংলার জনগণকে রাজনৈতিক সচেতনতার সিংহদ্বারে উপনীত করে। উদ্দীপ্ত করে তাদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার আদায়ে।
মহান একুশে আমাদের জাতীয় জীবনে যেমন এক অফার অর্জন, তেমনি ভবিষ্যতের সুখ স্বপ্নও। পূর্ব বাংলা ও পশ্চিমবঙ্গের ভাষা ও সাহিত্য, মনন ও প্রতিভা এবং জীবনবোধে যে পার্থক্য তার সুস্পষ্ট প্রকাশ ঘটে এ একুশে ফেব্রুয়ারীর মর্মভেদী আহবানে।
উন্নত সাহিত্য সম্ভার নিয়েও যেখানে পশ্চিমবঙ্গ বিলীন হলো ইনড়িয়ান সভ্যতার স্রোতধারায়। পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণ ছিন্ন করে সে েেত্র পূর্ব বাংলা রূপ নেয় বাংলাদেশ। মহান একুশে ফেব্রুয়ারী শুধু বাংলাদেশের নয়, এটি এখন সারা বিশ্বের। ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর জাতিসংঘের শিা-বিজ্ঞান-সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা (ইউনেস্কো) তার প্যারিস অধিবেশনে ২১ ফেব্রুয়ারীকে আর্ন্তজাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করেছে। ২০০০ সাল থেকে ২১ শে ফেব্রুয়ারী সারাবিশ্বে পালিত হচ্ছে আর্ন্তজাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে। ১ মে যেমন বিশ্বময় পালিত হয় আন্তর্জাতিক শ্রম দিবস। সর্বত্র উচ্চারিত হচ্ছে একুশে ফেব্রুয়ারী মহানায়কদের কথা। শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করা হচ্ছে বরকত, সালাম, জব্বার ও রফিকের কথা। তাদের আত্মদানের অমর কাহিনী সমগ্র বিশ্বে নতুন আলোকে প্রকাশিত ও প্রচারিত হচ্ছে। আর্ন্তজাতিক মাতৃভাষা দিবসে। তাদের অনবদ্য অবদানের স্বীকৃতির শুভ মুহূর্তে এসব ব্যক্তিত্ব এবং বহু নাম না জানা কর্মী সমর্থকদের প্রতি বিনয়াবনত শ্রদ্ধা নিবেদন করছি। গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে তাদের স্মরণ করছি।

0 comments:

Post a Comment