Saturday, July 2, 2016

পরিবেশ:জলবায়ু পরিবর্তনে কৃষি উৎপাদন কমবে

পরিবেশ:জলবায়ু পরিবর্তনে কৃষি উৎপাদন কমবে
আলী ফোরকান
জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশ বিপর্যয় গড়ছে। ফলে ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের কৃষি উৎপাদন ৩০ ভাগ কমে যাবে। একই কারণে এ সময়ের মধ্যে ধ্বংস হয়ে যাবে দক্ষিণ এশিয়ার ২২ শতাংশ কৃষি জমি। ফলে এ অঞ্চলে খাদ্য সঙ্কট চরম আকার ধারণ করবে। অথচ দক্ষিণ এশিয়ার মোট জিডিপির ২৬ ভাগ আসে কৃষিখাত থেকে।বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশ্বে ক্রমবর্ধমান জনগোষ্ঠীর খাদ্য, ওষুধ ও অন্যান্য প্রয়োজন মেটাতে জীববৈচিত্র্যের প্রতি মানুষের বিরূপ কর্মকা- যে হারে বাড়ছে, তাতে আগামী ১৫ বছরের মধ্যেই প্রায় ২৫ শতাংশ প্রাণী ও উদ্ভিদ পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। বিশেষজ্ঞদের মতে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব থেকে রক্ষা করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে বৃক্ষায়ন। বায়ুম-ল থেকে কার্বন গ্রহণের মাধ্যমে বৃক্ষ মানবসৃষ্ট গ্রিনহাউস গ্যাস হ্রাস করে তার প্রভাব থেকে রক্ষা করে। পৃথিবীতে নির্গত কার্বনের সবচেয়ে বড় অংশ অর্থাৎ ৬০ ভাগ ধারণ করতে পারে বনের প্রাকৃতিক পরিবেশ। এর অভাবে পৃথিবী থেকে বার্ষিক ৯০ ভাগ কার্বন বায়ুম-লে নিঃসরিত হয়। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা ও বনজ সম্পদের চাহিদা মেটানোর জন্য দেশের মোট আয়তনের ২৫ ভাগ বন থাকা আবশ্যক। কিন্তু দেশে বর্তমানে এর পরিমাণ অনেক কম। সরকারি হিসাবে দেশে মোট বনভূমির পরিমাণ প্রায় ২ দশমিক ৫২ মিলিয়ন হেক্টর। বিশ্বে প্রতি মিনিটে ৮ হেক্টর করে বনভূমি ধ্বংস হচ্ছে। ফলে প্রাকৃতিক ভারসাম্য ক্ষুণœ হচ্ছে। অন্যদিকে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অপরিকল্পিত শিল্পায়ন, নগরায়ন, রাস্তাঘাট তৈরির কারণে গাছ-পালা ও বনভূমি ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে। এসব বিপর্যয় রোধে ও চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার প্রধান হাতিয়ার হচ্ছে যতো বেশি সম্ভব বৃক্ষরোপণ। এজন্য ২০১৫ সালের মধ্যে বনাঞ্চলের পরিমাণ ২০ ভাগে উন্নীত করতে সরকার বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নিয়েছিল। বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশের পরিবেশ বিষয়ক এক রিপোর্টে বলেছে, সম্প্রতি বাংলাদেশ পাঁচ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি অর্জন করলেও একই সময়ে শুধু পরিবেশ বিপর্যয়জনিত অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ চার শতাংশ জিডিপির সমান। শুধু রাজধানীর পানিসম্পদের দুর্বল ব্যবস্থাপনায় বছরে সাড়ে চার হাজার কোটি টাকারও বেশি ক্ষতি হচ্ছে। দেশের পরিবেশ বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার আবাসন সঙ্কট মোকাবেলায় প্রতিনিয়ত উজাড় হচ্ছে বনভূমি ও জলাশয়সহ প্রাণিকুলের অপরাপর বাসস্থান। ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর নেচার কনজারভেশন সোসাইটি (আইইউসিএন) বাংলাদেশের প্রাণিজগতের ওপর পরিচালিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলেছে, বাংলাদেশে স্থানীয় পাখির প্রজাতির সংখ্যা ৩৮৮ এবং বিভিন্ন দেশ থেকে এসে এ দেশে বসবাস করছে এমন পাখির প্রজাতির সংখ্যা ২৪৪টি। এর মধ্যে ১২ প্রজাতির পাখি ইতিমধ্যেই বিলুপ্ত হয়ে গেছে, আরো ৩০ প্রজাতির পাখি দ্রুত বিলুপ্তির পথে। বাংলাদেশ ভূখ-ে একসময় ১১০ প্রজাতির পশুর বিচরণ ছিল। এর মধ্যে আইইউসিএনের জরিপে ৪০ প্রজাতিকে তাদের ‘রেড ডাটা বুক’-এ অন্তর্ভুক্ত করেছে। দেশে ঔষধি, বনজ ও ফলদসহ পাঁচ হাজারের বেশি গাছপালা ছিল। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, ইতিমধ্যে এর ১০ শতাংশ বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইন্সটিটিউট সূত্রে জানা গেছে, এক সময় দেশে ১৬৬ প্রজাতির মিঠাপানির ও ৪৪২ প্রজাতির সামুদ্রিক মাছ পাওয়া যেতো। আইইউসিএন এখানকার ৫৪ প্রজাতির মাছকে তাদের রেড ডাটা বুকে অন্তর্ভুক্ত করেছে। পরিবেশ দূষণের ফলে রাজধানীর বাতাসও দিন দিন ভারি হয়ে যাচ্ছে। বাতাসে বিষাক্ত শিসার পরিমাণ বেড়েই চলেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণে বাংলাদেশের লাখ লাখ মানুষের স্বাস্থ্য ও জীবিকা হুমকির মুখে পড়েছে। পরিবেশ অধিদপ্তর বলছে, রাজধানী ও আশপাশের শিল্প-কারখানা থেকে মোট ৬২ ধরনের মারাত্মক ক্ষতিকর রাসায়নিক বর্জ্য নদীর পানিতে পড়ছে। পরিবেশ দূষণের কারণে বছরে ১৫ হাজার মানুষ মারা যাচ্ছে। দূষণের ফলে দেশের প্রায় ৭০ লাখ মানুষ নানা রোগে ভুগছে। এর ফলে বছরে অতিরিক্ত খরচ হচ্ছে প্রায় ছয় হাজার কোটি টাকা। এছাড়া পরিবেশ দূষণের ফলে মাতৃগর্ভেই প্রায় চার হাজার শিশুমৃত্যু বরণ করে থাকে। পরিবেশ অধিদপ্তর ও বিশ্বব্যাংকের এক গবেষণায় এসব তথ্য পাওয়া গেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পৃথিবী ?মাগত উষ্ণ হচ্ছে গ্রিনহাউস গ্যাসের প্রভাবে। শিল্প বিপ্লবের আগে হাজার বছর ধরে বাতাসে কার্বন ডাইঅক্সাইডের ঘনত্ব ছিল কম-বেশি ১০ থেকে ২৮০ পিপিএম। অথচ বর্তমানে বায়ুম-লে কার্বন ডাইঅক্সাইডের ঘনত্ব ৩৬০ পিপিএম ছাড়িয়ে গেছে। যা বিগত ৪ লাখ ২০ হাজার বছরেও দেখা যায়নি। বায়ুম-লে কার্বন ডাইঅক্সাইডের ঘনত্বের এ পরিবর্তন নিঃসন্দেহে জলবায়ু ব্যবস্থায় বিরাট ভূমিকা রাখে। কিন্তু এর সঙ্গে জড়িত প্র?িয়াটি বহুমুখী ও জটিল এবং একে অন্যকে সবসময় প্রভাবিত করে। আইপিসিসির তথ্যমতে, ১৯৫০ সালের পর উত্তর গোলার্ধে বসন্ত ও গ্রীষ্মকালে সমুদ্রে ভাসমান বরফের ব্যাপ্তি ১০ থেকে ১৫ ভাগ পর্যন্ত কমেছে। ১৯৫০ সালের পর থেকে বিশ্বব্যাপী সমুদ্রের উষ্ণতা বেড়েছে এবং বিশ শতকে সমুদ্রের পানির গড় উচ্চতা ০.১ মিটার পর্যন্ত বেড়েছে। মানুষের ব্যবহারের কারণে বাতাসে কার্বন ডাইঅক্সাইড নির্গমনের পরিমাণ ২১০০ সালে গিয়ে দাঁড়াবে ৫৪০ থেকে ৯৭০ পিপিএম। ১৯৯০ থেকে ২১০০ সময়কালে ভূপৃষ্ঠের গড় তাপমাত্রা ১.৪০ থেকে ৫.৮০ সেলসিয়াস পর্যন্ত বাড়তে পারে। আর এ সময়ের মধ্যে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়তে পারে ০.০৯ থেকে ০.৮৮ মিটার পর্যন্ত। জলবায়ুর এ পরিবর্তন বৃদ্ধি পেতে থাকলে তা ঝড়, জলোচ্ছ্বাস, বন্যা, অনাবৃষ্টিসহ অন্যান্য আবহাওয়াগত বিপর্যয়ে পরিণত হতে পারে। পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা জানান, দেশে জৈব কৃষি ব্যবস্থা চালু হয়নি। টেকসই পরিবেশ নিশ্চিত করার জন্য ভূমি ব্যবহার নীতিমালা করা হয়নি। জলাভূমি ও বনভূমি ব্যবহারের ক্ষেত্রে এখন পর্যন্ত কোনো নীতিমালাও প্রণীত হয়নি। আর এসব কারণে কৃষি সঙ্কটের দিকে যাচ্ছে। বাংলাদেশে পরিবেশ সংরক্ষণ আইন (১৯৯৫) আছে। বাংলাদেশ ১৯৫১ সালের ইন্টারন্যাশনাল প্লান্ট প্রটেকশন কনভেনশন থেকে ১৯৯২ সালে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ সংক্রান্ত কনভেনশন ও সর্বশেষ ধরিত্রী সম্মেলন পর্যন্ত অনেক আন্তর্জাতিক চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে। কিন্তু দেশের পরিবেশ সংরক্ষণে এগুলোর বাস্তবায়ন কার্যত নেই। আমরা আশাকরি সংশ্লিষ্ট কতৃপক্ষ পরিবেশ সংরক্ষণে সব পদক্ষেপই গ্রহণ করবে। 

0 comments:

Post a Comment