মাদক বন্ধু নয় - শত্রু
আলী ফোরকান
জীবনে চলার পথে কত রোমাঞ্চের মুখোমুখি হতে হয়। কত বন্ধুর সাথে নির্ভরতার গল্প লুকিয়ে রয়। কিন্তু মাদক কখনই বন্ধু হতে পারে না। সিগারেটের সঙ্গে কোনো রোমাঞ্চ থাকতে পারে না। কৈশোরে অজানাকে জানার অহেতুক কৌতূহলে যে নামটি বিষাক্ত অজগর হয়ে গিলে ধরে সবাইকে, তা হলো সিগারেট। রোমাঞ্চকর এই অনুভূতিটি এক সময় নির্ভরশীল করে তোলে নিকোটিনের প্রতি। ধোঁয়ায় পুড়ে যাওয়া ফুসফুসের গর্তগুলো দিকভ্রান্ত করে তোলে আগামীর স্বপ্নকে। নিজেকে জাহির করা, কখনো অভিমান, হতাশা আর নিঃসঙ্গতার সঙ্গী খোঁজার ছলে দুই আঙুলের ফাঁকে আটকে যায় সিগারেট। সহজ নিঃশ্বাসের দরজায় ঢুকিয়ে দেয় বিষাক্ত খিল। তারুণ্যের মুগ্ধ পথচলায় মাদক প্রায়শই রোদেলা দুপুরের আলোতে গোধূলি হয়ে দেখা দেয়। কি জানি কি করে কোনো মোহের ছলনায় তারুণ্য বারংবার বিভ্রান্ত হয়েছে মাদকের গোলক ধাঁধায়। অনেক সম্ভাবনার অকাল প্রয়াণ যেমন ঘটে মাদকের জন্য তেমনি স্তম্ভিত হয়ে যায় কত না প্রাণোচ্ছ্বাস। অসময়ের মৃত্যু কখনই গ্রহণযোগ্য হয় না কারও কাছে। তারপরেও নিত্যদিনই নতুন নতুন ধূমপায়ীর সংখ্যা বাড়ছে। প্রতিদিনই নানাবিধ রোগে আক্রান্ত হচ্ছে অজস্র তরুণের স্বপ্ন। দুনিয়াজুড়ে মাদকবিরোধী প্রচারণা সবচেয়ে বেশি হয়ে থাকে। আর মজার বিষয় হলো এই প্রচারণাগুলোতে বহু ধূমপায়ী অংশ নিয়ে থাকে। র্যালি শেষ করেই সিগারেট ফুঁকতে দেখা গেছে বহু তরুণকে। এক নিরীক্ষায় দেখা গেছে ১৫ থেকে ২৫ বছর বয়সী ধূমপায়ীর সংখ্যা প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। কারণ হিসেবে যে সমস্যাগুলো চিহ্নিত করেছেন বিশেষজ্ঞরা, সেগুলো হলো কৈশোর কিংবা তারুণ্যের অহেতুক খেয়ালিপনা, বন্ধুদের অসৎ প্ররোচনা, পারিবারিক দায়িত্বহীনতা, বাবা-মায়ের সম্পর্কের বিচ্ছেদ, প্রেমের ব্যর্থতা, নায়কোচিত মনোভাব, অতি আধুনিকতার ব্যর্থ চিন্তা, নিঃসঙ্গতা, সৃজনশীলতার বিকাশ মনে করা ইত্যাদি। শুধু মাদকই একটি জাতিকে ধ্বংস করার জন্য যথেষ্ট। যে তরুণ সমাজ আজ মাদকের নেশায় বুঁদ হয়ে থাকছে, তারাই কিন্তু ভবিষ্যতের নেতৃত্ব। মাদক নিয়ে অসংখ্য সভা, সেমিনার আর গোলটেবিল বৈঠক হলেও মাদকের ব্যবহার কখনই কমেনি। সিগারেট দিয়েই মূলত মাদকের শুরু হয়। তারপর ক্রমান¦য়ে গাঁজা, চরশ, ফেনসিডিল, হিরোইন, পেড্রোথিন আরও কত কি। সাম্প্রতিক সময়ে ইয়াবা শব্দটি নেশার জগতকে খুব আলোড়িত করেছে। উচ্চ মধ্যবৃত্ত ও ধনী পরিবারের মাদকাসক্ত তরুণদের কাছে ইয়াবা বেশ পরিচিতি পেলেও এর ধ্বংসাত্মক বিষয়ে কতটা ভয়াবহ তা ইতোমধ্যেই অনেকের মাঝে দেখা দিয়েছে। কিছুদিন পূর্বে প্রকাশিত হওয়া এক প্রতিবেদনে ভয়াবহ এক তথ্য উঠে এসেছে। তা হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়ই প্রতি মাসে কোটি টাকার অধিক সিগারেট বিক্রি হয়। আর এর ৯০ শতাংশই হলো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া শিক্ষার্থী। মাদক থেকে একজন তরুণকে ফেরাতে পারে তার পরিবার। সন্তানদের প্রতি বাবা-মা’র কর্তব্য সঠিকভাবে হওয়া উচিত। গাইডনেস ব্যাপারটি তাই খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বাবাকে সিগারেট টানতে দেখে অনেক সন্তান এই বস্তুটির মোহে পড়ে যায়। তাই পিতার দায়িত্ব রয়েছে সš-ানকে সিগারেটে আসক্ত না করার বিষয়ে। অনেক সময়ই বাবা-মা’র সম্পর্কের বিচ্ছেদে মাদক ব্যবচ্ছেদ করে বহু তরুণের। মদ, হিরোইন এমনকি ইয়াবার মতো অতিবিষাক্ত মাদকে আসক্তি গড়ে তোলে বহু তরুণ-তরুণী। পারিবারিক বন্ধন এক্ষেত্রে খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। শহরায়নের ফলে যৌথ পরিবারগুলো এক পরিবারে পরিণত হয়েছে। মূল্য বৃদ্ধির এই শহরে বাবা-মা দু’জনকেই চাকরি করতে হয়। তাই সন্তান বেড়ে ওঠে কম্পিউটার, গেমস, টিভি আর কাজের লোকের কাছে। যথাযথ যতœআত্তির অভাবে এই ছেলে-মেয়েগুলো কৈশোরে পা দিয়েই হাতে তুলে নেয় সিগারেট। পরে হিরোইন ও ইয়াবা তাদের জীবন করে দেয় ধ্বংস। প্রেমে ব্যর্থ হলেই মদ গিলতে হবে কিংবা মাদক গ্রহণ করে জীবনকে দুর্বিষহ করতে হবে এমন মনোভাব কখনই গ্রহণযোগ্য নয়। যে ছেলেটি কিংবা মেয়েটি আপনার জীবন থেকে হারিয়ে গেছে তার জন্য অশ্রুর রোদন থাকতে পারে, স্মৃতিকাতরতার আস্ফালন থাকতে পারে, কিন্তু মাদক গ্রহণ করে তাকে ভুলে থাকার ইচ্ছেটার কোনো মানে হয় না। মনে রাখতে হবেÑ যে যায় ভুলে, সে তো ভালোই থাকে। তাই আপনার ভালো থাকতে দোষটি কোথায়। অন্যদিকে কেউ কেউ সৃজনশীল কাজের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে মাদককে মনে করেন, যা হাস্যকর বৈ কিছু নয়। দুনিয়াজুড়ে বহু স্বনামধন্য শিল্পী রয়েছেন, যারা মাদককে না বলেই সৃষ্টি করেছেন অসংখ্য শিল্পকর্ম। সাদা চোখে সিগারেটে আসক্ত হলে যে রোগগুলো হতে পারে সেগুলো হলো ফুসফুসে ক্যান্সার, উচ্চরক্ত চাপ, গলব¬াডারের ক্যান্সার, মুখের ক্যান্সারসহ চুল পড়ে যাওয়া, ঠোঁট ও দাঁতের মাড়ি কালো হওয়া ছাড়াও সিগারেটের আলকাতরা জাতীয় পদার্থ গলা থেকে মুখাবয়বের সৌন্দর্যহানি ঘটায়। ফুসফুস সব সময়ই নির্মল বাতাস নিতে চায়। কিন্তু ধূমপায়ীরা তার বদলে দেয় নিকোটিনের কালো ধোঁয়া। ফুসফুসকে প্রতিনিয়ত নির্মল বাতাস গ্রহণ করতে দিন। সব দ্বিধা, ভুলকে প্রশ্রয় না দিয়ে সিগারেট তথা মাদককে না বলুন। কারণ মাদক কখনই আপনার বন্ধু হতে পারে না। জীবন সুন্দর, তাই সুন্দরকে আলিঙ্গন করুন ভালোবেসে। কারণ আপনি নিজেই সৃষ্টির অনবদ্য এক সৌন্দর্য।
0 comments:
Post a Comment