মাদকের আইন ও প্রয়োগ
আলী ফোরকান
আমাদের বর্তমান সমাজ জীবনে মাদকের ব্যবহার সবাইকেই উদ্বিগ্ন করেছে। এর বিষাক্ত ছোবল অকালে কেড়ে নিচ্ছে অনেক প্রাণ। অনেক সম্ভাবনাময় তরুণ-তরুণী হচ্ছে বিপথগামী। এ থেকে পরিত্রাণের আশায় ১৯৯০ সালে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন (১৯৯০ সালের ২০ নং আইন) প্রণীত হয়। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ ও মাদকাসক্তদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনকল্পে ওই আইন ১৯৯০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি প্রণয়ন করা হয়। ওই আইনের ২(ঠ) ধারায় মাদকের সংজ্ঞা নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। সে মতে মূলত অপিয়াম পপি বা তৎনিঃসৃত আঠালো পদার্থ; আফিম; আফিম থেকে উদ্ভূত মরফিন, কোডিন, হেরোইন ইত্যাদি এবং এদের ক্ষারগুলো; শতকরা ০.২% এর অধিক মরফিনযুক্ত যে কোনো পদার্থ, কৃত্রিম উপায়ে তৈরি আফিমের সমধর্মী দ্রব্য যথাÑ পেথিড্রিন, হাইড্রোমরফিন, ডিমেরাল, বেটাপ্রোডাইন ইত্যাদি, কোকা পাতা এবং তা থেকে উদ্ভূত সব দ্রব্য, কোকেন এবং ০.১% এর অধিক কোকেনযুক্ত যে কোনো পদার্থ অথবা কোকেনের যে কোনো ক্ষার, চরস, হাশিশ, গাঁজাগাছ, গাঁজা, ভাংগাছ, ভাং, গাঁজা বা ভাং সহযোগে প্রস্তুত যে কোনো পদার্থ, অ্যালকোহল এবং ০.৫%-এর অধিক অ্যালকোহলযুক্ত যেকোনো পদার্থ, রেক্টিফাইড স্পিরিট এবং তৎসহযোগে যে কোনো ওষুধ বা তরল পদার্থ, বিয়ার, বারবিচুয়েটস, তাড়ি, পচুই, মেথিলেটেড স্পিরিট ইত্যাদি দ্রব্য মাদক হিসেবে পরিচিত। ভারতে তৈরি ফেনসিডিল সিরাপ আমাদের দেশে মাদক হিসেবে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এই সিরাপের লেবেলে তা কাশির সিরাপ বলে উল্লিখিত আছে। এই সিরাপের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান আফিম থেকে উদ্ভূত কোডিন, এই কারণেই ফেনসিডিল সিরাপ সেবন করলে মাদকতা আসে। তাই ফেনসিডিল সিরাপ মাদক হিসেবে পরিচিত। অ্যালকোহল ব্যতীত অন্য কোনো মাদকদ্রব্যের চাষাবাদ, উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ, বহন, পরিবহন, আমদানি-রফতানি, সরবরাহ, ক্রয়, বিক্রয়, ধারণ, সংরক্ষণ, গুদামজাতকরণ, প্রদর্শন, প্রয়োগ ও ব্যবহার ওই আইনের ৯ ধারায় নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সেই সঙ্গে ওইরূপ উদ্দেশ্যে কোনো প্রচেষ্টা বা উদ্যোগ গ্রহণ, অর্থ বিনিয়োগ কিংবা কোনো প্রতিষ্ঠান স্থাপন, পরিচালনা বা তার পৃষ্ঠপোষকতা করাও নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তবে ওষুধ প্রস্তুত, চিকিৎসা বা বৈজ্ঞানিক গবেষণার প্রয়োজনে তা করা যাবে এবং সে ক্ষেত্রে লাইসেন্স নিতে হবে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের মহাপরিচালক বা তার কাছ থেকে এতদুদ্দেশ্যে ক্ষমতাপ্রাপ্ত কোনো কর্মকর্তা এই লাইসেন্স, পারমিট ও পাস বিধি মোতাবেক প্রদান করবেন। অ্যালকোহলের ক্ষেত্রেও একইরূপ বিধিনিষেধ রয়েছে। কোনো ডিস্টিলারি বা ব্রিউয়ারি স্থাপন করতে হলে অথবা ওষুধ তৈরির উপাদান হিসেবে অ্যালকোহল ব্যবহার করতে হলে উল্লিখিত মতে লাইসেন্স নিতে হবে। অ্যালকোহল পান করতে হলেও ওই মতে পারমিট নিতে হবে। মুসলমানদের ক্ষেত্রে চিকিৎসার প্রয়োজনেই শুধু অ্যালকোহল পান করার পারমিট দেয়া যাবে, সে ক্ষেত্রে অন্যূন সিভিল সার্জন বা মেডিকেল কলেজের মেডিসিন বিভাগের কোনো সহযোগী অধ্যাপকের ব্যবস্থাপত্রের ভিত্তিতেই এরূপ পারমিট দেয়া যাবে। এ ক্ষেত্রে ব্যবস্থাপত্রে রোগের নাম উল্লেখ করতে হবে এবং ওই রোগের চিকিৎসার জন্য অ্যালকোহল পান করার আবশ্যকতা সম্পর্কে ওই চিকিৎসক প্রত্যয়নপত্র দেবেন। নৈতিক স্খলনজনিত কোনো ফৌজদারি অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হয়ে অন্যূন কারাদ-ে অথবা পাঁচশত টাকার অধিক জরিমানায় দ-িত ব্যক্তি এরূপ লাইসেন্স পাবে না। তবে দ-ভোগ বা জরিমানা পরিশোধের পর তিন বৎসর অতিবাহিত হওয়ার পর সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে লাইসেন্স প্রদানের বিষয় বিবেচনা করা যাবে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের অধীনে কোনো অপরাধের জন্য আদালত কর্তৃক দ-িত ব্যক্তি এবং ওই আইনের অধীনে প্রদত্ত লাইসেন্স বা পারমিটের শর্ত ভঙ্গের কারণে যার লাইসেন্স বা পারমিট বাতিল হয়ে গেছে এরূপ ব্যক্তি এই আইনের অধীন লাইসেন্স বা পারমিট পাওয়ার জন্য বিবেচিত হবেন না। মুচি, মেথর, ডোম, চা বাগানের কুলি ও উপজাতীয়রা তাড়ি এবং পচুই পান করতে পারবে, তাদের ক্ষেত্রে এই বিধি-নিষেধ প্রযোজ্য হবে না। রাঙ্গামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলাগুলোর উপজাতিরা তাদের ঐতিহ্যগতভাবে প্রস্তুতকৃত মদ পান করতে পারবে, এ ক্ষেত্রেও উল্লিখিত বিধিনিষেধ প্রযোজ্য হবে না। বিংশ শতাব্দীর নবম দশকে (১৯৮১ থেকে ১৯৯০ সাল) বাংলাদেশে ব্যাপকভাবে মাদকের ব্যবহার ছড়িয়ে পড়ে। ওই সময় বিদেশ থেকে আসা মাদক সম্পর্কিত অপরাধের বিচার করা হতো ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইন অনুসারে। সেখানে শুধু শুল্ক ফাঁকি দিয়ে চোরা পথে আমদানিনিষিদ্ধ পণ্য দেশে নিয়ে আসা বা নিজ হেফাজতে রাখার অপরাধেই আসামির বিচার হতো। জনজীবনে ব্যাপক ক্ষতি সাধনকারী এই মাদকসংক্রান্ত অপরাধ দমনের জন্য ওই আইন পর্যাপ্ত ছিল না। তাই মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ এবং মাদকাসক্তদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনকল্পে ১৯৯০ সানে ‘মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন’ প্রণয়ন করা হয়। ১৩৯৬ বঙ্গাব্দের ১৯ পৌষ মোতাবেক ১৯৯০ সানের ২ জানুয়ারি তারিখ থেকে এ আইন কার্যকর হয়। কিন্তু কুড়ি বৎসরেরও অধিককাল পথপরিক্রমায় মাদকদ্রব্য ব্যাপকভাবে নিযন্ত্রিত হয়নি। এর ব্যবহার এবং প্রসার বেড়েই চলেছে। অভিভাবকরা আজ চিন্তিত তাদের সন্তানদের মাদকাসক্তি নিয়ে। মাদকের হিংস্র ছোবল থেকে সারা জাতি চায় আত্মরক্ষা করতে। আইনের কার্যকর প্রয়োগ হয়নি বলেই আজ মাদক নিয়ে এত সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। বেড়েছে উৎকণ্ঠা, উদ্বেগ।
এ থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে তল্লাশি অভিযান পরিচালনা, তদন্ত করা, উদ্ধারকৃত দ্রব্যের রাসায়নিক পরীক্ষা যথাযথভাবে করার বিষয়ে আইনে বর্ণিত বিধান যথাযথভাবে অনুসরণ করতে হবে। সেই সঙ্গে আদালতে সঠিকভাবে সাক্ষ্য প্রমাণ উপস্থাপন করতে হবে, খামখেয়ালিভাবে নয়, আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই তা করতে হবে। সব ক্ষেত্রে সুষ্ঠু নজরদারি রাখতে হবে। এসবের অভাবের কারণেই মাদকদ্রব্যসংক্রান্ত আইনটি জনজীবনে সুবাতাস প্রবাহিত করতে পারছে না।
0 comments:
Post a Comment