মাদকমুক্ত হোক কারগার
আলী ফোরকান
মাদক ব্যবসা । কঠোর নিরাপত্তা আর নজরদারিতেও বন্ধ হয়নি । তাও আবার কারাগারে। এ কেমন কথা! বাস্তবতা কিন্তু তাই। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারসহ ৬৭টি কারাগারে চলছে রমরমা এই ব্যবসা। অথচ কারাগারে অপরাধী ও বিভিন্ন মামলায় সাজাপ্রাপ্তদের চারদেয়ালের মধ্যে আটক রাখতে একদিকে বাইরে নজরদারি অন্যদিকে ভেতরে কঠোর পর্যবেক্ষণের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। কারাগারে এক শ্রেণীর দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা, কারারক্ষী ও কয়েদি মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত বলে পুলিশের কাছে তথ্য এসেছে। দুর্নীতিবাজ এ চক্রটি প্রতি মাসে হাতিয়ে নিচ্ছে লাখ লাখ টাকা। এক পরিসংখানে দেখা যায়, বছরে মাদক ব্যবসায় জড়িত থাকার অভিযোগে ২০ কারারক্ষীকে আটক করেছে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা। কারাগারের ভেতরে মাদক কেনাবেচা রোধ করতে একটি গোয়েন্দা সোর্স দল গঠন করেছে কারা কর্তৃপক্ষ। মাদক সংক্রান্ত একটি রিপোর্ট স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠায় সংশি¬ষ্ট গোয়েন্দারা। সূত্র মতে, কারাগারের ভেতরে মাদক ব্যবসা বন্ধ করতে কর্তৃপক্ষ ২০ বন্দীর সমন্বয়ে একটি গোয়েন্দা সোর্স দল গঠন করেছে। কারা কিভাবে কারাগার অভ্যন্তরে মাদক কেনাবেচা করে এবং জড়িতদের নাম ঠিকানা সংগ্রহের দায়িত্ব পালন করছে এ দলটি। তারপরও মাদক ব্যবসা বন্ধ করতে পারেনি কারা কর্তৃপক্ষ। এ প্রসঙ্গে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার কতৃপক্ষের দাবি,বন্দীরা আদালতে হাজিরা দিয়ে কারাগারে ফেরার পথে পায়ুপথ, জুতার সঙ্গে সেলাইসহ বিভিন্ন কৌশলে মাদক নিয়ে কারাগারের ভেতরে যাওয়ার চেষ্টা করে। তবে হাজিরা থেকে ফেরার পথে যৌথ বাহিনীর তল্লাশিতে ধরা পড়ার পর অনেক মাদক বহনকারীর বিরুদ্ধে মামলা দেয়া হয়। মাদকের কেনাবেচার সঙ্গে যেসব কারা কর্মকর্তা ও কারারক্ষী জড়িত আছে তাদের চিহ্নিত করে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ইতিমধ্যে কিছু কারারক্ষীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। প্রতিটি কারাগারে নিয়মিত মনিটরিং করা হচ্ছে। কয়েদিদের মাদক ব্যবসায় সম্পৃক্ত থাকার প্রমাণ মিললে তার বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়। দীর্ঘদিন ধরে দেশের সবকটি কারাগারে মাদক ব্যবসাসহ নানা অনিয়ম চলে আসছে। বন্দীরা জড়িয়ে পড়ছে নানা অপরাধের সঙ্গে। কারা কর্তৃপক্ষ নানা পদক্ষেপ নিয়েও মাদক বিক্রেতাদের নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছে না। কারারক্ষীরা বন্দীদের কাছে চড়াদামে মরণনেশা ইয়াবাসহ নানা রকমের মাদকদ্রব্য বিক্রি করছে বলে অভিযোগ রয়েছে। বিশেষ করে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে হেরোইন, গাঁজা ও ইয়াবা ব্যবসা চলছে ব্যাপক হারে।এখানে ইয়াবা ট্যাবলেটের চাহিদা সবচেয়ে বেশি। দীর্ঘদিন কারাগারে মাদক বেচাকেনা সম্পর্কে কারা কর্তৃপক্ষ অবহিত হলেও বিষয়টি ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে। কিছুদিন আগে ৬৮টি পিস ইয়াবাসহ এক কারারক্ষীকে আটক করে গোয়েন্দারা। এর আগে ৪৯টি ইয়াবাসহ এক কারারক্ষী, ৮০টি ঘুমের ট্যাবলেটসহ কারারক্ষী ইউনুছ মিয়া ও ২০টি ইয়াবা ট্যাবলেটসহ কামার সাইফুল ইসলামকে আটক করা হয়। এর আগে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ও পুলিশ কারা প্রাচীর সংলগ্ন মাজার বরাবর এলাকা থেকে এক কেজি হেরোইন দেয়ালের উপর দিয়ে অভ্যন্তরে নিক্ষেপকালে একজনকে হাতেনাতে গ্রেপ্তার করেছিল। তার কাছ থেকে গোয়েন্দারা জানতে পারেন এক শ্রেণীর কর্মকর্তা-কর্মচারী ও কারারক্ষী সরাসরি মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। বন্দীদের কাছ থেকে তারা নিয়মিত মোটা অংকের উৎকোচ পেয়ে থাকেন। একজন কারারক্ষী প্রতি মাসে শুধু মাদক ভেতরে নিয়ে যাওয়ার সুযোগে মোটা অংকের টাকা পেয়ে থাকেন বলে গোয়েন্দা রিপোর্টে বলা হয়েছে। রিপোর্টটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। রিপোর্টে বলা হয়েছে ৬৭টি কারাগারেই মাদক ব্যবসা হচ্ছে। রিপোর্টে কোন কোন মাদক ব্যবসায়ী এই ব্যবসায় জড়িত তারও একটি তালিকা দেয়া হয়েছে। বিভিন্ন গ্রুপ কৌশলে কারাগারে বিভিন্ন রকমের মাদক পাঠিয়ে থাকে বলে রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে। তাদের সঙ্গে বন্দী ও কিছু কারারক্ষীর যোগসাজশ রয়েছে। মাদক ব্যবসা রোধ করতে কিছু সুপারিশ করা হয়। বন্দীরা আদালতে হাজিরা দিয়ে ফেরার সময় গোপন অঙ্গের সঙ্গে বেঁধে কিংবা মলদ্বারে ঢুকিয়ে ইয়াবা, হেরোইন ও গাঁজার পুরিয়াসহ নেশার উপকরণ কারাগারে নিয়মিত নিয়ে আসা হয়। কারাগারে আটক শীর্ষ সন্ত্রাসীরা ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে মাদক ব্যবসা চালিয়ে আসছে। তাছাড়া স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র কিংবা কিশোররা নানা অভিযোগে গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে যাচ্ছে। কারাগারে মাদকের এমন পরিস্থিতিতে কিছুদিন থাকার পর বাধ্য হয়ে তারাও মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে। কেন্দ্রীয় কারাগার সংলগ্ন ঘনবসতি এলাকায় এবং বাউন্ডারির পাশে গড়ে ওঠা বহুতল ভবন ও স্থাপনা থেকে গভীর রাতে কারাগারের অভ্যন্তরে হেরোইন, ইয়াবা ট্যাবলেটসহ নেশার উপকরণ নিক্ষেপ করা হয় মাদক বিক্রেতাদের কাছে। পরে বন্দীদের কাছে তা চড়া দামে বিক্রি করা হচ্ছে। একেকটি ইয়াবা ট্যাবলেট ৮০০ থেকে ১০০০ টাকা, গাঁজার পুরিয়া ১০০ থেকে ১৫০ টাকা, হাফ বোতল ফেনসিডিল ৬০০ টাকা, এক পুরিয়া হেরোইন ৩০০ টাকা, একটি বেনসন সিগারেট ২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এ মাদক দিনে মাদকাসক্ত বন্দীরা গ্রুপে গ্রুপে ভাগ হয়ে বিভিন্ন কক্ষে ও সিঁড়ির নিচে বসে মাদক সেবন করে। আর রাতে সেল ও ‘খাতা’র প্রতিটি কক্ষেই চলে মাদক সেবন। এছাড়া আদালতের হাজতখানার টয়লেটও বন্দীদের মাদক সেবনের নিরাপদ স্পট! বন্দীদের কাছে এখন সবচেয়ে প্রিয় নেশা হচ্ছে ইয়াবা ট্যাবলেট। এছাড়া হেরোইন ও গাঁজার ব্যাপক কদর রয়েছে কারাগারে। কারাগারগুলো মাদক ব্যবসায়ীদের একটি বড় মার্কেট। কোনো কোনো কারাগারে দিনে লাখ লাখ টাকার মাদক বেচাকেনা হয় বলেও অভিযোগ রয়েছে। মাদকাসক্তদের মধ্যে ধনাঢ্য পরিবারের সন্তান এবং পেশাদার অপরাধীর সংখ্যা বেশি। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে ছাড়া পাওয়া একাধিক বন্দীর বরাত দিয়ে রিপোর্টে জানানো হয়েছে, এই কারাগারে ১০ সহস্রাধিক বন্দীর মধ্যে প্রায় ২ সহস্রাধিকই মাদকাসক্ত। দেশের প্রায় সব কারাগারেই রয়েছে মাদকাসক্ত বন্দী। কারাগারে মাদক বাণিজ্যকে কেন্দ্র করে সক্রিয় আছে শক্তিশালী সিন্ডিকেট। আদালত পাড়ায় একশ্রেণীর মাদক ব্যবসায়ীর রয়েছে অবাধ যাতায়াত। তারা পেশাদার খুনি, দুর্ধর্ষ অপরাধী ও শীর্ষ সন্ত্রাসীদের খোঁজখবর রাখে। চিহ্নিত অপরাধীরা কারাগার থেকে কোর্ট হাজতে যাওয়ার পর সেখানকার চিত্র পাল্টে যায়। অভিযোগ আছে, হাজতখানায় দায়িত্বে থাকা একশ্রেণীর পুলিশ এই মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। তারা মাদক ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে মোটা অংকের উৎকোচ পাচ্ছে। এ ব্যাপারে ওয়াকিবহাল কারা কর্তৃপক্ষও। কারা কর্তৃপক্ষ পুলিশকে একটি চিঠি দিয়ে আদালত ফেরত বন্দীদের কাছে মাদক পাওয়ার কথা জানিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের আবেদন করেন। এরপর পুলিশ থেকে এ ব্যাপারে সবাইকে সতর্ক থাকতে নির্দেশ দেয়া হয়। পুলিশের দাবি, ঢাকার আদালতে প্রতিদিন ৭-৮শ বন্দী আদালতে আনা-নেয়া হয়। আর এ কাজে নিয়োজিত ১৭৫ জন পুলিশ। বন্দীরা আদালতে হাজিরা শেষে পুনরায় কারাগারে ফেরা পর্যন্ত সারাক্ষণ পুলিশের হেফাজতে থাকে। কারাগার গেটে দেহ তল্লাশি ছাড়া কাউকে ভেতরে প্রবেশ করতে দেয়া হয় না। কারাগারে প্রতিদিনই বন্দীদের রুম ও ব্যাগ দুবেলা তল্লাশি করা হয়। তবে কতিপয় অসাধু পুলিশের মাধ্যমে বন্দীরা মাদক পেতে পারে। একথা স্বীকার করেছেন পুলিশ কর্র্তৃপক্ষও। এমন কাজে সহযোগিতার অভিযোগে এ পর্যন্ত কয়েকজন কারারক্ষীকে সাসপেন্ড এবং বেশ কয়েকজনকে শাস্থিমূলক বদলি করা হয়েছে। এমনকি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের প্রধান কারারক্ষী পর্যন্ত ইয়াবাসহ আটক হয়েছেন। বলাই বাহুল্য, সর্ষের মধ্যে ভূত থাকলে তা তাড়ানো কঠিন। তারপরও কিন্তু মাদকের বিস্তার থামেনি। বোঝা যাচ্ছে, কারাগারকে কেন্দ্র করে এই মাদক সিন্ডিকেটের শেকড় অনেক দূর বিস্তৃত। কারাগার একটি সংরক্ষিত এলাকা, অপরাধীদের সংশোধনের জায়গা। অথচ, দেখা যাচ্ছে, ছোটখাটো অপরাধে তরুণরা গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে গিয়ে উল্টো মাদকাসক্ত হয়ে পড়ছে। ঢাকার তুলনায় ঢাকার বাইরের কারাগারগুলোর পরিস্থিতি আরো নাজুক। সারা দেশের কারাগুলোকে মাদকমুক্ত করতে হবে। এর জন্য কারাভন্তরে মাদক প্রবেশের সব রন্ধ্্র বন্ধ করতে হবে। মাদকাসক্ত বন্দীদের চিহ্নিত করে তাদের বিশেষ নজরদারি ও কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। সবার আগে কারাকেন্দ্রিক মাদক সিন্ডিকেট ভাঙা এবং সর্ষের ভূত তাড়ানো জরুরি।
0 comments:
Post a Comment