Monday, August 15, 2016

ইয়াবা ও নাফ নদী

ইয়াবা ও নাফ নদী
আলী ফোরকান
বঙ্গোপসাগরে দিনে দুবার জোয়ার আসে। আবার দুবার ভাটাও হয়। কিন্তু সাগরসংলগ্ন টেকনাফে মাদকদ্রব্য ইয়াবার জোয়ার এলেও ভাটা হয় না। ইয়াবার জোয়ারে তাই এখন ভাসছে গোটা টেকনাফ। আর ভয়ঙ্কর এই মাদকের নেটওয়ার্ক বিস্তৃত দেশজুড়ে। টেকনাফের মানুষের প্রধান ব্যবসায়ই ইয়াবা। টেকনাফের রাজনীতি আর অর্থনীতি- সব ইয়াবা কেন্দ্র করেই চলছে। জনপ্রতিনিধি, রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী থেকে শুরু করে এমন কোনো সেক্টর নেই যারা ইয়াবার ব্যবসায় জড়িত নন। ইয়াবার ব্যবসায় জড়িয়ে ঠেলাগাড়ি চালকও যেমন রাজপ্রাসাদের মালিক হয়েছেন। তেমনি ইয়াবার কারণেই টেকনাফের প্রশাসনিক চেয়ারগুলোর মূল্যও হয়েছে কয়েক গুণ। ইয়াবা এখন এতটাই লাভজনক ব্যবসা যে লবণ, মাছ চাষ ও কাঠসহ বিভিন্ন বৈধ ব্যবসা ছেড়ে শত শত ব্যবসায়ী ইয়াবায় অর্থলগ্নি করছেন। আর এসব কারণে সীমান্তবর্তী টেকনাফ হয়ে উঠেছে মাদকের স্বর্গরাজ্য। মাফিয়াদের বিচরণে মুখর থাকে সৌন্দর্যের লীলাভূমি টেকনাফ। কক্সবাজারের একটি উপজেলা টেকনাফ। দেশের দক্ষিণ-পূর্ব কোণে অবস্থিত এ উপজেলার সঙ্গে কক্সবাজার সদরের দূরত্ব ৮৬ কিলোমিটার। টেকনাফের উত্তরে উখিয়া উপজেলা, পুবে নাফ নদ ও মিয়ানমার এবং দক্ষিণ ও পশ্চিমে বঙ্গোপসাগর।টেকনাফের সীমান্তবর্তী বিভিন্ন এলাকায় অধিকাংশই ইয়াবা ব্যবসার আদ্যোপান্ত। ইয়াবা ব্যবসায় সরকারি দল আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতাদের সংশ্লিষ্টতা যেমন পাওয়া গেছে, তেমনি পাওয়া গেছে অন্যান্য দলের নেতাদেরও। টেকনাফে সাধারণ মানুষ এখানে অসহায়। ইয়াবা ব্যবসায়ীদের ভয়ে তারা কখনো মুখ খোলেন না। দু’একজন মুখ খুললেও তাদের পরিণতি হয়েছে ভয়াবহ। লোকজনের সঙ্গে লুকিয়ে কথা বলতে গেলেও কোথা থেকে হাজির হয়ে যেতেন মাদক ব্যবসায়ীরা। তাদের নজরদারির কারণে সাধারণ মানুষ কোনো তথ্য দিতেও ভয় পায়। টেকনাফ শহরে এখন আর কোনো নিরাপদ স্থান নেই। যেখানে কারো সঙ্গে বসে ইয়াবার বিষয়ে তথ্য নেওয়া যায়। একদিকে পুলিশের নজরদারি, আরেকদিকে অস্ত্রধারীদের পাহারা- সব মিলিয়ে ভিন্ন এক অঞ্চলে পরিণত হয়েছে টেকনাফ। টেকনাফে এমন কিছু বিচ্ছিন্ন এলাকা গড়ে উঠেছে, যা শুধু ইয়াবা ব্যবসায়ীদের চলাচলের জন্য উম্মুক্ত। সাধারণ মানুষের জন্য নয়। অচেনা লোকজনের জন্য ওই অঞ্চল অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। এ ছাড়া টেকনাফে চাকরি করা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা ওই অঞ্চলকে সোনার ডিম পাড়া হাঁস হিসেবেই মনে করেন। যে কারণে তারাও টাকা আয়ে বেপরোয়া হয়ে পড়েন। পুলিশের গ্রেফতার বাণিজ্য টেকনাফে জমজমাট। আসামিকে পাহাড়ে নিয়ে যাওয়ার কথা বলা হলেই ধরে নেওয়া হয় ‘ক্রসফায়ার’ দেওয়া হবে। যে কারণে পাহাড়ের কথা বললেই পুলিশের কাছে চলে আসে বস্তাভর্তি টাকা। এ ধরনের অসংখ্য ঘটনা ঘটেছে এ এক মাসে। পাহাড়, নদী ও সাগর ঘেরা নিসর্গ টেকনাফ এখন ভয়ঙ্কর অঞ্চল হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ শহরে দাঁড়িয়ে যেদিকে দৃষ্টি যায়, সেদিকেই দেখা মেলে ইয়াবা ব্যবসায়ীদের। দুই থেকে আড়াই লাখ টাকা মূল্যের মোটরসাইকেলে দলবেঁধে ঘুরে বেড়াচ্ছেন ইয়াবা ব্যবসায়ীরা। কেউ কেউ কোটি টাকা মূল্যের গাড়িতে চড়ছেন। খোঁজখবর নিচ্ছেন ইয়াবার চালানের। ইয়াবার গডফাদারদের দেখা যায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পদস্থ কর্মকর্তাদেরও সঙ্গে বসে খোশগল্প করতে। টেকনাফবাসীর অভিযোগ, ইয়াবা ব্যবসা জিইয়ে রেখেছেন প্রশাসনের লোকজন। যে কারণে ব্যবসায়ীর সংখ্যা দিন দিনই বাড়ছে। টেকনাফের ৯০ শতাংশ মানুষই এখন এ ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, স্থানীয় এমপি, ক্ষমতাধর রাজনীতিক, প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা ইয়াবা ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করায় কোনোভাবেই রোধ করা যাচ্ছে না এর আগ্রাসন। টেকনাফের সাধারণ মানুষের অভিযোগ, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা ইয়াবা ব্যবসায় সরাসরি জড়িত। কক্সবাজারের পুলিশ সুপার জানান, ইয়াবার বিরুদ্ধে পুলিশের জিহাদ চলছে। যে কারণে প্রায় প্রতিদিনই ইয়াবার চালান ধরা পড়ছে। গডফাদাররাও পলাতক।ইয়াবার ৩৭ কারখানা : মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরে বিজিবির পাঠানো মিয়ানমারে ইয়াবা তৈরির কারখানাসংক্রান্ত গোপন তালিকায় দেখা যায়, মিয়ানমারের সীমান্তে এলাকায় রয়েছে ৩৭টি ইয়াবা কারখানা। এসব কারখানা বাংলাদেশি ইয়াবা ব্যবসায়ীদের অর্থে স্থাপন করা হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, এসব কারখানায় প্রতিদিন তৈরি হচ্ছে ইয়াবা। ট্রলারসহ বিভিন্ন মাধ্যমে নাফ নদ পেরিয়ে টেকনাফে ঢুকছে এসব মাদক। কখনো পুলিশ প্রটেকশনে, আবার কখনো অবৈধ অস্ত্রধারীদের নিয়ন্ত্রণে। সূত্র জানায়, মিয়ানমারের কোচিন প্রদেশে রয়েছে ১০টি ইয়াবা কারখানা। এসব কারখানা নিয়ন্ত্রণ করে দেশটির বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন কোচিন ডিফেন্স আর্মি। এ কারখানায় ১৩ ধরনের ইয়াবা উৎপাদিত হয় বলে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। এ ছাড়া দুর্গম নামখাম এলাকায় দুটি কারখানা রয়েছে। এ দুটি নিয়ন্ত্রণ করে পানহেসি কেও মেও ইয়াং মৌলিয়ান গ্রুপ। মিয়ানমারের কুনলং এলাকায় হাউ স্পেশাল পুলিশ ট্র্যাক্ট গ্রুপের অধীনে আছে বড় আকারের একটি ইয়াবা কারখানা। ব্রিগেড টাঙ্গাইয়ান এলাকায় ম্যাংপ্যাং ও মংঘা বিচ্ছিন্নতাবাদী গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে আছে তিনটি কারখানা। লয় হাসোপুসুর ও মংসু এলাকায় রয়েছে একটি। এটির নিয়ন্ত্রণ ইয়ানজু গ্রুপের হাতে। মিয়ানমারের নামজ্যাং এলাকায় আছে দুটি কারখানা। সান ন্যাশনাল পিপলস লিবারেশন ও কাই সান চৌ ঝ্যাং গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হচ্ছে এ কারখানা দুটি। এ ছাড়া মাহাজা ও হোমং এলাকায় এ গ্রুপের অধীনে আরও দুটি কারখানা পরিচালিত হচ্ছে। কাকাং মংটন এলাকায় ইউনাইটেড আর্মির নিয়ন্ত্রণে আছে তিনটি কারখানা। এ গ্রুপের কাছে মিয়ানমারের মংসাট এলাকায় দুটি, দুর্গম ট্যাচিলেক এলাকায় তিনটি, বিদ্রোহী গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে থাকা মংপিয়াং এলাকায় একটি, মং ইয়াং এলাকায় দুটি ও পংস্যাং এলাকায় দুটি কারখানা আছে। মিয়ানমারের মাও ক্যামাই এলাকায় সান ন্যাশনালিস্ট পিপলস আর্মির নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হচ্ছে আরও দুটি কারখানা। এ ছাড়া মিয়ানমার ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স আর্মির (এমএনডিএএ) দ্বারা কোকান এলাকায় পরিচালিত হচ্ছে আরও একটি ইয়াবা কারখানা।
অরক্ষিত ১৫ পয়েন্ট : টেকনাফের স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের ১৫টি পয়েন্ট অরক্ষিত। এসব পয়েন্ট দিয়ে ইয়াবার চালান বাংলাদেশে ঢুকছে। অরক্ষিত এসব পয়েন্ট হলো টেকনাফের নাইট্যংপাড়া, কাইয়ুকখালীপাড়া, মৌলভীপাড়া, নাজিরপাড়া, চৌধুরীপাড়া, জালিয়াপাড়া, সাবরাং, নওয়াপাড়া, শাহপরীর দ্বীপ, হ্নীলা ও হোয়াইক্যং। এ ছাড়া উখিয়া উপজেলার বালুখালী, ঘুমধুম, ধমনখালী, রহমতবিল, নাইক্ষ্যংছড়ি ও উপজেলার তুর্মব সীমান্ত পয়েন্ট। এসব পয়েন্টের পাশাপাশি টেকনাফ স্থলবন্দর ও শাহপরীর দ্বীপ করিডর দিয়ে ট্রলারে আসছে ইয়াবার বড় বড় চালান।
রাজনীতি : টেকনাফে কোনো রাজনীতি নেই। নেই কোনো দলাদলি। মাঝেমধ্যে টেকনাফের সরকারদলীয় এমপি আবদুর রহমান বদির কর্মকান্ড নিয়ে হৈচৈ হয়। এতটুকুই। স্থানীয়রা বলেছেন, টেকনাফে রাজনীতিকরা রাজনীতি নিয়ে ব্যস্ত নন, তারা সবাই ব্যস্ত ইয়াবা ব্যবসা নিয়ে। ইয়াবা ব্যবসায়ই এখানকার রাজনীতি, অর্থনীতিসহ সবকিছুর মূলে। ইয়াবা ব্যবসার প্রশ্নে রাজনীতিকদের মধ্যে কোনো দ্বন্দ্ব নেই। কেন্দ্র থেকে কী বলল না বলল, তাতে টেকনাফের রাজনীতিকদের কোনো মাথাব্যথা নেই। ইয়াবার চালান আসছে কি না ঠিকমতো, এটাই তাদের মূল রাজনীতি।
বৈধ ব্যবসায় ধস : অবাধে ইয়াবা আসায় একদিকে কমছে টেকনাফ স্থলবন্দরের রাজস্ব, অন্যদিকে কমছে মিয়ানমারের মুদ্রার বিপরীতে এ দেশীয় টাকার মান। ফলে ভারসাম্য হারাচ্ছে অর্থনীতি। উৎসাহিত হচ্ছে চোরাচালান ও হুন্ডি ব্যবসা। পাচার হচ্ছে অবৈধ পথে বৈদেশিক মুদ্রা। অনুসন্ধানে জানা গেছে, আগের তুলনায় গত কয়েক বছরে ক্রমাগত কমছে টেকনাফ স্থলবন্দরের রাজস্ব। এ আয়ের পরিমাণ আগে ছিল ঊর্ধ্বমুখী। কিন্তু এখন প্রতি বছরই এ আয় কমছে। এ দেশের যুবসমাজের মতোই ইয়াবা গিলে খাচ্ছে দেশের অর্থনীতিও। অবাধে ইয়াবা আসায় এ অবস্থা তৈরি হয়েছে।টেকনাফ স্থলবন্দরের এক দায়িত্বশীল সূত্র নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আগে বিভিন্ন আমদানিপণ্যের ভেতরে লুকিয়ে ইয়াবার চালান আনা হতো বলে শুনেছি। কিন্তু এখন এ বন্দর ইয়াবার গডফাদার ও আর্ন্তজাতিক মাফিয়াদের হাতে চলে গেছে। তাদের সহায়তায় ইয়াবা ব্যবসায়ীরা আর কোটি কোটি টাকার আমদানিপণ্যের ভেতরে ইয়াবা পাচারে নির্ভরশীল নন, সরাসরি দুটি বা তিনটি প্যাকেটে ইয়াবা নিয়ে এলেই হয়। এসব প্যাকেট যেহেতু ঘোষণা ছাড়াই ইয়াবার গডফাদারদের হাতে পৌঁছে যায়, তাই বন্দরকেও রাজস্ব দিতে হয় না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশকে ইয়াবামুক্ত করতে প্রয়োজনে মায়নামার সীমান্ত স্থায়ী বন্ধ রাখা হোক।

0 comments:

Post a Comment