মাদক ও নিয়ন্ত্রণ আইন
আলী ফোরকান
সারাদেশে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের দায়ের করা মামলার জট বেড়েই চলেছে। মামলা দায়েরের তুলনায় নিষ্পত্তির হার কম। আর বেশির ভাগ মামলায় অভিযুক্তরা খালাস পেয়ে যাচ্ছে। মৃত্যুদ- এবং যাবজ্জীবন সাজার পরিমাণ হাতেগোনা কয়েকটি। বেশির ভাগ সাজাই তিন বছরের কম। এর কারণ অনুসন্ধানে দেখা গেছে, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে দায়ের করা মামলা পরিচালনায় রয়েছে ত্রুটি। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে প্রসিকিউটরের অভাব। মামলা তদন্ত এবং প্রতিবেদনেও রয়েছে গলদ। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থাগুলোর মধ্যেও রয়েছে সমন্বয়হীনতা। সারাদেশে বিভিন্ন আদালতে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের দায়ের করা মাদকদ্রব্য আইনে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা প্রায় ৪২ হাজার। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের মামলাগুলো প্রথম এজাহার আকারে থানায় রুজু করার পর তদন্ত প্রক্রিয়া শুরু হয়। এ তদন্তের দায়িত্ব থাকে অধিদফতরের পরিদর্শকদের ওপর। পরিদর্শকেরা তদন্ত শেষে আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করেন। মামলার বিচার শুরু হয় আদালতে। বিধি অনুযায়ী এ মামলাগুলো পরিচালনা করার কথা অধিদফতরের প্রসিকিউশন বিভাগের। প্রসিকিউটররাই অধিদফতরের পক্ষে মামলা পরিচালনা করবেন। কিন্তু প্রতি জেলায় প্রসিকিউটর অফিস স্থাপিত হয়নি। বর্তমানে শুধু ঢাকাতে প্রসিকিউশন বিভাগ রয়েছে। চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও খুলনায় প্রসিকিউশন সেল রয়েছে শুধু কাগজে কলমে। বাস্তবে অকার্যকর । ঢাকার প্রসিকিউশন অফিস সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা আর লোকবলের অভাবে কাজে ধীরগতি। যে কয়জন কর্মকর্তা রয়েছেন, তাদের দেয়া টাকা থেকে পিয়নের বেতন দেয়া হয়। নেই কম্পিউটার এবং টেলিফোন। মামলার সংখ্যার অনুপাতে আদালত পরিদর্শক নেই। অন্যান্য জেলায় প্রসিকিউশন বিভাগ নেই, সেখানে থানার পরিদর্শকেরা কিংবা এপিপিরা মামলা পরিচালনায় নিয়োজিত থাকেন। মামলা নিষ্পত্তিতে বিলম্ব এবং সাজা কম হওয়ার পেছনে সব জায়গায় প্রসিকিউশন বিভাগ না থাকায় দায়ী বলে মনে করছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর। আবার প্রসিকিউশন বিভাগের কাজ শুধু মামলার বিচার শুরু হওয়া পর্যন্তই অর্থাৎ চার্জশিট দেয়া পর্যন্ত। বিচার শুরু হলে মামলার পরিচালনার কাজ বর্তায় পিপি এপিপিদের ওপর। অধিদফতরের একাধিক তদন্ত পরিদর্শকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মামলার বিচার-প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার পর তাদের মামলার সাক্ষী হওয়া ছাড়া কোনো ভূমিকা থাকে না। কিন্তু আইন কর্মকর্তারা এ মামলাগুলো জোরালোভাবে পরিচালনা করতে চান না। ফলে সাজার পরিমাণ কমে যাচ্ছে। আসামিপক্ষের আইনজীবীদের তুলনায় রাষ্ট্রপক্ষের ভূমিকা কম থাকে। প্রসিকিউশন বিভাগকে শক্তিশালী করার বিকল্প নেই বলে তারা মনে করছেন। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের মামলাগুলো পরিচালনার জন্য বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠনের প্রয়োজন বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। ঢাকা মহানগরে বর্তমানে দুটি আদালতকে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের মামলা পরিচালনার এখতিয়ার দেয়া হয়েছে। এখানে অধিদফতরের মামলা ছাড়াও অন্যান্য সংস্থা যেমন পুলিশ, র্যাবের দায়ের করা মাদকের মামলার কার্যক্রম পরিচালিত হয়। তবে মামলাগুলোতে চার্জশিট এলে চার্জ গঠন থেকে পরবর্তী বিচারিক কাজগুলো বিচারিক আদালতে পাঠিয়ে দেয়া হয়। এর ফলে মামলাগুলো অন্যান্য মামলাগুলোর সঙ্গে বিচারকাজ চলে। এতে মাদকের মামলাগুলো নিষ্পত্তিতে দীর্ঘসূত্রতা তৈরি হয়। ঢাকা, ময়মনসিংহ, রাজশাহী ও চট্টগ্রামে আদালতে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পাঁচ-ছয় বছর আগের মামলা এখনো চলছে। বিচারকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মাদক মামলা বিচারে প্রধান প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে সাক্ষ্য জটিলতা। অধিকাংশ মামলায় সাক্ষী আসে না। সাক্ষীর বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট জারি হলেও সাক্ষী পাওয়া যায় না। সাক্ষ্যে দুর্বলতার কারণে মামলায় সাজার হার কম বলে তারা জানান। আবার জব্দকৃত আলামত প্রমাণেও দুরূহ হয়ে পড়ে বলে বিচারকেরা জানিয়েছেন। অনেক মামলায় তদন্ত কর্মকর্তাদের সাক্ষ্য হয় না সময়মতো। মাদক মামলার দ্রুত নিষ্পত্তিতে বড় বাধা হচ্ছে, আইনে তদন্তের জন্য সময় বেধে দেয়া হলেও মামলা নিষ্পত্তি কত দিনের মধ্যে হবে, এর বাধ্যবাধকতা নেই। বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন না হলে এবং বিচারকের সংখ্যা না বাড়ালে মামলার নিষ্পত্তিতে দীর্ঘসূত্রতা বেড়ে যাবে বলে মনে করছেন অধিদফতরের কর্মকর্তারা। মাদকের মামলাগুলো পরিচালনায় রয়েছে সমন্বয়হীনতার অভাব। প্রতিটি সংস্থাই নিজেদের মতো করে মামলা পরিচালনা করে। বিধি অনুযায়ী, অধিদফতরের মামলার তদন্তের কাজে র্যাব ও পুলিশ কর্মকর্তাদের সহায়তা চাওয়ার এখতিয়ার আছে। কিন্তু কোনো তদন্তকাজে পর্যাপ্ত লোকবল পাচ্ছেন না বলে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। তা ছাড়া কোনো অপারেশনে গেলে অস্ত্র ও গাড়ির অভাব রয়েছে পরিদর্শকদের। পুলিশ ও র্যাবের দায়ের করা মামলার পরিস্থিতি অধিদফতরে অবগত করা হয় না। জামিন বাতিলের আবেদন আসে না: সাধারণত দেখা যায়, কোনো মামলায় নিম্নআদালতে জামিন নিয়ে অভিযুক্তরা আবার মাদক অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। ফৌজদারি কার্যবিধি অনুযায়ী এ কারণে জামিন বাতিল চেয়ে আবেদনের সুযোগ রয়েছে। আদালতে অনুসন্ধান করে দেখা গেছে, এ কারণে কোনো অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে জামিন বাতিল চেয়ে আবেদন আসে না। গুটিকয়েক মামলায় এলেও জামিন বাতিলের আবেদন মঞ্জুর হয় না। এ সুযোগে অভিযুক্তরা অপরাধ চালিয়ে যায় নির্বিঘেœ। মাদক-বিক্রেতাদের সঙ্গে পুলিশের সম্পর্কটি চোর-পুলিশ খেলার নিয়মেই চলছে। মাঝে মধ্যে মাদকের আখড়া উচ্ছেদ হয়, বিক্রেতাদের হাজতে পাঠানো হয়, কিন্তু অচিরেই নতুন জায়গায় নতুন মানুষ মাদক ব্যবসার জাল নিয়ে বসে। বহু ক্ষেত্রেই মাদক ব্যবসার বখরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাও পেয়ে থাকেন। দেশের অনেক রাঘব বোয়ালও এসবের সঙ্গে জড়িত। বাংলাদেশের মাদকাসক্তদের মধ্যে ফেনসিডিল ও গাঁজাসেবীরাই বেশি। এ দুটো মাদক চোরাইপথে ভারত থেকে আসে। সীমান্তে এ বিষয়ে কঠোর নজরদারি থাকলে পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে। দ্বিতীয়ত, হেরোইন কোকেইন ও ইয়াবার মতো মারাত্মক নেশাদ্রব্য আসে আকাশপথে। বিমানবন্দরের কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে এরও নিবারণ সম্ভব। মূলত শহরাঞ্চলেই মাদকের প্রসার বেশি। বিভিন্ন তথ্য থেকে অনুমান করা যায়, নাগরিক-জীবনের বিচ্ছিন্নতা, মানসিক চাপ, বিনোদনের অভাব ও নিঃসঙ্গতা থেকেই শহুরে তরুণ-তরুণীদের মধ্যে মাদকের প্রতি আকর্ষণ জন্মে। বেকারত্বজনিত হতাশাও মাদকাসক্তি বাড়ায়। দীর্ঘমেয়াদে নগরের জীবনকে আনন্দময় ও মেলামেশার উপযোগী করা এবং বেকারত্ব দূর করার মাধ্যমে মাদকের বিস্তার কিছুটা কমতে পারে।
প্রতিরোধের পাশাপাশি প্রতিকারের দিকে নজর দিতে হবে। তারুণ্যকে মাদকমুক্ত করতে না পারলে জাতির ভবিষ্যৎও মাদকের গ্রাসে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তরুণদের মধ্যে আশা-জাগানো, ইতিবাচক কর্মকা-ে তাদের জড়িত করার সামাজিক আন্দোলন দরকার। এ কাজে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, গণমাধ্যম এবং সরকারের করণীয়ই এ ব্যাপারে প্রধান। বন্ধু-পরিজন ও পরিবারের থেকে বিচ্ছিন্নরাই মাদকের খপ্পরে আগে পড়ে। পরিবারের অভিভাবকদের উচিত, শৈশব শাসনের বদলে তাদের বন্ধু হয়ে ওঠার চেষ্টা করা। তবে সবার আগে মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত গডফাদারদেরও চিহ্নিত করতে হবে, বিকল্প কর্মসংস্থানের মাধ্যমে মাদক-বিক্রেতাদের এ পথ থেকে সরিয়ে আনার ব্যবস্থাও প্রয়োজন। মাদক বিক্রির সঙ্গে জড়িত শিশুদের জন্য সংশোধনের মাধ্যমে আশ্রয় ও পড়ালেখার ব্যবস্থা করা যায়। যারা মাদকের পথ ছাড়তে আগ্রহী, তাদের জন্য চিকিৎসার বন্দোবস্ত বাড়াতে হবে। দেশি-বিদেশি অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, মাদক নিয়ন্ত্রণের বড় পথ হলো, সামাজিক প্রতিরোধের পাশাপাশি আইনের যথাযথ প্রয়োগের মাধ্যমে এ সর্বনাশা পণ্যটির প্রাপ্তি কঠিন করে তোলা। এ থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে তল্লাশি অভিযান পরিচালনা, তদন্ত করা, উদ্ধারকৃত দ্রব্যের রাসায়নিক পরীক্ষা যথাযথভাবে করার বিষয়ে আইনে বর্ণিত বিধান যথাযথভাবে অনুসরণ করতে হবে। সেই সঙ্গে আদালতে সঠিকভাবে সাক্ষ্য প্রমাণ উপস্থাপন করতে হবে, খামখেয়ালিভাবে নয়, আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই তা করতে হবে। সব ক্ষেত্রে সুষ্ঠু নজরদারি রাখতে হবে। এসবের অভাবের কারণেই মাদকদ্রব্যসংক্রান্ত আইনটি জনজীবনে সুবাতাস প্রবাহিত করতে পারছে না।
0 comments:
Post a Comment