Friday, August 5, 2016

মাদকাসক্তি ও পথশিশু

 মাদকাসক্তি ও পথশিশু
আলী ফোরকান
ঢাকার ফুটপাত কিংবা পার্কে চোখে পড়বে ১০/১২ বছর বয়সের একদল শিশু। এই বয়সেই ওরা সারা শহরের ময়লা-আবর্জনার স্তুপ থেকে সংগ্রহ করে, বিভিন্ন ধরনের পচা খাবার, প্লাস্টিক, কাঁচ আর লোহা-লক্কড়ের ফেলে দেয়া বিভিন্ন সামগ্রী। ছিন্নমূল এসব শিশুর দিকে তাকালে সহজেই চোখে পড়বেÑ এরা একেক জন বিভিন্ন পলিথিন কিংবা কাগজের মোড়কের মধ্যে মুখ গুঁজে গভীর নিঃশ্বাস নিচ্ছে। পার্কে, রাস্তার পাশে পথচলতি মানুষেরা ভাববেন ওইসব কিশোরীরা হয়তো কৈশোরের স্বাভাবিক আচরণের কারণেই অমনভাবে কাগজে মুখ গুঁজে হাঁটছে নিঃশ্বাস নিচ্ছে, নয়তো বসে আছে। কিন্তু বাস্তবতা বলে ভিন্ন কথা। ঢাকার ফার্মগেট, ধানমন্ডি পার্ক, সংসদ ভবন এলাকার পাশে, কমলাপুর, গুলিস্তানের দোকানপাটের অলিগলিতে দৃশ্যমান এসব শিশুদের অধিকাংশই এখন নেশায় আক্রান্ত। কাঠের, হার্ডবোর্ড এবং টায়ারের দোকান থেকে বিভিন্ন আঠার কৌটা কিনে আঠার গন্ধে তারা এক ধরনের মাদকদ্রব্যের নেশার স্বাদ পূরণ করছে। আঠার রাসায়নিক গন্ধের মধ্যে এক ধরনের নেশা ওইসব কোমলমতি শিশুদের নেশাগ্রস্ত করছে। এমনই এক নেশাগ্রস্ত শিশু বেলাল। কমলাপুর বস্তিত বেড়ে ওঠা বেলালের বাবা-মা নেই। দুঃসম্পর্কের আত্মীয় মজিদ মোল্লার সঙ্গে তার বসবাস। সারাদিন আবর্জনা টুকিয়ে বস্তা ভর্তি করে জমা দিতে হয় মজিদ মোল্লাকে। বেলালের সারাদিনের এই পরিশ্রমের মজুরি হিসেবে পায় মাত্র ২০ থেকে ৩০ টাকা। সারাদিন আবর্জনার স্তুপে স্তুপে ঘুরে ক্লান্ত শরীর নিয়ে পার্কে যখন ওদের বয়সী ৮/১০ জন একত্রে বিশ্রাম নেয়, তখনই পলিথিনের মধ্যে মোড়ানো আঠার কৌটা লুকিয়ে তারা ঘ্রাণ নেয়। এই ঘ্রাণ তাদের মাদকের নেশার মতোই তৃপ্তি দেয়। বেলাল বলছিল প্রথম প্রথম গন্ধটা নিলে শরীরটা শীতল মনে হতো। এখন যতোবারই নেয় ততোবারই শরীরটায় ঝিমঝিম ভাব আসে। অনেক সময় ঘুম এসে যায়। একটি আঠার কৌটা সাইকেল গ্যারেজের দোকান, পানের দোকান, ফার্নিচার বা পাড়া-মহল্লায় জুতার কিংবা হার্ডওয়্যার দোকান থেকে মাত্র ২০/২৫ টাকায় ওরা কিনতে পারে। শিশু বিশেষজ্ঞরা জানান, যেসব শিশুদের আমরা পথশিশু বলছি, তারা এমনিতেই প্রচুর পরিশ্রম করে। শরীরে ক্লান্তি ভাব থাকে। ক্লান্ত শরীরে খুবই ক্ষুধায় তারা হয়তো বিকল্পভাবে পলিথিনে আঠার গন্ধ নিয়ে ক্ষুধা দমন করতে পারে। তবে এক্ষেত্রে লক্ষ্য রাখতে হবে, যে বস্তুটি শিশুদের এমন আকৃষ্ট করছে সেই বস্তুটি আসলে নেশা দ্রব্যের মধ্যে পড়ে কিনা তা পরীক্ষা করতে হবে। ওই গন্ধের মধ্যে কোনো রাসায়নিক পদার্থ আছে কিনা। সেই রাসায়নিক পদার্থ কোনো মাদকদ্রব্যের কোন শ্রেণীতে পড়ে তার পরীক্ষা-নিরীক্ষা না করে শিশুরা কেন এমন আচরণে আসক্তি প্রকাশ করছে তার অনুসন্ধান করা উচিত। বিশেজ্ঞরা আরো বলেন, শিশু বলে আমরা ফুল বিক্রেতা, পার্কে ময়লা টোকাইকারীদের অবহেলার চোখে দেখি। এমনিতেই জীবনের চরম দুর্ভোগ বা ক্ষতিকর প্রভাব তাদের জীবনী শক্তিকে অবশ্যই ক্ষয় করছে। তাই মাঠ পর্যায়ে যারা শিশুদের উন্নয়নে কাজ করেন তাদের বিষয়টির গভীরে যাওয়া উচিত। জাতিসংঘের সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণা এবং আর্ন্তজাতিক মানবাধিকার নীতিমালায় একথা স্বীকৃত হয়েছে যে, গোত্র, বর্ণ, লিঙ্গ, ভাষা, ধর্ম, রাজনৈতিক অথবা ভিন্নমত, জাতীয়তা কিংবা সামাজিক পরিচয়, শ্রেণী, জন্মসূত্র কিংবা অন্য কোনো মর্যাদা নির্বিশেষে প্রতিটি মানুষ কোনো প্রকার বৈষম্য ছাড়াই এই ঘোষণার বর্ণিত সব ধরনের অধিকার ও স্বাধীনতা ভোগ করবে। জাতিসংঘের সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণা অনুযায়ী প্রতিটি শিশুর প্রাপ্য হচ্ছে বিশেষ যতœ ও সহায়তা। জাতিসংঘ সনদে ঘোষিত আদর্শের চেতনায় এবং বিশেষ করে শান্তি,মর্যাদা, সহনশীলতা, স্বাধীনতা, সমতা ও সংহতির চেতনায় শিশুকে লালন-পালন করতে হবে। শিশুকে বিশেষ যতœ প্রদানের প্রয়োজনীয়তার কথা ১৯২৪ সালের জেনেভা শিশু অধিকার ঘোষণা ও ১৯৫৯ সালের ২০ নভেম্বর সাধারণ পরিষদে গৃহীত শিশু অধিকার ঘোষণায় বর্ণিত হয়েছে এবং সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণা, আর্ন্তজাতিক নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার বিষয়ক চুক্তিপত্র (বিশেষ করে এর ২৩ ও ২৪ নং অনুচ্ছেদ), আর্ন্তজাতিক অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার বিষয়ক চুক্তিপত্র (বিশেষ করে এর ১০ নং অনুচ্ছেদ) এবং শিশু কল্যাণের সঙ্গে সংশ্লি¬ষ্ট বিশেষায়িত সংস্থা ও আর্šÍজাতিক সংগঠনসমূহের সংবিধি ও প্রাসঙ্গিক দলিলাদিতে স্বীকৃত হয়েছে। শিশু অধিকার ঘোষণায় যেমনটা বলা হয়েছে, ‘শিশুর শারীরিক ও মানসিক অপরিপক্বতার কারণে তার জন্মের আগে ও পরে তার জন্য উপযুক্ত আইনগত সুরক্ষাসহ বিশেষ রক্ষাকবচ ও যতœ নিশ্চিত করা প্রয়োজন’। শিশুদের এই চরম অবনতি নিয়ে মানবাধিকার সনদগুলোতে স্বীকৃত তথ্য থাকলেও এর সমাধানে কোনো বাস্তব পদক্ষেপ সম্মিলিত প্রচেষ্টায় পুরোপুরি সফল হয়নি। এক পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, দেশে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত ১২ লাখ ৯১ হাজার শিশুর মধ্যে নির্দিষ্ট করে এখনো চিহ্নিত করা যায়নি কতো ভাগ পথশিশু, কতো ভাগ দুস্থ শিশু এবং এসব শিশুরা নেশাদ্রব্য গ্রহণে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে কিনা। বেসরকারি সংস্থা অপরাজেয় বাংলাদেশ-এর সমন্বয়কারী জানান, বিআইডিএস-এর এক পরিসংখ্যানে দেশে পথশিশুদের সংখ্যা প্রায় ৭ লাখ। এসব শিশুদের ৪টি ক্যাটাগরিতে ভাগ করা হয়েছে। তবে এসব শিশুদের শতকরা ৪০ ভাগ শিশু মাদকের সঙ্গে জড়িত। এসব ছিন্নমূল শিশুদের জীবনে নতুন ধরনের এই নেশা তাদের জীবনকে ভয়াবহ ক্ষতির দিকে ঠেলে দেয়ার আগেই শিশু অধিকার এবং শিশুর স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিয়ে যাদের বিভিন্ন কর্মসূচি রয়েছে। তাদের আরো দায়িত্বশীল হয়ে শিশুদের এই ভয়াবহ পরিণতি থেকে রক্ষার জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার এখনই সময়। তথ্যসূত্র : বাসস

0 comments:

Post a Comment