Thursday, July 21, 2016

মাদকে শৈশব চুরি হচ্ছে

মাদকে শৈশব চুরি হচ্ছে 
আলী ফোরকান
কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম চত্বরসহ রাজধানীর বিভিন্ন রাস্তার মোড়ে মাদকাসক্ত শিশু কিশোরদের হরহামেশাই চোখে পড়ে। আসক্ত শিশুদের নিয়ে কেউ ভিক্ষা করছেন আবার কেউ ভাড়া খাটাচ্ছেন। শিশুদের দিয়ে প্রকাশ্েয এরকম মানব ধ্বংস নীলায় একটি চক্র মেতে উঠলেও আইন প্রয়োগকারী ও মাদক প্রতিরোধকারী সংস্থা, জনপ্রতিনিধি কিংবা সচেতন সমাজ চোখে দেখেও যেন দেখছেন না। যেন শিশুদের জন্য সবই হালাল আর বধৈ! রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো এসব মাদকাসক্তের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের যথাযথ কোনো ব্যবস্থা নেই। আবার এদের নিয়ে জানা-অজানা বহু এনজিও বছরের পর বছর কাজ করলেও প্রত্যাশিত ফল পাচেছন না ভোক্তভোগীরা। পথশিশু কিশোর হিসেবে যারা ছোট্ট কাল থেকে মাদকাসক্ত হয়ে উঠছেন তাদের প্রায় সবাই অপাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছেন। অভিজাত এলাকায় কিংবা উচ্চবিত্ত পরিবারের মধ্যে যেসব শিশু-কিশোর মাদকাসক্ত হয়ে পড়ছেন তারা পথশিশুদের ন্যায় না হলেও ‘ঐশী’ হয়ে উঠছেন। অপর দিকে যারা সমাজ ও পরিবারের অসচেতনতায় যারা মাদকাসক্ত হয়ে উঠছেন তাদের কেউ আর মানুষ মনে করে না। এমনকি নিকটাত্মীয়দের কাছেও ওইসব শিশু-কিশোর মানে চরম অবহেলা আর ঘৃণার পাত্র। এমনটাই বলেছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মনোবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. নজরুল ইসলাম, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউট ও হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক ডা. অভ্র দাশ ভৌমিক ও অপরাধ বিষেজ্ঞরা।
অপরাজয়ী বাংলাদেশ নির্বাহী পরিচালক জানান, দেশে বর্তমানে প্রায় ১৪ লাখ পথশিশু রয়েছে, যারা কোনো না কোনোভাবে মাদক সেবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত। মাদকদ্রব্য অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, দেশের বিভিন্ন মাদক নিরাময় কেন্দ্রে প্রায় ১৩ হাজার মাদকাসক্ত চিকিৎসাধীন রয়েছে। যাদের মধ্েয বেশির ভাগই মধ্য ও উচ্চবিত্ত পরিবারের উঠতি বয়সী ছেলেমেয়ে। এ থেকে প্রমাণিত হয়, পথশিশুদের মধ্েয আসক্ত শিশু-কিশোররা চিকিৎসার সুযোগ-সুবিধা না পেলেও মধ্য ও উচ্চবিত্ত পরিবারের আসক্ত শিশু-কিশোররা চিকিৎসার সুযোগ পাচ্ছেন। মধ্য ও উচ্চবিত্ত পরিবারের বিশেষ করে স্কুল কলেজপড়ুয়া শিক্ষার্থীরা মাদকাসক্ত হয়ে পড়ছেন। ছোট্ট বেলা থেকেই শিশুদের নৈতিকতা ও ধর্মীয় মূল্যবোধ বিষয়ে সচেতন করে তুলতে হবে জানিয়ে বিশিষ্ট আইনজীবী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক জানান, মাদকের ভয়াবহ নেশা একটি সম্ভাবনাময় যুবসমাজকে ক্রমশ ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এজন্য সমাজ, পরিবার ও রাষ্ট্রকে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিতে হবে। শিশু-কিশোর মাদকাসক্তরাই এক পর্যায়ে ভয়ানক কিলার হয়ে উঠে।
এক সমীক্ষায় দেখা যায়,রাজধানীতে বিভিন্ন জনবহুল যেমন রেলওয়ে স্টেশন, বাসস্ট্যান্ড, লঞ্চ টামর্নিাল, বাজার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চত্বর ও রাস্তার মোড়ে মোড়ে মাদকাসক্ত শিশুদের নিয়ে একটি চক্র বাণিজ্যে মেতে উঠেছে। সমীক্ষায় আরো দেখা যায়, মাদকাসক্ত শিশু-কিশোরদের দিয়ে মাদক ব্যবসাও নিয়ন্ত্রণ করছে এই চক্রটি। নাম প্রকাশে অনিচছুক এ চক্রের বেশ কয়েকজন বলেন, কম বয়সী শিশুদের দেয়া হচেছ ঘুমের ওষুধ, আবার দুই থেকে তিন বছরের শিশুদের দেয়া হচেছ বিভিন্ন ধরনের নেশার ইনজেকশন। ভাগ্যের নিষ্ঠুর পরিহাস, জন্ম থেকেই কিছু শিশু মাদকে অভ্যস্ত হয়ে আসছে। যাদের অনেকে জীবনের সঙ্গে যুদ্ধ করে বেঁচে রয়েছে, আবার অনেকে মারা যাচ্ছে ওই বয়সেই।
কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় আসক্ত শিশু কিশোর দিয়ে মাদক বিক্রি করা হচেছ। বিভিন্ন ট্রেনে করে প্রায় এসব শিশু-কিশোর আসক্ত মা-বাবা কিংবা অন্য কারও হাত ধরে রাজধানীতে আসছে। অনেক মাদকাসক্ত শিশু-কিশোর ও মা-বাবাকে আটক করে আদালত ও শিশু-কিশোর সংশোধন কেন্দ্ের পাঠানো হয়।
নাম প্রকাশে অনিচছুক মাদকাসক্ত ও মাদক ব্যবসায়ী জানান, আসক্ত শিশু-কিশোরদের শরীরের বিভিন্ন স্থানে আগুনের ছ্যাঁকা দিয়ে দগদগে ঘা বানিয়ে চিকিৎসার নাম করে টাকা নেয়া হচেছ, আবার কখনও ফুটপাত বা বস্ত—ি থেকে নবজাতক কিনে এনে তাদের কষ্ট ও অসহায়ত্ব দেখিয়ে ভিক্ষা চাওয়া হচেছ। এসব শিশু যাতে চিৎকার না করতে পারে সেজন্য ঘুমের ওষুধ কিংবা নেশা জাতীয় ইনজেকশন দেয়া হয়। মাদকাসক্ত ও মাদক ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, যারা শিশু-কিশোরদের দিয়ে ভিক্ষাবৃত্তি ও মাদক বিক্রি করায় তারা খুবই হিং¯্র ও পাষ- হয়। এসব শিশু দিয়ে বিভিন্ন স্কুল কলেজ ও ইংরেজি মাধ্যম স্কুলগুলোর সামনেও বসানো হয় মাদক বিক্রির জন্য। উদ্বেগের বিষয় হচেছ, আসক্ত শিশু-কিশোর দিয়ে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আবাসিক হলগুলোতে মাদক পাচার করা হয়। শিশু-কিশোরদের ভালো পোশাক পরিয়ে, হলে থাকা শিক্ষার্থীদের স্বজন বানিয়ে ভেতরে প্রবেশ করানো হয়। ওইসব শিশু-কিশোরদের সঙ্গে থাকে ইয়াবা হেরোইনসহ বিভিন্ন ধরনের মাদকদ্রব্য।
পুলিশ সদর দফতর ও ডিএমপি সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে, শিশু-কিশোরদের মধ্েয অপরাধের সংখ্যা বাড়ছে, বিভিন্ন অপরাধে আটকও করা হচেছ শিশু-কিশোরদের। যাদের মধ্েয ৯০ শতাংশই মাদকাসক্ত। আবার অনেক মধ্য ও উচ্চবিত্ত পরিবারের সদস্যরা মাদকাসক্ত শিশু-কিশোরদের সেচ্চায় থানায় সোর্পদ করছেন। অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুধু আইন ও প্রতিরোধকারী সংস্থা দিয়ে মাদকের ভয়াবহ প্রসার-ব্যবসা বন্ধ করা সম্ভব হবে না। পারিবারিক, সামাজিক ও জনপ্রতিনিধি সমন্বয়ে মাদকের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে।
জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদে বলা হয়েছে, শিশুদের নিরাপত্তা ও বেঁচে থাকার অধিকার জন্মগত। সনদের ১৯ ধারায় বলা হয়েছে, রাষ্ট্র শিশুদের যে কোনো ধরনের অনাচারের কবল থেকে রক্ষা করার দায়িত্ব পালন করবে। যা এসব আসক্ত শিশু-কিশোরের বেলায় অধরা। এক কথায় শৈশব চুরি হচেছ মাদকের ব্যবহার ও প্রসারে।

0 comments:

Post a Comment