মাদক -ক্ষয়ে যায় নৈতিক মূল্যবোধ
আলী ফোরকান
গুলশান হত্যা ঘটনার পর সবাই চিন্তিত। আসলে আমাদের তরুণদের হয়েছে কি? যে কারণে খবরের কাগজ খুলতে বা পড়তে ভয় হয়। তা পাছে আবার ও না ঐ রকম কোন ঘটনার খবর থাকে। আবারও না একটা সাংঘাতিক, নির্মম, লোমহর্ষক হত্যার সংবাদ নজরে আসে। এতটুকু বাচ্চা-বাচ্চা কিশোর-কিশোরীদের হলোটা কী? এরা ঠান্ডা মাথায় নির্বিকারভাবে, নিশ্চিন্তে অবলীলায় খুন করছে দেশী-বিদেশীদের। বাবা-মা-ভাই-বোন-বন্ধু-বান্ধব এবং প্রেমিকাকে। এসব সুকুমার কিশোর-কিশোরী এত নৃশংস হয়ে যাচ্ছে কীভাবে? কিশোর তরুণদের বলা হয় সমাজের প্রাণ। তারুণ্যের স্রোতেই বদলায় সমাজ। তরুণরা মাদকাসক্ত ও বিপথগামী হয়ে পড়লে সামাজিক অস্থিরতা বাড়ে। সার্বিক আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটে। সর্বোপরি বেড়ে যায় সামাজিক অবক্ষয়। ক্ষয়ে যায় নৈতিক মূল্যবোধ। ভেঙে পড়ে পারিবারিক আস্থা আর বিশ্বাস।
কিশোরদের এই সমস্যা একদিনে তৈরি হয় না। একজন কিশোর কেন অপরাধী হয়। কেন হত্যা করার মতো মানসিকতা অর্জন করে ফেলে বাবা-মায়ের অলক্ষ্যে। সেটা বুঝতে গেলে দেখতে হবে জন্ম থেকে তার বেড়ে ওঠার ইতিহাস। অর্থাৎ পরিবার। শিশুর জীবন নিয়ন্ত্রিত হয় বাবা-মায়ের মানসিকতা ও চাহিদা অনুযায়ী। অর্থনৈতিক অস্বাচ্ছন্দ্য রাজনৈতিক ডামাডোল, যৌথ পরিবার ভেঙে যাওয়া ইত্যাদি নানা জটিল ঘটনা বাড়ছে। সমাজের প্রতিস্তরেই শুরু হয়েছে প্রতিযোগিতা। এই প্রতিযোগিতায় উত্তরে যাওয়ার জন্য অভিভাবকরা ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। সন্তানের প্রতি চিরন্তন ভালবাসা, স্নেহ পরিবর্তিত হয়ে প্রকাশ পেল এক ধরনের পেশাদার মনোবৃত্তিতে। ফলে মায়েরা নিজের স্ট্যাটাস রক্ষা করতে ক্রমাগতই বাইরের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। যথাযথ নজর রাখতে পারেন না সন্তানের ওপর। এতে ছেলে-মেয়েরা নিজেদের অবহেলিত মনে করে। আর একটু একটু করে অবহেলিত হতে হতেই বাড়তে থাকে বাবা-মায়ের সঙ্গে সন্তানের দূরত্ব। অর্থাৎ্ বাবা-মায়ের উদাসীনতার দৌলতে সমস্যা অনেকদিন ধরে জমতে জমতে অবশেষে সন্তানের ঘাতক বনে যাওয়ার ঘটনা ঘটে। এছাড়া আজকের শিশুদের সামনে নেই কোনও 'রোল মডেল'। সন্তান সাধারণত বাবাকে অনুকরণ করেই বড় হয়। ছোট বয়স থেকেই সন্তান জানে, দেখে বা বুঝতে পারে পরিবারের কর্তা বাবা। তিনি মুখ্য ভূমিকায় থেকে সবকিছু সুন্দর ও সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করে থাকেন। তিনিই তার আদর্শ। তার সম্পর্কে একটা সমীহ এবং সম্ভ্রম ভাব গড়ে ওঠে শিশুমনে। পরে যখন সে দেখে যে যিনি তার কাছে আদর্শ বলে পরিগণিত হয়ে আসছেন তাঁর কাজে প্রকাশ পাচ্ছে চরম নীতিহীনতা বা দুর্নীতি। তখন সে শুধু বড় ধাক্কা খায় তাই নয়, তার ভেতরে একটা যন্ত্রণারও সৃষ্টি হয়, ফলে হয় বিপথগামী। বর্তমান সময়ে একক পরিবার শিশুকে করে তোলে অসামাজিক,স্বার্থপর, মূল্যবোধহীন, স্পর্শকাতর সর্বোপরি একাকী। আর নিঃসঙ্গতা কাটাতে সে কম্পিউটার ও টেলিভিশনকে বেছে নেয়। যে জগৎ্ তাকে কোনও কিছু ভাবতে শেখায় না বরং অস্থির করে তোলে। বাবা-মায়ের আচরণ বদলাতে হবে। সময় বের করতে হবে শিশুকে সঙ্গ দেয়ার। তার কোন কাজ অপছন্দ হলে শ্লেষাত্মক বাক্য ব্যবহার না কওে সমালোচনা না করে আন্তরিকতার সঙ্গে তার ত্রুটি কোথায় তা বুঝতে সাহায্য করুন এবং ভালো কাজের প্রশংসা করে উত্সাহ দিন। এছাড়া তার স্কুলের বন্ধু, পাড়ার বন্ধুদের— সম্পর্কে খোঁজ-খবর নিন। স্কুলের নানা গল্প যেমন কোন্ বন্ধু কী বলল, খেলার মাঠে কী হলো, শিক্ষকরা কী বলল ইত্যাদি গল্প জানতে চান। খেয়াল রাখবেন পুরো ব্যাপারটাই যেন গল্পচ্ছলে হয়। ওর একবারও যেন মনে না হয় যে, আপনি ওর ওপর নজরদারি করছেন বা জেরা করছেন। নিজের বন্ধু-বান্ধব, অফিসের গল্প এবং ছেলেবেলার গল্পও করুন। এভাবেই সন্তানের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি হবে ও পরস্পরের মধ্যে বন্ধনের সেতু গড়ে উঠবে।
অন্যদিকে দেশে মাদকের যে ব্যাপকতা বেড়েছে তা তো পত্র-পত্রিকায় ছাপা হচ্ছে। যা পড়ে মনে হওয়া খুব স্বাভাবিক যে বাংলাদেশ যেন এখন মাদকের অভয়াশ্রম। আর এত সহজলভ্য যে হাত বাড়ালেই মেলে ফেনসিডিল, হেরোইন, গাঁজা, বাংলা মদ ও ইয়াবা। অথচ দেশে মাদক প্রতিরোধে বা নিয়ন্ত্রণে কঠোর আইন প্রণয়ন করা হয়েছে কিন্তু এর প্রয়োগ নেই। যে পুলিশ দম্পতি খুন হলেন নিজের আত্মজার হাতে সেই পুলিশ প্রশাসনের ছত্রচ্ছায়ায় তো আজ মাদকের রমরমা ব্যবসা। তাদের সামনেই তো প্রকাশ্যে কেনাবেচা হচ্ছে মাদকদ্রব্য।
কারণ যাই হোক কিশোর অপরাধ যে বাড়ছে, বাড়ছে বিপজ্জনকভাবে। নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার আগেই সমাজ পিতাদের বোধহয় ভেবে দেখা দরকার। কীভাবে এটা আটকানো যায়। প্রশাসনকেও সক্রিয় ভূমিকা রাখতে হবে। মুখ ঘুরিয়ে থাকার দিন শেষ। বিপদ এখন আমাদের প্রত্যেকের চৌকাঠে।
0 comments:
Post a Comment