Wednesday, August 17, 2016

মাদকমুক্ত হোক সীমান্ত


মাদকমুক্ত হোক সীমান্ত
আলী ফোরকান
সীমান্তে মাদক চোরাচালান উদ্বেগজনকভাবে বেড়ে গেছে। দেশের আইন রক্ষাকারি বাহিনীকে ফাকি দিয়ে জয়পুরহাট,  চাঁপাইনবাবগঞ্জ মাদক ব্যবসায়ীরা সক্রিয় হয়ে উঠেছে। অশান্ত করে তুলেছে যুবকদের। মাদকসেবী আর মাদক ব্যবসায়ীদের তোপের মুখে মুখ খুলতে সাহস পাচ্ছে না। চাঁপাইনবাবগঞ্জ জয়পুরহাট সীমান্তবর্তী জেলা হওয়ায় এখানে ফেনসিডিল ও মাদকদ্রব্য বেশ সহজলভ্য। ফলে জেলায় এখন ফেনসিডিল ও মাদকদ্রব্যের ছড়াছড়ি। এক কথায় মাদকে ভাসছে চাঁপাইনবাবগঞ্জ,জয়পুরহাট। এসব জেলার বিভিন্ন এলাকার বসবাসকারি বাবা-মায়ের আকুতি, বাবা আমার ছেলেকে বাঁচাও। বাসায়ও স্বাভাবিক আচরণ করে না। আমার খুব সন্দেহ হয়। খোঁজ নিয়ে জানা যায় তার ছেলে বেশ কয়েক মাস ধরে মাদকাসক্ত হয়ে পড়েছে। এরকম আরো অনেক পরিবারের একই আকুতি। তারা বলেন, জেলায় মাদকসেবীদের সংখ্যা বিপজ্জনকভাবে বেড়ে গেছে। প্রশাসনের দৃষ্টি আর্কষণ করেও পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হচ্ছে না। ইতিপূর্বে অনেক ছেলেকে মাদকাশক্ত পুনর্বাসন হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে স্বাভাবিক হলেও পরিবেশগত কারণ ও মাদকদ্রব্য সহজলভ্য হওয়ায় পুনরায় তারা মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে। জয়পুরহাট জেলার সীমন্তবর্তী এলাকার অধিকাংশ বেকার যুবক ফেনসিডিল ও মাদক ব্যবহারের সাথে জড়িত। এরা ভারতের দক্ষিণপাড়া, উজাল, ইন্ডিয়া হিলি, হাড়িপুকুর, বাংলাপুর, পতিরামপুর, শিয়ালা, বাঙ্গালীপুরসহ প্রভৃতি সীমান্ত অঞ্চল খুব নিকটে হওয়ায়, বাংলাদেশের সীমান্তঘেঁষা চেচড়া, আটাপাড়া, পাঁচবিবি, বাগজানা, কল্যাণপুর, ভিমপুর, রামচন্দ্রপুর, রতনপুর, সোনাতলা, চানপুর, উচনা, ঘোনপাড়া, শেকটা, ঘোরপা, বরনখোলা, সোনাপুর, ভালকুগাড়ী, চকশমশের, নওদা, ভুটিয়াপাড়া, রামকৃষ্ণপুর এলাকার এক শ্রেণীর অসাধু মাদক ব্যবসায়ী সীমান্তের উপরোল্লিখিত এলাকা থেকে প্রতিদিন হাজার হাজার বোতল ফেনসিডিল ও মাদকদ্রব্য পাচার করে এনে ঐসব গ্রামে মজুদ রাখে। পরে বাস, ট্রাক, মাইক্রোবাস, ট্রেনযোগে ও বিভিন্ন যানবাহনে জেলার অভ্যন্তরে এবং দেশের বিভিন্ন স্থানে নিয়ে যাচ্ছে নির্বিঘেœ। বর্তমানে জেলার ৬০টি পয়েন্টে ফেনসিডিল ও মাদকের কেনা-বেচা চলছে নির্বিঘেœ। এর মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য জেলা সদর ভাদসা কলোনি, ভাদসা লাইলীপাড়া, পাটনিপাড়া, কামারপাড়া, দুগাঁদহ বাজার, তেঘর রেলগেট, তাজুর মোড়, সাগরপাড়া রেলবস্তি, নতুন হাট গোস্তহাটির পার্শ্বে, সুইপার কলোনি, বিশ্বাসপাড়া, পিয়নপট্টি, ভোয়াতাপাড়, পাহাড়পুর বাসস্ট্যান্ড, জয়পুরহাট স্টেশনের পাশে ফুলতলী মোড়, চিত্রাপাড়া, সৈয়দ আলীর মোড়, জামতলী বাজার, গতনশর পাঁচবিবির বাগজানা বাজার, নাকুরগাছী, বড়নারায়ণপুর, বালিখাটা বাজার, রেলবস্তি, হরিপুর, নওদা, ঘোড়াপা, চেচরা, সোনাপুর, ভিমপুর, আটাপাড়া, পূর্ব-পশ্চিম রামচন্দ্রপুর, চানপুর, রতনপুর, রতপাড়া কালাই সিনামা হলের পাশে কলেজপাড়া, পুনট, মোলামগাড়ী, কাদিরপুর, মোলামগাড়ী, কাজীপাড়া, আক্কেলপুর হাস্তা বশন্তপুর, চৌধুরীপাড়া, রেল কলোনি, গুপিনাথপুরসহ জেলার ৬০টি পয়েন্ট মদ, ফেনসিডিল বিক্রি হচ্ছে দেদার। শত শত যুবক, ছাত্র, রিকশা-ভ্যান চালক, ট্রাকের ডাইভার, হেলপার, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী এই ৬০টি পয়েন্ট থেকে মাদকদ্রব্য কেনে। এছাড়া জেলার আক্কেলপুর উপজেলার জামালগঞ্জ জগাপাড়া এলাকার চোলাই মদ বিশাল আস্তানা থেকেও প্রতিদিন কয়েক হাজার লিটার চোলাই মদ জেলার বিভিন্ন স্থানে মঙ্গলবাড়ী দিনাজপুর জেলার হাকিমপুর এলাকায় সরবরাহ করা হয়। জয়পুরহাটের ৩০ শতাংশ যুবকই কোনো না কোনো মাদকে আসক্ত। মাদকসেবীদের মতে, এর হার আরো বেশি। জয়পুরহাট মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অফিস সূত্র জানায়, জয়পুরহাট সদর, পাঁচবিবি ও আক্কেলপুর উপজেলায় একটি করে সরকার অনুমোদিত মাদকের দোকান রয়েছে। এদের মধ্যে জয়পুরহাট সদরে ১০০ লিটার, পাঁচবিবি-৫০, আক্কেলপুর উপজেলার ৫০ ও কালাই ৫০, ক্ষেতলালে ৫০ লিটার করে মোট ২০০ লিটার মদ বরাদ্দ থাকলেও প্রতি মাসে জেলায় মদ বিক্রি হয় ২০ লিটার। জেলা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা বলেন, আমাদের সোর্স মানি, জনবলের অভাবসহ অনেক সীমাবদ্ধতা রয়েছে। ফলে আমরা আশানুরূপ কাজ করতে পারছি না। তাছাড়া বিষয়টি অত্যন্ত স্পর্শকাতর। এ ব্যপারে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে এবং সবাইকে সহযোগিতা করতে হবে। বিজিবির দিনাজপুর সেক্টর কমান্ডার কর্নেল বলেন, ইতিপূর্বে মাদকদ্রব্য চোরাচালানে যা হয়েছে সামনের দিনে আর তা হবেনা। নিজ ইমান ও অন্তর দিয়ে মাদক চোরাচালান পতিরোধ করা হবে। তিনি সমাজ ও দেশের স্বার্থে এ কাজে সকল শ্রেণী-পেশার মানুষের সার্বিক সহযোগিতা কামনা করেন। জেলা পুলিশ বলেন, মাদকদ্রব্য প্রতিরোধের ব্যপারে জেলা পুলিশ আপ্রাণ চেষ্টা করছে। প্রতিদিন মাদকদ্রব্য উদ্ধার এবং মাদক ব্যবসায়ী গ্রেফতার অব্যাহত রয়েছে। অপরদিকে 
অনেকের দাবি শুধুমাত্র বাংলাদেশে পাচারের জন্য তৈরি নিম্নমানের ভারতীয় ফেনসিডিলে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা শহর সয়লাব হয়ে গেছে। প্রকাশ্য এবং অবাধে নবাবগঞ্জ শহরে চিহ্নিত শতাধিক পয়েন্টে ফেনসিডিল বেচাকেনা হচ্ছে। আমের আড়ালে প্রতিদিন ট্রাকভর্তি হয়ে হাজার হাজার বোতল ফেনসিডিল ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় অবাধে চলে যাচ্ছে। হঠাৎ করে দাম কমে যাওয়ায় এর ব্যবহার ও বেচাবিক্রি চরম হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। মূলত এর গ্রাহক স্কুল-কলেজের তরুণ যুবক ছাত্ররা। এ অবস্থায় উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে অভিভাবক মহল। জেলার যুব ও তরুণ সমাজের বিশাল একটি অংশ মাদকের নেশায় আসক্ত হয়ে পড়লেও প্রশাসনের তেমন নজরদারি নেই। চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরের ঢাকা বাসস্ট্যান্ড, স্টেডিয়াম মোড়, সোনালী ব্যাংক সংলগ্ন এলাকা, সন্ধ্যা সিনেমা হল মোড়, রেলবস্তি, রেলস্টেশন, উসকাঠিপাড়া, গুড়িপাড়া, চন্ডিড়লা, পশ্চিমপাড়া, শিউতলা মোড়, ভেলুর মোড়, পিটিআই বস্তিপাড়া, বালুবাগান, আরামবাগ, রামকৃষ্ণপুর, আজাইপুর, সংকরবাটি, রাজারামপুর ও শহরতলীর বারোঘরিয়া, মহারাজপুর-ঘোড়াস্ট্যান্ড, চক আলামপুর, রাম চন্দ্রপুরহাটসহ নবাবগঞ্জ সদর, শিবগঞ্জ, ভোলাহাট, গোমস্তাপুর ও নাচোল উপজেলার চিহ্নিত শতাধিক পয়েন্টে অবাধে ফেনসিডিল বেচাকেনা ও ব্যবহার হচ্ছে। এসব ফেনসিডিল সীমান্ত পেরিয়ে ভারত থেকে আসছে। ২৫ ফেব্রুয়ারি পিলখানা ঘটনার পর ফেনসিডিল চেরাচালান চরমভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। অধিক পরিমাণ আমদানি হওয়ায় এর মূল্য একেবারে কমে গেছে। আর মূল্য কমে যাওয়ায় মাদকাসক্ত স্কুল-কলেজের ছাত্র তরুণদের কাছে ফেনসিডিল হাতের নাগালে চলে এসেছে। চরমভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে এর ব্যবহার ও বিক্রি। সীমান্ত এলাকার একটি সূত্র জানিয়েছে, ভারত হতে পাচার হয়ে আসা ফেনসিডিল আসলে কোনো কফ সিরাপ নয়। এটি শুধুমাত্র বাংলাদেশে পাচারের উদ্দেশ্যে তৈরি হচ্ছে। ভারতের একটি ওষুধ কোম্পানি কফ সিরাপ হিসেবে ফিনসিডিল তৈরি করলেও সেই ফেনসিডিল বাংলাদেশে আসে না। সূত্র জানিয়েছে, ভারতের বিভিন্ন সীমান্ত এলাকায় প্রচুর ফেনসিডিল তৈরির কারখানা গড়ে উঠেছে। যেখানে তৈরি হচ্ছে নেশাজাতীয় নিম্নমানের ফেনসিডিল। যা সবই পরিকল্পনামাফিক এদেশের ছাত্র, তরুণ-যুবসমাজকে ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে অবাধে পাচার হয়ে আসছে। এদিকে চরমভাবে ফেনসিডিলের দাম কমে যাওয়ায় দেশের বিভিন্ন জেলার মাদক ব্যবসায়ীরা এখন চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে ফেনসিডিল নিয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে ভরা আম মৌসুম হওয়ায় এখন ফেনসিডিল পাচার খুবই সহজ হয়ে পড়েছে। আমের আড়ালে কুখ্যাত চোরাচালানিরা প্রতি বছর লাখ লাখ বোতল ফেনসিডিল দেশের বিভিন্ন জেলায় নিয়ে যায়। একেবারে দাম কমে যাওয়ায় বর্তমানে ফেনসিডিলের মজুদ যেমন বেশি ঠিক তেমনি বিভিন্ন জেলায় পাচারও বেশি হচ্ছে।চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার শিবগঞ্জ থানার ঐতিহ্যবাহী একটি ইউনিয়ন শাহবাজপুর। এখানে রয়েছে অনেক দর্শনীয় স্থান। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলÑ ছোট সোনা মসজিদ। অন্য অনেক এলাকার তুলনায় এখানে চাঁদাবাজির ঘটনা অনেক কম। তবে বর্তমানে ছাত্র ও যুব সমাজকে ধ্বংস করে দিয়েছে মাদক ও ফেনসিডিলের রমরমা ব্যবসা। যেখানে ছাত্রদের হাতে বই-কলম-খাতা নিয়ে সুন্দর সুশৃংখল জীবনযাপন করার কথা, সেখানে তাদের কাছে থাকে ফেনসিডিলের বোতল। এভাবে নেশাগ্রস্থ হয়ে তারা জড়িয়ে পড়ছে নানা অপকর্মে। আর এ কাজে সহযোগিতা করতে এদের পেছনে রয়েছে একটি শক্তিশালী মাদকচক্র। এ মাদক ব্যবসায়ী চক্র অনেক ক্ষমতাসম্পন্ন। তারা বিভিন্ন বর্ডার, যেমন হুদমা তেলকুপির বিভিন্ন স্পট দিয়ে বিজিবি ও বিএসএফের চোখ ফাঁকি দিয়ে এনে থাকে মাদক। বাবার সামনেই ছাত্র ও যুবকরা হয়ে পড়ছে নেশাগ্রস্থ। এতে করে সমাজ শেষ হয়ে যাচ্ছে। অনেকের অভিযোগ,প্রশাসন এদের থেকে নিয়মিত কমিশন পায় বিধায় এদের বিরুদ্ধে কোন আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণে এগিয়ে আসছে না। এটাকে নির্মূল করতে হলে মানুষকে সচেতন করতে হবে এবং সীমান্ত এলাকায় নজরদারি বাড়াতে হবে। শান্তিপ্রিয় ও সহজ-সরল যুবকদের ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করতে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
 লেখক:গবেষক ও সাবেক অধ্যক্ষ
ড.ফোরকান আলী
০১৭১১৫৭৯২৬৭




0 comments:

Post a Comment