মাদক! সন্ত্রাস ও অপরাধের জনক
আলী ফোরকান
বর্তমান বিশ্বের অন্যতম অভিশাপ ড্রাগ। আলো ঝলমল নগরীর প্রাণকেন্দ থেকে শুরু করে অন্ধকার গ্রামেও এখন এর অবাধ বিচরণ। বাংলা নেশা শব্দটি মূলত এসেছে আরবী শব্দ নশাতুন থেকে- যার অর্থ হচ্ছে মত্ততা। বাংলা ভাষায় সাধারণের চাইতে বেশী যে কোন আকর্ষণকেই নেশা বলা হয়। গানের নেশা, পড়ার নেশা, বইয়ের নেশা যেমন নেশা, তাসের, জুয়ার নেশাও তেমনি নেশা। কারো আবার আছে ষ্ট্যাম্প কালেকশনের নেশা কারো বা শুধু কাজ আর কাজের নেশা, কিন্তু ড্রাগ বা মাদকদ্রব্যের নেশা এমনই নেশা যে, তা ব্যক্তিকে শুধু তার পরিবার, সমাজ, দেশ থেকেই বিছিন্ন করে না, তার জীবনকেও বিপন্ন করে তোলে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে ড্রাগ হলো এমন বস্তু যা গ্রহণ করলে ব্যক্তির এক বা একাধিক কার্যকলাপের পরিবর্তন ঘটায়। একটা ড্রাগের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নির্ভর করে তার রাসায়নিক গঠন বৈশিষ্ট্যের উপর। এই ড্রাগ অপব্যবহারের কারণে রোগী তার রোগের জন্য ওষুধের গুণাগুণ পাওয়ার বদলে হয়ে যায় বিষ। তাই অনেক সময় বিষ স্বল্পমাত্রায় প্রয়োগ করলে হয় ওষুধ, কিন্তু বেশী মাত্রা বা অযথা গ্রহণ করলে হয় বিষাক্ত যা শরীরকে নিস্তেজ করে, মৃত্যু ডেকে আনে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই অপব্যবহারের মাধ্যমে মাদকাশক্তির সূচনা হয়। অপব্যহার থেকে অভ্যাস, অভ্যাস থেকে আসক্তি। এ আসক্তি ছড়িয়ে পড়ছে সমাজের সবক্ষেত্রে। বিশেষত যুব-যুবাদের মাঝে। তাই যুব সমাজকে নিয়ে আমরা সবাই চিন্তা করি । কারণ যুব সমাজই আমাদের ভবিষ্যৎ, অথচ সেই যুব সমাজ আজ মাদকাসক্ত হয়ে খুনের নেশায় মত্ত হয়েছে। কেন তারা আজ মাদকাসক্ত? মাদক কি আমাদের সমাজে তাহলে সকল পরিবারেই ঢুকে পড়ছে ? নাকি আমরা আমাদের সন্তানদের সঠিকভাবে পরিচালিত করতে পারছি না ? এই দায়ভার কারা নেবে ? পরিবার , সমাজ না দেশ ? মাদক! যাকে বলা হয় সকল সন্ত্রাস ও অপরাধের জনক। একজন মানুষ যখন অন্ধকারের ভুবনে পা বাড়ায় তখন সে প্রথম সিঁড়ির যে ধাপটিতে পা রাখে তা মাদকদ্রব্য। এই মাদকদ্রব্য তাকে টেনে নেয়, উৎসাহিত করে পরবর্তী ধাপগুলো পেরিয়ে যেতে। ভৌগোলিক অবস্থানের ভিত্তিতে বাংলাদেশের মাদক ব্যবসা ও প্রাপ্তির সহজলভ্যতা বেশি এবং বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থান প্রেক্ষিতে তরুণ সমাজ এদিকে ঝুঁকেছেও বেশি - ঠিক যেমনটি প্রত্যাশা মাদক ব্যবসায়ীদের। ২০১৪-১৫ সালের ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী মাদকাসক্তদের মধ্যে ইয়াবা সেবনের মাত্রা বেশি। ইয়াবা সেবনের হার মারাত্মক হারে বেড়েই চলেছে। মোট মাদকাসক্তের ৭৫ ভাগই এখন ইয়াবাসেবি। বিভিন্ন সময়ে পরিচালিত বহু সরকারী ও বেসরকারী সমীক্ষায় পাওয়া তথ্যে প্রকাশ করা হয় ইয়বা পাচারের জন্য এদেশকেই সবচেয়ে বেশি নিরাপদ মনে করছে পাচারকারীরা। কমপক্ষে দেশের ৩০টি রুট দিয়ে স্থল ও নৌপথে এদেশে মাদক প্রবেশ করে বিমান ও জাহাজে করে পৌঁছে যাচ্ছে উন্নত বিশ্বে। বাংলাদেশে এক্ষেত্রে বাজার বা গোডাউন হিসেবে ব্যবহƒত হচ্ছে। সম্প্রতি আমাদের দেশের সংবাদপত্রে প্রতিদিন যেসব খুন , সন্ত্রাসী, মেয়েদের উত্ত্যক্ত করার ঘটনাসহ সকল অপরাধ এর খবর ছাপা হচ্ছে তার সকল ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে দেশের তরুণ যুব সমাজ এর একটি অংশ । কিন্তু সবচেয়ে মারাত্মক যে বিষয়টি জাতির জন্য উদ্বেগের এবং আমাদেরকে সতর্ক হতে নির্দেশ দিচ্ছে তা হলো এদের অধিকাংশই আজ মাদকাসক্ত। নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের কারণেই দেশে যুব সমাজের মধ্যে মাদকাসক্তির পরিমাণ সাম্প্রতিক সময়ে আশংকাজনকভাবে বেড়ে গেছে। বাংলাদেশের শহর জনপদের ধনী পরিবারের সন্তানদের মধ্যে সম্প্রতি ইয়াবা আসক্তির যে প্রবণতা দেখা দিয়েছে তা সমগ্র জাতির জন্য এক ভয়াবহ পরিণতির ইঙ্গিতবাহী । ইয়াবা কেবল আমাদের তরুণ প্রজšে§র প্রাণশক্তি ও মেধাকে ধংস করছে না, ইয়াবার কারণে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে অপসংস্কৃতি ও অপরাধের বিস্তার ঘটছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, মাদকাসক্তদের শুধু দায়ী করলেই হবে না এর সাথে একদিকে দারিদ্র্য ও বেকারত্বজনিত বিপুল হতাশা, অন্যদিকে সকল পর্যায়ে নীতি - নৈতিকতা বিবর্জিত সীমাহীন লোভ গোটা সমাজকে ভারসাম্যহীন করে তুলেছে । মাদক পাচার ও ব্যবসায়ীদের কঠোর শাস্তি দেয়াসহ মাদক পাচার রোধ ও মাদকের সহজপ্রাপ্যতা বন্ধ করতে হবে। এছাড়াও প্রত্যেক অভিভাবকের মাঝে মাদক সম্পর্কিত সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। নিজ সন্তানের প্রতি যতœশীল হতে হবে। দেশের সরকার ও জনগণের সমন্বয় প্রচেষ্টায় এই ভয়াবহ ব্যাধি দূর করতে হবে। সম্প্রতি এসব মাদকাসক্তদের দ্বারা খুন-রাহাজানি বন্ধ করতে আইন প্রয়োগের মাধ্যমে দোষিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা জরুরী। পাশাপাশি আমাদের সমাজে তরুণ যুবসমাজকে মাদকাসক্ত ও বখাটে হবার আগেই সচেতন করার জন্য সকল মাধ্যমকে জরুরীভিত্তিতে কার্যকর করা জরুরী । এ ক্ষেত্রে ধর্মীয় , মানবিক,ও সামাজিক মূল্যবোধকে উৎসাহিত করতে হবে। পরবর্তী পর্যায়ে যে বিষয়টি বিবেচ্য তা হলো মাদকাসক্ত চিকিৎসা ও পুনর্বাসন। পর্যাপ্ত চিকিৎসা ব্যবস্থা না থাকা এবং পদ্ধতিগত ক্রুটির কারণে যৎসামান্য চিকিৎসা নেয়ার পরও এ দেশে পুনরায় মাদকাসক্তিতে জড়িয়ে পড়া হার অনেক বেশী। মাদকাশক্তি প্রতিরোধের সর্বাপেক্ষা কার্যকর উপায় হচ্ছে মাদকদ্রব্য ও নেশার বিরুদ্ধে সমাজ- সচেতনতা গড়ে তোলা। মাদকদ্রব্যের অনুপ্রবেশ সম্পূর্ণ বন্ধ করা, মাদক ব্যবসার সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িতদের গ্রেফতার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা, বেকারদের কর্মসংস্থান ও স্কুল-কলেজে সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি ধর্মীয় শিক্ষা প্রদান এবং মাদকাসক্তদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা।
লেখক: গবেষক ও সাবেক অধ্যক্ষ
ড.ফোরকান আলী
০১৭১১৫৬৯২৬৭
0 comments:
Post a Comment