মাদকসেবীর সংখ্যা বাড়ছে
আলী ফোরকান
বর্তমানে মাদকের ভয়াবহ বিস্তার ঘটেছে তরুণদের মধ্যে। এক সময় রাজধানীতে হেরোইন, গাঁজা, চরস, ফেনসিডিল, তাড়ি, নেশার ইনজেশকশন টিডিজেসিক ও বুনোজেসিক বেশি ব্যবহার ছিল। এর মধ্যে হেরোইন ও ফেনসিডিলের চাহিদা ছিল সবচেয়ে বেশি। এ ছাড়া গাঁজায় আসক্তদের সংখ্যাও অনেক। ইনজেকশনের মাধ্যমে মাদকগ্রহীতার সংখ্যাও দিন দিন বাড়ছে। বর্তমানে অভিজাত শ্রেণীর তরুণ-তরুণীরা নেশাদ্রব্য হিসেবে ব্যবহার করছেন ইয়াবা ট্যাবলেট। সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেশে ১৩ হাজার এইডসের রোগী রয়েছেন। বেসরকারি সংস্থার মতে, প্রকৃত সংখ্যা আরো অনেক বেশি। আর নেশাগ্রস্তদের মধ্যেই এ রোগের হার চার শতাংশ। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশে মাদকাসক্তের সংখ্যা প্রায় ৫০ লাখ। যাদের অধিকাংশই তরুণ। ফ্যামিলি হেলথ ইন্টারন্যাশনালের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০০৭-এ দেশে সুঁই-সিরিঞ্জের মাধ্যমে মাদকসেবীর সংখ্যা ছিল প্রায় ৩৬ হাজার। যা বর্তমানে আরো কয়েকগুণ বেড়েছে। ফলে বর্তমানে শিরায় মাদক গ্রহণকারীদের মধ্যে এইচআইভি অবস্থা আশঙ্কাজনক। পরিসংখ্যানে আরো বলা হয়, প্রতি বছর সীমান্তবর্তী দেশ ভারত থেকে প্রায় ৩৪৭ কোটি টাকার মাদক আসছে। এর মধ্যে প্রায় ২২০ কোটি টাকার আসে ফেনসিডিল। মাদকাসক্তদের শতকরা ৪৫ ভাগই নানা অপরাধে জড়িত হয় উল্লেখ করে রিপোর্টে বলা হয়েছে, দেশে মাদকাসক্তদের শতকরা ৯১ ভাগই কিশোর ও তরুণ। কেউ শখের বসে নেশা করছে, কেউ একাকিত্ব কাটাতে আবার কেউ অন্যের প্ররোচনায় মাদকাসক্ত হচ্ছে। মাদকাসক্তদের শতকরা ৪৫ ভাগ বেকার এবং ৬৫ ভাগ আন্ডারগ্র্যাজুয়েট। আর উচ্চশিক্ষা নিচ্ছেন এমন মাদকাসক্তের সংখ্যা ১৫ ভাগ, ২২ ভাগ ব্যবসায়ী, ৬৭ ভাগ চাকরিজীবী, ৬ ভাগ ছাত্র এবং ৬ ভাগ শ্রমিক। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী দেশে অন্তত ৭০ লাখ মানুষ সরাসরি মাদকাসক্ত। এদের মধ্যে ৮৭ ভাগ পুরুষ ও ১৩ ভাগ নারী। এক লাখেরও বেশি লোক কোনো-না-কোনোভাবে মাদক ব্যবসায় জড়িত। এদের মধ্যে প্রভাবশালী ব্যক্তি থেকে শুরু করে নারী, শিশু ও কিশোর রয়েছে। ইউনাইটেড নেশনস ড্রাগ কন্ট্রোল প্রোগ্রামের (ইউএনডিসিপি) এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, গত এক বছরে সরকারের কেন্দ্রীয় মাদক নিরাময় কেন্দ্রে যেসব মাদকসেবী চিকিৎসা নিয়েছেন তাদের ৭২ ভাগই হেরোইনসেবী। এ ছাড়া গাঁজায় আসক্ত ৯ ভাগ ও ফেনসিডিলসেবীর সংখ্যা ৭ ভাগ। তারা বলছেন, প্রতি বছর সীমান্ত দিয়ে ভারত থেকে প্রায় সাড়ে ৩ কোটি টাকার মাদক আসে। এর মধ্যে বেশি পরিমাণে আসে ফেনসিডিল। সূত্রমতে, একজন মাদকসেবী মাদক কিনে বছরে গড়ে ৫০ হাজার টাকার বেশি খরচ করেন এবং মাদকাসক্তদের শতকরা ৪৫ ভাগই নানা অপরাধে জড়িত। ফ্যামিলি হেলথ ইন্টারন্যাশনালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, মাদকাসক্তদের শতকরা ৪৫ দশমিক ৭২ ভাগ বেকার এবং ৬৫ দশমিক ১ ভাগ আন্ডারগ্র্যাজুয়েট। উচ্চশিক্ষা নিচ্ছেন এমন মাদকাসক্তের সংখ্যা ১৫ ভাগ। ২২ দশমিক ৬২ ভাগ ব্যবসায়ী। ১০ দশমিক ৬৭ ভাগ চাকরিজীবী, ৬ দশমিক ৬৭ ভাগ ছাত্র এবং ৬ দশমিক ৮০ ভাগ শ্রমিক। অপর এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়,রাজধানীর মাদকাসক্তদের কাছে মরণনেশা ইয়াবার চাহিদা বাড়ছেই। একদিকে মূল্যবৃদ্ধি এবং ভেজালের কারণে ফেনসিডিল ও হেরোইনের ব্যবসায় ধস নেমেছে। ২৫০ টাকার ফেনসিডিলের দাম বাড়তে বাড়তে এখন ২৫০ মিলির বোতল ১৫০০ টাকায় ঠেকেছে। তাও আবার ভেজাল, তৈরি হচ্ছে ঢাকা শহরের আনাচে-কানাচে। ইদানীং বেশকিছু এলাকায় ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে চিনির সিরা, ঘুমের বড়ি আর কেমিক্যাল মিশিয়ে তৈরি হচ্ছে ফেনসিডিল। চার রঙের লেবেল এবং কর্ক লাগানোর ছোট ডাইস ব্যবহার করে অবিকল ফেনসিডিল তৈরি করে বাজারজাত করছে একশ্রেণীর অসাধু প্রতারক ব্যবসায়ী। ঢাকার আন্ডারগ্রাউন্ড প্রেসে ছাপা হলেও লেবেলের গায়ে লেখা থাকে ভারতের তৈরি। পুলিশ র্যাব মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের কর্মকর্তারা ইতিমধ্যে এ ধরনের বেশকিছু কারখানা আবিষ্কার করেছেন। আটক করেছেন ভেজালকারীদেরও। কিন্তু কঠোর আইন না থাকায় গ্রেফতারকৃতদের বেশি দিন কারাগারে আটকও রাখা যাচ্ছে না। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের ঢাকা মেট্রো অঞ্চলের সেগুনবাগিচাস্থ প্রধান কার্যালয়ের পাশে একটি বহুতল অ্যাপার্টমেন্ট ফ্ল্যাটের ছোট একটি কক্ষ ভাড়া নিয়ে ভেজাল ফেনসিডিল তৈরির সময় কারখানায় অভিযান চালানো হয়। সেখান থেকে গ্রেফতারকৃতরা জানায়, নয়াবাজার থেকে পুরনো বোতল কিনে নিজেদের তৈরি ফেনসিডিল ভর্তির পর স্থানীয় প্রেসে ছাপানো অবিকল লেবেল সেঁটে ছোট আকারের হ্যান্ড মেশিনে কর্ক লাগানো হয়। এ ধরনের কর্কও একশ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী ২০০ টাকায় ১০০ কর্ক বিক্রি করে। পার্শ¦বর্তী দেশ থেকে চোরাইপথে আনা আর স্থানীয়ভাবে তৈরি ফেনসিডিলের বোতল দেখলে কারো বোঝার উপায় থাকে না কোনটা আসল আর কোনটা নকল। গত মাসে প্রথমে ৬০০ পরে ৮০০ এরপর এক লাফে ১ হাজার টাকায় বিক্রি হতে থাকে। এরপর আরেক লাফে ১২০০ টাকায় কয়েকদিন বিক্রির পর এখন ১৫০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে এক বোতল ফেনসিডিল। এ কারণেই ফেনসিডিল আসক্তরা ঝুঁকে পড়েছে আরেক মরণ নেশা ইয়াবার দিকে। এটাও এখন ভেজাল হচ্ছে দেশেই। সম্প্রতি দেশে তৈরি বেশকিছু চালান আটকও করা হয়। ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষায় দেখা যায় এসব ভেজাল ইয়াবায় আসল ইয়াবার কোনো উপাদানই নেই। যেসব উপাদান দিয়ে ভেজাল ইয়াবা তৈরি হচ্ছে সেসব উপাদান মানবদেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। এ ধরনের মাদক সেবনে দ্রুত কিডনি বিকল, মস্তিষ্কের নার্ভের কার্যক্ষমতা হ্রাস, হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বাধাগ্রস্ত, শ্বাসনালিতে ক্ষত এবং ফুসফুসে ছিদ্র হওয়াসহ বিভিন্ন ধরনের সমস্যা দেখা দেবে। র্যাবের পরিচালক (লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইং) জানান, বর্তমানে বাজারে যেসব ইয়াবা বেচাকেনা হচ্ছে এবং যারা সেবন করছে তাদের জন্য ভয়াবহ পরিণতি অপেক্ষা করছে। কয়েক মাস সেবনের পরই আসক্ত ব্যক্তি আর স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারবে না। চিকিৎসা ব্যবস্থায়ও আসক্তদের যথাযথ সুস্থতায় ফিরিয়ে আনতে সক্ষম নাও হতে পারে। একই সূত্রের মতে, বাজার থেকে ইয়াবা সংগ্রহের পর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা যায় যে, মানবদেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর কয়েক ধরনের কেমিক্যালের সংমিশ্রণে এসব ইয়াবা তৈরি হচ্ছে। দেশের বাইরে থেকেও যেসব ইয়াবা আসছে তাতেও একই ধরনের উপাদান রয়েছে। র্যাবের পক্ষ থেকে ইয়াবা পাচার, বেচাকেনা ও আসক্তদের বিরুদ্ধে জোরদার অভিযান অব্যাহত রয়েছে। তারপরও এ ব্যবসার শক্তিশালী সিন্ডিকেট ভেঙে দেয়া যাচ্ছে না। গডফাদাররা একেক সময় একেক ধরনের কৌশল অবলম্বন করে চলছে। তিনি আরো জানান, যে কোনো ধরনের মাদক নিয়ন্ত্রণ কিংবা নির্মূলে র্যাব-পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থার পক্ষে সম্ভব নয়। এজন্য গণসচেতনতা প্রয়োজন। শহরে, বন্দরে, পাড়া-মহল্লা, গ্রামেগঞ্জে এজন্য প্রতিরোধ কমিটি এবং মোটিভেশন ব্যবস্থা চালু করা জরুরি হয়ে পড়েছে। নয়তো যুব ও তরুণ সমাজকে রক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়বে। বর্তমানে ভেজাল হেরোইন ও ফেনসিডিলের কারণে মাদকাসক্তদের বড় অংশ ইয়াবার দিকে ঝুঁকে পড়েছে। বাজারে এখন ৮ থেকে ১০ ধরনের ইয়াবা পাওয়া যায়। সবচেয়ে নিম্নমানের ইয়াবার দেশীয় নাম চম্পা, দাম ২০০ টাকা। এরপর চম্পা সুপার, দাম ২৫০ টাকা। আর নামের তিনটি কোয়ালিটি যথাক্রমে আর-৭০, আর-৮০ ও আর-৯০, এগুলোর দাম ৪০০ থেকে ৫৫০ টাকা পর্যন্ত। জিপি এবং এন সিরিজ নামের ইয়াবার দাম ৮০০ থেকে ১০০০ টাকা। থাইল্যান্ডের তৈরি ডাব্লিউ ওয়াই নামের ইয়াবা প্রতিটি ২৫০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। জিপি, এন সিরিজ ও ডাব্লিউ বেচাকেনা হয় অভিজাত গুলশান-উত্তরা-বনানী এলাকায়। কম দামের চম্পা এবং আর বিক্রি হচ্ছে রাজধানীর অন্যান্য এলাকায়। প্রায় প্রতিটি পাড়া-মহল্লায় এখন মোবাইল ফোনের মাধ্যমে ইয়াবার জমজমাট ব্যবসা চলছে। শুধু যুবসমাজ নয়, স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রী থেকে শুরু করে মুদি দোকানি, ফুটপাত ব্যবসায়ীরাও এখন ইয়াবার পেছনে ছুটছে। রাজধানীর অধিকাংশ হোটেল-মোটেল, রেস্টহাউস-গেস্টহাউস থেকে শুরু করে বিভিন্ন বাসাবাড়ি-ফ্ল্যাটেও চলছে লাভবান এবং লোভনীয় এ মরণ নেশার ব্যবসা। যেসব বাসাবাড়ি-ফ্ল্যাটে অসামাজিক কার্যকলাপ চলে সেখানেও ইয়াবা সেবনের আসর বসে। ১/১১’র পর ইয়াবাবিরোধী অভিযানের সময় যেসব রথী-মহারথীরা ধরা পড়েছিল, এখন তারাও গডফাদারের ভূমিকা নিয়ে ইয়াবা ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। সূত্রটির হিসাব অনুযায়ী বর্তমানে রাজধানীতে প্রতিদিন ১০ লাখের বেশি ইয়াবা বেচাকেনা হচ্ছে। এ সংখ্যা দিন দিন যে হারে বাড়ছে তাতে আগামী ৩ মাসের মধ্যে বেচাকেনার পরিমাণ দ্বিগুণ অর্থাৎ ২০ লাখে পৌঁছবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো আশঙ্কা প্রকাশ করেছে। আমরা আশাকরি সংশ্লিষ্ট কতৃপক্ষ মাদক বিকিকিনির হাট ও ক্রয়-বিক্রেতার শাস্তি আরো কঠিনভাবে প্রয়োগ করবে।
0 comments:
Post a Comment