Saturday, July 30, 2016

মাদককে না বলূন

মাদককে না বলূন
আলী ফোরকান
বর্তমান সময়ের মারাত্মক সমাস্যাবলির মধ্যে মাদকাসক্তি অন্যতম একটি সমস্যা । আধুনিক সভ্যতার জন্য মাদকাসক্তি একটি অভিশাপ। বিশেষত যুব সমাজের জন্য মারাত্মক হুমকি। প্রতিনিয়ত এর বিষাক্ত ছোবলে হারিয়ে যাচ্ছে অসংখ্য সম্ভাবনাময় তরুণ। সমাজের যাবতীয় পাপাচার, অন্যায়, বিশৃঙ্খলা ও অস্থিরতার অধিকাংশের মূলে রয়েছে এই মাদক ও মাদকাসক্তি। মহাগ্রন্থ আল কুরআনে মহান আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, ‘হে মুমিনগণ, এই যে মদ, জুয়া, প্রতিমা এবং ভাগ্য-নির্ধারক শরসমূহ (ভাগ্য-নির্ধারক বলতে আরবে প্রচলিত শর দ্বারা এক ধরনের জুয়া বুঝানো হয়েছে) এসব শয়তানের কাজ বৈ অন্য কিছু নয়। অতএব, এগুলো থেকে বেঁচে থাকো; যাতে তোমরা কল্যাণপ্রাপ্ত হও।’ (সূরা মায়িদা-৯০)। আলোচ্য আয়াতে মদ, জুয়া, মূর্তি এবং ভাগ্য-পরীক্ষার শর এই চারটি বস্তুকে হারাম ঘোষণা করা হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে এ চারটি বিষয়কে শয়তানের নোংরা কাজ বলে অভিহিত করা হয়েছে। এবং এ বিষয়গুলো এমন যে, কোনো সুস্থ স্বাভাবিক বিবেকসম্পন্ন ব্যক্তির মনেই এগুলোর প্রতি ঘৃণা জন্মে। আরো ইরশাদ হচ্ছে, ‘শয়তান তো চায়, মদ ও জুয়ার মাধ্যমে তোমাদের পরস্পরের মাঝে শত্রুতা ও বিদ্বেষ সৃষ্টি করে দিতে এবং আল্লাহর স্মরণ ও নামাজ থেকে তোমাদেরকে বিরত রাখতে। অতএব, তোমরা কি নিবৃত্ত হবে? (সূরা মায়িদা-৯১)। বিভিন্ন প্রকার নেশা বা নেশাজাতক মাদকতায় মত্ত হয়ে পরস্পরের মাঝে খুন-মারামরিসহ নানা প্রকার অরাজকতা বর্তমান সমাজের স্বাভাবিক চিত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর এ কারণেই পবিত্র কুরআনে স্পষ্টভাবে মদকে শয়তানের জঘন্য কাজ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। এবং এও বলা হয়েছে যে, মাদক মানুষের মাঝে শত্রুতা ছড়িয়ে দেয়। বর্ণিত আয়াতে মাদকের আরেকটি ভয়াবহ পরিণতির কথা বলা হয়েছে। আর তা হলো, মাদক মানুষকে তার স্রষ্টা মহান আল্লাহর স্মরণ থেকে দূরে সরিয়ে রাখে। যখন কোনো মানুষ সম্পূর্ণ আল্লাহ বিমুখ হয়ে যায়, সৃষ্টিকর্তা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় তখন তার কাছে নীতি-নৈতিকতা বলতে কিছু বাকি থাকে না। ন্যায়-অন্যায়ের কোনো বাধ্যবাধকতা থাকে না। ফলে এ অবস্থা তার নিজের জন্য যেমন ক্ষতিকর তেমনি তার পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য আরো বেশি বিপজ্জনক। ইবনে ওমর রা. সূত্রে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘সকল নেশাজাতীয় দ্রব্যই ‘খামার’ তথা মদের অন্তর্ভুক্ত। আর সব ধরনের মাদকই হারাম’ (সহীহ মুসলিম)। উম্মুল মুমিনিন হজরত আয়েশা রা. বর্ণনা করেন, রাসূল (সা.) বলেন, ‘সব ধরনের নেশা সৃষ্টিকারী পানীয় হারাম’ (সহীহ বুখারি ও মুসলিম)। উপরোক্ত হাদিসদ্বয়ে সব ধরনের নেশা সৃষ্টিকারী জিনিসকে হারাম করা হয়েছে। চাই তা পানীয় হোক কিংবা খাদ্য জাতীয় হোক কিংবা ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে নেয়া হোক বা অন্য যে কোনো উপায়ে নেশা করা হোক। আবদুল্লাহ বিন উমার (রা.) সূত্রে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘যদি কেউ মদ পান করে, আল্লাহ তায়ালা তার চল্লিশ দিনের নামাজ কবুল করেন না। আর যদি এ অবস্থায় সে মৃত্যুবরণ করে তাহলে সে জাহান্নামি হবে। তবে যদি সে লজ্জিত ও অনুতপ্ত হয়ে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে তবে আল্লাহ তায়ালা তাকে ক্ষমা করে দেবেন। এরপর যদি আবার দ্বিতীয়বার মাদক গ্রহণ করে তাহলে তার চল্লিশ দিনের নামাজ কবুল হবে না। তবে যদি দ্বিতীয় বার তওবা করে তাহলে আল্লাহ তায়ালা তার তওবা কবুল করবেন। এরূপ যদি চতুর্থবার সে পুনরায় মদ পান করে, তাহলে আল্লাহ তায়ালার ওপর হক্ব হয়ে যায় যে তিনি তাকে জাহান্নামিদের মলমুত্র খাওয়াবেন। (অর্থাৎ তাকে জাহান্নামে প্রবেশ করাবেন)। ইবনে ওমর রা. বর্ণনা করেন, রাসুল (সা.) বলেন, তিন ব্যক্তির জন্য আল্লাহ তায়ালা জান্নাতকে হারাম করে দিয়েছেন। তারা হলো; মদ্যপানে অভ্যস্ত, আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী ও জাদুতে বিশ্বাসকারী। (মুসনাদে আহমাদ) । হজরত ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত একটি হাদিস রয়েছে, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘মদ সব অশ্লীলতার মূল ও মারাত্মক কবিরা গুনাহ। যে ব্যক্তি মদ পান করল সে যেন আপন মা, খালা ও ফুফুর সাথে অপকর্মে লিপ্ত হলো।’ (তাবরানি) মদের কুফল বর্ণনার ব্যাপারে এর চেয়ে মারাত্মক কথা আর কি হতে পারে! মুসনাদে আহমাদে বর্ণিত অন্য এক হাদিসে রাসূল (সা.) মাদক ও এর সঙ্গে সম্পৃক্ত সবাইকে অভিসম্পাত করেছেন; প্রথমত মদ এবং তা পানকারী, পরিবেশনকারী, ক্রেতা, বিক্রেতা, যিনি নিংড়িয়ে রস বের করেন অর্থাৎ উৎপাদনকারী, মাদক বহনকারী এবং যার কাছে মাদক নিয়ে যাওয়া হয়; মোট কথা মাদকের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব লোককে অভিসম্পাত করেছেন। ইসলামি দৃষ্টিকোণে মাদক এবং মাদক সেবনের নানাবিধ কুফল-ভয়াবহ পরিণাম তো রয়েছেই, পাশাপাশি সামাজিক এবং ব্যক্তিগত পর্যায়েও মাদকের ছোবল ভয়ংকর। মদ ও বিভিন্ন প্রকারের নেশায় অভ্যস্ত লোক অসংখ্য শারীরিক ও মানসিক রোগে আক্রান্ত হয়। মানবদেহের ওপর মাদকদ্রব্যের মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে। এ ব্যপারে বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন বার বার মাদক গ্রহণের ফলে মস্তিষ্ক ও শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের অভ্যন্তরীণ স্বাভাবিক কার্যক্ষমতা ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। মাদক গ্রহণের ফলে শরীরে মারাত্মক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। এবং মানসিক অস্থিরতা বিরাজ করে। দৈনন্দিন কাজ-কর্মের প্রতি তার কোনো মনোযোগ থাকে না। পুনরায় মাদক গ্রহণের জন্য সে অস্থির হয়ে পড়ে। এমনকি তা মানুষকে মৃত্যুর দিকে ধাবিত করে। মাদকের ক্ষতিকর প্রভাব শুধু মাদক গ্রহণকারীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না। বরং এর কু-প্রভাব পরিবার ও সমাজে ছড়িয়ে পড়ে। মাদকাসক্ত ব্যক্তি পরিবারের জন্য যেমন বোঝা হয়ে দাড়ায় তেমনি সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্যও। নেশার অর্থ যোগাড় করতে গিয়ে সর্বস্ব হারিয়ে ফেলে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে চুরি, ডাকাতি, ছিনতাইসহ বিভিন্ন অসামাজিক কার্যকলাপে জড়িয়ে পড়ে। ফলে সামাজিক জীবনে নেমে আসে ভয়াবহ অস্থিরতা। মাদকের কারণে দাম্পত্য কলহ সৃষ্টি হয়ে সোনালী সংসার ভেঙ্গে যাওয়ার ঘটনাও বিরল নয়। মাদকের অন্যতম আরেকটি মারাত্মক খারাপ দিক হলো, মাদক গ্রহণের ফলে অশ্লীলতার বিস্তৃতি ঘটে। মাদক অশ্লীলতার দ্বারকে উম্মুক্ত করে দেয়। মোট কথা সামাজিক অধিকাংশ বিশৃঙ্খলার মুলে রয়েছে মাদকের প্রভাব। সামাজিক অন্যান্য সমস্যার মতো একেও প্রতিরোধ করতে সরকার ও অন্যান্য বেসরকারী সংগঠন বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণ করলেও মাদকের ব্যবহার বন্ধ হয়েছে কিংবা হ্রাস পেয়েছে এমনটা কেউ হলফ করে বলতে পারবে না। বরং বাস্তবতা হচ্ছে মাদকের ব্যবহার দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে, মাদকাসক্তের সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে। মাদক গ্রহণের নতুন নতুন পদ্ধতি আবিস্কৃত হচ্ছে। মুলত মানব বিধ্বংসী এই সমস্যার প্রকৃত সমাধান করতে হলে প্রথমেই মানুষের মাঝে খোদাভীতি তথা তাক্বওয়া সৃষ্টি করতে হবে। কোনো মানুষের মাঝে যখন পরিপূর্ণ খোদাভীতি বিদ্যমান থাকবে তখন নিজেই নিজের কু-প্রবৃত্তি নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হবে। মাদকের মতো ঘৃণিত বিষয় থেকে খোদাভীতি তাকে নিবৃত্ত রাখতে সক্ষম হবে। মাদকের কুফল ও এর ভয়াবহতা সম্পর্কে জনসচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। এসবের পাশাপাশি মাদকের ব্যাপারে ইসলামি আইন যথাযথভাবে প্রয়োগ করতে হবে। আমাদের দেশে দেখা যায় প্রতি বছর মাদক নিয়ন্ত্রণে বার্ষিক বাজেটে বিশেষ বরাদ্ধ থাকে। কিন্তু তা মাদক নিয়ন্ত্রণে তেমন কোন কাজে আসে না। মাদক নিয়ন্ত্রণে আইনের যথাযথ প্রয়োগ হয় না। কোনো কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেখা যায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীই মাদক বিক্রয়ে সহায়তা করছে। আর রক্ষক যখন ভক্ষক হয়ে যায় তখন আইনের কার্যকারিতা আর থাকে কোথায়?



0 comments:

Post a Comment