Monday, August 1, 2016

মাদক: অ্যাডভেঞ্চারের পেছনে ছুটছে


মাদক: অ্যাডভেঞ্চারের পেছনে ছুটছে
আলী ফোরকান
মাদকের ভয়াল ছোবলে সারাদেশ। দিন দিন বাড়ছে মাদকাসক্তের সংখ্যা। এক সময় বেকার আর হতাশাগ্রস্থরা বিপথগামী হয়ে নেশার জগতে পা বাড়াত। আর এখন মাদক সেবন পরিণত হয়েছে ‘হাল ফ্যাশনে’। স্কুল ও কলেজগামী ছাত্রছাত্রী থেকে শুরু করে নেশার হাতছানিতে পা বাড়াচ্ছেন বিভিন্ন বয়স ও পেশার নারী-পুরুষ। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক ছাত্রছাত্রী দিনের পর দিন নীল নেশায় বুঁদ হয়ে থাকছে। মরণ নেশার কবলে পড়ে দিনে দিনে দেশের তরুণ সমাজের বড় একটি অংশ অতল গহ্বরে তলিয়ে যাচ্ছে। সংশ্লি¬ষ্ট সূত্রগুলো জানায়, এক সময় এ ব্যবসার মাফিয়ারা মাদক পাচারে আর্ন্তজাতিক রুট হিসেবে ব্যবহার করত বাংলাদেশকে। আর এখন বাংলাদেশকেই তারা মাদক ব্যবসার টার্গেটে পরিণত করেছে। দেশে মাদকসেবীর প্রকৃত সংখ্যা কত তার সঠিক পরিসংখ্যান কারও কাছে নেই। তবে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ফ্যামেলি হেলথ ইন্টারন্যাশনালের হিসাব অনুযায়ী এ সংখ্যা প্রায় অর্ধকোটি। আর সারাদেশে মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত রয়েছে লক্ষাধিক নারী ও পুরুষ। কূটনীতিক ও আর্ন্তজাতিক সংস্থায় কর্মরতদের জন্য আনা বিদেশী মদ-বিয়ারে সয়লাব হয়ে গেছে রাজধানীসহ দেশের সর্বত্র। কূটনৈতিক বন্ডেড ওয়্যারহাউসগুলো বিভিন্ন কৌশলে পাচার করছে শত শত কোটি টাকার শুল্কমুক্ত মদ-বিয়ার। হরিলুট চলছে হাজার কোটি টাকার সরকারি রাজস্বের। শক্তিশালী একটি সিন্ডিকেট অবৈধ এ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর বলছে, তারা তাদের সাধ্য মতে মাদকের ভয়াবহ এ বিস্তার রোধে কার্যকর ভূমিকা রাখতে চেষ্টা চালাচ্ছে। দেশের মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রগুলোর অবস্থা ও নাজুক। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নানা নামে মাদকের বিস্তার ঘটছে। সূত্রগুলো আরও জানায়, বর্তমানে দেশে ৩২ প্রকার মাদক সেবন চলছে। আর প্রতি বছর মাদক ক্রয়ে বিপুল পরিমাণ দেশী-বিদেশী মুদ্রা পাচার হয়ে যাচ্ছে। বানের পানির মতো মাদক এলেও ধরা পড়ছে মাত্র ১০ শতাংশ। এসব ঘটনায় মামলা হলেও সাক্ষীপ্রমাণের অভাবে ছাড়া পেয়ে যাচ্ছে অভিযুক্তরা। 
যে পথে মাদক আসছে : সংশি¬ষ্ট সূত্রগুলো জানায়, বাংলাদেশে মাদকের বড় বড় চালানগুলো আসছে ভারত  ও মায়সামার থেকে। বিস্তীর্ণ সীমান্তপথ দিয়ে মাদকের চালান ঢুকছে দেশে। সীমান্ত পেরিয়ে ঢুকছে ফেনসিডিল, হেরোইন, গাঁজা, ইয়াবাসহ নানা মাদক। শুধু বাংলাদেশে সরবরাহের জন্য প্রতিবেশী দেশের বিস্তীর্ণ সীমান্ত এলাকায় গড়ে উঠেছে অসংখ্য মাদকের কারখানা। বিশেষ করে যশোরের বেনাপোল, হরিদাসপুর, সাতক্ষীরার তালা, কলারোয়া, রাজশাহীর গোদাগাড়ী, চাঁপাইনবাবগঞ্জের সোনামসজিদ, জীবননগর, পোড়াদহ, কুড়িগ্রাম, কুমিল¬ার আখাউড়া, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা, দিনাজপুরের হিলি, কুড়িগ্রামের ভুরুঙ্গামারী, ভোমরা, চিলাহাটি, বুড়িমারী, কুলিয়ারচর, সিলেটের জাফলং সীমান্ত দিয়ে মাদক ঢুকছে। মিয়ানমার থেকে টেকনাফ সীমান্তপথে কক্সবাজার হয়ে অবৈধভাবে বাংলাদেশে ঢুকছে হেরোইন, ইয়াবা, বিয়ার ও বিদেশী মদের বড় বড় চালান। সরকারের রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে আনা মাদকের এসব চালান রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন বার ও ক্লাবে অবাধে বিক্রি হচ্ছে। 
মাদকের ব্যবহার : মরণ নেশা এখন ছড়িয়ে পড়েছে ধনীর দুলালদের মাঝে। তাদের কাছে নেশা এখন ‘ফ্যাশনে’ পরিণত হয়েছে। ‘হাই সোসাইটির এসব সদস্য নীল নেশায় বুঁদ হয়ে থাকছে দিনের পর দিন। এক্ষেত্রে মেয়েরাও পিছিয়ে নেই। বাবার অফুরন্ত টাকা আর পরিবারের উদাসীনতায় এক ধরনের অ্যাডভেঞ্চারের পেছনে ছুটছে তারা। বিশেষ করে গুলশান, বনানী, বারিধারা, উত্তরা ও ধানমন্ডির অভিজাত এলাকাগুলোতে হেরোইন ও বিদেশী মদের পাশাপাশি হাল আমলের ইয়াবা ট্যাবলেট ব্যবসা জেঁকে বসেছে। ধনীর বখে যাওয়া ছেলেমেয়েদের পুঁজি করে এসব এলাকায় একের পর এক গড়ে উঠছে বার ও ক্লাব। সময় কাটাতে ধনীর দুলালরাও এসব এলাকায় বাসা ভাড়া করে গড়ে তুলছে তাদের আলাদা ভুবন।  
মাদকের বৃহৎ চালান : ২০০৭ সালের ১২ নভেম্বর বেইজিং পাচারকালে শাহজালাল আর্ন্তজাতিক বিমানবন্দরে ধরা পড়ে ২৪ কেজি হেরোইন। এর আগে ছোটখাটো মাদকের চালান ধরা পড়লেও প্রায় ২৪ কোটি টাকা মূল্যের ওই হেরোইন ধরা পড়ার পর টনক নড়ে সরকারের। বাংলাদেশ মাদক পাচারের ট্রানজিট হিসেবে ব্যবহারের বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে পড়ে। সম্প্রতি বিমানবন্দরে ৫ কেজি হেরোইনের আরও একটি চালান ধরা পড়েছে। এছাড়া মালয়েশিয়া পাচারের সময় প্রায় শত কোটি টাকা মূল্যের ৮৪ কেজি মাদকের কাঁচামাল ‘এমপিটান’ উদ্ধার করে শাহজালাল আর্ন্তজাতিক বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ। মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে বিভিন্ন সময়ে ইয়াবা উদ্ধার করে। 
চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ী : স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ফ্যামেলি হেলথ ইন্টারন্যাশনালের হিসাব অনুযায়ী সারাদেশে চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ীর সংখ্যা লক্ষাধিক। এর মধ্যে নারী ব্যবসায়ীর সংখ্যা ১০ শতাংশ। রাজধানীতে মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করে থাকে এমন ১১৬ জনের একটি তালিকা করেছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর। বিভিন্ন থানা এলাকায় অনুসন্ধান চালিয়ে সম্প্রতি তারা এ তালিকাটি করে। তবে মাঠ পর্যায়ের এসব ব্যবসায়ীর গডফাদার কারা তা এখনও পর্দার আড়ালেই রয়ে গেছে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর মাদক ব্যবসায়ীদের চিহ্নিত করতে রাজধানীকে ১৪ উপ-অঞ্চলে ভাগ করেছে। 
৩২ ধরনের মাদক : দেশে বর্তমানে ৩২ ধরনের মাদক সেবন চলছে। এ পর্যন্ত ভিন্ন ভিন্ন নামের যেসব মাদক উদ্ধার হয়েছে সেগুলো হচ্ছেÑ হেরোইন, গাঁজা, চোলাই মদ, দেশী মদ, বিদেশী মদ, বিয়ার, রেক্টিফাইড স্পিরিড, কেডিন, ফেনসিডিল, তাড়ি, প্যাথেডিন, ব্রুপ্রেনরফিন, টিডি জেসিক, ভাং, কোডিন ট্যাবলেট, ফার্মেন্টেড, ওয়াশ (জাওয়া), বনোজেসিক ইনজেকশন (বুপ্রেনরফিন), টেরাহাইড্রোবানাবিল, এক্সএলমুগের, মরফিন, ইয়াবা, আইচপিল, ভায়াগ্রা, সানাগ্রা, টলুইন, পটাশিয়াম পারম্যাঙ্গানেট, মিথাইল, ইথানল, কিটোন। এছাড়া ইনোকটিন, সিডাক্সিনসহ বিভিন্ন ঘুমের ট্যাবলেট, জামবাকসহ ব্যথানাশক ওষুধ কিংবা টিকটিকির লেজ পুড়িয়ে কেউ কেউ নেশা করে থাকে।
১০ হাজার কোটি টাকা পাচার : সংশি¬ষ্ট সূত্র জানায়, অবৈধ মাদক আনার জন্য প্রতি বছর ১০ হাজার কোটি টাকারও বেশি পাচার হয়ে যাচ্ছে। হেরোইন, মদ, ফেনসিডিল, ইয়াবা, আইসপিলসহ নানা মাদক আমদানি করা হচ্ছে বিদেশ থেকে। ওষুধ শিল্প খাতের বৈধ অনেক ব্যবসায়ীও অধিক মুনাফার লোভে অবৈধভাবে মাদক আনছে বিদেশ থেকে। অবৈধভাবে আনা এসব মাদকের মাত্র ১০ ভাগ ধরা পড়ছে।
মাদক মামলা ঝুলে থাকে বছরের পর বছর : সারাদেশে বর্তমানে প্রায় ৩০ হাজার মাদকের মামলা তদন্তাধীন আছে। এর মধ্যে র‌্যাব ও পুলিশের হাতে তদন্তাধীন মামলার সংখ্যা ২২ হাজার। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের হাতে তদন্তাধীন মামলা রয়েছে ৭ হাজার ৮১৫টি। সূত্র জানায়, অধিকাংশ সময় মাদকসহ গ্রেফতার হয় খুচরা ব্যবসায়ী। রাঘব বোয়ালরা থেকে যায় ধরাছোঁয়ার বাইরে। অনেক সময় নিরীহ পথচারীরাও গ্রেফতার হয়ে থাকে। সূত্র আরও জানায়, অধিকাংশ ক্ষেত্রে মাদকসেবীদের গ্রেফতারে পুলিশ আগ্রহ দেখায় না। হেরোইনখোর বা হিরোঞ্চি বলে পরিচিত মাদকসেবীদের গ্রেফতার করে মাঝে মধ্যেই বিপাকে পড়ে পুলিশ। রাজধানীতে হেরোইনসেবীরা দিন দিন বেপরোয়া হয়ে উঠছে। রাজধানীর অনেক স্থানে বিশেষ করে পুরনো ঢাকায় হেরোইনসেবীরা প্রকাশ্যে বে¬ড কিংবা ধারালো অস্ত্র নিয়ে পথচারীদের ভয় দেখিয়ে টাকা-পয়সা কেড়ে নিচ্ছে।
মাদকাসক্তের চিকিৎসার বেহাল অবস্থা : দেশে মাদকাসক্তের চিকিৎসার কোন সুব্যবস্থা নেই। সরকারি নিরাময় কেন্দ্রগুলোর অবস্থাও নাজুক। মাদকাসক্তদের সুস্থ জীবনে ফিরিয়ে আনতে চলছে মান্ধাতা আমলের চিকিৎসা পদ্ধতি। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অধিকাংশ চিকিৎসা কেন্দ্রে মাদকাসক্তদের পানিতে চুবিয়ে রাখা হয়। ঘুমের ট্যাবলেট খাইয়ে অচেতন করে রাখা হয় দিনের পর দিন। ন্যাড়া মাথা নিয়ে প্রায় বিবস্ত্র অবস্থায় অপরিচ্ছন্ন নোংরা স্যাঁতসেঁতে ঘরে তাদের কাটাতে হয় বন্দি জীবন। সংশি¬ষ্ট সূত্রে জানায়, দেশে সরকারি মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্র আছে মাত্র ৪টি। এর শয্যা সংখ্যা মাত্র ৫৫টি। ঢাকার তেজগাঁওয়ে ৪০ শয্যার কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠান এবং চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও খুলনায় ৫ শয্যার তিনটি কেন্দ্র আছে। ঢাকার কেন্দ্রীয় মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রটি ১০০ শয্যায় উন্নীত ও ১৫০ শয্যার পুনর্বাসন কেন্দ্র করার প্রতিশ্রুতি তিন বছরেও বাস্তবায়ন হয়নি। অপরদিকে সারাদেশে দেড় শতাধিক বেসরকারি মাদক নিরাময় কেন্দ্র থাকলেও মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের অনুমতি রয়েছে মাত্র ৬টি প্রতিষ্ঠানের। 
বিশেষজ্ঞের মতামত : বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোরোগ বিভাগের চিকিৎসক বলেন, এক্ষেত্রে ট্রাপিউটিক কমিউনিটি (টিসি) একমাত্র নিয়মতান্ত্রিক ও বৈজ্ঞানিক চিকিৎসা পদ্ধতি। এ পদ্ধতির মাধ্যমে একজন মাদকাসক্ত ব্যক্তিকে সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে সুস্পষ্ট ধারণা দেয়া হয়। 

0 comments:

Post a Comment