Friday, August 5, 2016

মাদকাসক্তিতে বাংলাদেশ

মাদকাসক্তিতে বাংলাদেশ
আলী ফোরকান
ভৌগলিক কারণে বাংলাদেশ একটি মাদক ব্যবসার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ দেশ। ইতিমধ্যে আমাদের দেশ, আশেপাশে দেশগুলোর মাদক পাচারের অন্যতম ট্রানজিট পয়েন্টে পরিণত হয়েছে। কারণ এর পাশেই গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গেল। ইন্টারন্যাশনাল নারকটিকস্ কন্ট্রোল বোর্ড মাদক বাণিজ্যের প্রসারের পিছনে উৎপাদনকারী ও ট্রানজিট দেশগুলোর সরকারের ব্যর্থতার কথা উল্লেখ করেছে। কিছু দিন আগে আমাদের প্রধানমন্ত্রীও জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির সভায় সাম্প্রতিককালে যুব সম্প্রদায়েল জীবন ও ভবিষ্যৎ নিয়ে সময়োপযোগী ও একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য রেখেছেন। সেইসাথে তিনি যে ইয়াবা সম্পর্কে সাম্প্রতিককালের একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনাও যে মনে রেখেছেন এবং তার জন্য ব্যবস্থা নিতে বলেছেন। তিনি আরো উল্লেখ করেছেন দেশের যুব সমাজ এই দেশের প্রাণ আর তারা যদি মাদকাসক্ত হয় তবে দেশ বিপথে যাবে। বিশ্বব্যাংকের গবেষণায় বলা হয়েছে তামাক ব্যবহারের ফলে প্রতিবছর ৫৭,০০০ লোকের মৃত্যু হয় এবং ৩,৮২,০০০ লোক তামাক ব্যবহার করায় পঙ্গু হয়ে বেকার অবস্থায় জীবন কাটায়। একটি গবেষণায় দেখা যায়, মাদকাসক্তদের শতকরা ৮০% ভাগই ধূমপায়ী এবং এদের মধ্যে শতকরা ৪৪% ভাগ নানা ধরনের অপরাধের সঙ্গে জড়িত। উল্লেখ্য, আমাদের জনসাধারণের শতকরা ৫৫% কোনো না কোন ধরনের তামাক ব্যবহার করে। জাতিসংঘের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বছরে মাদক ব্যবসায় লেনদেন হয় ৪০০ বিলিয়ন ডলার যা মার্কিন প্রতি বছর বাজেটের চেয়ে বেশী। যুক্তরাষ্ট্রে এক গ্রাম হেরোইন বিক্রি হয় ৭০ ইউরোতে (অর্থাৎ প্রায় ৭ হাজার টাকা)। তাই এত সহজে টাকা কামানোর কারণে মাদক ব্যবসার সঙ্গে খুন, সন্ত্রাস ও জঘন্য অপরাধগুলো মিশে আছে। যুক্তরাষ্ট্রের পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, মাদক সংক্রান্ত কারণেই শতকরা ৫ শতাংশ খুনের ঘটনাগুলো ঘটে। ইউএনএইডস রিপোর্ট অনুযায়ী এ বছর ৪.৯ মিলিয়ন লোক নতুনভাবে এইচআইভি সংক্রমিত হয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মহিলা ও নেশা গ্রহণকারীদের মধ্যে সংক্রমণ যথেষ্ট বড়েছে। বেশির ভাগ সংক্রমণ ঘটেছে যৌন প্রক্রিয়ায় তবে মাদকের নেশা গ্রহণকারীদের মধ্যে ইনজেকশনে মাধ্যমে ও এইচআইভি সংক্রমিত হয়েছে। এইচআইভি/এইডস-এ আক্রান্ত ব্যক্তির সংখ্যা কম হলেও অন্যান্য দেশের অভিজ্ঞতার আলোকে বর্তমানে বাংলাদেশও ঝুঁকিপূর্ণ দেশ হিসেবে বিবেচিত। মাদক হলো বর্তমান বিশ্বের একটি অন্যতম লাভজনক ব্যবসা। বর্তমানে এক কেজি কোকেন এর মূল্য ১ কোটির টাকারও বেশী। সুতরাং এই ব্যবসা করে যে কোনো কেউ রাতরাতি বড়লোক হয়ে যেতে পারে। কিন্তু ধ্বংস হয়ে যাবে পায় ১ কোটিরও বেশী সোনার টুকরা ছেলে-মেয়েরা, যারা এদেশের হবে কাণ্ডারি। তবে মাদকের বিরুদ্ধে লড়াই সহজ কাজ নয়। এর জন্য প্রধান ০৪টি বিষয় গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করতে হবে। যেমন:
১. মাদকদ্রব্য সরবরাহ বন্ধের পদক্ষেপ নেয়া
২. বেকার যুব সমাজকে কর্ম সংস্থানের ব্যবস্থা করা
৩. সামাজিক অস্থিরতাকে বোধ করা
৪. সকল সরকারী, বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তামাক ও মাদকের ভয়াবহতা সম্পর্কে শিক্ষা ও কাউন্সিলিং এর ব্যবস্থা করা। বর্তমানে বাংলাদেশে মাদকাশক্তি সমস্যা শুধু শহরেই সীমাবদ্ধ নয়, প্রত্যন্ত অঞ্চলে বিশেষত সীমান্ত এলাকায় মাদকের সহজ প্রাপ্তি এবং তা কম মূল্যে ক্রয় করা যায় বিধায় গ্রামে অনেক তরুণ-তরুণীরাও মাদকের করাল গ্রাসে নিমগ্ন। এই নেশাখোরদের বিরাট অংশ এখন ছোট-বড় নানা অপরাধে জড়িত। দীর্ঘদিন নেশার রাজা হেরোইন হলেও বর্তমানে এর রাণী হয়ে বাজারে এসেছে ইয়ারা। এই ইয়াবার বিরুদ্ধেও প্রধানমন্ত্রী সেদিন বলেছেন, তিনি বলেছেন বর্তমানের এই ইয়াবার অবস্থা কি এবং এর বিরুদ্ধে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীকে এখনই ব্যবস্থা নিতে বলেছেন। সুতরাং প্রধানমন্ত্রীর দুটো বিষয়ই বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। ইয়ারা দিয়ে নেশার জগতে প্রবেশের পর ইয়াবাসক্তরা এখন নেশাতেও জড়িয়ে পড়েছে। ইয়াবা ব্যবসায়ীরা শুরুতে ইয়াবাকে এক ধরনের যৌন উত্তেজক ট্যাবলেট হিসেবে প্রচার করে। তখন এর নাম ছিলো ক্রেজি মেডিসিন, হিটলারস ড্রাগ, টেস্টি ভায়াগ্রা ইত্যাদি। পরবর্তীতে তরুণীরা ব্যাপক হারে ইয়াবা খাওয়া শুরু করলে এর নাম দেয়া হয় “দ্য কুইন”। গুলশান, বনানী, ধানমন্ডি, মহাখালি, পুরান ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন মার্কেটে ও মুদি দোকানে বর্তমানে এটি বিক্রি হচ্ছে। চিকিৎসকদের অভিমত হচ্ছে এই ইয়াবা টেবলেট বেশীদিন গ্রহণ করলে মানুষের কিডনি, লিভার নষ্ট হয়ে যায় সেই সাথে যৌনশক্তিও পুরোপুরি নষ্ট হয়ে পড়তে থাকে। ফলে এই ট্যাবলেট দ্রুত একজন মানুষকে পঙ্গু করতে করতে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়। সহজ কথায়, মাদক হলো বহু গুরুতর অপরাধের জননী। একটি পরিবারের জন্য মাদক কত বড় অভিশাপ হতে পারে তা আমাদের দেশের প্রতিদিনের দৈনিক খবরের কাগজ খুললেই বোঝা যায়। মাদকাশক্ত ছেলের অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে এক মা তার মেয়ের সহযোগিতায় তার একমাত্র ছেলেকে হত্যার মত কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। অন্যদিকে মাদকের টাকা না পেয়ে বাবা, মাকে খুন করার ঘটনাও ঘটে যখন-তখন। মাদকাসক্তি একটি সামাজিক ও মানসিক সমস্যা। কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো-
১. সমবয়সীদের চাপ (চববৎ মৎড়ঁঢ় ঢ়ৎবংংঁৎব),
২. হাতের কাছে মাদকদ্রব্য পাওয়া অর্থাৎ মাদকের সহজলভ্যতা,
৩. বেকারত্ব ও কর্মক্ষেত্রে ব্যর্থতা,
৪. আর্থসামাজিক অস্থিরতা,
৫. মাদকের কুফল সম্পর্কে অজ্ঞতা ও
৬. সমাজে ধর্মীয় ও নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় ইত্যাদি।
তাই এই সমস্যার প্রবণতা অনুধাবন করে সরকার, সমাজ চিন্তাবিদ, মনোবিজ্ঞানী, ডাক্তার, গবেষক, সমাজকর্মী, ধর্মীয় বিশেষজ্ঞ সবাই মিলে এই সমস্যা সমাধানের উপায় সন্ধানে আত্মনিয়োগ করা প্রয়োজন। তাই আসুন, আমরা সবাই মিলে মাদকাশক্তির নেশা থেকে আমাদের সন্তানদের রক্ষা করতে এখনই নিজেদের ঘর থেকেই সচেতনতা কার্যক্রম শুরু করি।

0 comments:

Post a Comment