মাদক ইয়াবার আসক্তি বাড়ছে
আলী ফোরকান
এত ইয়াবা আসছে কোত্থেকে? আর্ন্তজাতিক মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ বোর্ডের রিপোর্ট অনুযায়ী, প্রতি মাসেই ইয়াবার চাহিদা বাড়ছে। চাহিদা অনুপাতে সরবরাহ ও বাড়ছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, বাংলাদেশে ইয়াবা আমদানির একটিই রুট। তা হচ্ছে মিয়ানমার সীমান্ত। আর ইয়াবার পুরোটাই আসছে মিয়ানমার থেকে। প্রতি মাসে কম করে হলেও এক শ’ কোটি টাকার ইয়াবা ট্যাবলেট আসছে এই পথ দিয়ে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের মতে, শুধু বাংলাদেশেই নয়, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অনেক দেশেই ইয়াবার বিস্তার মহামারী আকার ধারণ করেছে। বাংলাদেশে ব্যবহৃত মাদকের মধ্যে ইয়াবাকে এক নম্বরে রেখে ইয়াবার বিস্তার ও ব্যবহার রোধে প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে। আইন শৃংখলা -রক্ষাকারি বাহিনী প্রতিনিয়ত অভিযান চালাচ্ছে। উদ্ধার ও হচ্ছে। তবু ও থেমে নেই মাদক চোরাকারবারিরা। আইন শৃংঙখলা -রক্ষাকারি বাহিনী বলছে, এই অভিযান অব্যাহত থাকবে। সংশ্লিষ্ট সূত্রের দাবি, ইয়াবা আসছে শুধুই মিয়ানমার সীমান্ত দিয়ে। আর দেশের অভ্যন্তরেও নিম্নমানের কিছু ইয়াবাসদৃশ্য ট্যাবলেট তৈরি করছে মাদক ব্যবসায়ীরা। যদিও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর বলেছে, দেশের অভ্যন্তরে ইয়াবা তৈরি হচ্ছে বলে তাদের কাছে কোনো তথ্য নেই। তাদের দাবি, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোয় ইয়াবার বিস্তার নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে আর্ন্তজাতিক মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ বোর্ড। লন্ডন স্কুল অব ইকোনোমিক্সের এক জরিপে দেখা গেছে গড়ে ১০০০ জনের মধ্যে ১০ জনকে মাদকের জন্য তল্লাশি করা হয়। ১০০০ নিবাসীর মধ্যে গড়ে ৭ থেকে ১৪ জন সাদা, ১৮ জন এশিয়ান এবং ৪৫ জন নিগ্রো। অর্থাৎ, মাদক বহনকারী সন্দেহে তল্লাশির শিকার হওয়ার সম্ভাবনা সাদাদের তুলনায় এশিয়ানদের ২.৫ গুণ এবং কালোদের ৬.৩ গুণ বেশি। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে কালো কিংবা এশিয়ানদের তুলনায় সাদারাই বেশি মাদকাসক্ত। লন্ডন জুড়ে গাঁজা রাখার দায়ে সাদাদের তুলনায় এশিয়ান ও কালোরা ৫ গুন বেশি অভিযুক্ত হয়। সবমিলিয়ে দেখা যাচ্ছে, কালো ও এশিয়ানরা সাদাদের তুলনায় কঠোর পুলিশি ব্যবহারের সম্মুখীন হয়। জরিপ অনুযায়ী ২০১৪-১৫ সালে কোকেন রাখার দায়ে মেট্রোপলিটন পুলিশের হাতে গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে ৪৪ শতাংশ সাদা পক্ষান্তরে ৭৮ শতাংশ কালো। জরিপে আরও দেখা গেছে, মাদকসহ আটক হলে কালো ও এশিয়ানদের ক্ষেত্রে মামলা আদালত পর্যন্ত গড়ানোর সম্ভাবনা সাদাদের থেকে ৪.৫ গুণ বেশি। বিচারে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার হারও একই। ইংল্যান্ড ও ওয়েলসে প্রতি বছর আনুমানিক ৮০,০০০ ব্যক্তি মাদক বহনের অভিযোগে অভিযুক্ত হন। ১৯৯৬ থেকে ২০১১ পর্যন্ত ১৫ বছরের ব্যবধানে মাদক আইনের অধীনে ১২ লাখ মামলার রেকর্ড পাওয়া গেছে। এদিকে বাংলাদেশে মাদকসেবীদের ব্যবহারের ক্ষেত্রে প্রথম রয়েছে ইয়াবা। এরপর ফেনসিডিল, তিন নম্বরে গাঁজা এবং চার নম্বরে রয়েছে প্যাথেড্রিন ও মরফিন জাতীয় মাদক। যারা মুখে সেবন করে আর ভালো লাগে না তারাই কেবল চার নম্বর মাদক সেবন করে। সুই দিয়ে শরীরে প্রবেশ করায়। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, ইয়াবা হচ্ছে থাই শব্দ। যারা অর্থ হচ্ছে ক্র্যাজি বা উত্তেজনা ট্যাবলেট। ‘ইয়া’ অর্থ ক্র্যাজি, আর ‘বা’ মানে হচ্ছে ট্যাবলেট। ইয়াবা হচ্ছে তাদের ব্র্যান্ড নেম। এটা শতভাগ মাদক বলে জানিয়েছেন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর। যদিও ইয়াবাসেবী এবং বিক্রেতারা বলার চেষ্টা করে আসছে ইয়াবা মাদক নয়, এটা স্বাভাবিক ওষুধ জাতীয়। মাদক ব্যবসায়ীরা তো কখনোই বলবে না ওটা মাদক এবং ওটা মানুষের সর্বনাশ করে। বিশেজ্ঞরা বলেছেন, এটা এখন মহামারী আকার ধারণ করতে যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে এবং চাহিদা হ্রাস করতে হবে। এক দিকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নিরলস কাজ করতে হবে। অপর দিকে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। ইয়াবার অপকার সম্পর্কে সবাইকে জানাতে হবে। বিশেজ্ঞরা আরো বলেন, অনেকের অর্থকড়ি হয়েছে। ধর্মকর্ম ছেড়ে দিয়েছে, নামাজ-রোজার ধারেও নেই, বাসায় বসে ইয়াবা সেবন করে ঝিম মেরে বসে থাকছে। আগে ফেনসিডিলে সেবন করলে বা অন্য কোনো মাদক সেবন করলে ধরা পড়ার ভয় থাকত। এখন আর ভয় নেই। নির্বিঘেœ সেবন করতে পারে ইয়াবা। এমনকি দেখা গেছে কাঠপেন্সিলের পেছনের রাবার খুলে সেখানে ইয়াবা রাখা হয়। এটা শনাক্ত করা খুবই কঠিন। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বাংলাদেশে যে ইয়াবা আসছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে আর-৭। এই আর-৭ এর অন্তত ১০টি ক্যাটাগরির ইয়াবা এখন বাজারে অহরহ মিলছে। এমনকি পান দোকান, ফুটপাথের চা দোকান, এমনকি, যারা হেঁটে চা বিক্রি করছে তাদের কাছেও পাওয়া যাবে। তবে তাকে চিনতে হবে। যারা সেবন করে তারা কেবল ওই লোকগুলোকে চেনে। আর পরিচিত লোক ছাড়া ইয়াবা বিক্রিও করে না তারা। আর-৭ এর এক নম্বর ক্যাটাগরির এক পিস ইয়াবার মূল্য চার হাজার টাকা। এর সর্বনিম্ন যে মূল্য রয়েছে তার এক পিস চার শ’ টাকা। ১০ পিসের এক প্যাকেট কিনলে প্রতিটির দাম পড়ে ৩৬০ টাকা করে। এ দেশে আর-৭ এর ছয় নম্বর ক্যাটাগরি থেকে চার ক্যাটাগরির ইয়াবা সহজলভ্য। এক নম্বর থেকে পাঁচ নম্বর পর্যন্ত যে মূল্য তা অনেকেই সেবন করতে পারে না। যাদের এসি বাসা, এসি গাড়ি নেই তারা ওই ক্যাটাগরির ইয়াবা সেবন করতে পারে না। এখানে আর একটি ইয়াবা সহজলভ্য। তার নাম ‘চম্পা’। লাল রঙের এটি। এটির বাজারমূল্য প্রতি পিস ৩৩০ থেকে ৪৭০ টাকা। এই জাতীয় কিছু ইয়াবা রাজধানীর যাত্রাবাড়ী, গাজীপুর ও টঙ্গী এলাকায় স্থানীয় মাদক ব্যবসায়ীরা প্রস্তুত করছে। অনেকটা ভেজাল ট্যাবলেট উৎপাদনের মতো। প্রতি মাসে মিয়ানমার থেকে কম হলেও এক শ’ কোটি টাকার ইয়াবা আসছে। তবে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা বলেছেন, এই হিসাব তাদের কাছে নেই। তারা কেবল বলতে পারবেন উদ্ধারকৃত ইয়াবার কথা। উদ্ধারই হচ্ছে লাখ লাখ টাকার ইয়াবা। যারা ধরা পড়ে তাদের মধ্যে মূল ব্যবসায়ী এবং আমদানি কারকদেরও কেউ থাকে না। ইয়াবাসহ যারা গ্রেফতার হয় তারা শুধু ক্যারিয়ার। এদের আগে ও পরে কারা আছে তা জানা যাচ্ছে না। ইয়াবার সেবন ও বহন সহজ হওয়ার কারণে এটার বিস্তৃতি ব্যাপক হচ্ছে। ইদানীং ব্যাপকহারে স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়–য়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে ইয়াবা সেবনের আসক্তি বাড়ছে। অনেকেই রয়েছে যারা সরাসরি বাংলাদেশ থেকে মিয়ানমারে গিয়ে ইয়াবা নিয়ে আসছে। কক্সবাজার, উখিয়া ও টেকনাফসহ মিয়ানমার সীমান্তের বিভিন্ন এলাকায় ইয়াবা এনে মজুদ রাখা হয়। সময়-সুযোগমতো তা দেশের বিভিন্ন স্থানে পৌঁছে দেয়া হয়। মাঝে মধ্যে দু-একজন ধরা পড়লেও মূল হোতারা থেকে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। আমরা আশাকরি মাদক আমদানিকারক ও বাজারজাতকারির বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট কতৃপক্ষ আরো কঠিন হবে।
লেখক: গবেষক ও সাবেক অধ্যক্ষ
ড.ফোরকান আলী
০১৭১১৫৭৯২৬৭
0 comments:
Post a Comment