মাদক- অপসংস্কৃতি ও সা¤্রাজ্যবাদীদের নীরব মারণাস্ত্র
আলী ফোরকান
শোলাকিয়া ও গুলশান ট্র্যাজেড়ির প্রেক্ষিতে মাদকের ব্যাপারে উদ্বেগ নতুন মাত্রা পেয়েছে। নতুন প্রজন্মের নীরব ঘাতক মাদক এখন সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, এক শ্রেণীর পুলিশসহ বিভিন্ন শ্রেণী পেশার অনেকেই এই ঘাতক মাদকের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েছে। রাজধানীর অভিজাত এলাকা থেকে শুরু করে বস্তি সর্বত্র মাদক থাবা বিস্তার করেছে। বিশেষ করে ইংলিশ মিডিয়ামের স্কুল-কলেজ ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এবং বিত্তবানদের সন্তানের মধ্যে মাদক এখন বাসা গেড়ে বসেছে। এই বাস্তবতার কারণ নিয়ে নানা মত থাকলেও মূলত ধর্মীয় মূল্যবোধের অভাব। পারিবারিক বন্ধন শিথিল হওয়া, একান্নবর্তী পরিবার ভেঙে যাওয়া। রাজনৈতিক নেতৃত্বের দৃষ্টিভঙ্গিগত ব্যর্থতা এবং সর্বোপরি সীমান্ত দিয়ে মাদক প্রবেশ ঠেকানোর ব্যর্থতাই এ জন্য প্রধানত দায়ী। সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তোলার দায়িত্ব যে নতুন বংশধরদের উপর বর্তায় তাদের পরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করে দেয়ার দেশী-বিদেশী নানা মহলের নীল-নকশা এর পেছনে থাকাও বিচিত্র কিছু নয়। দেখা যাচ্ছে, পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত তথাকথিত প্রগতিশীলদের যখন মাদকের আসক্তি অক্টোপাশের মতো গিলে খাচ্ছে, তখন মাদ্রাসা শিক্ষায় শিক্ষিত তথা মূল্যবোধের চর্চাকারীদের মধ্যে এর কোন প্রভাবই নেই। সে কারণেই শিক্ষা নীতি ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আচরণবিধির বিষয়টির খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই সঙ্গে মাদকের সাথে জড়িত মূল হোতাদের দৃষ্টান্তমূলক কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করাও জরুরী।
সাম্প্রতিক ঘটনাবলী সমাজের নানা স্তরে আঘাত হানলেও মাদকাসক্তির নেতিবাচকতা নিয়ে বহু দিন থেকেই নানাভাবে লেখালেখি, কথাবার্তা, আলাপ-আলোচনা হয়ে আসছে। মাদক নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকারের একটি বিভাগ রয়েছে। সেখানে উচ্চ বেতনভোগী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পাশাপাশি দেশব্যাপী নেটওয়ার্ক রয়েছে। এমনকি এই সংস্থার গোয়েন্দা শাখাও আছে। বাস্তবতা হচ্ছে, দিন দিনই মাদক আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। সঙ্গত প্রশ্ন হচ্ছে, কেন এই বাস্তবতা? অন্যদিকে এই বিভাগের সাথে যুক্ত এক শ্রেণীর কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিত্ত-বৈভব দিন দিন বৃদ্ধি হচ্ছে। আজ পর্যন্ত এ ধরনের কারো বিরুদ্ধে কোন কার্যকর শাস্থিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। কখনো কখনো শাস্থিমূলক পোস্টিং হিসাবে এ সব বিভাগে দায়িত্বশীলদের নিয়োগ দেয়া হয়। আবার অনেক ক্ষেত্রে চাকরির মেয়াদের শেষ দিনগুলো এখানে কাটাতে দেয়া হয়। বাস্তবতার আলোকে দেখতে হলে অবশ্যই কিভাবে মাদক দেশে প্রবেশ করে সেদিকে তাকানো দরকার। দেশে যেহেতু উৎপাদন নিষিদ্ধ সুতরাং চোরাচালান হয়েই মাদক দেশে প্রবেশ করে। এই চোরাচালানের প্রধান রুট হচ্ছে দেশের বিভিন্ন সীমান্ত। সীমাস্তের চার পাশ দিয়ে নানা ধরনের মাদক দেশে প্রবেশ করছে। প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী, এই চোরাকারবারীর সাথে প্রভাবশালী মহলের সম্পৃক্ততা রয়েছে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কোন কোন মহলের বড় আয় হচ্ছে মাদক বাণিজ্য থেকে। যুক্তিসঙ্গতভাবেই বলা যায়, সীমান্ত যারা দেখভাল করে তারা যদি শক্ত অবস্থান গ্রহণ করতে পারে। প্রভাবশালী মহলকে যদি নিয়ন্ত্রণ করা যায় আর সেই সাথে দেশের অভ্যন্তরে দেখা যাদের দায়িত্ব তাদের উপর যদি যথাযথ নজরদারি করা যায় তাহলে অবশ্যই শতকরা ৯০ ভাগ সফলতা অর্জন সম্ভব। এর পরে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে মোটিভেশন। সামাজিক নীতি, শৃঙ্খলাবিধি এবং শিক্ষা নীতিতে মূল্যবোধের চর্চাকে সুসঙ্গত করা গেলে অবশ্যই এই প্রবণতা থেকে নতুন বংশধরদের মুক্ত রাখা সম্ভব। দুর্ভাগ্যের বিষয় হচ্ছে, শিক্ষকসহ যে শ্রেণীর দায়িত্ব তরুণদের মাদক আসিক্তমুক্ত রাখতে উদ্বুদ্ধ করা তাদেরই কোনো কোনো অংশের মধ্যে মাদকাসক্তি ও এতে প্ররোচনা দেয়ার প্রবণতা রয়েছে। এই প্রবণতা ঝেড়ে ফেলতে হবে। প্রধানত তরুণদের এই প্রবণতা থেকে মুক্ত রাখতে রাজনীতিকদের ভূমিকা পালন করা জরুরী হয়ে পড়েছে। মাদকাসক্তি অবৈধ যৌনাচারকে প্ররোচিত করে। মাদকের সাথে সম্পর্ক রয়েছে অবৈধ অস্ত্রের। সুতরাং এই অপশক্তি মুক্ত বাংলাদেশ গড়ে তুলতে হলে দৃঢ় রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের কোন বিকল্প নেই। বাস্তবতা হলো, আমাদের রাজনীতিক মহলে পারস্পারিক দোষারোপ প্রক্রিয়া সক্রিয় থাকলেও বংশধরদের সুনাগরিক হিসাবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তাদের কোন ভূমিকাই পরিলক্ষিত হচ্ছে না। এটা মনে রাখা দরকার, তরুণরা যদি নিষ্প্রভ, নিষ্ক্রীয় এবং দেশ-ভাবনা বিচ্যুত হয় তার বড় নেতিবাচক প্রভাব পড়বে রাজনীতিতেও।
দেশ রক্ষার প্রয়োজনেই মাদকের বিরুদ্ধে দলমত শ্রেণী, পেশা নির্বিশেষে সকলের ঐক্যবদ্ধ হওয়া প্রয়োজন। মাদক হচ্ছে অপসংস্কৃতি ও সা¤্রাজ্যবাদীদের নীরব মারণাস্ত্র। আফ্রিকার দেশগুলোতে সম্পদ লুটতে সস্তা মাদকের নেশায় বুদ করে রাখা হয়েছে নাগরিকদের। সুস্থ সংস্কৃতি রক্ষার প্রয়োজনেই মাদককে না বলতে হবে। শুধু আনুষ্ঠানিকতার মধ্য নয় বাস্তবও প্রতিফলন ঘটাতে হবে। ঘরে ঘরে সচেতনতা ও সতর্কতার মশাল জ্বালিয়ে রাখতে হবে। যারা আসক্ত হয়ে পড়েছে তাদের সারিয়ে তোলা এবং সেই সাথে নতুন করে যাতে কেউ আসক্ত হতে না পারে সে লক্ষ্যে পরিবার, সমাজ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে সর্বস্তরে কার্যকর নজরদারী বহাল রাখতে হবে। রাষ্ট্রকে এক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকায় থাকতে হবে। মাদককে নিয়ে যে আতঙ্ক-উদ্বেগ সর্বোচ্চ পর্যায়ে ছড়িয়ে পড়েছে। তার অবসানে সরকারসহ সকলকে আন্তরিক ও কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
0 comments:
Post a Comment