Tuesday, July 5, 2016

ঘুটুর আশ্রয়






ঘুটুর আশ্রয়
ড. ফোরকান আলী






প্রথম প্রকাশ:




প্রকাশক ঃ-
ফাতেমা আলী
৩৭/২ গগনবাবু রোড়
খুলনা -৯১০০।

স্বত্ত্ব ঃ লেখক কর্তৃক সংরক্ষিত।

প্রচ্ছদ পরিকল্পনায়
ফরহাদ হোসেন সোহাগ

অক্ষর বিন্যাসে
ফাতেমা কম্পিউটার
৩৭/২ গগনবাবু রোড়
খুলনা -৯১০০।

মুদ্রণে ঃ
মুদ্রাকর
নব পল্লী লেন-
খুলনা।
মুল্য -    টাকা মাত্র।



এড়ঃড়ৎ অংৎড়ু, ইু উৎ.ঋড়ঁৎশধহ অষর. চঁনষরংযবফ ইু ঋধঃবসধ অষর, ৩৭/২ এধমড়হ ইধনঁ জড়ধফ কযঁষহধ.




ভূমিকা:




ঘুটুর মনে প্রশ্ন জাগে কে ঐ নার্স? তাকে একান্ত আপন মনে হয়। মনে হয় সে কতযুগের চেনা। নার্সিং একটি মহৎ পেশা। তাতে তার সন্দেহ নেই। অধিকাংশ নার্সই রোগীকে অতি যতেœর সাথে সেবা করে থাকেÑ এটা তাদের মহান কর্তব্য। তাও ঘুটু জানে। কিন্তু তাকে যে নার্সটি দেখাশুনা করছে, সে কী তার পেশার খাতিরে এবং মানবিক কারণেই অতটা করছে, নাকি এর পেছনে অন্য কোন কারণ আছে! যদি কিছু থেকে থাকে তবে সেটি কী? কে ও?
ও সব সময় আসে না। শিপ্টিং ডিউটি তাই অন্যান্য নার্সও আসে। সবকজন নার্স তাকে ঠিক নার্সের মতোই দেখাশুনা করে শুধু ঐ একজন ছাড়া। সে একেবারে অন্যরকম। সে এসে ঘুটুর মাথাটা তুলে নিয়ে কখনও থাই-এর ওপর আবার কখনও বুকের ওপর ঘুটুর মাথাটা রাখে। তারপরে সে ঘুটুকে ঔষধ খাওয়ায়। সে ঘুটুকে এত সাবধানে নাড়াচাড় করে যে, সামান্য নড়া চড়ায় ও ঘুটু যেন আঘাত না পায়। তাই সে অতটা সতর্ক। ঘুটুর মাথাটা যখন সে বুকের মধ্যে তুলে নেয়, তখন ঘুটুর খুব লজ্জা করে। কেউ দেখলে কী মনে করবে! সে নিজেকে সরানোর চেষ্টা করে কিন্তু শরীরে জোর পায়না। তাই সুবোধ শিশুর মতো নার্সটিকে মেনে চলে।
ঘুটু হাসপাতালে এসেছে পাঁচদিন হলো। বাড়ী ফেরার পথে হঠাৎ সে জ্ঞ্যান হারিয়ে ফেলে। ঘুটুকে রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখে কয়েকজন লোক তাকে হাসপাতালে রেখে গেছেÑ একথা সে নার্সদের মুখে শুনেছে। তারপর থেকে সে হাসপাতালে আছে। শরীরের কয়েক জায়গায় চোটÑলেগেছে। সারতে হয়ত বেশ কিছুদিন সময় লাগবে। তাকে দেখাশুনা করার কেউ নেই তাই হাসপাতাল ছাড়া তার উপায়ও নেই। হাসপাতালের পরিবেশ তার কাছে অসহ্য তবুও ঐ নার্সটির জন্য কষ্টের ভারটা একটু কম মনে হয়।
হাসপাতালে জ্ঞান ফেরার পর সে তার পাশে বসা নার্সকে জিজ্ঞেস করেছিল, আমি কোথায়? আমি এখানে এলাম কী করে? তখন ঐ নার্স জবাব দিল, আপনি হাসপাতালে। অজ্ঞান হয়ে আপনি রাস্তায় পড়েছিলেন। কিছু সহৃদয় লোক আপনাকে এখানে দিয়ে গিয়েছে। কিন্তু আপনি অজ্ঞান হলেন কিভাবে?
ঘুটু বলল, চোখে দেখিনাতো, রাস্তার একপাশ থেকে অন্যপাশে যাচ্ছিলাম অমনি।
ঘুটুর মুখের কথা কেড়ে নিয়ে নার্সটি বলেছিলো, কী বললেন! আপনি চোখে দেখেন না!!
সত্যি বলছেন আপনি চোখে দেখেন না!!
অতো কষ্টেও ঘুটুর হাসতে ইচ্ছে করেছিল। বেশী কষ্টেও কারো কারো হাসতে ইচ্ছে করে। কিন্তু ঘুটুর শরীর তখন শক্তিহীন, সারা গায়ে ব্যথা! তাই হাসতে গেলেও কান্নার অভিব্যক্তি ফুটে উঠল। সে বলল, কী যে বলেন, মিথ্যা বলব কেন! নিজের চোখ নিয়ে কী কেউ রহস্য করে!
কিন্তু আপনি তো চোখে দেখতেন। আপনার এ অবস্থা হলো কী করে?
আপনি কি করে জানলেন যে, আমি চোখে দেখতাম?
নার্সটি কিছু সময় চুপ করে থাকল। হয়ত মনের মধ্যে কিছু সাজানো। বলল, আমি জানি, কিন্তু সেটা কথা নয়, আপনার এ অবস্থা হলো কী করে তাই দয়া করে বলুন।
ঘুটুর আগ্রহ হলো ঐ মহিলা কী করে তার পূর্বাবস্থা জানে তা জানার জন্যে, কিন্তু কথা বলতেও ভাল লাগলো না তাই সহজ করে বলল, প্রতিবাদের প্রতিদান।
নার্সটি আবার আগ্রহ ওআকুতি জানিয়ে বলল,বিষয়টি পরিস্কার করে বলুন।
ঘুটু একটু চুপ থাকে। তারপর বলল, আমার গ্রামের পাশে যে স্কুলে পড়েছি, তার পাশ দিয়ে হেটে যাচ্ছিলাম। আচমকা শব্দ শুনি বাচাঁও বাচাঁও। আমি তখন এগিয়ে গেলে কয়েকজন বখাটে আমার মুখেও এসিড় নিক্ষেপ করে। তবে মেয়েটি রক্ষা পেয়ে যায়।
Ñ কতদিন এ অবস্থা হয়েছে?
Ñ এই বছর চারেক হলো।
Ñ চিকিৎসা করান নি?
Ñ করিয়েছি কিন্তু কোন ফল হয়নি। হয়ত যেরকম চিকিৎসার প্রয়োজন ছিল, ঠিক সেরকমটি করানো হয়নি।
নার্সটি কিছু সময় কোন কথা বলল না। ঘুটু তার নাকটানার শব্দ পেলো। বুঝতে পারল ঐ নার্স কাঁদছে। এর পরে যখন দু’তিন ফোঁটা নোনা পানি তার মুখের উপর গড়িয়ে পড়ল, তখন ঘুটু ঐ নারীর কান্না সম্পর্কে নিশ্চিত হলো। তখনই ঘুটুর মনে প্রশ্ন দেখা দিল; নারীটি কে! তার দুঃখের কথা শুনে সে কাঁদছে কেন!
ঘন্টা খানেক পরে ঐ নার্স আবার এলো। ঘুটুকে বলল, আপনার বাসার ঠিকানা বলেন, আমি খবর দেবার ব্যবস্থা করি।
Ñ আমার তো কোন বাসা নেই। কোন ঠিকানা নেই।
Ñ সে কেমন কথা! বাসা না থেকে কী পারে! ভাবি কোথায়?
Ñ ঢাকায়।
Ñ তাহলে আপনি এখানে কেন? বেড়াতে এসেছিলেন বুঝি? তা এখানে কোন আত্মীয় স্বজন নেই? আপনার এক কাকা এই কক্্রবাজারে চাকরি করতেন না? উনি আছেন না?
Ñ না, উনি বদলী হয়ে সাতকানিয়া চলে গেছেন।
Ñ কক্্রবাজারে কি জন্য এসেছিলেন বললেন নাতো।
Ñ এমনিই।
Ñ না, এমনি হতে পারে না। আপনি চোখে দেখতে পান না, একা একা আপনি কক্্রবাজারে এমনি এমনি আসতে পারেন না। আমাকে খুলে বলেন না প্লিজ।
Ñ এটা আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার। আপনার এসব শুনতে চাওয়া উচিৎ নয়।
Ñ আমি দুঃখিত। আসলে ব্যাপারটা আমার কাছে একটু খটকা মতো মনে হলো। তাই একটু বেশী কৌতুহল দেখিয়ে ফেললাম। কিছু মনে করবেন না প্লিজ।
Ñ ঠিক আছে, মনে কিছু করলাম না। কিন্তু আমারও কৌতুহল জাগছে। আপনি আমার সম্পর্কে এতকিছু জানেন কী করে? কে আপনি?
Ñ আমি একজন নার্স।
Ñ সেতো জানি। কিন্তু এটাই তো পুরো পরিচয় নয়।
Ñ আমি সিস্টার।
Ñ এটাও আপনার পুরো পরিচয় নয়। নার্স, সিস্টার, এর বাইরেও আপনার একটা পরিচয় আছে। সে সূত্রেই হয়ত আপনি আমাকে চেনেন। সেটি কি বলেন প্লিজ।
Ñ এ ছাড়া আমার অন্য কোন পরিচয় নেই। আমি শুধ্ইু নার্স, শুধুই সিস্টার।
কিন্তু আপনার নাম, ঠিকানা আর কিভাবে আমাকে চেনেন, তাতো বললেন না।
Ñ প্লিজ এসব কথা জানতে চাইবেন না। তাহলে আমি আর আপনার দেখাশুনা করতে আসবো না।
এর পরে ঘুটু ওর কাছে ওর সম্পর্কে আর কিছু জিজ্ঞেস করেনি। তবে অন্যের কাছ থেকে জেনেছে যে ঐ নার্সের নাম রতœা।
ঘুটু আশা করেছিল ওর নাম হয়ত হবে তৃপ্তি । তৃপ্তির সাথে তার দেখা হয় না প্রায় দশ বছর হলো। যখন শেষ দেখা হয়েছিল তখন তৃপ্তি সবে এস.এস.সি পাস করে কলেজে ভর্তি হয়েছে। এই সূদীর্ঘ দশ বছরে তার কন্ঠস্বরে কিশোরীর কন্ঠস্বর থেকে আধা বয়সি নারীর কন্ঠস্বরে অবশ্যই পরিণত হয়েছে। চেহারায়ও অবশ্যই অনেক পরিবর্তন হয়েছে। তবুও চোখ দুটো ভালো থাকলে এই দশ বছর পরেও তাকে ঠিকই চিনতে পারতো। তৃপ্তিকে তো সে ভুলতে পারে না। তাহলে তো তার অতীত কে ভুলে যেতে হয়। কিন্তু কন্ঠস্বর শুনে চেনার উপায় নেই। শৈশব থেকে কৈশোরে, কৈশোর থেকে যৌবনে পদার্পন করার সাথে সাথে মানুষের কন্ঠস্বরও পাল্টে যায়। এরপরে অবশ্য কন্ঠস্বর আর খুব একটা পাল্টায়না। চৌদ্দপনের বছরের তৃপ্তির কন্ঠস্বর আর চব্বিশ-পঁচিশ বছরের তৃপ্তির কন্ঠস্বরে অনেক ব্যবধান হতে বাধ্য।
ওর নাম রতœা হলেও ঘুটুর সন্দেহ দূর হয় না। তার কেবলই মনে হয় ও তৃপ্তি । তৃপ্তিকে সে আজো ভুলে যায়নি। তার হাতের স্পর্শ ও তার মনে আছে। সে নার্সের স্পর্শের সাথে তৃপ্তির স্পর্শের মিল খুঁজে পায়। তৃপ্তির মতো করে তাকে জীবনে আর কেউ কোনদিন ভালোবাসা দেয়নি। হাসপাতালে অমন যতœ সহকারে সেবা করতে, ঔষধ খাওয়াতে শুধু তৃপ্তিরই পারার কথা।
ঘুটু হাসপাতালে বসে একা একা ভাবে, আজ তার পাশে বসে সেবা করার কথা তার স্ত্রী মিমের। অথচ আজ সে কাছে নেই, কে একজন রতœা তাকে দেখাশুনা করছে।
মিমের কথা মনে হতেই ঘুটুর বুকের মধ্যে দাউ দাউ করে যেন আগুন জ্বলে ওঠে। মিম একটা  জঘন্য নারী। ওর মতো নিকৃষ্ট নারী ঘুটুর কাছে আর নেই। মিম ঘুটুর জীবনটা নষ্ট করে দিয়েছে। জীবনের উপর, সকল নারীর উপর ঘৃনা ধরিয়ে দিয়েছে। মিমকে ঘুটু মনে করতে চায় না, ভুলে যেতে চায়। কিন্তু ভুলতে পারে না। যাকে মানুষ ভালোবাসে তাকে ভুলতে যতটা না কষ্ট হয়, তার চেয়ে বেশী কষ্ট যাকে মানুষ বেশী ঘৃনা করে, তাকে ভুলতে। ভালোবাসার জনকে ভোলা যায় না, তবুও কেউ কেউ ভুলতে পারে কিন্তু ঘৃনার জনকে সহজে ভুলতে পারে না। ঘুটুও পারেনি মিমকে ভুলতে। আর ভুলতে না পারাটাই তার যন্ত্রণার সবচে বড় কারণ।
মিমকে যে কারনে ঘুটু ভুলতে পারেনি, ঠিক তার উল্টো কারণে ভুলতে পারেনি তৃপ্তিকে। তৃপ্তিকে সে ভুলে থাকার জন্যে অনেক চেষ্টা করেছে। এই ভুলে থাকার চেষ্টা অবশ্য তার নিজের সুখের জন্যে। তৃপ্তিকে মন থেকে মুছে ফেলতে না পারলে সে জীবনে মোটেও সুখী হতে পারবে না বলে সে তাকে ভুলতে চেয়েছে কিন্তু পারেনি। আসলে মানুষ যাকে ভুলতে চেষ্টা করে তাকে ভুলতে পারে না কিন্তু যাকে ভুলতে চায় না, তাকে সহজে ভুলে যায়। মানুষের মনের এ এক জটিল ব্যাপার। ঘুটু এর যুক্তি পায়নি কোনদিন।
ঘুটু তৃপ্তিকে ভুলার শত চেষ্টা করেও পুরো ভুলতে পারেনি কোন দিন, বরং বিভিন্ন পরিস্থিতিতে বিভিন্নভাবে তৃপ্তির স্মৃতি মনে উকি দিয়েছেই।
তৃপ্তির সাথে ঘুটুর প্রথম পরিচয় হয়েছিল সেই প্রায় চৌদ্দ বছর আগে। কিন্তু চৌদ্দটি ক্যালেন্ডারের দিন শেষ হয়ে গেলেও ঘুটুর মনে হয় এই সেদিনের ঘটনা। সে সব ঘটনা যেন তার স্মৃতির পর্দায় সব সময় জ্বলজ্বল করে। চোখ বুজলেই সে যেন সব দেখতে পায়। দেখতে পায় প্রথম দেখার দিন থেকে শেষ দেখার দিন পর্যন্ত সব ঘটনা এক এক করে। প্রতিটি স্মরণীয় মুহুর্ত যে কত হাজারবার করে তার মনে পড়েছে তার হিসেব নেই।
ঘুটুর কাছে দিন আর রাত সমান অন্ধকার। তবুও সে সময়ের হিসেব রাখে, দিন রাতের হিসেব রাখে, মানুষ, যন্ত্রপাতি, গাড়ি ঘোড়ার শব্দ, পাখির ডাক, আজান-এসবের মাধ্যমে সে সময় নির্ণয় করে। হাসপাতালে একটা নিস্তব্ধতা বিরাজ  করছে। চার দিকের সমস্ত কোলাহল থেমে গেছে, কোন শব্দ নেই। ঘুটু বুঝতে পারে এখন গভীর রাত, সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। সে ঘুমুতে চেষ্টা করে কিন্তু পারে না। সে ভাবে তার অতীত জীবনের ঘুমের কথা। পড়তে পড়তে কতবার বইয়ের ওপর ঘুমিয়ে পড়েছে তার ঠিক নেই। ঘুমকে চেষ্টা করে কখনও আনতে হয়নি। ঘুম নিজে এসে তাকে অচেতন করে দিয়েছে। ঘুম তাড়াবার জন্যে রাতে চা খেয়েছে, হাটাহাটি করেছে। চোখে পানি দিয়েছে তবুও ঘুম তাকে ছাড়েনি। তার মনে হতো ঘুমটা একটু কম হলে জীবনে অনেক দুর আগাতে পারবে। বড় একটা কিছু করতে পারত। অথচ দৃষ্টিশক্তি হারাবার পর থেকে ক্রমে ক্রমে তার ঘুম দুর হয়ে যেতে লাগল। এখন সাধনা করে ঘুমকে আনতে হয়। ভালো ঘুম হওয়ার জন্যে ব্যয়াম করে, মাথায় ঠান্ডা তেল মাখে, ঠান্ডা খায়, রাতে শুয়ে গান শোনে। উল্টোভাবে একশো থেকে এক পর্যন্ত গুনেÑ এমন নানা রকম চেষ্টা চালায় ঘুমের জন্যে। তবুও ঘুম ভালো হয় না। এখন মনে হয় সুখী মানুষের চোখে ঘুম সবসময় ধেয়ে আসে আর দুঃখী মানুষের কাছ থেকে পালিয়ে বেড়ানোর চেষ্টা করে।
অন্যদিন তবুও কিছুটা ঘুম আসে কিন্তু আজ কিছুতেই ঘুম আসছে না। এর পেছনে দুটো কারণ। প্রথমত দিনে একটু ঘুমিয়ে ছিলো দ্বিতীয়ত তৃপ্তিকে আজ খুব মনে পড়ছে। মনটা চলে গেছে সেই চৌদ্দ বছর পেছনে। যেদিন তৃপ্তির সাথে প্রথম দেখাÑ সেদিনে। সেই চৌদ্দবছর আগে ঘুটু তার একবন্ধুÑ বাটুলের মাধ্যমে তৃপ্তিদের বাড়িতে লজিং পেয়েছিল। ছাত্রছাত্রী দুজন। একজন তৃপ্তি আরেকজন সুমন। ওদের দুজনকে সকালে ও রাতে পড়াতে হবে। বিনিময়ে থাকা খাওয়া।
সেদিন বিকেলে ঘুটু তার বিছানাপত্র ইত্যাদিসহ লজিং বাড়িতে উঠল। তার মালজিনিস তার থাকার  জন্য নির্দিষ্ট স্থানে রেখে সে বাটুলের সাথে বাইরে ঘুরতে গেল। সন্ধ্যায় ঘুটু বাসায় ফিরল। তৃপ্তিদের ঘরের একটু দুরেই তার থাকার ঘর। ঘরে ঢুকে সে দেখল তৃপ্তি তার বিছানাপত্র, মশারি ঠিক করেছে। এবার বই খাতাগুলি সাজিয়ে রাখছে। ঘুটুর খুব ভালো লাগল। ছাত্রীর কাছ থেকে এটা তার বড় পাওয়া। এতটা সে আশা করেনি। এর আগে সে আরো কয়েক জায়গায় লজিং থেকেছে কিন্তু এরকমটি কোথাও জোটেনি। ঘুটু মুগ্ধ হয়ে গেল। সে বুঝতে পারল এ ছাত্রী অনুগতা হবে এবং এখানে থেকে শান্তি পাওয়া যাবে। তার দীর্ঘ দিনের শিক্ষকতা জীবনে এই অভিজ্ঞতা হয়েছিল যে, ছাত্র ছাত্রী পড়াশোনা না পারলে সেটি তেমন বড়ো সমস্যা নয়। বড়ো সমস্যা হলো তাদের পড়াশুনা না করা এবং শিক্ষককে ভক্তি শ্রদ্ধা না করা। শিক্ষকের বাধ্যগত না হওয়া। সেদিক দিয়ে আগের সব লজিঙের চেয়ে এ লজিংটি ভালো হবে বলেই তার ধারণা হলো।
রাতে পড়াতে বসে দেখতে পেলো তৃপ্তি ছাত্রী হিসেবে বেশ ভালো। পড়াশুনার প্রতি গরজ আছে বলেই মনে হলো। ছাত্রটি ঠিক উল্টো। তার ব্রেইন মোটামুটি ভালোই কিন্তু পড়াশুনার চেয়ে গল্প গুজবের দিকে তার ঝোক বেশী বলে মনে হলো। পড়াশুনা শেষ হলে তৃপ্তি খাবার নিয়ে এলো। অন্যান্য বাড়ীতে সে দেখেছে কেউ একজন খাবারের সরঞ্জাম রেখে চলে যায় পরে সে নিজে নিয়ে খায়। এবারই সে ব্যতিক্রম লক্ষ্য করল। তৃপ্তি খাবার নিয়ে এসে সব সাজিয়ে গ্লাসে পানি ঢেলে প্লেটটা ঘুটুর সামনে  দিল এবং তাকে খেতে বলল। ঘরে যাবার সময় তৃপ্তি বলে গেল, স্যার, কোনকিছু দরকার হলে আমাকে ডাকবেন। আপনার যখন যে সমস্যা হয়, যখন যা লাগে আমাকে বলবেন, লজ্জা করবেন না।
তৃপ্তি চলে যাবার পর ঘুটু ওর কথাগুলি ভাবতে থাকল। এসব কথা সে আগেকার লজিংগুলোতে অভিভাবকদের মুখে শুনেছে। এবার ছাত্রীর মুখে শুনে একটু অবাকই লাগল।
এর পরে যতই দিন গড়িয়েছে, তৃপ্তি ততই ঘুটুকে আপন করে নিয়েছে। ঘুটুও তৃপ্তিকে আপন করে নিয়েছে। তৃপ্তি ঘুটুর গ্রামের বাড়ির কথা প্রায়ই শুনতে চাইত। গ্রামে তার বাবা-মা, ভাই-বোন, আত্মীয়-স্বজন পাড়া প্রতিবেশী, গ্রাম্য জীবন, ঘুটুর ছোট বেলা- এসব ব্যাপারে তৃপ্তি জানতে চাইতো। ঘুটুও বলত আর তৃপ্তি মুগ্ধ হয়ে শুনতো। ঘুটু বলত তার বাবা-মা কিভাবে তাকে মানুষ করেছে। তাকে তারা কেমন জানে, তার ভাইবোন কে কেমন- সেসব কথা। সে আরো বলত ছেলেবেলার স্কুল জীবনের নানা কথা। খেলধুলার কথা, মাছ ধরার কথা, পাখি ধরার কথা, পাখির বাচ্চা ধরার কথা, নৌকায় চড়ে স্কুলে যাবার কথা, নৌকায় চড়ে শাপলা তোলার কথা আরো কতকি। তৃপ্তি সেসব মন দিয়ে শুনত। মাঝে মাঝে বলতো, আহারে আমি যদি আপনাদের ওখানে জন্মগ্রহণ করতাম তাহলে কত আনন্দই না হতো জীবনে! আপনার জীবন কত বৈচিত্রময় ছিল, অমন জীবন যদি আমি উপভোগ করতে পারতাম। কিন্তু আমার দুর্ভাগ্য তাই জন্মেছি শহরে। শহরে কোন বৈচিত্র নেই, ধরাবাধা, গদবাধা জীবনের গতি।
তৃপ্তির এসব কথা শুনে ঘুটু অবাক হয়ে যেতো। ওর বয়সটা কম কিন্তু ভাবনা, কথাবার্তা বড়ো বুঝমান মানুষের মতো। তার দেহে গড়ন দেখে যে বয়স অনুমান করা যায়, কথা-বার্তা শুনে চিন্তা ধারা দেখেÑ তার সাথে অন্তত পাঁচ সাত বছর যোগ না করে উপায় নেই।
তৃপ্তিদের বাড়িতে একটি আম গাছ ছিল। ও নিজেই গাছে চড়ে আম পাড়ত।
অভিভাবকরা গাছে চড়তে নিষেধ করত কারণ ও তখন বড়ো হয়েছে, গাছে চড়লে লোকে মন্দ বলবে। কিন্তু ও শুনত না, লুকিয়ে লুকিয়ে গাছে চড়ত। আম পেড়ে ভালো ভালো আম নিয়ে ঘুটুর ঘরে আসত। ঘুটুকে ভালো ভালো দেখে বাছা আম গুলো দিত আর ও খারাপগুলো খেতো। তার ভাই এবং অন্যেরা চাইলে এমনকি তার মা বা দাদিকেও ভালোটা দিত না। শুধু ঘুটুকে দিত। ঘুটু অবাক হয়ে ভাবত। সে তার এ বয়সের আচরণের সাথে তৃপ্তির আচরণের তুলনা করত। ঐ বয়সে ঘুটু সবসময় ভালোটা খেয়ে খারাপটা অন্যকে দিত। অথচ তৃপ্তি নিজে না খেয়ে ভালোটা তাকে দেয়। নিজের মা, দাদী ও ভাইয়ের চেয়েও তাকে ভালো জানে। আম খুব বড়ো জিনিস নয় কিন্তু নিজে খারাপটা খেয়ে অন্যকে ভালোটা খাওয়ানো কম কথা নয়। তৃপ্তি এত বেশী বেশী আম তাকে খেতে দিয়ে যেত যে সে যেন ভাত না খেয়ে শুধু আম খেয়েই থাকবে। সে খেতে পারত না আর তা নিয়ে তৃপ্তি রাগ করত। বলত, অত কম খায় বলেই ঘুটুর স্বাস্থ্যটা এ রকম খারাপ। ঘুটু অবাক হয়ে যেতো। অতটুকু মেয়ে তার স্বাস্থ্য নিয়েও ভাবে।
মাষ্টার হিসেবে এবং মানুষ হিসেবে সবাই ঘুটুকে খুব ভালো বলত, ভালো জানত। তৃপ্তির মাও তার ব্যতিক্রম নয়। সে ঘুটুকে বেশ øেহ করত। সে ঘুটুকে গৃহশিক্ষকের মতো না দেখে বরং নিজের বাড়ীর একজন সদস্যের মতো দেখত। খাবার দাবার সে ঘুটুকে ভালোই দিত। সে দুজনকে বেশী করে খাওয়াতো। একজন হলো তার একমাত্র মেয়ে তৃপ্তি আর অন্যজন হলো ঘুটু। তৃপ্তি তার একমাত্র মেয়ে সেকারণে এবং মেয়ে কার না কার ঘরে যায়, সেখানে মনপ্রাণ ভরে খেতে পারে কিনা। তাই ভেবে সে হয়ত সারাজীবনের ভালো ভালো খাবার খাইয়ে শেষ করতে চাইত। আর আদর যতেœর ব্যাপারেও ঐ একই রকম। আর ঘুটু পরের ছেলে। বাপ-মা, ভাইবোন, আত্মীয়-স্বজন সব ছেড়ে সে তাদের ওখানে আছে। তাকে ভালো না জানলে, তাকে ভালো না খাওয়ালে তার মন খারাপ থাকবে। তাতে তার নিজের এবং ছাত্রছাত্রীদের ও ক্ষতি হবে। তাই তাকে এমনভাবে দেখতে হবে যাতে সে তার আপনজনের অভাব উপলব্ধি করতে না পারে। তাছাড়া ঘুটুকে সে খুব পছন্দও করে। এসব কথা অবশ্য সে ঘুটুকে সরাসরি বলেনি। অন্যের কাছে বলেছিল আর ঘুটু তা শুনতে পেয়েছিল। অবশ্য এর সত্যতাও কাজে প্রমানিত হয়েছিল। সে ঘুটুকে বেশ বেশী বেশী করে বিভিন্ন জিনিস খেতে দিত। তৃপ্তি তার উপরে আরোও দিত। ভালো কিছু খাবার হলে তৃপ্তির মা দেবার পরেও অন্য সময় হয়ত তৃপ্তি ঘুটুর জন্যে আরো কিছুটা মায়ের কাছে বলে দিত, সম্ভব হলে গোপনে দিত। আর তার নিজের ভাগেরটার থেকেও দিত। আর খাদিমদারী তৃপ্তি করলে তো কোন কথাই ছিল না। এতে করে দেখা যেত সে অনেক সময় পরিবারের অন্য সদস্যদের দু’তিন জনের সমান ঘুটুর একার ভাগে পড়ত। ঘুটু নিষেধ করত কিন্তু তৃপ্তি শুনত না। নিজে কম খেয়ে নিজের ভাগেরটা শিক্ষককে দেয়া ঘুটুর কাছে কম কথা বলে মনে হতো না।
খাবার দাবার নিয়ে একটি কথা খুব মনে পড়ছে ঘুটুর। কথাটি জীবনে কত হাজারবার যে মনে পড়েছে তার গোনাগাথা নেই। সেদিনের খাদ্যটি যদিও সামান্য ছিল কিন্তু তা খাওয়ানোর জন্যে তৃপ্তির আন্তরিকতা ছিল অসামান্য। আসলে উপহারটা কত মূল্যবান সেটা বড় কথা নয়। বড়
কথা হলো উপহারদাতার আন্তরিকতা কতটুকু সেটা। সেদিক দিয়ে সেদিনের সেই খাদ্য দেয়াটা ঘুটুর জীবনে বিরাট কিছ্ ুসেদিন বাইরে একটু কাজ থাকায় ঘুটুর একটু দেরি করেই বাসায় ফিরেছিল। তৃপ্তির চাহনী দেখে ঘুটুর মনে হলো তৃপ্তি কিছু বলতে চাচ্ছে কিন্তু কী বলবে তা অনুমান করতে পারল না। সুমন বাথরুমে গেলে তৃপ্তি ঘুটুকে বলল, স্যার চোখ বুঁজে হা করেন।
Ñ কেন?
Ñ আহা বলছি করেন না।
Ñ কী দেবে আমার হাতে দাও।
Ñ আহা, হা করেন না। আমি কী আপনাকে বিষ দেবো নাকি যে অমন করছেন?
Ñ না, তা নয়, তবে আমার কাছে দাও।
Ñ ঠিক আছে, লাগবে না। আপনি পড়ান। তৃপ্তি পড়তে শুরু করে দিল। তার মুখের দিকে চেয়ে বোঝা গেল সে খুব রেগে গেছে। বাবা মায়ের এক মাত্র মেয়ে বলে আদরে আদরে তৃপ্তি বেশ রাগী হয়ে গেছে এবং একবার রাগলে সহজে রাগ যায় না। এটার প্রমাণ ঘুটু একাধিকবার পেয়েছে। এবার আর রাগাতে মন চাইল না। তাছাড়া ঘুটু লক্ষ্য করল তৃপ্তি প্রায় কেঁদে ফেলেছে। সে বলল, ঠিক আছে দাও, এই আমি চোখ বুঁজে হা করছি। ঘুটু দেখল তৃপ্তি কাগজে মোড়ানো কী একটা বের করছে। তৃপ্তির কাগজের ভেতর থেকে ওটি বের করে ঘুটুর মুখের মধ্যে পুরে দিল। ঘুটু চোখ খুলল। মুখের মধ্যে থেকে বের করে দেখল একটা মুরগীর মাথা। তৃপ্তি বলল, মা ওটি আমাকে খেতে দিয়েছিল। বিকেলে স্কুল থেকে ফিরে খেতে গিয়ে আপনার কথা মনে পড়ল। মাথাটা আর খেতে পারলাম না, কাগজে মুড়ে আপনার জন্য গুজে রাখলাম। আপনাকে রেখে ভালো কিছু খেতে আমার মন চায় না।
Ñ কিন্তু আমাকে তো কাকী মুরগীর কলিজা ও গিলে দিয়েছিল। মাথাটা তুমি খেতে পারতে।
Ñ সে তো মা দিয়েছিল, আমি কিছু দেব না?
ঘুটু সেদিন বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গিয়েছিল। এই তৃপ্তি তার জন্যে এতটা করছে এর উদ্দেশ্য কী? তৃপ্তি কী তাকে ভালোবাসে। কিন্তু ওতো ছোট মানুষ, ভালোবাসার ওকি কিছু বোঝে? হয়ত ও শিক্ষককে খুব ভালো জানে বলে ওরকম করে। কিন্তু শুধু ভালো জানলেই কারো জন্যে এতটা করা যায়? এর পেছনে কী অন্য কোন উদ্দেশ্য নেই? ঘুটু নিজেকে অনেক প্রশ্ন করে কিন্তু সঠিক জবাব পায় না। তৃপ্তি অন্যান্য দিনও স্কুলে টিফিনের সময় যা খায় তা ঘুটুর জন্য নিয়ে আসে। যেন  ঘুটু ছোট মানুষÑ এমন একটা ভাব তৃপ্তির। ঘুটু মানা করে কিন্তু তৃপ্তি শোনেনা। কিন্তু অন্যদিন হাতে দেয়, আজ একে বারে গালে তুলে দিল! কী আছে ওর মনে?
আগে ঘুটু লন্ড্রী থেকে তার জামাকাপড় ইস্ত্রি করিয়ে আনত। এখন তৃপ্তি তার জামাকাপড় ইস্ত্রি করে দেয়। কাপড় ধুয়েও দেয়। সে জামাকাপড় ময়লা হবার আগেই ধুয়ে দেয়। ঘুটু তাকে নিষেধ করত, তৃপ্তি শুনত না। ঘুটু অন্তত একটু ময়লা হবার পরে জামা কাপড় ধুতে বলে কিন্তু তৃপ্তি বলে ময়লা জামাকাপড় পরলে মন প্রফুল্ল থাকে না। গায়ে চুলকানি পাঁচড়া হয়, গন্ধ আসে তাই জামা কাপড় ময়লা না হলেও তিনদিনের বেশী এক শার্ট প্যান্ট পরা উচিৎ নয়। এ নিয়ে তৃপ্তির সাথে অনেক তর্কাতর্কী হয়েছে কিন্তু তৃপ্তি শোনেনি। একসময় ঘুটু এ নিয়ে আর কিছুবলা ছেড়ে দিয়েছে। এরপর থেকে তৃপ্তি নিয়মিত তার জামাকাপড় ধুয়ে ইস্ত্রি করে দিয়েছে।
ঘুটু ঘুম থেকে ওঠার পর যখন বাথরুমে যায়, তখন তৃপ্তি এসে তার বিছানা গুছিয়ে দেয়। ঘুটুও বিছানা গোছায়, মশারী তোলে কিন্তু তা তৃপ্তির পছন্দ হয় না। ঘুটুর গোছানো নাকি ঠিকমতো হয় না। আবার সন্ধ্যার আগে ঘুটুর বিছানাটা ছেড়ে মুছে গুছিয়ে মশারীটা একটু আলগা করে রাখে যাতে ঘুটুর শুধু মশারীটা একটু টেনেই শুয়ে পড়তে পারে। এ নিয়ে ঘুটু তৃপ্তিকে অনেকবার নিষেধ করেছে কিন্তু তৃপ্তি তার কাজ নিয়মিত করেই গেছে। তৃপ্তি প্রায়ই তার বালিশ রোদে দিয়েছে, চাদর ও বালিশের কভার ধুয়ে দিয়েছে, প্রতিদিন বালিশ এদিক ওদিক ঘুরিয়ে চেপে নরম করে দিয়েছে। এভাবেই চলছে দিনের পর দিন। যেন রুটিনবাধা কাজ, কোনদিন হেরফের হয়নি।
তৃপ্তিদের বাড়িতে অনেকগুলো লোকের জন্য একটিমাত্র ল্যাট্রিন। সকালে স্বাভাবিকভাবেই সিরিয়াল পড়ে যায়। ভোরের দিকে চাপটা একটু কম থাকে কারণ শহরে অধিকাংশ লোকই একটু দেরী করে বিছানা ত্যাগ করে। ঘুটুর সকাল সকালই ঘুম থেকে ওঠে। তখন ল্যাট্রিনে সিরিয়াল বেশি থাকে মহিলাদের, কারণ তারা বেলা দুপুর পর্যন্ত শুয়ে থাকলে সংসার চলে না। ঘুটুর কেমন লজ্জা লাগে এই সিরিয়াল ধরতে। তৃপ্তি ঘুটুর মুখের ভাব দেখে বুঝতে পেরেছিল প্রথম দিকেই। সে খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে এক বদনা পানি ঘুটুর দরজার সামনে রেখে ঘুটুকে ডেকে তোলে। ল্যাট্রিন ফাঁকা আছে কিনা তা দেখে নেয়। ফাঁকা থাকলে ঘুটুকে যেতে বলে আর ফাঁকা না থাকলে বদনাটা রেখে আসে। ঘুটুর বদনা দেখলে সবাই চেনে। সে ব্যবহার করে একটা দামী বড় সাইজের কাসার বদনা। ওটি তৃপ্তির দাদার ছিল। ঐ রকম বদনা এখন কেউ ব্যবহার করে না। তাই ঘুটুর বদনা দেখলে সবাই চেনে এবং ঘুটুকে আগে সিরিয়াল দেয়। এই বদনা এগিয়ে দেয়ার কাজটি না করার জন্যে তৃপ্তিকে সে অনেক নিষেধ করেছে, অনেক করে বুঝিয়েছে যে, এটা দেখতে খারাপ দেখায়, লোকে মন্দ বলবে, সমালোচনা করবে, অন্য রকম কিছু মনে করবে। তৃপ্তি নিষেধ শোনেনি, উপদেশ মানেনি। তার এ এক কথা- আমিতো আর পরকে এগিয়ে দেইনা, আমার শিক্ষককে এগিয়ে দেই। শিক্ষকের সেবা করার মধ্যে দোষের কিছু নেই। এ নিয়ে লোকে সমালোচনা করলে আমার কিছু আসে যায় না। মানুষ সমালোচনা করতে ওস্তাদ। নানা ছুতায় মানুষ সমালোচনা করেই। সমালোচনার ভয় করলে কিছু করা যায় না। আমি যখন অন্যায় কিছু করব, তখন সমালোচনার ভয় করব, শিক্ষকের সেবা করার সময় নয়।
তৃপ্তিদের বাসার খানিকটা দূরে একটি পুকুর। তৃপ্তির বাবা, ভাই, ওদের বাড়ীর আশপাশের পুরুষেরা ছেলেমেয়েরা এবং কোন কোন ঘরের মহিলারাও ঐ পুকুরে গোছল করে। ঘুটু ও প্রথম দিকে ঐ পুকুরে গোছল করেছে কিন্তু একসময় তৃপ্তির জন্যেই তা বন্ধ হয়েছে। ঐ পুকুরে নানান লোক গোছল করে, ময়লা কাপড় চোপড় ধোয়, অনেক ছেলে পেলে নাকি গোচল করতে গিয়ে পানিতে প্রশ্রাবও করে। এসব কারণে তৃপ্তি ঐ পুকুরে ঘুটুর গোছল করা বন্ধ করে দিয়েছে। তৃপ্তি ও তার মা পাশের বাড়ির নলকূপ থেকে আনাপানি দিয়ে গোছল করত। তৃপ্তির একদিন কাজের মহিলাটিকে প্রতিদিন আরো দু বালতি করে পানি বাড়িয়ে দিতে বলল। ঐ দু বালতি ঘুটুর জন্যে।
ঘুটুকে বাথরুমে তোলা পানি দিয়ে গোছল করা শুরু করতে হলো। সে আপত্তি করেছিল, বলেছিল- তার জন্যে এতটা করার প্রয়োজন নেই, কিন্তু তৃপ্তি একরোখা, সে যা বলে তা হতে হয়। ঘুটু ও তাই এটা মেনে নিয়েছে বাধ্য হয়ে। আর শুধু তোলাপানি দিয়ে বাথরুমে গোছল করাই নয়, গোসল করে জামা কাপড় ও তার ধোয়া লাগেনি। তার নাকি লুঙ্গী, গামছা ঠিকমতো ধোয়া হয় না, নিংড়ানো হয় না তাই তৃপ্তি ওগুলো ধুয়ে দেয়। এ কাজটিও ঘুটুর ভালো লাগে না, বেশ লজ্জা লাগে। সে বাড়ির শিক্ষক অথচ গোছল করে লুঙ্গী-গামছাটাও যদি নিজে না ধোয়, তা যদি ছাত্রী ধুয়ে দেয় তা কেমন দেখায়। লোকে কি বলবে? আর সে একজন ছাত্রীর কাছ থেকে এতটা নিচ্ছে কোন অধিকারে? তৃপ্তির কাছে নিজেকে খুব ঋণী মনে হয়।
তৃপ্তিদের বাড়িতে তিনটি সিলিং ফ্যান। একটি ওর বাবা মার রুমে, একটি ওর রুমে আরেকটি ওর দাদী ও ভাই যে রুমে থাকে সে রুমে। ঘুটু যে ঘরে থাকে, সে ঘরে কোন ফ্যান নেই। গরমের দিন ঘুটুর একটু কষ্ট অবশ্য হয় তবে সেটা এত বেশী নয় যে সহ্যের বাইরে। বেশ কয়েকবছর অন্যের বাড়ীতে লজিং থেকেছে। এ কয় বছরে ফ্যানের বাতাস খাওয়া হয়নি। আর ছোট বেলায় গ্রামে ছিল, সেখানে তো ফ্যানের বালাই নেই। তাই গরমটা এখন গা-সওয়া হয়ে গেছে। ঘুটু যে ঘরে থাকে সেটি টিনের। তাই দুপুরের দিকে গরমটা বেশ বেশী হয়। ঘুটু কলেজ থেকে ফিরে খেয়ে দেয়ে একটু না ঘুমিয়ে পারে না। যতক্ষণ জেগে থাকে, ততক্ষণ পাখা দিয়ে বাতাস করে, তারপরে ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়ে। তখন গরমে ঘেমে যায়। এ নিয়ে তৃপ্তি তাকে মন্দ বলেছে অনেকবার। দুপুরে ঘুটুকে তৃপ্তির খাটে গিয়ে ঘুমুতে বলেছে। তৃপ্তির স্কুল ছুটি হয় বিকেলে তাই দুপুরে খাটটি খালিই পড়ে থাকে ওখানে গিয়ে ফ্যানের নিচে ঘুমালে কী ক্ষতি তা অভিভাবক শুলভ প্রশ্নের সুরে জানতে চেয়েছে। ঘুটু এটা ওটা বলে পাশ কাটিয়ে গেছে। আসলে তার লজ্জা লাগে এবং বিবেকে বাধে। ছাত্রীর বিছানায় গিয়ে ঘুমানো কে ওদের চোখে খারাপ না দেখালেও অন্যে হয়ত খারাপ চোখে দেখতে পারে তাই ঘুটুুু রাজি হয়নি। রাতে গরম থাকে বলে তখন অবশ্য ওখানে বসেই পড়ায়। পড়ানো শেষ হলে নিজের ঘরে চলে আসে। সকালে তার ঘরে বসেই পড়ায়। আবার বেশী গরম থাকলে সকালেও তৃপ্তির ওখানে গিয়ে পড়ায়। কিন্তু পড়াতে যাওয়া আর শুতে যাওয়া এক কথা নয়। তাই সে শুধু তৃপ্তির অনুরোধেই নয়, তৃপ্তির মা ও অনেকবার তাকে ও ঘরে গিয়ে শুতে বলায়ও ঘুটু রাজি হয়নি। অবশ্য তৃপ্তির মা অনেক করে বলার পর একদিন ওখানে গিয়ে শুয়েছিল কিন্তু অস্বস্তিতে ঘুমোতে পারেনি। এরপর আর যায়নি। গরম যতই হোক সে তার ঘরেই শুয়ে থাকে।
তৃপ্তি স্কুল থেকে ফিরে এসে খেয়ে দেয়ে তারপরেও যদি দেখে ঘুটু ঘুমিয়ে আছে, তখন সে একটা হাতপাখা নিয়ে এসে বাতাস করে আর বলে, কতদিন বললাম ঘরে গিয়ে শুতে তা শোনবে না। এত গরমে মানুষ ঘুমোতে পারে! দেখদেখিÑ ঘেমে কি হয়ে গেছে। এভাবে প্রায়ই সে বাতাস করে আর কথা বলে। ঘুটু আধা ঘুমন্ত-আধা জাগ্রত অবস্থায় এসব শোনে, দেখে আবার কোনদিন হয়ত ঘুম ভেঙে দেখে তৃপ্তি তাকে বাতাস করছে। তার গায়ের ঘাম শুকিয়ে কেমন একটা ঠান্ডা ঠান্ডা ভাব লাগছে আর যে তার ঘাম শুকানোর সাধনায় মসগুল, তার কপাল, নাকÑমুখ দিয়ে ঘাম বেয়ে বেয়ে পড়ছে। ঘুটু অনেক মানা করেছে, অনেক করে বলেছে গরমে তার কষ্ট হয় না বরং গরমে ঘুমটা ভালো হয়; কিন্তু তৃপ্তি শোনেনি। ঘুটুর মনে হয় তৃপ্তিকে মানা করলে সেই কাজ সে বেশী করে করে। ঘুটু এও জানতো তৃপ্তিকে বলে কয়ে ফেরানো যাবে না। তাই কতদিন যাবার পর নিষেধ করা ছেড়ে দিয়েছে। তৃপ্তি রুটিন বাধা কাজের মতোই তার কাজ চালিয়ে গেছে।
জৈষ্ঠ্য মাসের এক শুক্রবার। দুপুরে খাওয়া দাওয়া সেরে বাসার সবাই ঘুমিয়েছে। তৃপ্তি ঘুটুর ঘরে এলো। ঘুটুর ঘুম আসছিল তবে তখন ও ঘুমিয়ে পড়েনি কিন্তু সে তৃপ্তিকে দেখে ঘুমের মতো পড়ে রইল। সে জেগে আছে টের পেলে তৃপ্তি হয়ত আবদার করে বসবে গল্প শোনাবার জন্যে। কিন্তু তার ঘুমানো দরকার। রাতে ওদেরকে পড়াবার পর তাকে রাত জেগে পড়তে হয়। তাই দুপরের ঘুমটা তার অপরিহার্য। তৃপ্তি ঘুটুকে ঘুমন্ত দেখে বাতাস করতে শুরু করল। ঘুটুর মনে চিন্তা ঢুকল। সে তৃপ্তিকে নিয়ে ভাবতে লাগল। এই মেয়েটি তার জন্যে এতো করে, সে কী চায়? কোনদিন প্রেম ভালোবাসার কোন ইংগিত ও তো পাওয়া যায়নি, তাহলে সে এত করে কী জন্যে?
ভাবনায় ঘুটর ঘুম আসেনা, কিন্তু সে ঘুমের মত পড়ে থাকে। তৃপ্তি বাতাস করেই চলে। ঘন্টা পেরিয়ে যায়, সে থামে না। একবার ডান হাত দিয়ে আরেকবার বাম হাত দিয়ে আবার ডান হাত দিয়ে পাখা চালায়। মাঝে মাঝে কয়েকবার ক্ষণিকের জন্যে নিজের দিকে পাখাটা ঘোরায়। মাঝে মাঝে কপালের, নাকমুখের ঘাম হাতের আঙ্গুল দিয়ে মুছে ঝেড়ে ফেলে। আবার বাতাস করে। ঘুটুর খারাপ লাগে, ওর জন্য মায়া হয়। সে ভাবে তৃপ্তি এতো ভালো হলো কী করে। এতো সেবাপরায়না কোন মেয়েলোক হয়। একজন শিক্ষকের জন্যে ও এতটা করে, ওর স্বামীর জন্যে সে ও আরো কত কি করবে, কে জানে! ওর স্বামী হবে মহাভাগ্যবান। কে হবে ওর স্বামী কে জানে? ঘুটু নিজে কী হতে পারে না? আবার ভাবে সে তৃপ্তির শিক্ষক, ছাত্রীকে নিয়ে এমন ভাবাটা অন্যায়। আবার ভাবে অন্যায় কিসের, ছাত্রীকে কী কেউ ভালোবাসে না? বিয়ে করে না? সে ভালোবাসলে দোস কি? বিয়ে করলে দোস কি? তাছাড়া তৃপ্তি যে এতকিছু করে, এর নাম কি ভালোবাসা নয়? ভালো না বাসলে কি একজনের জন্যে অতটা করা যায়? আবার ভাবে তৃপ্তি ছোট মানুষ, ও ভালোবাসার কিছু বোঝে না। ও প্রকৃতিগতভাবে ভালো স্বভাবের মেয়ে। শিক্ষকের উপর ওর অগাধ ভক্তি, ঘুটু তার মনের মতো শিক্ষক- এজন্যে সে ঘুটুর জন্যে এতকিছু করে।
ঘুটুর একটা দারুন মায়া জন্মে যায় তৃপ্তির প্রতি। তৃপ্তিকে সে খুব বেশী ভালো জানে, আদর করে। কিন্তু এসবের নাম টিক ভালোবাস নয়। আর যদিও বা ভালোবাসা বলা যায়, এটাকে প্রেম বলা যায় না। ঘুটু তৃপ্তিকে প্রেমিকা হিসেবে ভাবতে গিয়ে হোচট খায়, ভাবতে পারে না। এর পেছনে একাধিক কারণ বিদ্যমান। প্রথমতঃ তৃপ্তি তার ছাত্রী, দ্বিতীয়ঃ ও ছোট মানুষ, তৃতীয়ত ও বেশ একরোখা ও বদমেজাজী, চতুর্থতঃ ও দেখতে খুবই সুশ্রী নয়, পঞ্চমতঃ ঘুটু উঁচু বংশের ছেলে নয় আর তৃপ্তিদের বংশমর্যাদা ভালো। অন্য সবদিক মেনে নিলেও ঘুটু তৃপ্তির চেহারাটাকে মেনে নিতে পারে না। আসলে সৃষ্টিকর্তা কাউকেই একেবারে সবকিছু দেয় না; কোন না কোন অপূর্ণতা প্রত্যেকের মধ্যে থেকেই যায়। কিন্তু আমরা ভালোবাসার জন্যে, বিয়ে করার জন্যে একজন পরিপূণর্  পাত্র চাই যা আদৌ মেলেনা। আর একারণেই আমাদের চাওয়াটা ষোল আনাপূর্ণ হয় না কোনদিন, কিন্তু তবুও আমরা চাই, ঘুটু ও চায়। ঘুটু নিজে সুদর্শন যুবক। সে এমন একজনকে চায় যে রূপে, গুণে বিদ্যায় সবকিছুতে পরিপূর্ণ বিশেষ করে রূপে। তৃপ্তির মধ্যে সৃষ্টিকর্তা অনেক রুপ গুণের সমাহার ঘটালেও চেহারায় কার্পন্য করেছে। এটাকেই ঘুটু সবচে বড় বাধা বলে মনে করে। সে অনেকভাবে কিন্তু হিসেব মেলাতে পারে না।
তৃপ্তি যে এতকিছু করে তা ওর বাবা-মা এবং প্রতিবেশীদের চোখ এড়ায় না। বাবা মা অবশ্য এটাকে খুব খারাপ চোখে দেখে না। তবে তারা ঘুটরু সাথে মেয়েকে ঘনিষ্ঠ হতে বাধা না দিলেও খারাপ কিছু যেন না হতে পারে সেদিকে খেয়াল রাখে যা ঘুটু টের পায়। তারা অবশ্যÑ ঘুটুকে খুব ভালোবাসে এবং মনে মনে তাকে ভাবী জামাই এর আসনে বসিয়েছে তাই এতটুকু কনসিডার তারা করে। প্রতিবেশীরা কিন্তু এটা সহজ চোখে দেখে না। এ নিয়ে অনেক কানা ঘুসা হয় যা ঘুটুর কান পর্যন্ত আসে। এসব নিয়ে প্রতিবেশীদের সাথে তৃপ্তিও তার মায়ের একাধিকবার মৃদু কথাকাটাকাটিও হয়েছে। এসব ঘুটুর কানে আসার পরে সে সতর্ক হয়ে যায় এবং তৃপ্তিকেও বোঝায় কিন্তু তৃপ্তি শোনে না। তবে ঝগড়াঝাটি হবার পর থেকে ওর বাবা মা ওকে একটু সাবধান করে দেয় এবং মানুষের চোখে লাগে এমন কিছু করতে নিষেধ করে। এসব নিয়ে ঘুটু বেশ ভাবনায় পড়ে যায়। সে অন্য লজিঙে চলে যাবে কিনা ভাবে কিন্তু সুখকে পায়ে দলে চলেও যেতে পারে না। ভালোবাসার প্রতি কার না লোভ আছে আর কেই বা তা ছেড়ে যেতে পারে!
দিন যেতে থাকে আর তৃপ্তির ভালোবাসা গাঢ় থেকে গাঢ়তর হতে থাকে। ঘুটু বুঝতে পারে এসবের জন্যে সেই অনেকটা দায়ী। তার অবশ্য খারাপ উদ্দেশ্য ছিল না, তবুও তার বোঝা উচিৎ ছিল। সে না বুঝে ভুল করেছে। সে নিজেকে একটু গুটিয়ে রাখার চেষ্টা করে। সে বুঝতে পারে তৃপ্তির সাথে অতটা গল্প করা, গ্রাম্য জীবনের বিচিত্র কাহিনী বলা, তৃপ্তির চোখে তাকে বড় করে তোলা তার ঠিক হয়নি। তৃপ্তি গল্প করেছে, হাসি ঠাট্টা করেছে, তাকে খাইয়েছে, সেবা করেছেÑ এসবের মধ্যে ঘুটু দোষের কিছুই দেখেনি বলে প্রশ্রয় দিয়েছে আর তাতেই তৃপ্তি ধরে নিয়েছে, ঘুটু তাকে ভালোবাসে। তাই সেও এগিয়ে গেছে অনেকদূর। তাকে আর আগাতে দেয়া উচিৎ না। ঘুটু অনেকটা সাবধান হয়ে যায়।
ঘুটু সাবধান হলেও তৃপ্তি তখন অনেকদূর এগিয়ে গিয়েছিল। সে নিজেকে গুটিয়ে রাখল না। একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে ঘুটু দেখল তার বুকের উপর অনেকগুরি ফুলের পাপড়ী ছড়ানো রয়েছে। সে বুঝতে পারল এটা তৃপ্তির কাজ। সে তৃপ্তিকে বুঝালো এমন করা ঠিকনা। বাবা মা দেখে ফেললে কি মনে করবে!  তৃপ্তি একথার কোন উত্তর দিল না; শুধু একটু হাসল। মনে হলো ও যেন বোঝাতে চাইছেÑ বাবা মা দেখে পেললে কিছুই হবে না। আবার মনে হলো ও বলতে চাইছেÑ আমি ওসেবের ভয় করি না।
তৃপ্তি যে ঐ একদিনই ঘুটুকে ফুল দিয়েছে তা নয়। এরপরে সে অনেকবার ওরকম বুকের উপর ফুলের পাপড়ী রেখেছে। বালিশের পাশে সুগন্ধী ফুল রেখেছে, ঘুটুর পড়ার টেবিলে গ্লাসে পানির মধ্যে গোলাপ, রজনীগন্ধা ইত্যাদি ফুল রেখে দিয়েছে।
এমনি করে কখন যে দুটো বছর কেটে গেছে তা যেন ঘুটু টেরই পায়নি। আসলে সুখের দিনগুলি বড় তাড়াতাড়ি চলে যায়।
তৃপ্তি অষ্টম শ্রেণী পাস করে নবম শ্রেণীতে উঠল। ঘুটু এখন আর তাকে ছোটমানুষ ভাবে না। সে আগে তৃপ্তিকে ছোট মানুষ ছোট মানুষ বলত। একদিন তৃপ্তি উদাহরণ দিয়ে বুঝিয়ে দিল সে ছোট নয়। তার বয়সী তার এক মামাতো বোনের বিয়ে হয়েছে, আরেক মামাতো বোনের একটি বাচ্চা। এসব শুনে ঘুটু হাসে কিন্তু হাসলেও সত্যিই যে তৃপ্তি বড় হয়েছে, অনেক কিছু বুঝতে শিখেছে- এটা ঘুটু বুঝতে পারে। মেয়েদের পরিপক্কতা যে একটু অল্প বয়সেই আসেÑ এটা ঘুটু তার নিজের নাইনে পড়াকালীন মন মানষিকতার সাথে তুলনা করে বুঝতে পারে।
তৃপ্তির বিভিন্ন সময়Ñ বিভিন্ন কারণে ঘুটুর ওপর অভিমান করে। মাঝে মাঝে অভিমানের মাত্রা বেশী হলে কথাও বন্ধ হয়ে যায়। সুমনের সাথে তার সম্পর্ক ভালো না, অথচ তার সাথে মন কষাকষি, মান-অভিমান হয় না। কথা বন্ধ হয় না আর তৃপ্তির সাথে বেশী ভাব বলে তার সাথেই এসব বেশী হয়। ঘুটু বুঝতে পারে যেখানে বেশী ভালোবাসা বাসা বাঁধে, সেখানে মান-অভিমানও বেশী থাকে। তৃপ্তি অভিমান করলে ঘুটু ভাবে-থাক, অভিমান করুক, কিন্তু বেশী সময় সে সহ্য করতে পারে না। তৃপ্তি রাগ করলে, কথা না বললে, সেবা-যতœ না করলে ঘুটুর মোটেও ভালো লাগে না। তাই সে নিজেই চেষ্টা করে বলেÑ কয়ে অভিমান ভাঙ্গায়। এভাবে কতদিন কতবার যে মান অভিমানের পালা চলেছে তার গোনাগাথা নেই। মাঝে মাঝে ঘুটুর রাগও হয়েছে কিন্তু শেষ পর্যন্ত রাগ ধরে রাখতে পারেনি।
একদিন পড়ানোর সময় কথা প্রসঙ্গে হঠাৎ নরম হাত ও শক্ত হাতের প্রসংগ উঠল। সুমন বলল যে, তাদের আগের স্যারের হাতের তালু খুব শক্ত ছিল, মারা লাগত না, হাতটা গায়ে ছুইয়ে দিলে তাতেই ব্যাথা লাগত। তৃপ্তি হাসল। সে ঘুটুর হাতটা ধরে বলল, স্যারের হাতটা খুব নরম- একেবারে মেয়ে লোকের হাতের মতো। সুমন বলল যে, তার হাতটাও নরম। তৃপ্তি বলল, তুই ছোট মানুষ বলে তোর হাত নরম, স্যারের মতো বড়ো হলে দেখবি তোর হাত শক্ত হয়ে গেছে। সুমন তৃপ্তির যুক্তি মেনে নিলনা। তৃপ্তি এবার তার হাতটা ঘুটুর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, স্যার আমার হাতটা কি নরম না শক্ত, দেখেন তো। ঘুটুর লজ্জা লাগল। তৃপ্তি যখন তার হাত ধরেছিল, তখনই তার লজ্জা লেগেছিল। আর এবার তাতেই হাত ধরে দেখতে বলছে। ঘুটুর এর আগে কোনদিন কোন মেয়ের হাত ধরেনি; এমনকি তৃপ্তির ও না। তাই তার খুব লজ্জা লাগল। তাছাড়া কাজটা ঠিক হবে না মনে করে সে তৃপ্তির হাতটা ধরে দেখল না। তৃপ্তি রেগে পড়া ছেড়ে উঠে পড়ল। বলল, আমি সব বুঝি। আমি কালো বলে, আমার চেহারা খারাপ বলে আপনি আমাকে পছন্দ করেন না। আমাকে ভালোজানেন না, আমাকে এড়িয়ে এড়িয়ে থাকেন, আর আমার হাতটাও একটু ধরে দেখলেন না। ঠিক আছে, আমিও আর বেহায়ার মতো.......।
তৃপ্তি আর বলতে পারল না। কি বলতে যাচ্ছিল কে জানে! কথা থেমে গেল। তৃপ্তির চোখ দিয়ে জল ঝরতে লাগল। ওর কান্না শুনে ওর মা ছুটে এলো। সে ব্যাপার কি তা জানতে চাইল। তৃপ্তি তার মায়ের ওপর রাগ করে উঠল। সুমন বলতে যাচ্ছিল, ঘুটু তাকে থামিয়ে দিল।
পরদিন সকালে তৃপ্তি ঘুটুর সাথে কোন কথা বলল না, বিকেলে স্কুল থেকে ফিরে এসেও না। ঘুটুর মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল এবার আর সে মান ভাঙাবার চেষ্টা করবে না। রাতেও তৃপ্তি ঘুটুর সাথে কথা বলল না। পরদিন তৃপ্তি বই খাতা নিয়ে তার নানার বাসায় চলে গেল। নানার বাসা বেশী দূরে নয়Ñ মাইল দুয়েক দুরে হবে। তিনদিন সে নানাবাড়ী থেকেই স্কুল করল। সুমন তাকে আনতে গেল, সে আসলনা। তৃপ্তির মা গেল, তবুুও তৃপ্তি ফিরল না, বলল যে, আরো দু’তিন দিন থেকে তারপর বাসায় ফিরবে। নানাবাড়ীর লোকে ব্যাপারটা জানত না আর তৃপ্তির মাও তাদেরকে কিছু বলল না, তাই তারাও তৃপ্তিকে ছাড়ল না। তৃপ্তির মা অগত্য একা একা বাসায় ফিরল। সে বুঝতে পারল যে ঘুটুর ওপর তৃপ্তির গভীর অভিমান হয়েছে, ঘুটু নিজে মান ভাঙাতে না গেলে তৃপ্তি আসবে না। তৃপ্তির সম্পর্কে সে তো ভালোই জানে। একমাত্র মেয়ে, আল্লাদ দিতে দিতে ওরকম হয়ে গেছে। এখন  ঠিক করারও উপায় নেই। সে শেষ পর্যন্ত ঘুটুকে বলল তৃপ্তিকে তার নানাবাড়ি থেকে নিয়ে আসার জন্যে। ঘুটু ও এমনটিই চাচ্ছিল। তৃপ্তি চলে যাবার পর থেকেই তার খুব খারাপ লাগছিল। তৃপ্তিকে ছাড়া সবকিছু কেমন শূন্য শূন্য মনে হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল যেন কতকাল সে তৃপ্তিকে দেখে না। তৃপ্তির জন্যেই সে ও  বাড়িতে ছিল। তৃপ্তিকে ছাড়া ও বাড়ীতে থাকা কষ্টকর।
ঘুটু নিজেকে প্রশ্ন করে তৃপ্তিকে কদিন না দেখে এমন লাগে কেন? তৃপ্তির জন্যে মনটা এত কাঁদে কেন? তৃপ্তিকে ছাড়া সবকিছু কেমন শূন্য শূন্য লাগে কেন? ঘুটু এর কোন উত্তর পায় না। আবার প্রশ্ন করেÑ এরই নামকি ভালোবাসা? সে কি তৃপ্তিকে ভালোবেসে ফেলেছে? একবার উত্তর পেয়েছে হ্যাঁ, আবার পেয়েছেÑ না, আবার পেয়েছেÑঅতশত বুঝি না, ওকে কাছে চাই, ওর সেবা যতœ চাই, ব্যাস।
ঘুটু তৃপ্তিকে আনার জন্যে সুমনকে নিয়ে তার নানার বাসায় গেল। তৃপ্তির নানাবাড়ির লোকেরা তৃপ্তিকে মাস্টারের সাথে পাঠিয়ে দেয়া সংগত মনে করলনা এবং এ নিয়ে বাড়ির মধ্যে তৃপ্তির মায়ের বুদ্ধিহীনতা সম্পর্কে বেশ করে আলোচনা হলো যা ঘুটু শুনতে পারল। সে দারুন বিব্রত বোধ করল। ওদের আলাপ শেষ হলে ওরা এসে ঘুটুকে ফিরে যেতে বলল এবং সুমনের সাথে ঘন্টা দুয়েক পরে তাকে পাঠিয়ে দেবে বলল। ঘুটু দারুন অপমানিত বোধ করল। অভিমানে সে হনহন করে বেরিয়ে গেল। বাসায় ফিরে সে তৃপ্তির মাকে সব খুলে বলল। তার বাপের বাড়ির লোক সম্পর্কে তার ভালো ধারণা থাকা উচিৎ এবং সে বাড়ীতে ঘুটুকে পাঠানো ঠিক হয়নিÑএকথাটিও ঘুটু কৌশলে সুমিষ্ট স্বরে তাকে জানিয়ে দিল। তৃপ্তির মা দুঃখ প্রকাশ করল।
তৃপ্তি বাসায় ফিরেই তার মায়ের সাথে ঝগড়া শুরু করে দিল। নানাবাড়ির লোকের অপরাধের জন্যে সে মাকে অপরাধী করল। সে প্রতিজ্ঞা করল সে আর কোনদিন নানা বাড়িতে যাবে না। তৃপ্তি তার প্রতিজ্ঞা রক্ষা করেছিল। ঐ ঘটনার পরও ঘুটু অনেকদিন তৃপ্তিদের বাড়ীতে ছিল। ঐ সময়ে সবাই ও বাড়ীতে বেড়াতে গেছে অনেকবার কিন্তু তৃপ্তি আর যায়নি। এর ব্যাখ্যায় একদিন সে ঘুটুকে বলেছিল, আমার স্যারকে যারা অবিশ্বাস করে বিব্রতকর অবস্থায় পেলে, তাদের বাড়ি আমি যেতে পারি না।
একটি বিশেষ রাতের কথা ঘুটুর মনে পড়ল। সে রাতটি ঘুটুর জীবনে বিরাট একটি ঘটনা। সে রাতের কথা সে কোনদিন ভুলতে পারেনি। হয়তো কোনদিন পারবেওনা। সে রাতের স্মৃতিকে সে ধরে রেখেছে বছরের পর বছর। তারপরে কেটে গেছে দীর্ঘ এগারটি বছর। এরমধ্যে কতবার যে সে রাতের কথা তার স্মৃতির পর্দায় ভেসে উঠেছে তার সঠিক হিসেব তার জানা নেই। আজও খুব করে মনে পড়ছে। ঈদের আগের দিন। সন্ধ্যায় ঈদের চাঁদ দেখার পর ঘরে ঘরে আনন্দের ঢেউ উঠল। ঢেউ উঠল তৃপ্তিদের বাসায়ও। তৃপ্তি ঘুটুর সামনে এমন হাসিখুশী ভাবে এলো যে মনে হলো তৃপ্তিই দুনিয়ার সবচেয়ে সুখী মানুষ। পরের দিন ঈদ তাই ঐদিনকার খাদ্য তৈরীর প্রস্তুতি চলতে লাগল। ডাল ভেজানো, ডালবাটা, মসলা বাটা, মুরগী জবাই করা, গোস্ত বানানোÑ এসব কাজ চলল গভীর রাত পর্যন্ত। আশপাশের ঘরেও চলছে তাই কারো চোখে ঘুম নেই। ঘুটুর মনেও আনন্দের কমতি নেই। তার চোখেও ঘুম এলো না। তার ঘরে বসেও অনেক কাজ চলল, তাছাড়াÑ তার ঘরটিকে বিভিন্নভাবে সাজানো হচ্ছিল। ঘুটুও  সাজানোর কাজে যোগ দিল। তৃপ্তির ঘরও সাজানো হয়েছিল। সেটি সাজানো হয়েছিল তৃপ্তির মায়ের মনের মতো আর ঘুটুর ঘর তৃপ্তি তার মন মতো সাজালো। তাদের ঘরের চেয়ে বাড়তি কিছু সাজসজ্জা করা হলো ঘুটুর ঘরের। এই বাড়তি উপাদান তৃপ্তি তার নিজস্ব তহবিল থেকে খরচ করে কিনেছিল।
রাত অনেক হলো। একে একে সবাই ঘুমিয়ে পড়ল। ভোর রাতে আবার ঐ ঘরে কাজ করতে আসবে, তখন ঘুটুকে জাগালে তার ঘুমের ব্যঘাত হবে বলে ব তৃপ্তি বাইরে থেকে ঘর আটকিয়ে চলে গেল। ঘুটু ঘুমিয়ে পড়ল।
একটা খারাপ স্বপ্ন দেখে ঘুটুর ঘুম ভেঙে গেল। সে উঠে আলো জালালো। ঘড়িতে সময় দেখল। ভেবেছিল রাত পোহাতে হয়ত বেশী দেরী নেই। এ রাতটুকু জেগেই থাকবে। ভালো স্বপ্ন ভেঙে গেলে যেমন ঘুম ভেঙে যাওয়ার জন্যে আফসোস হয়, আবার ঘুমিয়ে পড়তে ইচ্ছে হয়, খারাপ স্বপ্ন দেখলে ঠিক এর উল্টোটা হয়। মনে হয় না ঘুমিয়ে জেগে থাকলে খারাপ স্বপ্নটা দেখতে হতো না। তাছাড়া আর ঘুমুতে ও ইচ্ছে করে না। কিন্তু বাড়ি দেখে বুঝতে পারল যে, না ঘুমিয়ে উপায় নেই। রাত কেবল দুটো বাজে। একটু আগেই ঘুমিয়েছিল, এরমধ্যে ঘুম ভেঙে গেছে। তাই সারারাত না ঘুমিয়ে পারা যাবে না। ঘুটু জেগে জেগে তার স্বপ্নের কথা ভাবতে লাগল।
দরজার কাছে একটা মৃদু শব্দ শুনে ঘুটু কান খাড়া করে রইল। দেখল দরজা খুলে ব তৃপ্তি ঘরে ঢুকছে। ঘুটু ভাবল তৃপ্তি হয়তো কোনো কাজে এসেছে। হয়ত রান্নার সরঞ্জাম তৈরির কাজ নয়তো ঘর সাজানোর কাজ। একবার ভাবল বলবে এতরাতে আবার কি করবে? কিন্তু কিছু বলল না। ঐ গভীর রাতে যুবতী ছাত্রীর সাথে কথা না বলাই ভালো। সে ঘুমের ভান করে পড়ে রইল। দেখল তৃপ্তি বড় আলোটা জ্বালালো না। ঘরে যে ডিমলাইট টা জ্বলছিল, তার আলোতে তৃপ্তিকে অনেকটা ছায়ার মতো লাগছিল। ও কাজ করতে শুরু করল না, আলো জ্বালাল না। ঐ আলোতেই সে খাটের ওপর বসে পড়ল। তারপরে আবার একটু সরে একেবারে ঘুটুর বুকের কাছে বরাবর বসল। তৃপ্তি প্রমাদ গুণল। এ গভীর রাতে তৃপ্তি কি উদ্দেশ্য নিয়ে এসেছে তা সে এবং অন্তর্যামীই জানে। ঘুটুর মনে বিপদের আশংকা দেখা দিল। এ অবস্থায় যদি কেউ দেখে ফেলে, তাহলে কি অবস্থা হবে সে ভেবে পেল না। তৃপ্তি ঘুটুর একটা হাত কোলের উপর তুলে নিল। তারপরে হাতের কনিষ্ট আঙ্গুলটায় মেহেদী লাগিয়ে দিল। ঐ আবছা আলোতে অবশ্য বোঝার উপায় ছিল না যে, মেহেদী না অন্যকিছু মাখছে। কিন্তু মেহেদীর গন্ধে সে বুঝতে পারল। তার তখন মনে পড়ল তিনদিন আগে শবেকদরের রাতে সবাই মেহেদী লাগিয়েছিল। তৃপ্তি তার হাতে নিজে হাতে মেহেদী লাগিয়ে দিতে চেয়েছিল কিন্তু ঘুটু তাতে রাজি হয়নি। সে তৃপ্তি কাছ থেকে মেহেদি নিয়ে নিজে লাগাতে চেয়েছিল আর তাতে তৃপ্তি অভিমান করে মেহেদীতো দিলই না তারপরে আবার দুদিন পর্যন্ত তার সাথে কথাই বলল না। জাগ্রত অবস্থায় যে মেহেদী সে দিতে পারেনি, ঘুমন্ত অবস্থায় সে সেই মেহেদী লাগিয়ে দিল। ঘুটু মনে মনে আল্লাকে ডাকতে থাকল যেন কোন বিপদ না হয়।
তৃপ্তি যে এমন একটা কাজ করে বসবে তা ঘুটু কোনদিন কল্পনাও করতে পারেনি। তৃপ্তি তাকে গভীরভাবে ভালোবাসে এটা সত্য। কিন্তু আর দশটা প্রেমিকার সাথে তার ব্যবধান অনেক। সে কোনদিন ঘুটুর সাথে কোন অশালীন কথা বলেনি, অশোভন কোন হাসি হাসেনি, অশোভন কোন ইঙ্গিত করেনি। সে শুধুই ভালোবেসেছে আর সেবা করেছে। তার ভালোবাসার মধ্যে কোন নোংরামী ছিল না; ছিল পবিত্রতা। তাই ঘুটু কোনদিন ভয় করেনি, তৃপ্তির কাছ থেকে খারাপ কিছু আশা করেনি। কিন্তু আজ তৃপ্তি কি করতে যাচ্ছে। তার উদ্দেশ্য কি! কি চায় সে ঘুটুর কাছে! এই গভীর রাতে কি ওর জৈবিক তৃষ্ণা জেগেছে আর তাতে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে জৈবিক তৃষ্ণা মেটাতে এসেছে, পবিত্র ভালোবাসাকে অপবিত্র করতে এসেছে! তাহলে আর দশটা সাধারণ দেহসর্বস্ব প্রেমিকার সাথে তার পার্থক্য কোথায়! ঘুটুর ধারণা কি সব মিথ্যে হয়ে গেল? তৃপ্তি কি এখনই তার পাশে শুয়ে পড়বে বা হাত রাখবে? অশুভ ইংগিত জানাবে? যদি তাই জানায় তাহলে কি হবে? যদি এ অবস্থায় কেউ দেখে ফেলে তাহলে কেলেংকারির একশেষ হয়ে যাবে। হয়ত জোর করে দুজনের বিয়ে দিয়ে দেবে। তাহলে কি শেষ পর্যন্ত একজন অভিসারীনীকে বিয়ে করতে হবে? তাও কলংক মাথায় নিয়ে? সে কি এমন পাপ করেছিল যে আজ এ অবস্থায় পড়তে হলো? তবে কি তৃপ্তির মাÑই তাকে এভাবে ঘরে ঢুকিয়ে দিয়ে বাইরে বসে আছে আর খারাপ কিছু টের পেলেই সে এসে হাতেনাতে ধরে ফেলবে আর তৃপ্তিকে বিয়ে করতে তাকে বাধ্য করবে? কি এর উদ্দেশ্য ঘুটু তা ভেবে পায় না।
ঘুটু ভয়ে কাঁপতে থাকে। ঘামে সারা শরীর ভিজে যায়। তৃপ্তির বিড় বিড় শুনে সে কান আরো খাড়া করল। শুনল তৃপ্তি বলছে, স্যার, আপনার জন্যে আমি আমার জীবনটাও দিয়ে দিতে পারি, অথচ আপনি আমাকে কিছুই দিলেন না। ভালোবেসে পরশ বুলাতে দিলেন না। কিন্তু এখন আপনি ঘুমে অচেতন, এখন আপনি আমাকে অবহেলা করতে পারবেন না, আমার ভালোবাসার পরশ ও ফিরিয়ে দিতে পারবেন না। আমি আমার ভালোবাসার পরশ আপনার শরীরে বুলিয়ে যাব।
তৃপ্তি ঘুটুর একটা হাত তুলে নিল। হাতটা কাধের উপর রেখে মুখ তার সাথে চেপে রাখল। এভাবে কিছুক্ষন থাকার পর ঘুটুর হাতটি সে নিজের মুখে কয়েকবার বুলালো। এরপর হাতে কয়েকটা চুমো দিল এবং বেরিয়ে গেল।
ঘুটু যেন নরক থেকে বের হলো। বিপদ কেটে যাওয়ায় সে আল্লার দরবারে শুকরিয়া জানালো। এত সময় তৃপ্তিকে নিয়ে কত আজেÑবাজে চিন্তা করেছেÑ সেসব ভেবে নিজেকে ধিক্কার দিল। তৃপ্তি যে আর দশটা সাধারণ প্রেমিকার মতো না, তা আবারো সে মর্মে মর্মে উপলব্ধি করতে পারল। মনে হলে তৃপ্তি অন্যান্য, অসাধারণ, খাঁটি প্রেমিকা।
খুব সকালে কোলাহলে ঘুটুর ঘুম ভেঙে গেল। মহিলারা রান্নার আয়োজন করছে, ছোটরা আনন্দ ফুর্তি করছে। খানিক পরে তৃপ্তি ঘুটুর ঘরে এলো। তৃপ্তির দিকে তাকাতে ঘুটুর লজ্জা লাগল। এতদিনের পরিচিতা তৃপ্তিকে তার হঠাৎ অপরিচিতা মনে হলো। মনে হলো সে অন্য কেউ। এতদিন সে যে তৃপ্তিকে দেখেছে। সে তৃপ্তি আর এ তৃপ্তিতে অনেক তফাৎ। এতদিন যে তৃপ্তিকে সে দেখেছে সে একজন ছাত্রী, সেবা পরায়না ছাত্রী, আর আজ যে তৃপ্তিকে দেখছে সে একজন নারী, একজন প্রেমিকা। সে তৃপ্তির মুখের দিকে এক নজর তাকাল। দেখল তৃপ্তি তার দিকে তাকাল, তার আঙ্গুলের দিকে তাকালো, তার মুখের দিকে তাকাল তারপর একটু মুচকি হেসে চলে গেল।
সেমাই রান্না হলে তৃপ্তি এক পিরিচি সেমাই এনে নিজে চামচে করে ঘুটুর মুখে তুলে দিতে গেল। ঘুটুর লজ্জা লাগল সে বাধা দিল কিন্তু তৃপ্তি ছাড়ল না। ঘুটু বাধ্য হয়ে কয়েক চামচ খেল্ োতৃপ্তি এবার পিরিচি ও চামচ ঘুটুর হাতে তুলে দিল। বলল, আপনাকে তো খাইয়ে দিলাম, আমাকে খাইয়ে দেবেন না? ঘুটু এর জন্যে প্রস্তুত ছিল না। কিছু সময়ের জন্য সে অন্য জগতে চলে গেল। তৃপ্তির কথায় সে সংবিৎ ফিরে পেল। তৃপ্তি আবার বলল, কি ব্যাপার, লজ্জা করছে, না ঘৃণা? ঘুটু এর কোন জবাব খুঁজে পেল না। সে কি করবে বুঝে উঠতে পারল না। সেতো এসব চায় না কিন্তু তৃপ্তি একটু বেশী বাড়াবাড়ি করে ফেলছে। সে কি করবে? ওর মুখে খাবার তুলে দেয়া কি ঠিক হবে?
তাতে কি ওকে বেশী প্রশ্রয় দেয়া হবে না? আবার এই ঈদের দিনে তৃপ্তির আনন্দ মাটি করে দেয়াটাকে ঠিক হবে? সে শেষ পর্যন্ত এক চামচ সেমাই তৃপ্তির মুখে তুলে দিল। তৃপ্তি যেন জীবনে অনেক কিছু পেল, এমন তৃপ্তির হাসি হেসে চলে গেল।
ঈদের নামাজ পড়তে যাবার আগে তৃপ্তি একটি ঈদকার্ড এবং তার নিজের হাতে সেলাই করা একটি রুমাল ঘুটুকে উপহার দিল। ঘুটু প্রথমে সংকোচ করল কিন্তু উপহার ফিরিয়ে দেয়াটাও কেমন দেখায় তাই সে উপহারগুলি নিল।
ঈদ কার্ডে এবং রুমালে ভালোবাসার নানান কথা লেখা। সেসব পড়ে ঘুটুর বুকের ধুকধুকানি বেড়ে গেল। সে বুঝতে পারল যে, সে তৃপ্তির ভালোবাসার জালে জড়িয়ে পড়ছে। একটু পরে তৃপ্তির মা একটা পাঞ্জাবী ঘুটুকে ঈদের উপহার হিসেবে দিল। ঘুটু এসবের জন্যে প্রস্তুত ছিল না। তাকে যে বৃষ্টি ও বৃষ্টির মা কিছু দেবে, তা সে আগে ভাগে ভাবেনি। তাহলে ওদের জন্যেও কিছু কিনে রাখত। সে অবশ্য ভেবে রেখেছিল যে, ঈদের দিন সৌজন্য হিসেবে সুমনকে সে বিশটি টাকা দেবে। এখন ওদের উপহার গ্রহণ করে সে আর ঐ বিশ টাকা দিয়ে খালাস পেতে পারে না। কি করা যায় সে ভাবতে থাকল।
ঈদের নামাজ পড়ে ফেরার পথে ঘুটু তৃপ্তির জন্যে দু’টো উন্নতমানের ঈদকার্ড কিনে নিয়ে এলো। বাসায় ফিরে সুমনকে প্রথমে পঞ্চাশটি টাকা দিল। তৃপ্তি ঘুটুর দিকে তাকাল। মনে হলো সেও কিছু চাচ্ছে। ঘুটু হাসিমুখে ঈদ কার্ড দুটি তৃপ্তির হাতে তুলে দিতে পারল না, রিসবদনে মলিন মুখে সে ও দুটো তৃপ্তির হাতে তুলে দিল। এটা তার ভালোবাসার দান নয়, এটা উপহার নয়, এটা শুধুই প্রতিদান, শুধুই ভদ্রতা।
তৃপ্তি ঈদকার্ড দুটো লুফে নিল। সে আনন্দে প্রায় নেচে উঠল। বলল স্যার, কার্ডদুটো খুব সুন্দর হয়েছে, আপনার পছন্দ আছে। সে একটি কার্ডের ভেতরের অংশ দেখল, মুখটা কিছুটা অন্ধকার হযে গেল। অন্যটার ভিতরটা দেখে সে মুখ একেবারে কালো হয়ে গেল। বলল, কার্ডের মধ্যে কিছু লিখে দেননি।
ঘুটু কি বলবে বুঝে পেল না, চুপ করে রইল। তৃপ্তি বলল, আপনি আমাকে কার্ড দুটি কেন দিয়েছেন আমি জানি। আমি আপনাকে দিয়েছি তাই ভদ্রতা রক্ষার খাতিরে আমাকে আপনি ও দুটি দিয়েছেন। এ আপনার উপহার নয়, দেনা শোধ। কিন্তু এর কোন প্রয়োজন ছিল না। এই শূন্য কার্ড দুটো মুল্যহীন। এতো আমি দোকান থেকে নিজেও কিনে নিতে পারি। এ দিয়ে আমি কি করব?
ঘুটু বলল, দেখ তৃপ্তি, আমি অতটা ভেবে দেখিনি। তাছাড়া কি লিখব ভেবে পাচ্ছিলাম না।
তৃপ্তি বলল, ভেবে পাবার কথা নয় স্যার। কারো জন্যে অন্তরে ভালোবাসা থাকলে তার উদ্দেশ্যে অবশ্যই কিছু লেখা যায়, তাকে লেখার অনেক কিছু থাকে। আপনি আমাকে পছন্দ করেন না বলে আমাকে কিছুই লিখে দিতে পারেননি। কিন্তু আজকের এই দিনে অন্তত মিথ্যে করে হলেওতো কিছু লিখে দিতে পারতেন। আর তাও যদি না পারতেন, তাহলে আমাকে যে আপনি অবজ্ঞা করেনÑ এ কথাটি তো লিখে দিতে পারতেন।
ঘুটুর অনেক কিছু বলতে ইচ্ছে করল। কিন্তু সব কথা সব সময় বলা যায় না, ঘুটু ও বলল না। সে বলল, দাও, আমি লিখে দিচ্ছি।
তৃপ্তি বলল, না থাক। জোর করে কিছু হয় না। এই ভালো। ঘুটু বলল, দাও, আমি স্বাক্ষর করে দেই তোমার যা খুশী লিখে নিও।
তৃপ্তি একটু মুচকি হাসল। মনে হলো সেই হাসিতে ফুটে উঠেছে অনেক কিছু। সে হাসি হৃদয়ের আনন্দধারা থেকে বেরিয়ে আসেনি, দীর্ঘনিশ্বাস এবং বিদ্রুপ থেকে অতিকষ্টে হাসি ঠোটের কোনে দেখা দিয়েছে। সে কার্ড দুটো ঘুটুর হাতে দিল। ঘুটুর দুটো কার্ডেই তার নাম লিখে দিল। তৃপ্তি প্রায় কাঁদো কাঁদো হয়ে চলে গেল।
ঐ দিন তৃপ্তি আর ঘুটুর সামনে এলো না। সে কারো বাসায় গেলনা সারাদিন ঘরে শুয়ে থাকল। সে কিছু খেলও না। তৃপ্তির মা তাকে খাওয়ানোর জন্যে স্বাভাবিক করার জন্যে অনেক চেষ্টা করল, কিন্তু পারল না। তৃপ্তির এই একটা বৈশিষ্ট্য ঘুটুর খুব খারাপ লাগে। সে ভাবল তৃপ্তি কে সেধেÑবলে কয়ে তার অভিমান ভাঙাবে কিন্তু নানা কথা ভেবে শেষ পর্যন্ত সে তা করলনা। তার মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। বিকেলে সে চলে গেল সোজা সিনেমা হলে। ঈদের দিনে সিনেমা হলে খুব ভিড়। টিকিট কেনার জন্যে অনেক চেষ্টা করল, কিন্তু পারল না। শেষমেষ ব্লাকে প্রায় দ্বিগুণ পয়সা দিয়ে টিকিট কিনে পরপর দুটি সিনেমা দেখে অনেক রাতে বাসায় ফিরল। সারাদিনে শুধু তৃপ্তিদের বাসায় খেয়ে, আত্মীয় বন্ধুদের বাসায না গিয়ে খারাপ মন নিয়ে দুটো সিনেমা দেখে ঈদের আনন্দটাই মাটি করে দিল।
ঈদের পরদিন অনেক বেলা করে ঘুটুর বিছানা ছেড়ে উঠল। ঈদের আনন্দ ঘরে ঘরে লেগেই ছিল। ছাত্রছাত্রীদের পড়ানো লাগবে না আর কলেজ ও বন্ধ তাই তাড়া ছিল না। তাছাড়া তৃপ্তি অন্য দিনের মতো ডেকে জাগায়নি তাই অনেক বেলা করে বিছানা ছেড়ে হাতমুখ ধুয়ে খাবারের জন্যে অপেক্ষা করতে থাকল। সুমন খাবার নিয়ে এলো। অন্যদিন তৃপ্তি নিয়ে আসে, হঠাৎ সুমন খাবার নিয়ে আসায় ঘুটু বুঝতে পারল যে, তৃপ্তির অভিমান তখনও ভাঙেনি।
খাওয়া দাওয়া শেষ করে ঘুটু বাইরে বেরুবার জন্যে তৈরি হচ্ছিল, এমন সময় তৃপ্তির মা ঘরে ঢুকল। বলল, তোমার সাথে আমার কিছু কথা ছিল। তোমার কি এখনই বাইরে যাওয়া দরকার না একটু পরে গেলেও চলবে? ঘুটু বলল, না, ব্যস্ততা নেই। কোন কাজবাজ নেই, ভালো লাগছে না তাই একটু বাইরে ঘুরে বেড়াতে যেতে চাচ্ছিলাম। বলেন কি বলবেন।
তৃপ্তির মা বসল। তার ঠোঁট মাঝে মাঝে নড়ল কিন্তু কিছু বললনা। এভাবে চলল অনেক সময়। ঘুটু বুঝতে পারল উনি কি বলবে তা মনের মধ্যে সাজাচ্ছে। কোথা দিয়ে কিভাবে শুরু করবে ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না।
বেশ কিছু সময় কেটে গেল, কিন্তু তৃপ্তির মা কিছুই বলল না। ঘুটু ও চুপ করে রইল। তার মনটা ব্যাকুল কি বলবে তা শোনার জন্যে। শেষ পর্যন্ত সে কিছুই না বলে উঠে পড়ল। যাবার সময় বলল, ঠিক আছে তুমি বাইরে যাও, আমি পরে বলব।
ঘুটুর মনে ভয় হলো। সন্দেহ হলো লজিংটা আর থাকবে কিনা। তার ভয় হলো গত পরশু রাতের ব্যাপারটা হয়ত উনি টের পেয়েছে। সেজন্যে কি তাকে চলে যেতে বলবে! নাকি তৃপ্তিকে বিয়ে করতে বলবে! নাকি তার একমাত্র মেয়েকে কষ্ট দিচ্ছে বলে তাকে চলে যেতে বলবে। তৃপ্তিকে তাকে বিদায় দিয়ে দিতে বলেছে? কী বলতে এসেছিল তৃপ্তির মা?
ঘুটুর মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। সে বাটুলের কাছে গেল। বাটুল তার সবচেয়ে প্রিয়বন্ধু। বিপদেÑআপদে নানা প্রয়োজনে ঘুটু সবসময় বাটুলের কাছে যায় পরামর্শ বা সাহায্যের জন্যে। বাটুলকে সে বলল, বাটুল, আমার হয়ত দুয়েক দিনের মধ্যে লজিং পাল্টাতে হবে। তোমার খোঁজে যদি কোন লজিং থাকেতো চলো ঘুরে আসি। আর যদি না থাকেতো খুঁজতে হবে। খুব তাড়াতাড়ি লাগবে বলে মনে হয়। ভাব বেশী ভালো মনে হচ্ছে না।
বাটুল সবকিছু খুলে বলতে বলল। ঘুটু পরশু রাত থেকে শুরু করে যা যা হয়েছে সব খুলে বলল। আর আগের সব ঘটনাতো ঘুটু তাকে আগেই বলেছে। বাটুল সব শুনে একটু হাসল। ঘুটুর খুব খারাপ লাগল। তার এমন বিপদের কথা শুনেও বাটুল হাসছে। বাটুলের এই একটা অভ্যেস তার পছন্দ হয় না। বাটুল কোন কিছুকে গুরুত্ব দেয় না। তার কাছে ভয়ংকর বা খারাপ কোন খবর বললেও সে একটু হাসে। যেন খবরটি সে আগেই জানত অথবা খবরটির কোন গুরুত্ব নেই। কিন্তু অন্য সময়ের কথা আলাদা। ঘুটুর এই ঝামেলার সময়ও সে অমন করে হাসবে তা ঘুটুর সহ্য হয় না। তার মুখ কালো হয়ে গেল, মনটা ভার হয়ে গেল।

 বাটুল কিছু সময় চুপ করে থাকল। তারপর বিজ্ঞের মতো বলল, লজিং ছাড়ার দরকার হবে না। তৃপ্তির মা সেরকম কিছু বলবে না। সে বিয়ের কথা বলবে, মানে তোমার সাথে তৃপ্তির বিয়ের প্রস্তাব দেবে।
তুিম বুঝলে কি করে?
আমি বুঝি। ঐরকম কায়দা করেই ছেলে বা মেয়েরা বলে প্রেমের কথা আর মেয়ের অভিভাবকেরা বলে বিয়ের কথা। তুমি তো আবার কারো সাথে প্রেমই করনি তো বুঝবে কি করে! মেয়েরা যখন ছেলেদেরকে ভালোবাসার কথা বলতে চায় বা অন্যরকম কিছু বলতে চায়, তখন ঐরকম করে বলে তোমার সাথে আমার একটা কথা আছে। খুব জরুরি অথবা বলে খুব গুরুত্বপূর্ণ অথবা বলেÑ খুব গোপনীয়। তখন ছেলেটির ব্যস্ততা বেড়ে যায়। সে শুনতে চায় কি এমন কথা যা মেয়েটি তাকে বলতে চায়। তখন মেয়েটি বলে, থাক, আজ নয়, কাল শুনো। তখন ছেলেটি ওই কথা শোনার জন্যে মেয়েটির পিছু লাগে আর এভাবেই আস্তে আস্তে তারা ঘনিষ্ট হয়। আর মেয়ের অভিভাবকরা যদি ওরকম বলে তো বুঝতে হবে তারাÑ বিয়ের প্রস্তাব দেবে। কিন্তু হয় সংকোচ কাটাতে পারছে না, নয়তো ছেলেটির আগ্রহ বাড়িয়ে তারপরে বলতে চাচ্ছে। তোমার ক্ষেত্রে হয়ত প্রথমটি হয়েছে। সেদিন রাতের ব্যাপারটা হয়ত তৃপ্তির মা টের পেয়েছে, নয়তো কালকের ব্যাটারটা তাকে ভাবিয়ে তুলেছে। সে অবশ্যই আগেই তোমার সাথে তৃপ্তিকে বিয়ে দেবার ব্যাপারে ভেবেছিল এবং আশা করে রেখেছিল কিন্তু গত দুদিনের বা একদিনের ঘটনায় তার মনে হয়েছে ব্যাপারটি আর গড়াতে দেয়ার আগে বিয়ের ব্যাপারে একটা আলাপ করে নেয়া ভালো। নয়ত, পরে সমস্যা দেখা দিতে পারে। তিনি তোমাকে বলতে চেয়েছিল কিন্তু বলতে গিয়েও বলেনি। এর পেছনে দুটো কারণ থাকতে পারে। প্রথমতঃ লজ্জা বা সংকোচ, কি বলবে বুঝে উঠতে পারছিল না। আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে ওনার স্বামীর সাথে হয়ত এ ব্যাপারে পাঁকা আলাপ হয়নি যা আজ রাতে সারবে। তৃপ্তির বাŸা যদি রাজি থাকে তো কালই বিযের প্রস্তাব দেবে। এখন তুমি আগে ভাগে ঠিক করে রাখো তৃপ্তিকে তুমি বিয়ে করবে কী না।
বাটুলের কথা ঘুটুর মনে ধরল। বাটুলের ওরকম আন্দাজ করেই অনেক কিছু আগেভাগেই বলে দেয় আর ঐ আন্দাজ করে বলা কথাই খেটে যায় প্রায়ই। এবারও হয়ত খেটে যাবে।
বাটুল আবার বলল, আর যদি বিয়ের প্রস্তাব না দিয়ে চলে যেতে বলেই, তাতেও চিন্তার কিছু নেই। লজীং একটা দু’চারদিনের মধ্যেই ঠিক করে দিতে পারব; তুমি নিশ্চিত থাকো।
ঘুটুর মনটা সারাক্ষণ অস্থির হয়ে থাকল তৃপ্তির মায়ের কথা শোনার জন্যে। কোন কথার আভাস পেয়ে বা কোন কথার আংশিক শুনে বাকীটুকু শুনতে না পারাটা যে কতটা কষ্টের তা ঘুটু এর আগে অনুভব করতে পারেনি , এবার হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করতে পারল। পরদিনও তৃপ্তির মা ঘুটুর ঘরে এলো কিন্তু এটা ওটা বলে চলে গেল। তার পরদিন সে আবার ঘুটুর ঘরে এলো। কিছু সময় এটা ওটা বলে তারপরে মূল প্রসঙ্গে ফিরে এলো। বলল, তোমাকে কিছু কথা বলতে চাই, তুমি কিভাবে নেবে জানিনা, তবুও কথাটা তোমাকে বলা দরকার। এর আগেও আমরা অনেক মাষ্টার রেখেছি। তোমাকে খুশি করার জন্য নয়, সত্যিই বলছি তোমার মতো কাউকে পাইনি। তৃপ্তির বাŸা তো তোমার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। সে তোমাকে খুবই ভালো জানে। আমারও তোমাকে খুব পছন্দ। আর তৃপ্তি তোমার কথা খুব ভালো বলে, তোমাকে পছন্দ করে। সে আমাদের একমাত্র মেয়ে, তার সুখের জন্যে আমরা সব করতে পারি। ও সুখী হোক, এটা আমরা মনে প্রাণে চাই। কিন্তু ওকে আমাদের খুব ভয়। ছোট বেলা থেকে ওকে একটু বেশী আদর দিতে দিতে ও খুব একরোখা হয়ে গেছে। মেয়েদের অতো জিদ ভালো না। তাই ওকে নিয়ে খুব চিন্তায় ছিলাম। কার না কার হাতে পড়ে, ভাগ্যে কি হয়। কিন্তু তুমি আসার পরে আস্তে আস্তে আমাদের চিন্তাটা একটু একটু করে কমেছে। ও তোমাকে খুব পছন্দ করে, তোমাকে বেশ মানেও। তাই আমরা সবাই মিলে একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি। অবশ্য তুমি এখন বেকার, তাও আমরা বিবেচনা করেছি। তৃপ্তির নামে ব্যাংকে লাখখানেক টাকা আছে। ভেবেছিলাম ওটা দিয়ে ওর বিযের খরচ চালাবো। এখন আমরা ঠিক করেছি বিয়ের যাবতীয় খরচ আমরা অন্য টাকা দিয়ে মেটাবো। বিয়ের পরে ওই পুরো টাকাটা ওকেই দিয়ে দেবো। টাকাটা কাজে খাটালে হয়ত তোমার মতো একজন শিক্ষিত বুদ্ধিমান যুবকের পক্ষে চলা কষ্টকর হবে না। তাই তোমার যদি আপত্তি না থাকে তো তোমার সাথে আমরা আত্মীয়তা করতে চাই। এখনই তোমার কিছু বলা লাগবে না, তুমি ভেবে আমাকে পরে জানিও। চাহিদার বা অন্য কোন ব্যাপারেও যদি তোমার কিছু বলার থাকে তো আমাকে সরাসরি বলবে। লজ্জা করবে না। কথাগুলো কোন তৃতীয় ব্যক্তি দিয়ে বললে ভালো দেখাতো কিন্তু অকেনদনি তুমি আমাদের সাথে আছ, তোমাকে আমরা আপনের মতোই মনে করি, তাই আমি নিজেই বললাম।
তৃপ্তির মা চলে গেল। ঘুটু ভাবতে বসল। ভেবে কোন কুল কিনারা না পেয়ে শেষে বাটুলের কাছে গেল। বাটুলকে সব বলল। বাটুল বলল, রাজী হয়ে যাও। তৃপ্তি মেয়েটা ভালো। এছাড়া যৌতুকের অংকটাও তো কম নয়। মেয়েদের সবচেয়ে সৌন্দর্য তার গুণ। যে গুণ সব সময়ই থাকে। বাহ্যিক সৌন্দর্য একটা দু’টো ছেলে মেয়ে হলে সব শেষ। ঐ কয় বছরপরে ঐ তৃপ্তি আর অন্য পাঁচটা সুন্দরী মহিলার মধ্যে তেমন ব্যবধান থাকবে না। তাছাড়া ভালোবাসা থাকলে যে কোনো স্ত্রীকে নিয়েও সুখী হওয়া যায়, কিন্তু ভালোবাসা না থাকলে সুন্দরী স্ত্রী নিয়েও সুখী হওয়া যায় না। তুমি তোমার চারপাশে দেখ। সব সুন্দীর স্বামীই কী সুখী আর সব অসুন্দরীর স্বামীই কী অসুখী? নিশ্চয়ই না। তুমি রাজী হয়ে যাও। টাকা আজকের জগতে খুব মূল্যবান। টাকা না থাকলে কোনদিন চাকরি পাবে কীনা তার নিশ্চয়তা নেই। আর ওই টাকাটা পেলে অর্ধেক টাকা দিয়ে ভালো একটা চাকরি আমার মামাকে দিয়ে ধরিয়ে দিতে পারব। আমাদের মতো মধ্যবিত্তের এর চেয়ে বেশী চাওয়া আর কী বা হতে পারে।
ঘুটু বলল, কিন্তু যৌতুক নিয়ে বিয়ে করা কি ঠিক?
তুমি তো আর চাচ্ছনা ওরা সেধে দিচ্ছে। তাছাড়া তোমার এখন রোজগারের কোন পথ নেই বলেই তো ওরা তোমাকে সাহায্য করতে চাচ্ছে। আর বিয়ের পর যদি এমনিই চাকরি পাও, যদি টাকাটা না লাগে বা খরচ করার পরেও যদি ফেরৎ দিতেচাও বা পার তো দিয়ে দেবে।
Ñ ওর যে রাগ, অভিমান আর জিদ খুব বেশী?
Ñ ভালোবাসা করলে তখন এগুলোর প্রয়োগ একটু বেশী হয়। বিয়ে হয়ে গেলে অতটা থাকবে না।
Ñ ওর তো বংশ ভালো,আর আমি নিম্ন বংশের ছেলে ।
Ñ বংশÑ মর্যাদা এখন আর শহরে তেমন দেখে না, গ্রামে দেখে। খানদানী বংশের সব লোকই কী ভালো হয় আর খারাপ বংশের সব লোকই কী খারাপ হয়?
Ñ না, তা অবশ্য হয় না।
Ñ তাহলে আর দ্বিমত করো না, রাজী হয়ে যাও। চাওতো আমি আলাপ করতে পারি। তোমার জন্যে হয়ত আরও কিছু করতে পারবো।
Ñ ঠিক আছে, আমি একটু ভেবে দেখী।
Ñ ঠিক আছে, ভাবো।
Ñ ঘুটু ভেবে চলল। ভেবে ভেবে কোন কুল কিনারা পেল না।  তৃপ্তি তাকে ভালোবাসলেও সে তৃপ্তিকে ঠিক ভালোবাসতে পারেনি, তাকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত ও আগে নেযনি। এখন হঠাৎকরে সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে। সে তৃপ্তির খারাপ দিকগুলোর পর্যালোচনা করল, তার সাথে তার ভালোবাসা ও টাকার-অংকটার তুলনা করল বারবার। হিসেব করে করে একবার সিদ্ধান্ত নিল বিয়ে করবে একবার, একবার সিদ্ধান্ত নিল বিয়ে করবে না বলে। এভাবে সে নিজের সাথে যুদ্ধ করল অনবরত। শেষে সিদ্ধান্ত পাকা, তৃপ্তিকে বিয়ে করার। সে তৃপ্তির মাকে বলল, আমি গ্রাম থেকে একটু ঘুরে এসে আমার সিদ্ধান্ত জানাবো। গ্রামে কার কাছে যাচ্ছে জানতে চাইলে ঘুটু জানালো যে, সে তার মামার বাসায় বেড়াতে যাচ্ছে।
ঘুটু ওদের কাছে মিথ্যে বলেছিলো। আসলে সে তার গ্রামের বাড়িতে তার মাÑ বাবার মতামতÑ আনার জন্যে যেতে চাচ্ছিল। কিন্তু ঘুটু মিথ্যে বললেও তৃপ্তি ও তার মা ঠিকই বুঝতে পেরেছিল। তৃপ্তিতো বলেই বসল, স্যার, আসলে আপনি আপনার মামার বাসায় যাবেন না, যাবেন আপনাদের বাড়ি। কিন্তু আপনি আমাদের কাছে বলছেন না যে আমাদের কেউ হয়ত আপনার সাথে যেতে চাইবে। ঘুটু তৃপ্তির কথাকে জোর করে চাপা দিল।
ঘুটুর বাড়িতে যেতে হয় লঞ্চে। কক্্রবাজার থেকে সকালে ধলঘাটার উদ্দেশ্যে যে লঞ্চ ছেড়ে যায়। তাতেই ঘুটুকে যেতে হবে। তুপ্তি জিজ্ঞেস করল ঘুটুর পৌঁছাতে কতক্ষণ লাগবে। ঘুটু জানালো যে বিকাল হবে। তৃপ্তি কিছুক্ষণ চিন্তা করে বলল, তাহলে’ তো আপনার খুব কষ্ট হবে, সারাদিন লঞ্চে থাকা তারপরে আবার সন্ধ্যা পর্যন্ত।
তৃপ্তি ময়দা এনে রুটি, পরাটা বানালো। ডিম ভাজল। সেগুলি পলিথিনের ব্যাগে করে ঘুটুকে দিয়ে বলল ক্ষুধা লাগলে এগুলি খাবেন। পথে লঞ্চে খাবার পান না পান, তাছাড়া পথে ঘাটের খাবারÑখাওয়া ভালো না, এগুলি খাবেন। ঘুটু বলল, এতসব না করলেও পারতে, লঞ্চে খাবার দাবারের অসুবিধা হয় না।
সকালে ছয়টার দিকে ঘুটু রওনা দিল। তৃপ্তি একটা মিষ্টিপান ঘুটুর মুখে পুরে দিল। মিষ্টি করে একটু হাসল তারপর আরো কয়েকটি বানানো পান কাগজে মুড়ে ঘুটুকে দিল। বলল, একা একা যখন ভালো লাগবে না, তখন পান খাবেন, দেখবেন ভালো লাগবে।
আগেই ঠিক করা ছিল বাটুল আর ঘুটু একসাথে গ্রামের বাড়িতে যাবে। ঘুটু বাসা থেকে বেরিয়ে বাটুলের বাসার দিকে চলল। ব্যাগ তেমন ভারী না, অত সকালে কেউ দেখবে না, হাটতে ভালো লাগছে আর পথও বেশী না তাই ঘুটু হেঁটেই চলল। খানিকটা পথ যাবার পর একটা মোড়। ওখানে মাঝে মধ্যে ছিনতাই-টিনতাই হয়। কয়েকদিন আগেও একটা হয়েছিল। ওখানে গিয়ে ঘুটু একটু তাড়াতাড়ি চলতে লাগল। দু’জন পুলিশ তাকে থামালো। তার ব্যাগ খুলতে বলল। ঘুটু ব্যাগ খুলে দিল। পুলিশরা নেড়ে চেড়ে দেখতে লাগল। তৃপ্তি যে রুটির পুটলিটা দিয়েছিল তা লম্বা করে এমনভাবে বাধা ছিল যে পুিলশ-দুজন কেমন চমকে উঠল। তারা মনে করল ওটা হয়ত কোন অস্ত্রÑটস্ত্র হবে। তারা ওটি খুলতে বলল। ঘুটুর লজ্জা লাগল। সে বলল, ভাই, ওটার ভেতরে রুটি আর ডিম। পুলিশ-দুজন শুনল না। তারা ওটি খুলতে বলল। ঘুটু বিব্রত বোধ করল তবুও খুলে দেখাতেই হলো। তার খুব খারাপ লাগল। সে বলল, ভাই আপনারা লোক চেনেন না, আসল জিনিস ধরতে পারেন না, ধরেন আমার মতো লোকদেরকে।
ঘুটু বাটুলের বাসায় গিয়ে দেখল বাটুল রেডি। দেরী করলে সিট পেতে কষ্ট হবে বলে সে দেরী করার জন্যে ঘুটুকে মন্দ বলল।
বাড়ি পৌঁছে ঘুটু তার মাকে সবকিছু খুলে বলল এবং এ ব্যাপারে তার বাŸার সাথে আলাপ করতে বলল। ঘুটুর বাŸা খুব রাশভারী লোক। খুব রাগীও। কখনও হেসে কথা বলে না। সবাই তাকে ভয় করে। তার সামনে সবকথা বলতে ঘুটুর সাহসে কুলোয় না।
রাতে ঘুটুর বাŸা বাড়ি ফিরে খেয়ে দেয়ে বিছানায় যেতে প্রায় রাত এগারটা বেজে গেল। গ্রামে রাত এগারটা মানে গভীর রাত। ওসময় খুব কম লোকই জেগে থাকে। ঘরের অন্যান্য সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। ঘুটু ঘুমায়নি, ঘুম আসেনি। তার বাŸা বাড়ীতে ফিরে ঘুটুর আসার খবর পেয়ে তার সাথে কথা বলতে চেয়েছিল। তার মা তাকে ডেকেছিল কিন্তু সে ঘুমের ভান করে বিছানায় পড়েছিল।
ঘুটুর বাড়িতে থাকার ঘর একটা। চারদিকে বারান্দা। বারান্দায় ভাই বোন, অতীত-মেহমান প্রভৃতির থাকার জায়গা। ঘরের মধ্যে ঘুটুর বাŸা থাকে। বেশী লোক হলে তখন অবশ্য ঘরের মধ্যেও কারো কারো থাকার জায়গা দেয়া হয়। ঘুটু দক্ষিণ পাশের বারান্দায় একপাশে শুয়েছিল। ঘুটরু মা ঘুটুর বাŸার কাছে ঘুটু ও তৃপ্তির ব্যাপারে সব বলল। ঘুটু সব শুনতে পাচ্ছিল। এক পর্যায়ে ঘুটুর বাŸা খুব রেগে গেল। বলল, তোমার ছেলে আর কত ভালো হবে? আগেই বলেছিলাম, শহরে পাঠিয়ে লাভ নেই, গ্রামে থেকে লেখাপড়া করুক। তুমি শুনলে না। এখন সামলাও। আমার মান সম্মান সব খাবে। সামান্য টাকার জন্যে একটা মেয়েকে বিয়ে করতে হবে? ও এত নিচে নেমে গেছে? ঐ একলাখ নিয়ে বিয়ে করলে তার পেটের মেয়েকে বিয়ে দিতে লাগবে তিনলাখ। ঘরে বউ আনব তা যদি ঘর আলো না করে, তা আনব কেন? আর তারাও বা কেমন লোক? বাড়িঘর দেখাশুনা না, অভিভাবকদের সাথে কথা না, জানা শোনা না, শুধু ছেলে পেয়েই বিয়ে দিতে চাচ্ছে? আর তোমার ওই হতভাগা ছেলে সেখানেই বিয়ে করতে চাচ্ছে? যা করে করে বেড়াক। আমি এ বিয়েতে রাজী না। আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি। তিন আঙ্গুল ছেলে, সে বিয়ের কথা বলল কোন সাহসে। ডাকো দেখি ওকে। আমি একটু শুনে দেখি।
ঘুটুর মা অনেক কষ্টে স্বামীকে থামাল। ঘুটু সব শুনল। সারারাত সে ঘুমোতে পারল না। সকালে উঠে সে কীভাবে বাপের সামনে দাঁড়াবে। সে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল। সে বিছানা ছেড়ে উঠল। একটা কাগজে ছোট করে একটা চিঠি লিখলঃ
মা, রাতে বাŸার সব কথা আমি শুনেছি। ভয় নেই, তোমাদের মুখ আমি ছোট করব না। তোমাদের অবাধ্য কোনদনি হইনি, আজো হবো না। আমি কক্্রবাজারে গিয়েই অন্য লজিং এ চলে যাবো। তৃপ্তিকে আমি বিয়ে করব নাÑ এটা নিশ্চিত থাকো। বাŸাকে সকালে মুখ দেখাতে খুব লজ্জা করবে তাই অন্ধকারেই চলে যাচ্ছি। কোন চিন্তা করবে না কিন্তু। ইতি ঘুটু।
ফজরের আজান পড়ার সাথে সাথেই ঘুটু বাড়ী থেকে বেরিয়ে পড়ল। প্রথমে সে বাটুলের বাড়িতে গেল। বাটুলের বাড়ি তার বাড়ি থেকে মাাইল সাতেক দুরে। সেখানে গিয়ে সে একদিন থাকল। বাটুলের যদিও আরো দু’চার দিন বাড়ি থাকার ইচ্ছে ছিল কিন্তু ঘুটুর জন্যে সে আর বাড়ী থাকল না। পরদিনই দু’বন্ধু মিলে কক্্রবাজারের উদ্দেশ্যে রওনা দিল।
কক্্রবাজারে ফিরে ঘুটু প্রথমে বাটুলের বাসায় উঠল। দু’জনে মিলে অনেক খোঁজাখুঁজি করে একটি লজিং টিক করল। লজিং ঠিক হবার পর বাটুল ঘুটুকে বলল, শোন ওদের ভালো করে বলে কয়ে আসতে পারবে না। তৃপ্তি বাসায় না থাকতে একসময় কষ্ট করে বেরিয়ে আসতে হবে খুব রাগের সাথে। দেরি করে বেশী কথা বলাবলির সুযোগ দিলেই ঝামেলা হবে।
বাটুলের পরামর্শ মতো ঘুটু বাসায় গিয়ে তৃপ্তিকে না দেখতে পেয়ে তখনই তার বিছানাপত্র গোছাতে লাগল। তৃপ্তির মা বলল, কী ব্যাপার, বিছানা, বই-পত্র গোছাচ্ছ কেন?
Ñ চলে যাচ্ছি।
Ñ চলে যাচ্ছ মানে? কোথায় চলে যাচ্ছ? কেন চলে যাচ্ছ?
Ñ অত কথা বলার সময় নেই। দয়া করে কথা বাড়াবেন না। আমি এখনই চলে যাচ্ছি।
Ñ কিন্তু কেন চলে যাচ্ছ তাতো বললে না। তৃপ্তির সাথে কি ঝগড়া হয়েছে?
Ñ না।
Ñ তা হলে?
Ñ বললাম তো, আমার কথা বলার সময় নেই। প্লিজ, আমাকে শান্তিতে যেতে দিন।
তৃপ্তির মা ঘটনার আকস্মিকতায় দিশেহারা হয়ে গেল। সে ঘুটুর সামনে থেকে ভেজা চোখে সরে পড়ল। পাশের বাসার একটি মেয়েকে পাঠিয়ে দিল তৃপ্তির স্কুলে। কিছুক্ষণ পরেই তৃপ্তি ঝড়ের বেগে হাপাতে হাপাতে ঘরে ঢুকল। সে তার মায়ের কাছে সব শুনল। ঘুটুর পাশে এসে দাঁড়াল। বলল, চলে যেতেই হবে? না গেলে কী হবে না?
Ñ না হবে না।
Ñ যাবেন ভালো কথা। আপনাকে জোর করে আটকিয়ে রাখার কোন অধিকার আমার বা এ বাসার কারো নেই। কিন্তু এখনই চলে না গিয়ে ধীরে সুস্থে বিকেলের দিকে গেলে হতো না?
Ñ না, আমাকে এখনই যেতে হবে।
Ñ ঠিক আছে, যান। কেন যাচ্ছেন জানি, কেন দেরি করতে চাচ্ছেন না, তাও জানি। তাই কিছু জানতে চাই না। তবে দুপুরের ভাতটা অন্তত খেয়ে যান।
Ñ না সময় হবে না।
Ñ ঠিক আছে যান।
তৃপ্তি একটা জাপটা দিয়ে তার ঘরে চলে গেল। বিছানায় শুরে কাঁদল। ঘুটুর সবকিছু গোছানো হলে সেগুলি রিকসায় তুলতে লাগল। তৃপ্তি আবার ঘুটুর সামনে এলো। বলল, আমাকে কিছু বলে গেলেন না?
ঘুটু কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে পরে বলল, তুমি আমাকে ভুলে যেও। শুধু শুধু মনে রেখে কষ্ট পেও না। যদি পার আমাকে ক্ষমা করে দিও।
তৃপ্তি আবার তার ঘরে চলে গেল। রিকসা ছেড়ে দিল। ঘুটু পেছনে ফিরে তাকাল। দেখতে চাইল কেউ তারদিকে তাকিয়ে আছে কিনা। দেখল কেউ নেই। সে বুঝতে পারল অনেক ভালোবাসার জনকে সামনে থেকে বিদায় দেয়া যায় না বা তার বিদায় পথের দিকে তাকিয়ে থাকা যায় না তাই তৃপ্তি বা তার মা কেউই তাকে শেষ বিদায় দিতে পারেনি।
কয়েক মাস কেটে গেল, ঘুটু তৃপ্তিদের বাসায় আর গেল না। বাটুল তৃপ্তিদের বাসার কিছুটা দূরে এক বাসায় পড়াতো। সেই বাসায় তৃপ্তির যাতায়াত ছিল। তৃপ্তি বাটুলের কাছে ঘুটুর খোঁজ খবর নিত। সে ঘুটুকে বেড়াতে যাওয়ার জন্যে বলতে বলত প্রায়ই। বাটুল ঘুটুকে তা জানাতো কিন্তু ঘুটু গেল না। সে মিছেমিছি মায়ার বাঁধন রাখতে চাইল না। সে চাইল তৃপ্তি তাকে ঘৃণা করুক, ভুলে যাওয়ার জন্যে যেন তৃিপ্তর কষ্ট না হয়। যার ভালোবাসাকে মর্যাদা দেয়া যাবে না, শুধু তার ইচ্ছেকে মর্যাদা দিয়ে কী হবে!
অনেকদিন এভাবে কেটে গেছে। ঘুটু শান্তি পায় না। একটা অপরাধ বোধ তাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায় সব সময়। সে বুঝতে পারে তৃপ্তি যে কতদূর এগিয়েছিল, তার জন্যে প্রত্যক্ষ না হলেও পরোক্ষভাবে ঘুটুই দায়ী। তৃপ্তি একটি মেয়ে। ছোট হলেও তার মধ্যে নারীত্ব বিদ্যমান। তৃপ্তির আচরণ দেখে তার বোঝা উচিৎ ছিল যে তৃপ্তি তাকে ভালোবাসে। নিজেকে প্রথম থেকেই গুটিয়ে রাখা উচিৎ ছিল। ওকে প্রশ্রয় দেয়া, ওর সাথে গল্প করা ঠিক হয়নি। তার মনে অবশ্য অন্যরকম কিছু ছিল না। তার স্বভাবই ওই রকম। কিন্তু তার স্বভাবের ফলে যে অন্য একজনের জীবন নষ্ট হতে পারেÑ এটা তার বোঝা উচিৎ ছিল। সে ভুল করেছে আর তার খেসারত দিতে হচ্ছে তৃপ্তিকে। তৃপ্তির জীবনটা নষ্ট করার জন্যে সে নিজেকে দায়ী করে। বিবেকের দংশনে ক্ষতবিক্ষত হয় অনবরত। কিন্তু সে তৃপ্তির জন্যে এই অনুতাপটুকু ছাড়া আর কিছুই করতে পারে না।
বছর খানেক কেটে গেল। বাটুল আবার তৃপ্তিদের বাসার কাছে প্রাইভেট পড়াতে যায়। তৃপ্তি খুঁজে খুঁজে বাটুলের সাথে দেখা  করল। তার কাছে ঘুটুর ঠিকানা চাইল। কিন্তু ঘুটুর নিষেধ থাকায় বাটুল ঘুটুর ঠিকানা দিল না। তৃপ্তি কাঁদো কাঁদো স্বরে তাকে বলল, স্যারকে একটু আসতে বলবেন। ভয় নেই, আমি তাকে ভালোবাসার কথা বলব না, আমার মা বিয়ের কথা তুলবে না, আমি শুধু স্যারকে একবার দেখব। এর বেশী কিছু না। আমি আপনাকে কথা দিচ্ছিÑ এর বেশী কিছু না।
বাটুল ঘুটুকে সব বলল। একদিন বাটুল ও ঘুটু তৃপ্তিদের বাসায় গিয়ে উপস্থিত হলো। বিকেল বেলা। কেউ বাসায় নেই। ঘরের মধ্যে কপালের ওপর একটি হাত রেখে চিত হয়ে তৃপ্তি শুয়ে আছে ওপর দিকে তাকিয়ে। বাটুল গলা পরিস্কার করল। তৃপ্তি বিছানা ছড়ে উঠল। যেন ভুত দেখার মতো চমকে উঠল। বলল, স্যার আপনি এসেছেন! সত্যিই আপনি এসেছেন!!
তৃপ্তি অনেক্ষণ ঘুটুর দিকে তাকিয়ে রইল। ঘুটুর লজ্জা লাগল। সে নিচের দিকে চোখ নামিয়ে রাখল। তৃপ্তি বলল, স্যার, আপনি অনেক শুকিয়ে গেছেন। শরীরের যতœ নেন না ঠিকমতো? ঘুটু বলতে চাইলÑ আমি আর কতটুকু শুকিয়ে গেছি। তুমি কী আয়না দেখ না? তোমার কী হাল হয়েছে তাকি তুমি দেখ না? আমারটাই দেখলে?Ñ কিন্তু মুখে কিছুই বলল না।
তৃপ্তি ঘুটু ও বাটুলকে আপ্যায়ন করার জন্যে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ল। এ ঘর ওঘর দু’বার করার পর সে আর চলতে পারল না। তার পা জড়িয়ে আসল। বলল, মাথাটা কেমন যেন ঝিমঝমি করছে। আমি আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছি না। সে খাটের ওপর বসে পড়ল এবং পরক্ষণেই শুয়ে পড়ল। শুয়েই সে চোখ বুজে অসাড় হয়ে পড়ল। কতক্ষণ তার কোন সাড়া পাওয়া গেল না। ঘুটু বিব্রত বোধ করল। বাটুল হাত ধরে বলল, জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে, চোখে মুখে পানি ছিটালে ঠিক হয়ে যাবে। তুমি একটু পানি নিয়ে আস। ঘুটু ভাবলো তৃপ্তির জন্যে সে কোনদিন কিছু করতে পারেনি, পারবেও না কোনদিন। এইটুকুই বা করে কী হবে। তৃপ্তির জীবনে এটুকু স্মৃতি সে রাখবে না। তৃপ্তিকে সে ব্যথা দিয়েছে, ব্যথাই দেবে। এর মধ্যে একটু সুখ দিয়ে কী হবে। সে পানি আনতে গেল না, বাটুলকে পানি আনতে বলল। বাটুল একটু রাগ হলো। সে পানি এনে তৃপ্তির চোখে মুখে পানির ছিটা দিল। তৃপ্তি ধীরে ধীরে চোখ মেলল। চোখ মেলে সে দেখল বাটুল হাতে পানির গেলাস আর তার চোখে মুখে পানি। সে বুঝতে পারল যে, ঘুটু তার চোখে মুখে একটু পানি ছিটিয়ে দেয়নি। তার চোখ দুটো পানিতে টলমল করে উঠল তা ঘুটুর চোখ এড়ালো না। তৃপ্তি উঠে পাশের রুমে গেল। ঘুটু বুঝতে পারল চোখের পানি লুকানোর জন্যে তৃপ্তি সরে গেল।
একটু পরে তৃপ্তি ফিরে এলো। বলল, আপনাদেরকে কষ্ট দিলাম, আমি দুঃখিত। আমি শুয়ে শুয়ে স্যারের কথাই ভাবছিলাম আর ঠিক তখনই স্যারকে সত্যি সত্যি আমার চোখের সামনে দেখতে পেয়ে আমার মাথার মধ্যে কেমন যেন করে উঠল। আপনারা কিছু মনে করবেন না।
ঘুটু উঠতে চাইল। তৃপ্তি উঠতে দিতে চাইল না। সে তাদের জন্যে খাবার দাবার তৈরী করল। ঘুটু মুখে কিছু উঠাতে চাইল না। সে বিদায় নেবার জন্যে ব্যস্ত হয়ে গেল। তৃপ্তি বলল, স্যার, কতদিন আপনাকে দেখিনা, এবার গেলে আবার কবে দেখা হবে বা হবেই না তাতো জানিনা; আরেকটু সময় থাকেন না। একটু মূল্যবান সময় না হয় আমার জন্যে বৃথাই ব্যয় করলেন।
ঘুটু আরো কিছুসময় বসল। তৃপ্তি বলল, স্যার মাঝে মাঝে আসবেন। ভয় নেই। কিছু চাইব না।
ফেরার সময় বাটুল ঘুটুকে মন্দ বলল। বলল, তোমার মতো নিষ্ঠুর মানুষ আমি জীবনে দেখিনি। তুিম আমার বন্ধু বলে আমি সবসময় তোমার ভাল চেয়েছি, তোমার দোসত্র“টি দেখেও দেখিনি। কিন্তু আজ না বলে পারছি না। ওর জীবনটা তোমার জন্যেই নষ্ট হয়েছে, তোমার দোষেই। এতই যদি ওকে অবহেলা কর, এতই যদি নিজেকে দুরে সরিয়ে রাখতে চাও, তা তো আগে বোঝা উচিৎ ছিল। তোমার সাড়া না পেলে কী সে এতদূর আগাতে পারত?
Ñ হ্যাঁ, সে কথা ঠিক। পারতো না। কিন্তু বিশ্বাস কর, প্রথমদিকে আমি ভাবতাম ও ছোট মানুষ, ভালোবাসার কিছু ও অবশ্যই বোঝে না। ও আমার জন্যে যা কিছু করে, এটা ওর শিক্ষরেক প্রতি ভক্তি ছাড়া আর কিছূই না। আর আমার স্বভাবতো তুমি জানো। কাউকে আমি সহজে কষ্ট দিতে পারি না, কাউকে কষ্ট দিলে সেই কষ্টের অর্ধেকটা আমার ওপর পড়ে। তাই ওকে আমি কষ্ট দিতে চাইতাম না। আর- আমি হাসি-ঠাট্টা, গল্প-গুজব, আনন্দ-ফুর্তি ভালোবাসি তাতো তুমি জানো। কিন্তু এত যে এতবড় সর্বনাশ হয়ে যাবে তা আগে বুঝিনি। এখন বুঝতে পারি। কিন্তু কী করব বল। মানুষ নিজের ভুলটা এমন সময় ধরতে পারে, যখন আর তা শোধরাবার সময় থাকে না। আমি যে কী করব বুঝতে পারি না। আমার জন্যে ওর জীবনটা নষ্ট হচ্ছে, কিন্তু ওকে রক্ষা করতে গেলে আমার জীবনটা নষ্ট হবে। আর আমার টা নষ্ট হলে তার সাথে সাথে অনিবার্য ভাবেই ওরটাও নষ্ট হবে। তাই ওর জন্যে কিছু করতে চাইলেও হয়ত করা সম্ভব হবে না। তারচে বরং একটাই নষ্ট হোক। আমি অনেক ভেবেছি কিন্তু এছাড়া কোন স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারিনি। কী, আমার কথাটি দুর্বোধ্য মনে হচ্ছে?
বাটুল বলল, না ঠিক দুর্বোধ্য না, কথাটা কঠিন হলেও আমি বুঝতে পারছি। হয়ত কথাটা সত্যিও। কী যে বলব, কী যেÑ তোমার করা উচিৎ। আমার মাথায় খেলে না।
ঘুটুর লেখাপড়া শেষ হয়েছে। এবার একটা চাকরির চেষ্টা চালাতে হবে। চাকরির চেষ্টা করতে হলে তার জন্যে কক্্রবাজারের চেয়ে উপযুক্ত জায়গা হচ্ছে ঢাকা। ঘুটু কক্্রবাজারে না থেকে ঢাকায় চলে যেতে চাইল। ঢাকা চলে যাবার আগে তৃপ্তির সাথে একবার শেষ দেখা করে যেতে চাইল। তৃপ্তিকে শেষবারের মতো ভালো করে বুঝিয়ে বলে যেতে চাইল যে, সে ঢাকায় চলে যাচ্ছে, জীবনে আর কোনদিন কক্্রবাজার ফিরবে না, তার সাথে আর দেখা হবার সম্ভাবনা নেই এবং বিয়ে হবার কোন প্রশ্নই ওঠে না। কি জন্য বিয়েটা হবে না তাও তাকে বলতে চাইল। আর বলতে চাইল তাকে বুঝিয়ে বলতে যাতে সে তাকে ভুলে যায়, অন্য কাউকে ভালোবাসে বা অন্য কাউকে বিয়ে করে জীবনে সুখী হয়। এসব ভেবে সে তৃপ্তি দের বাসায় গেল।
ঘুটুকে দেখে তৃপ্তি ও তার মার চোখ ছলছল করে উঠল। প্রাথমিক কথাবার্তার পর তৃপ্তির মা তৃপ্তিকে একটু বাইরে যেতে বলল। ঘুটুর বুকের মধ্যে ধুক করে উঠল। ভাবল আজ হয়ত আবার সেই বিয়ের প্রস্তাব দেবে। সে কী বলবে তা মনে মনে গোছাতে লাগল। তৃপ্তির মা বলল, তৃপ্তির বাবার শরীর খুব খারাপ। ডাক্তার বলেছে কোন আশা নেই। তবুও শেষ চেষ্টাটুকু করে যাচ্ছি। ব্লাডক্যান্সার হয়েছিল, তার সাথে জন্ডিস। সেদিন আবার ওর ভাইদের সাথে ঝগড়া করেছিল। ঝগড়া চরমে উঠলে ওরা ওকে মারধর করতে শুরু করল। ও মাটিতে পড়ে গেলে ওরা ওকে বুকের ওপর লাথি মেরেছে, পাড়িয়েছে। এরপরে মুখ দিয়ে রক্ত পড়া শুরু হলো। ক্লিনিকে নিয়ে গেলাম। প্রচুর রক্ত দেয়া লাগল। ডাক্তার বলল, কোন আশা নেই। বর্তমানে অবস্থা একটু ভালো কিন্তু বোঝতো ক্যান্সার জন্ডিস আর রক্তপাতÑ এই তিনটির সাথে পাঞ্জা লড়তে হচ্ছে। এখনও প্রায়ই রক্ত পড়ে। কাশি দিয়েই তাজা রক্ত বেরিয়ে আসে এবং আসতেই থাকে। ডাক্তার আমাকে বলেছেন যে সময় বেশী নেই, ওর বাবাও কীভাবে যেন টের পেয়েছে। সে এখনই তৃপ্তির বিয়ে দিয়ে যেতে চাচ্ছে। এটাই তার শেষ ইচ্ছে। তুমি হয়ত বাটুলের কাছে শুনেছ যে, তৃপ্তিকে বিয়ে দেয়ার জন্যেও এর আগেও আমরা অনেক চেষ্টা করেছি কিন্তু পারিনি। ও ভীষণ একরোখা মানুষ। তাই জোর করেও বিয়ে দিয়ে দিতে সাহস পাচ্ছি না। তাতে হয়ত একটা অঘটন ঘটে যেতে পারে।
সেরকমÑইঙ্গিতও সে দিয়েছে। ওর একই কথা জীবনে যাকে চেয়েছে তাকে ছাড়া অন্য কাউকে বিয়ে করবে না। এদিকে বিয়ের বয়স ও হয়েছে। ঘরে সেয়ানা মেয়ে থাকলে বাবা মার যে কতটা মাথাব্যথা থাকে তা তুমি বুঝবে না। তাই ওকে বিয়ে দেবার জন্যে অকেদিন ধরে চেষ্টা করে আসছি। কোন পাত্রপক্ষ এলেই নানাভাবে ও সব পণ্ড করে দেয়। এখন ওর বাবার শেষ সময়, সে ওর বিয়েটা দিয়ে যেতে চাচ্ছে, কিন্তু তৃপ্তি কিছুতেই রাজি হচ্ছে না। এই মরার সময় লোকটা এতবড় আঘাত বুকে নিয়ে করবেÑ এ কী হয়? এখন কী হবে তুমিই বলো। তুমি একটা কিছু কর।
ঘুটু কিছু সময় মাথা চুলকালো। বলল, আমি কী বলব বলেন?
তৃপ্তির মা যেন একটু বিরক্ত হলো। বলল, যদি কিছুই বলার না তাকে তাহলে আমার মেয়েটার জীবন নিয়ে তুমি এমন ছিনিমিনি খেললে কেন?
ঘুটু বলল, আপনি আমাকে মিথ্যে দোষারোপ করছেন। আমি ছিনিমিনি খেলিনি। ওকে আমি কোনদিন কোনদিন ভালোবাসিনি, মিথ্যে ভালোবাসার অভিনয় করিনি, ভালোবাসায় ভোলাইনি। স্বপ্ন দেখাইনিÑ তবুও তৃপ্তি একাই অতদূর এগিয়েছে। এর জন্যে সম্পূর্ণ দোষ আমাকে দিতে পারেন না। ও হয়ত মনে করত যে, আমিও ওকে ভালোবাসি তাই হয়ত তাও না, শুধু শুধুই। আমাকে ওর ভালো লেগেছিল তাই ও এগিয়েছিল। সে জন্যে তৃপ্তিই দায়ী, আপনি সেজন্যে আমাকে দোষ দিচ্ছেন কেন?
তৃপ্তির মা বলল, আসলে তৃপ্তিও ভুল করেছিল আর আমরাত করেছিলামই। সত্যি কথা বলতে কী, তোমার হাবভাবে আমরাও মনে করতাম তুমি ওকে পছন্দ করো। আর তাইতো আমরাও আশা করেছিলাম তোমাকে নিয়ে। আর সেটাই বড়ো ভুল হলো। আর তৃপ্তিও  একই ভুল করল। এখন পস্তাচেছ। দেখ আমি ওর মা, এসব কথা তোমার সাথে আলাপ করতে আমার লজ্জা করছে, কিন্তু বিপদে পড়লে সবমানুষের এরকমই হয়ত হয়। তখন লজ্জা, মানÑসম্মান বোধÑকিছুই থাকে না। তোমাকে বলতে আমার সত্যিই লজ্জা করছে, বিবেকে বাধছে, আত্মসম্মানে বাধছে, বললে তুমি কী মনে করবে জানি না, তবুও তোমাকে না বলে পারছি না। ওর ব্যাপারটা আরেকবার কী ভেবে দেখা যায় না? এর বিনিময়ে তুমি যা চাও তা দেবার সামর্থ আমাদের থাকলে তাই দেব। আমাদের যা কিছু আছে তার সবটাও যদি চাও তবুও। আরেকবার কী বিবেচনা করা যায় না?
ঘুটু বলল, আসলে আপনি ভুল বুঝেছেন। আমি আপনাদের এখান থেকে চলে যাবার আগে আমাদরে বাড়িতে গিয়েছিলাম। আমার বাŸা বলেছে আমি এখানে বিয়ে করলে সে আমাকে ত্যাজ্য পুত্র করে দেবে। এর পরেই তো আমি চলে গেলাম।
তৃপ্তির মা কিছু সময় ভেবে বলল, আমি একজন মা। আমার কথাটা বলা টিক হবে না। আমার ছেলে আমার অমতে বিয়ে করলে হয়ত আমিও তাকে ক্ষমা করতে পারব না, হয়ত আমিÑআমরাও ওরকম করে ভয় দেখাব। কিন্তু বাবা মা সন্তানকে সহজে ত্যাগ করতে পারে না। একদিন না একদিন তাকে ক্ষমা করে দেয়, তার অপরাধ ভুলে যায়, তাকে বুকে টেনে নেয়। এরচে বেশী আর তোমাকে কিছু বলতে পারছি না। শোন, আমি তৃপ্তির বাবার জন্যে খাবার নিয়ে ক্লিনিকে যাবো। আমি যাবার জন্যে তৈরি হচ্ছিলাম সেই সময়ই তুমি এসেছ। আমি তাহলে যাই। তুমি ভাবো। তৃপ্তির সাথে আলাপ কর। তোমার যা বলার তা ওর কাছে বলে যেও। মন চাইলে ওর বাবাকে একটু দেখতে যেও।
তৃপ্তির মা চলে যাবার পর তৃপ্তি ঘরে ঢুকল। কিছু সময় দু’জনে চুপচাপ বসে থাকল। ঘুটু গলা পরিষ্কার করে তারপর বলল, তৃপ্তি আমি  কয়েক দিনের মধ্যে ঢাকায় চলে যাচ্ছি। ওখানে থেকে চাকরির চেষ্টা করব। এখানে থেকে কিছু হবে না। হয়ত কক্্রবাজারে আর কোনদিন আসা হবে না। তাই শেষবারের মতো তোমার সাথে দেখা করতে এলাম। তোমাকে কিছু কথা বলার ছিল, যদি শোন তবে বলব।
Ñজানি কী বলবেন। বলবেনÑআমি আর কক্্রবাজারে ফিরে আসব না, তুমি আমাকে ভুলে যাও, মনে করো কিছুই হয়নি, পারলে আমাকে ক্ষমা করে দিও। কী, ঠিক বলিনি?
Ñহ্যাঁ, তা অনেকটা। কিন্তু এছাড়াও আরো কিছু বলার আছে। সব না বললে আমি শান্তি পাব না। শোন জগতে কেউ কারো আপন না। জগতে চলতে গেলে অনেকে তোমার কাছে আসবে, অনেককে তোমার ভালো লাগবে, অনেককে খারাপ লাগবে। সব ভালোলাগার জনকে তুমি বাঁধতে পারবে না আবার সব মন্দ লাগার জনকে তুমি দূরে সরিয়ে দিতে পারবে না। এটাই রীতি। কিন্তু তাই বলে জগৎ থেমে থাকে না। মানুষের জীবন থেমে থাকে না। মানুষের জীবন থেমে থাকার জন্যে নয়, সামনে এগিয়ে যাবার জন্যে, চলার জন্যে। অতীতের দিকে, তোমার চারপাশে তাকাও দেখবে কারো জন্যে কারো পথচলা থেমে থাকেনি, থাকবেও না। তোমার চারদিকে তাকাও দেখবে কতজনকে কতজনের ভালো লেগেছে, ভালো বেসেছে, কিন্তু কজনইবা কজনকে পায়? এই না পাওয়াটাই জগতের রীতি। তবুও মানুষ থেমে থাকে না। এজগতে কত শত পুরুষ, সবাই তো আর খারাপ না। এই আমার চেয়ে সবদিক দিয়ে ভালো ছেলের সংখ্যা এই বাংলাদেশে কত লাখ আছে তার ঠিক নেই। কিন্তু তুমি আমার মধ্যে কী দেখলে তা তুমিই জানো। আসলে দেখার গুণেই কারো ভালোদিকগুলো চোখে পড়ে। আমাকে তুমি ভালোবাসার চোখ দিয়ে দেখেছ, আমাকে ভালো লেগেছে। অন্যকে ভাল লাগানোর চেষ্টা কর, অন্যের মধ্যে ভালো কিছু খোঁজ, দেখবে দেখতে পাবে, সে আমার চেয়ে ভালো। সব মনের ব্যাপার। তাই এই আমার স্মৃতিগুলো ধরে রেখে নিজের জীবনটা নষ্ট করার ও বাবা মায়ের মনে কষ্ট দেয়ার কোন মানে হয় না। আমাদের কতটুকুইবা স্মৃতি আছে? কতটা ভালোবাসার কথা আমাদের মধ্যে হয়েছে? কতটা দিন ধরে তুমি আমাকে দেখেছ? ভালো বেসেছো?
এর চেয়ে অনেক বেশীদিন ধরে চিনে, দেখে, ভালোবেসে হাজারো প্রেমের স্মৃতি বুকে নিয়েও অনেকে তার প্রিয় মানুষটিকে পায়নি। আর এটা কোন অস্বাভাবিক ব্যাপার না। তাই আমি বলি কী, তুমি আমাকে ভুলে যাও। মনে কর আমি একজন খুব ভালো শিক্ষক ছিলাম। তোমার মনের মতো করে তোমাকে পড়াতাম। আর তুমি সেই শিক্ষককে পরম গুরুজন মনে করে তাকে খুব শ্রদ্ধা ভক্তি করতে, ভালোবাসতে। এরচে বেশী কিছু না। একজন ভালো শিক্ষকের চেয়ে বেশী কিছু আমাকে তুমি ভেবনা। দেখবে তোমার পক্ষে অনেক কিছুই সহজ হবে। তাছাড়া যা সম্ভব নয়, তার জন্যে নিজের সুখকে বিসর্জন দেযার কোন অর্থ হয় না।
ঘুটু হাসল। সে তৃপ্তির মুখের দিকে তাকাল। চাইল তৃপ্তি কিছু বলুক। তৃপ্তি মুখ তুলল, মুখ খুলল। বলল, আপনাদের শিক্ষকদের এই একটা খারাপ দোষ। আপনারা দুনিয়ার সবাইকে ছাত্রছাত্রী মনে করেন আর সব বিষয়েই আপনারা সাধারণ মানুষের চেয়ে বেশী বোঝেন। আপনারা বোঝেন  না-এমন বিষয়ও অন্যকে খুব পান্ডিত্যের সাথে শিক্ষা দেবার চেষ্টা করেন। আমার খুব হাসি পায়। আমি এখন আপনার ছাত্রী নই, এটা পাঠ্য বিষয় নয় যে এ ব্যাপারে আমি কিছু বুঝি না, আপনি সবই বোঝেন। এটা যার যার নিজ নিজ সমস্যা, জীবন নিয়ে সমস্যা। এটা প্রত্যেকে তার দিক থেকে ভালো বোঝে। আপনি যে কথাগুলো বললেন, এই কথাগুলো যদি অন্য কেউ আপনাকে বলে তো আপনি তা মানতে পারবেন? এই আপনি যা বলছেন, তাও কী আপনি পুরো বিশ্বাস করেন, মানেন? আমি জানি কোন উত্তর আপনি দিতে পারবেন না। আসলে অন্যকে পরামর্শ দেয়া খুব সহজ কাজ কিন্তু সেই পরামর্শটা নিজের জীবনে প্রয়োগ করা খুব কঠিন। নিজের জীবনে যেটা প্রয়োগ করা সম্ভব নয়, এমন পরামর্শ কাউকে দেয়া উচিৎ না।
Ñ কিন্তু আমার কথা হলো তুমি কী আকড়ে পড়ে থাকতে চাচ্ছ? নির্মম হলেও সত্যি যে, আমি তোমাকে ঠিক ভালোবাসতাম না। ভালোবাসা একচাটিয়া হয় না, আর তা ধরে রাখার পেছনেও কোন যুক্তি নেই।
Ñ আমার ভালোবাস একচাটিয়া ছিল না কারণ প্রথমে আমি মনে করতাম আপনিও আমাকে ভালোবাসেন। তাই আমিও আপনাকে ভালো বাসতাম। কিন্তু যখন বুঝতে পারলাম যে আমি ভুল বুঝেছি, আপনার ওঠা ভালোবাসা নয়; ভালোবাসার অভিনয় বা অন্য কিছু তখন অনেক দেরী হয়ে গিয়েছিল। আমি তখন মনে মনে এতদূর এগিয়ে গিয়েছিলাম যে, ইচ্ছে করেও সেখান থেকে ফেরা সম্ভব হয়নি। ততদিনে আমি আমার অনেকটাই দিয়ে দিয়েছিলাম।
Ñ কিন্তু তোমার ওই কথাটা আপত্তিজনক।
Ñ কোন কথাটা?
Ñ ওই যে তুমি বললেÑ ভালোবাসার অভিনয়, ওই কথাটা।
Ñ না, ভালোবাসার অভিনয়, শুধু এটুকু বলিনি, বলেছি ভালোবাসার অভিনয় বা অন্য কিছু। ওই অন্য কিছুর অর্থ অনেক কিছুই হতে পারে যা আমি সঠিকভাবে বলতে পারি না; আপনি পারেন। ওসব কী ছিল বলবেন কী?
ওসব তোমার কাছে অন্য কিছু মনে হলেও আসলে ওসবের কোন অর্থই ছিল না। ওটা আমার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য।
তৃপ্তি বলল, ওই যে আপনি আমার সাথে কখনও খারাপ ব্যবহার করতেন না, মারতেন না, সুমনের সাথে খারাপ ব্যবহার করতেন, মারতেন, আর আমি অভিমান করলে আপনার মুখ ভার থাকত, আপনি অনেক শেধে শুধে আমাকে খাওয়াতেন। আমার মান ভাঙাবার জন্যে কত চেষ্টাই না করতেন। আমি রাগ হয়ে মামার বাসায় গেলে আপনি আমাকে আনতে গিয়েছিলেন। আমার দিকে মুগ্ধ চোখে তাকাতেন, অনেক যতœ করে পড়াতেন। আমাকে কষ্ট করতে দিতে চাইতেন না, আপনাদের বাড়ির নানা রকম গল্প, মাছ ধরার গল্প, ভুতের গল্প, সাপের গল্প, চুরি করে শীতের রাতে রসের পায়েস খাবার গল্পÑ এরকম হাজারো গল্প শুনিয়ে আমাকে আনন্দ দিতেন। আপনার বাবা-মা, ভাই-বোন আপনার গ্রামের সবকিছুকে আমার চোখে মধুর করে তোলার চেষ্টা করতেন। আমার মনকে সেখানে নিয়ে যেতেন, আমাকে খুশী করতে চাইতেনÑ এর পেছনে কী কোন উদ্দেশ্য ছিল না! এসবই কী আপনার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য?
হ্যাঁ, ওসবই আমার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য এবং কিছু কিছু ঠিক চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের মধ্যে পড়ে না কিন্তু সে সবের পেছনেও কোন উদ্দেশ্য কাজ করেনি। আমি একেক করে বলি। প্রথমে আমার বাবা-মা আত্মীয়-স্বজনের কথা বলি। সত্যি বলতে কী, আমার বাবা-মা-ই আমার চোখে পৃথিবীর মধ্যে সেরা মানুষ। আমার ভাই-বোনের সাথে আমার রক্তের সম্পর্ক, আমার প্রতিবেশীর সাথে আমার আত্মার সম্পর্ক। তাই তাদের দোষত্র“টি আমার মনে স্থায়ী দাগ কেটে থাকেনি, তাদের ভালোর দিকটাই আমি দেখেছি। তাদের ছেড়ে এসে অনেক জায়গায় ঘুরেছি, অনেকের সাথে হৃদ্যতা হয়েছে কিন্তু তাদের অভাবে আমার মধ্যে সে শুন্যতার সৃষ্টি হয়েছিল তা অন্যের দ্বারা পুরণ হয়নি। আর তুমি তো গ্রামে যাওনি। আমার গ্রাম্য জীবন, সেই ছোট বেলার গ্রাম্য জীবন। আমার কাছে এত মধুময় যে তুমি হয়ত বিশ্বাস করবে না। আমি সেই ছেলেবেলার গ্রামে চলে যাই, ছেলেবেলায় যা যা করতাম, তাই তাই করি। বাস্তবিকই আমি আমার ছোট বেলার কথা, আমার গ্রামের সবকিছুর কথা কোনদিন ভুলে থাকতে পারিনি। সে সব চুম্বকের মত আমাকে টেনেছে। এই যে গ্রাম ছেড়ে শহরে এলাম, এখানের জীবনে কোন বৈচিত্র খুঁজে পেলাম না। শহরে গদবাধা, ছকবাধা জীবন। আমার ছোট বেলার সেই গ্রাম্য জীবনের সাথে এ জীবনের কোন তুলনা হয় না। এসব কারণে স্বাভাবিক ভবেই আমি তোমাদেরকে আমার বাবা-মা, ভাই-বোন, প্রতিবেশী, ছোট বেলাকার নানা কাহিনী, গ্রাম্য জীবনের নানা কাহিনী শোনাতাম। বিশ্বাস কর, এর পেছনে অন্য কোন উদ্দেশ্য কাজ করেনি। তবে আমার ভুল হয়েছিল। ছাত্র-ছাত্রীর কাছে; বিশেষ করে ছাত্রীর কাছে এসব গল্প বলা টিক হয়নি। কিন্তু তখন বুঝলে করতাম না। আর ওই যে সুমনকে মারার কথা বললে সে প্রসংগে বলি শোন। সুমন পড়াশুনা করতো না, বেয়াদবি করত আর তুমি পড়াশুনা করতে, বেয়াদবি করতে নাÑ এ কারণে স্বাভাবিকভাবেই সুমনের সাথে খারাপ ব্যবহবার করেছি, মেরেছি আর তোমার সাথে খারাপ ব্যবহার করিনি, মারিনি। আর ছাত্রীদের গায়ে; বিশেষ করে একটু বড় ছাত্রীদের গায়ে হাত তোলা আমার অভ্যেসের বাইরে ছিল। আর ওই অভিমান প্রসঙ্গে বলতে চাই যে, আমি কাউকে কষ্ট দিলে নিজেরই কষ্ট হতো। আমি চাইতাম না আমার জন্যে কেউ কষ্ট পাক। তাই তোমার অভিমান ভাঙাতে চেষ্টা করতাম। পরে অবশ্য ধীরে ধীরে মনটা শক্ত হয়ে গেছে। আর ওই তাকানো প্রসংগে বলতে চাই যে, ঘরের মধ্যে তোমরা দু’জনই থাকতে। সেহেতু মানুষ চোখ বুঁজে থাকতে পারে না, নিচের দিকেও সবসময় তাকিয়ে থকাতে পারে না। ছাত্র-ছাত্রীদেরকে সামনে রেখেই পড়াতে হয়, সেহেতু তাদের দিকে তাকাতেই হয়। প্রতিদিন যতক্ষণ পড়াতাম ততক্ষণ দু’জনের দিকে সমান পরিমাণ সময় তাকালেও জীবনে অনেক ঘন্টা তোমার দিকে আমাকে তাকাতে হয়েছে। সে হিসেবে সুমনের দিকেও কম তাকাইনি। কিন্তু তুমি অন্য চোখে দেখতে বলে শুধু তোমার দিকে তাকানোটাই চোখে পড়ত। আসলে ওই তাকানোরও কোন অর্থ ছিল না। তুমি ওই তাকানোর অর্থ খুঁজবে বুঝতে পারলে তাকাতাম না।
তৃপ্তি বলল, আপনার একটি কথা বিশ্বাস করতে পারলাম না।
Ñ কোন কথাটা?
Ñ ওই যে বললেন কারো মনে আঘাত দিলে আপনার নিজেরই কষ্ট হতো। আপনি কী ভেবে দেখেছেন যে, কত কষ্ট আপনি একজনের মনে দিয়েছেন? সে কষ্টের অংশ কী আপনার ওপর পড়েছে? সত্যি করে বলেন তো আমাকে এত করে কাঁদিয়ে আপনার কী কোন কষ্ট হয়েছে?
ঘুটুর সত্যি কথাটি বলতে ইচ্ছে হলো। বলতে ইচ্ছে হলো, তৃপ্তি তুমি জাননা, তোমাকে কাঁদিয়ে আমিও কম কষ্ট পাইনি, কিন্তু করার কিছু নেই। কিন্তু ঘুটু তা বলতে পারল না। সব সময় সত্যি কথা বলা যায় না। ঘুটু কথা ঘুরিয়ে বলল, ঐ কথার সাথে আমি এও বলেছি যে, পরে ধীরে ধীরে মনটা কঠিন হয়ে গেছে। আসলে জগতে দুঃখের এতো ছড়াছড়ি যে, দুঃখটা এখন অস্বাভাবিক কিছু নয়; সুখটাই অস্বাভাবিক। জগতে প্রায় প্রতিটি মানুষেরই কিছু না কিছু দুঃখ আছে। ক’টা মানুষের দুঃখ আামদের এই ক্ষুদ্র জীবনের সীমিত সামর্থ্য দিয়ে দুর করতে পারি? তাই দুঃখ সহ্য করার মতো করে মনটাকে শক্ত করতেই হয়েছে। তোমাকেও করতে হবে।
তৃপ্তি খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে তারপরে কথার মোড় একটু অন্যদিকে ঘুরিয়ে বলল জানেন, আপনি যখন আপনার বাবা-মা, ভাই-বোন, পাড়া-প্রতিবেশী গ্রাম্য জীবন-এসব নিয়ে গল্প করতেন, তখন আমি যেন সেই গ্রামে চলে যেতাম। আমি কল্পনায় সব দেখতে পেতাম। স্বপ্নেও আমি অনেকবার আপনাদের গ্রামে গেছি, আপনার বাবা-মায়ের-সাথে কথা বলেছি, সেবা-যতœ করেছি। আপনার কাছে শুনে, কল্পনার চোখে দেখে, আমি আপনার গ্রামের বাড়ির একটি চিত্রও এঁকেছি। দেখবেন?
ঘুটু দেখতে চাইল। তৃপ্তি তার রুম থেকে একটা বড়ো কাগজ নিয়ে এলো। কাগজটি খুলে তৃপ্তি দেখিয়ে দিল- এই হলো আপনাদের ঘর, এই পশ্চিম পাশের পুকুর, এই পূর্বপাশের দিঘি, এই উত্তর পাশের বাগান, এই দক্ষিণ পাশের অন্যান্য প্রতিবেশীর ঘর। আর এই যে এটা সেই বিল ও খাল যেখানে আপনি মাছ ধরতেন। এই সেই ভিটা যেখানে রসের পায়েস খেতেন, বনভোজন করতেন। কী টিক বলিনি?
ঘুটু অবাক হয়ে গেল। কারো কাছে শুনে, কল্পনা করে এত নিখুঁত চিত্র তুলে ধরা যায়। এও কী সম্ভব! এর চেয়ে নিখুঁতভাবে হয়ত সে নিজেও আঁকতে পারত না। সে বুঝতে পারল কতটা দরদ তৃপ্তির ছিল।
তৃপ্তি বলল, সত্যি করে বলেন তো ঠিক ঠিক হয়েছে কীনা। ঘুটু বলল, হ্যাঁ, ঠিক আছে। সব ঠিক আছে। আমি ভাবতেই পারছি না এটা কী করে পারলে।
তৃপ্তি বলল, তাহলে বুঝতেই পারছেন আপনার সেসব গল্প আমার মনে কতটুকু দাগ কাটত। এতটা দাগ কাটত কী শুধুই আপনার গল্প শ্র“তিমধুর ছিল বলে? তা কিন্তু নয়। আসলে আপনার গল্প শুনে আমি স্বপ্ন দেখতাম। ঘুমিয়ে এবং জেগেও। সে সব শুনতে শুনতে আপনার আপনজনকে মনে মনে আমার আপনজন করে নিয়েছিলাম। কল্পনায় তাদের সাথে মিশেছি, চলেছি থেকেছি। আপনার গ্রামে ঘুরেছি। যা কিছু আপনার তার সবকিছুকে আমার করে ভেবেছি। আর এভাবেই আমি মরেছি। তখন যদি বুঝতে পারতাম, তাহলে এমন করে স্বপ্ন দেখতাম না। আসলে দুরদর্শিতার অভাব এবং ভাগ্য দোষে ভুল পথে পা বাড়িয়েছিলাম। এর আগে ভুল পথে কোনদনি পা বাড়াইনি তো তাই ভেবে-চিন্তে পথ চলিনি। ভুলপথ-সঠিক পথ চিনিনি। এখন ঠকেছি, বুঝতে পেরেছি, এখন আর নতুন করে কোন ভুল হয়ত সহজে করব না। আসলে মানুষ অনেক সময় না বুঝে ঝোকের মধ্যে নেশার মধ্যে অনেক ভুল করে বসে। আমিও তেমন করেছি। আমার আগেই বোঝা উচিৎ ছিল আপনার আর আমার ব্যবধান কতোটা। আমি যে কোনভাবেই আপনার যোগ্য নইÑ একথাটি আমার মাথায় তখন ঢোকেনি, কিন্তু ঢোকা উচিৎ ছিল। আমার বোঝা উচিৎ ছিল আপনি একজন শিক্ষীত, সুদর্শন, হ্যান্ডসাম পুরুষ। আমার মতো হতশ্রী, অল্প শিক্ষীতা কালো-কুৎসিৎ, খাঠো- এক কথায় অচল মেয়েকে যে আপনার মতো যোগ্য পুরুষ নিজের করে নেবে না। আমার মতো কাউকেই আমার পছন্দ করা উচিৎ ছিল। এক জাতে মিল হয়, দুজাতে মিল হয় না।
ঘুটু দেখল তৃপ্তি সত্যি কথাটাই বলছে। কিন্তু সব সত্যি কথা সবসময় বলাও যায় না, শোনাও যায় না। তৃপ্তির কথাগুলি তাকে আঘাত করল। সে বলল, তৃপ্তি, তুমি মিছে মিছি নিজেকে অনেক ছোট করে দেখছ আর আমাকে আঘাত করছ। আসলে তুমি যতটা বলছ, ততটা খারাপ বা অচল তুমি নও আর আমিও অতটা যোগ্য পুরুষ নই। তোমার চেয়ে অনেক অনেক গুণ খারাপ মেয়েকি ভালো বর পাচ্ছে না?
তা পাচ্ছে। তাদের কপালের জোর আছে বলে পাচ্ছে। আমার ছিল না বলেÑ
তোমার চেহারার জন্যেই যে তোমাকে ভালোবাসতে, ঘর বাঁধতে পারিনি, তা কিন্তু পুরোপুরি ঠিক নয়।
আপনি হয়ত মন-গড়া অনেক কারণ দেখাবেন। কিন্তু আমি জানি যে, আমার খারাপ চেহারার জন্যেই আপনি আমাকে অবজ্ঞা করেছেন সবচেয়ে বেশী।
তোমার আরেকটা কথা জানা দরকার। আমি এসময় তোমাকে বিয়ে করারও সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম কিন্তু আমার বাড়ি থেকেÑবিশেষ করে আমার আব্বা রাজী হয়নি। সে আমাকে ত্যাজ্যপুত্র করার ভয় দেখিয়েছিল। তাই আমি আর তাদের ইচ্ছের বিরুদ্ধে যেতে সাহস করিনি।
তার কারণও ওই একই। আমি কুৎসিৎ মেয়ে। আমার জন্যে আপনি কোন ঝামেলায় জড়াতে চাননি, ঝুঁকি নিতে চাননি। কিন্তু যদি আমার রূপ থাকত, আমাকে ভালোবাসতেন, বাবা মায়ের বিরুদ্ধে যাওয়া আপনার জন্যে একটুও অসম্ভব হতো না। এরকম ভুরি ভুরি প্রমাণ তো বাস্তবে পেয়েছি।
সে তোমার যা ইচ্চে ভাবতে পার। আমার কিছু করার নেই। আমার শেষ কথা হলো- সব ভুলে যাও, নতুন করে সুখী হবার স্বপ্ন দেখ। বাপ-মার মনে কষ্ট দিওনা, তাদের কথা মেনে নাও।
আপনি আমাকে সব ভুলে যেতে বলছেন, কিন্তু আপনি নিজে কী পেছনের কোন সুখের স্মৃতিকে, দুঃখের স্মৃতি ভুলতে পেরেছেন? হয়ত পারেননি, কেউ পারেও না। স্মৃতি-সে মধুময়ই হোক- আর বেদনাময়ই হোক, তাকে ভোলা সহজ নয়। তাহলে যে নিজের জীবনের পেছনের পুরোটাই ভুলে যেতে হয়। আর সেটা কেবল স্মৃতি পুরোপুরী লোপ পেলেই সম্ভব; সুস্থ মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়।
Ñ আচ্ছা তৃপ্তি, যা হবে না তার জন্যেই খামখোলীপনা করে কী লাভ?
Ñ লাভ লোকাসনের হিসেব করে জগতে সব কাজ হয় না। ভালোবাসা আসলে অন্ধও বধীর। সে চোখে দেখেনা কানে শোনেনা। তাই কোন যুক্তি তার মাথায় গিয়ে পৌঁছে না।
Ñ  আসলে আমারও মাঝে মাঝে খুব খারাপ লাগে। আমার ভুলের জন্যে তোমার এতটা ক্ষতি হলো। সেজন্যে আমি তোমার কাছে ক্ষমাপ্রার্থী। তুমি আমাকে ক্ষমা করে দিও। আমাকে মনে রেখ না; ভুলে যেও। যদি ভুলতে না পারো তো ঘৃণা করো। আমি ঘৃণা পাবার যোগ্য। আজ উঠি। হয়ত আর কোনদিন দেখা হবে না। চলি।
তৃপ্তি ঘুটুর পথ আগলে দাঁড়াল। বলল, আরো কিছুটা সময় থাকেন না। ভয় নেই, আপনার কাছে কিছু চাইবো না। আপনি হয়ত ভাবছেনÑ মেয়েটি কী বেহায়া। বারে বারে প্রত্যাখাত হবার পরও লজ্জাহীনার মতো দীর্ঘদিন ধরে ভালোবাসা পাবার চেষ্টা করছে। বেহায়ার মতো বারেবারে নিজের ভালোবাসার কথা বলছে। আমিও অনেক ভেবেছি। আপনিতো আগেই আমার পরিচয় পেয়েছিলেন যে, আমি ভীষণ জেদী ও একরোখা। আমার সাথে কেউ খারাপ ব্যবহার করলে আমি তাকে ক্ষমা করিনা। অপমান আমি সহ্য করতে পারি না। আমি যা চাই, জিদ করে তাই করতে পারি। কিন্তু এই একটি ক্ষেত্রে আমি হেরে গেছি। আপনি আমাকে চিরটা কাল অবজ্ঞা করলেন, তা বুঝতে পেরেও বারবার অপমানিত হয়েও জিদ করে আপনাকে ভুলতে পারিনি। আপনাকে আঘাত করতে পারিনি।
আপনি আমাকে যতটুকু অপমান করলেন, কষ্ট দিলেন কাঁদালেন- এর কানাকড়িও যদি অন্য কেউ করতো, তাহলে যে আমি কী করতাম তা নিজেই জানিনা। আপনার কাছে বারেবারে হেরেও আমার হুস হয়নি, লজ্জা হয়নি। আমার জিদ খুব বেশী কিন্তু ভালোবাসাটা তার চেয়েও বেশী তাই আজো বেহায়ার মতো আপনার সাথে এত প্যাচাল পাড়ছি। যাক অনেক কথাই হলো। আপনি চলে যাবেন যান। আপনাকে আটকাতে চাইবো না, আটকাতে চাওয়ার যোগ্যতা বা অধিকার কোনটাই আমার নেই। আমার জন্যে দোয়া করবেন, আমার বাŸার জন্যেও একটু দোয়া করবেন। আমি তার মনে অনেক কষ্ট দিয়েছি এবং দিচিছ। হয়ত সে আমাকে ক্ষমা করবে না। আমার মতো সন্তানকে ক্ষমা করার কথাও না। দোয়া করবেন, আমি যেন আপনার মতো বাবা-মায়ের যোগ্যসন্তান হতে পারি। আর একটি কথা। যদি কোনদিন আপনার সামনে দাঁড়াবার যোগ্যতা অর্জন করতে পারি, সেদিন আপনার সাথে দেখা হবে। এর আগে আপনার সামনে আর দাঁড়াব না। তার আগে হয়ত আর দেখা হবে না। আর একটি কথা, সুখের দিনে প্রয়োজনে আসব না জানি, কিন্তু দুঃখের দিনে, অসময়ে যদি কোন প্রয়োজনে কাজে লাগি তাহলে আমাকে স্মরণ করবেন। আপনি হয়ত মনে মনে হাসছেন। বলছেনÑ তোমাকে আবার কী কাজে লাগবে? আমি এর জবাব দিতে পারব না। শুধু এটুকু জানি যে আপনার জন্যে কিছু করতে পারলে সেটা আমার পরম সৌভাগ্য হবে।
ঘুটু উঠে পড়ল। বলল, তৃপ্তি আবারো বলিÑ আমাকে তুমি ক্ষমা করে দিও, ভুলে যেও। বাবা-মার মতে বিয়ে কর। দেখবে সব ধীরে ধীরে ঠিক হয়ে গেছে। চলি দোয়া করি সুখে থাক।
তৃপ্তির বাবা মরার আগে ঘুটুকে শেষ দেখা দেখতে চাইল। তৃপ্তি বাটুলের মাধ্যমে ঘুটুকে তা জানালো। ঘুটু ভাবল তাকে দেখতে গেলে সে হয়ত ঘুটুর হাত ধরে তৃপ্তিকে বিয়ে করতে অনুরোধ করবে। মৃত্যুপথযাত্রীর কথা ফেলতেও কষ্ট হবে আর রাখাও সম্ভব হবে না। ঘুটু তাকে দেখতে গেল না। তার দু’দিন পরে সে তৃপ্তির বাবার মৃত্যুর খবর পেল।
ঘুটু ঢাকা চলে গেল। সেখানে গিয়ে অনেক চেষ্টায় একটা চাকির পেল। চাকরি পাবার কিছুদিন পরই ঘুটুর বাবা-মা ঘুটুর বিয়ের জন্যে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। সে পরিবারের প্রথম সন্তান। প্রথম সন্তানকে বিয়ে দিয়ে ছেলে বউ, নাতি-নাতনি দেখার সখ তাদের মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। তারা  দেরি করতে চাইল না। তারা পাত্রী ঠিক করে ঘুটুকে খবর দিল। ঘুটু চিঠি লিখে দিল তার পাত্রী দেখা লাগবে না। বাবা-মায়ের পছন্দই তার পছন্দ। তারা-দিন তারিখ ঠিক করে তাকে জানালেই হবে।
ঘুটুর বিয়ে হয়ে গেল। তার স্ত্রীর নাম মিম। মিম দেখতে খুবই সুন্দরী। ঘুটু বাবা-মায়ের পছন্দের প্রশংসা না করে পারল না। সে মনে মনে খুশীই হলো।
ছুটি শেষ হবার দুদিন আগেই ঘুটু স্ত্রীকে রেখে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দিল। পথে বেরিয়ে মনে পড়ল তৃপ্তিকে বিয়ের খবরটা জানানো দরকার। বিয়ের খবরটা জানালে তৃপ্তি আর আশায় বুক বেধে থাকবে না।
ঘুটু তৃপ্তিদের বাসায় গেল। তৃপ্তি তাকে খুটিয়ে খুটিয়ে দেখল। তারপরে একগ্লাস শরবৎ নিয়ে হাসিমুখে তা ঘুটুকে দিল। ঘুটু বলল, এই ঠান্ডার দিনে শরবৎ খাবে! তৃপ্তি বলল, এমন সময় তো শরবতই খাওয়াতে হয়। আপনি আমাদের বাসায় প্রথম এলেন।
Ñ  তার মানে!
Ñ তার মানে আপনি ঠিকই জানেন। আপনাকে দেখেই বুঝতে পেরেছি, নতুন বিয়ে করেছেন।
Ñ কি করে বুঝলে?
Ñ বুঝতে কষ্ট হবার কথা না। আপনার আঙ্গুলে সোনার আংটি, গলায় সোনার চেন, গা থেকে এখন ও জিংক-অক্সাইডের দাগ নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়নি। আর সবার ওপরে আপনাকে অনেকটা ফ্রেস লাগছে। আগে কখনও এতটা ফ্রেস আপনাকে লাগেনি। আসলে আগে একটা দ্বন্দ্ব ছিল হয়ত, এখন আর সেটা নেই, তাই। আর আপনি যে এ বিয়েতে খুশী, তাও বোঝা যায়। ভাবি দেখতে কেমন? নিশ্চয়ই খুব সুন্দরী? একদিন নিয়ে আসবেন আমাদের এখানে।
ঘুটু কোন কথাই বলতে পারল না। অপরাধীর মতো নিচের দিকে তাকিয়ে চুপ করে রইল।
তৃপ্তি বলল, একটা কথা আপনাকে বলি। ভাবিকে কোনদিন আমার কথা বলবেন না। তাতে দু’টো ক্ষতি। ভাবি দুর থেকে এই অচেনা নির্লজ্জ মেয়েটিকে সমালোচনা করবে আর আপনাদের দাম্পত্য জীবনেও অশান্তি নেমে আসবে। তাকে কোনদিন ভুলেও আমার কথা কিছুই বলবেন না। আমি যে একচাটিয়া শুধু ভালোবেসেছি, আপনার কোন দোষ ছিলনা, আপনি পবিত্র একথাটিও না। তাতেও কিন্তু অশান্তি বাধবে। আমাদের বাসায় আনার কথা বলেছিলাম কিন্তু না, আমাদের বাসায়ও কোনদিন নিয়ে আসবেন না। তাহলে কিন্তু টের পেয়ে যাবে।
ঘুটু তৃপ্তির কথাগুলি শুনল, কিছুই বলল না। গাড়ী ধরতে দেরি হয়ে যাবেÑ এই অজুহাত দিয়ে সে বেরিয়ে পড়ল।
সেই যে তৃপ্তিদের বাসা থেকে ঘুটু বেরিয়ে এসেছিল, তারপরে আর সে কক্্রবাজারে আসেনি। তৃপ্তির সাথে আর দেখা হয়নি। প্রথম দিকে সে তৃপ্তিকে ভুলে থাকার চেষ্টা করেছিল এবং কিছুটা পেরেছিলও। কিন্তু যতদিন গেছে, তৃপ্তির স্মৃতিগুলি মনের মধ্যে ততো গভীরভাবে নাড়া দিয়েছে। সে তৃপ্তিকে আর ভুলতে পারেনি। মনে হয়েছে জীবনে সে অনেক কিছু পেলেও তৃপ্তিকে পায়নি বলে কিছুই পাওয়া হয়নি। তৃপ্তির স্মৃতি তাকে সবসময় তাড়াকরে ফিরেছে।
ফজরের আজানের শব্দ ভেসে এলো। ঘুটু সংবিৎ ফিরে পেল। সারররাত সে ঘুমায়নি! সারারাত জেগে জেগে তৃপ্তিকে নিয়ে ভেবেছে। তৃপ্তির কথা আজ এত করে মনে পড়ছে কেন! ঐ নার্সটিকে তার তৃপ্তি বলে মনে হয় কেন? ও যদি তৃপ্তি হতো, তাহলে সে লুকাবে কেন? কিন্তু কে ও? আজ এলে ওকে ধরতে হবে। ওর আসল পরিচয় বের করতে হবে।
ফজরের আজানের বেশ কিছুক্ষন পরে ঘুটু একটু ঘুমিয়ে পড়েছিল। কোমল হাতের মিষ্টি ছোঁয়ায় ঘুটুর ঘুম ভেঙে গেল। সে বুঝতে পারল এ হাত রতœার। রতœার হাতের স্পর্শ সে টের পায়। সে মাঝে মাঝে ভাবেÑ অন্ধদের অনুমান শক্তি কত প্রখর। সে অন্ধ হওয়ার আগে সে এমনটি ভাবতেও পারেনি। সে ছোটবেলায় ত্রিনেত্র কথাটি বিশ্বাস করত না। মনের চোখ দিয়ে মানুষ কীভাবে দেখে তা সে ভেবে পেতনা। কিন্তু নিজে অন্ধ হবার পর বুঝতে পেরেছে। সত্যিই মানুষ তার দু'টো চোখ ছাড়াও মনের চোখ দিয়ে দেখতে পায়, অন্তত অন্ধেরা। অন্ধ হবার পর ধীরে ধীরে তার এমন হয়েছে যে, কারো হাঁটার শব্দ দুয়েকবার শুনলে পরবর্তীতে তার হাঁটার শব্দ শুনেই বলে দিতে পারে লোকটি কে। একবার কারো কন্ঠস্বর শুনলে দীর্ঘদিন পরেও তার কন্ঠস্বর শুনে তাকে চিনতে কষ্ট হয় না। কারো গায়ে হাত বুলিয়ে তার শরীর স্বাস্থ্য কেমন, উচ্চতা কেমন তা বলে দিতে পারে। কারো মুখে হাত বুলিয়ে তার চেহারা বুঝতে পারে কন্ঠ শুনে মনের অবস্থা বুঝতে পারে। আরো অনেক কিছুই সে পারে যা সাধারণ লোকেরা বিশ্বাস করতেও পারবে না। আর এই পারাটার জন্যেই হয়ত অন্ধেরা বেঁচে থাকতে পারে। এই যে হাসপাতালে কতজন আসে যায়, কতজনের কন্ঠ শোনা যায়, কতজনের পায়ের শব্দ শোনা যায়, ঘুটু ঠিকই শনাক্ত করতে পারে। ঐ রতœা এলেই সে টের পায়, সে হাত রাখলে বুঝতে পারে সেটি কার হাত। সে বুঝতে পারে ওই রতœার মনে অনেক কষ্ট, সে কী যেন লুকোতে চায়। রতœা তাকে শুধু রুগী নয়; অন্য চোখেও দেখে। ঘুটুর জন্যে রতœার অন্তরে একটা টান আছে তা সে বুঝতে পারে। তৃপ্তির হাতের স্পর্শের সাথে রতœার হাতের স্পর্শের একটা মিল খুঁজে পায় কিন্তু মেলাতে পরে না। ওর মুখটা ধরে দেখতে পারলে হয়ত ঘুটু বলেও দিতে পারত ঐ রতœাই তৃপ্তি কী না। কিন্তু হাসপাতারে একজন নার্সের মুখটা ধরে দেখাও সম্ভব না। কিন্তু ওর পরিচয়টা পুরোপুরি না জানলেও নয়। আবেগের বসে হঠাৎ সে রতœার একটা হাত চেপে ধরল। রতœা তার হাত ছাড়িয়ে নিল না। বলল, কিছু বলবেন? ঘুটু বলল, সত্যি করে বলেন তো আপনি কে?
Ñ কেন, আমি রতœা । এর মধ্যে সত্যি করে বলার কী আছে?
Ñ আছে, আমার মনে হয় ঐ রতœা ছাড়াও আপনার অন্য আরেকটি পরিচয় আছে।
Ñ আপনার এরকম মনে হবার কারণ কী?
Ñ আমি একজনের সাথে আপনার মিল খুঁজে পাই। আমার মনে হয় আপনিই যেন সে।
Ñ কে সে?
Ñ একজন নারী, নাম তৃপ্তি। আমার ছাত্রী ছিল সে। আমার কেন যেন মনে হয় আপনিই সে।
Ñ আচ্ছা, আমি যে তৃপ্তি- এমন মনে হবার কারণ কী?
Ñ আপনার হাতে আমি মমতার স্পর্শ অনুভব করতে পারি। তৃপ্তি ছাড়া অন্য কারো হাত কোনদিন এতটা মমতা জড়ানো পাইনি বলে। তাছাড়া আপনি কী যেন লুূকোতে চান বলে, আপনার মনে চাপা দুঃখ আছে বুঝতে পেরে সেদিন আপনার চোখের পানি আমার গায়ে গড়িয়ে পড়েছিল বলে।
Ñ এতে আপনার মনে হয়েছে যে, আমি তৃপ্তি?
Ñ হ্যাঁ।
Ñ আপনি আজও তৃপ্তিকে মনে রেখেছেন! আমার খুব আনন্দ হচ্ছে। কিন্তু তাকে তো আপনার মনে থাকার কথা না। তাকে তো আপনি ঘৃণা করতেন, অবজ্ঞা করতেন। এখনও তাকে মনে রেখেছেন কেন?
Ñ সে আমাকে অনেক দিয়েছিল, কিন্তু আমি তাকে কিছুই দেইনি বলে কিন্তু আপনি কী করে জানলেন যে আমি ওকে অবহেলা করতাম, ঘৃণা করতাম?
Ñ জানি।
Ñ কী করে জানেন! আপনার  বাসা কী ওদের বাসার পাশে? নাকি আপনি নিজেই তৃপ্তি । সত্যি করে বলেন- না। আমি অন্ধ বলে এই পরিহাস করবেন না প্লিজ।
ঘুটু শক্ত করে রতœার হাত চেপে ধরল। রতœা হাত ছড়াতে চাইল কিন্তু পারল না। কয়েক ফোঁটা চোখের পানি ঘুটুর গায়ে পড়ল। তারপরে আরও কয়েক ফোঁটা। রতœা বলল, ভেবেছিলাম বলবনা কিন্তু আপনার একথার পরে আর না বলে পারলাম না। পরিহাস আমি করতে চাইনি। আপনি চোখে দেখতে পান না বলে আপনার যতোটা কষ্ট, ততটা কষ্ট আমি না পেলেও এটুকু বলতে পারি, আপনার পরে আমি ছাড়া অন্য কেউ এতটা কষ্ট পায়নি। কিন্তু আমি আমার পরিচয় জানালে চিরদিন আমাকে যেমন অবহেলা করেছেন, এখনও সে রকম করতেন। আপনার খারাপ লাগত। হয়ত আমার সেবা-যতœ গ্রহণ করতেন না, হয়ত হাসাতাল থেকে পালিয়ে যেতেন। আমি আপনাকে এই সেবা-যতœ করার সুযোগ থেকে নিজেকে বঞ্চিত রাখতে চাইনি। তাই আসল পরিচয়টা দেইনি। আমি আগে জানতাম না যে, আপনার এ অবস্থা হয়েছে। যখন বুঝতে পারলাম, তখন হঠাৎ মাথায় এলোÑ পরিচয়টা আপনাকে জানাবো না। আমার নিজের স্বার্থে। অবশ্য আপনি সুস্থ হলে, হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাবার সময় এলে তখন আমার পরিচয় দেব ভেবে রেখেছিলাম। কিন্তু ততদিন অপেক্ষা করতে দিলেন না। হ্যাঁ, আপনি ঠিকই ধরেছেন। আমি তৃপ্তি।
Ñ সত্যি বলছ, তুমি তৃপ্তি!
Ñ হ্যাঁ, সত্যি বলছি।
তৃপ্তির পরিচয় পেয়ে ঘুটু খুব খুশি হলো। কেন সে এত খুশি হলো তা সে বুঝতে পারল না। তার চিৎকার করতে ইচ্ছে করল। কিছু সময় সে খুশিতে কোন কথাই বলতে পারল না। কিছু সময় পরে সে বলল, তৃপ্তি, তুমি কত উদার। আমি তোমাকে কত দুঃখ দিলাম আর তুমি আমার জন্যে এত কিছু করলে।
Ñ এটাতো আমার কর্তব্য ছিল।
Ñ তৃপ্তি, এবার বল, তুমি কেমন আছ?
Ñ আছি ভালোই।
Ñ ভলো ভালো। ভালো থাকলেই ভালো। তা তোমার মা কেমন আছে? সুমন কী করে?
Ñ মা ভালোই আছে। সুমন বখাটে ছেলেদের সাথে মিশে মিশে বখে গেছে। জায়গা জমি যা ছিল সব শেষ করে ফেলেছে। এখন টুকিটাকি করে চালায়। মা আমার কাছে থাকে।
তোমার কাছে থাকে! তোমার স্বামী কি কিছু মনে করে না? আচ্ছা তোমার স্বামী কেমন? সে কী করে? তোমার ছেলেমেয়ে কয়টি? কোন ক্লাসে পড়ে তারা?
তৃপ্তি একটা শব্দ করল। ঘুটু মনে করল তৃপ্তি হাসলো, পরক্ষনেই মনে হলো-কাঁদল। পরে বুঝল অনেক সময় অতিদুঃখে মানুষ ব্যথা জড়ানো কান্না জড়ানো হাসি হাসে, তৃপ্তি সে হাসিই হেসেছে।
তৃপ্তি কিছুই বলল না। ঘুটু বলল, কই কিছু বলছো না যে?
Ñকী বলব? আসলে আপনি আজও আমাকে পুরোপুির চিনতে পারেন নি। আপনি হয়ত ভেবেছেন যে, আমি সব ভুলে বিয়ে করে স্বামী-সন্তান নিয়ে সুখে আছি। কিন্তু আপনার ধারণা ভুল। আমি এখনও বিয়ে করিনি।
Ñ কী বললে তৃপ্তি! তুমি আজও বিয়ে করোনি!
Ñ না। করিনি।
Ñএ তুমি কী করেছ তৃপ্তি! নিজের জীবনটা এমন করে নষ্ট করার কোন মানে হয়?
তৃপ্তি বলল, আচ্ছা বিয়ে না করলেই বুঝি মানুষের জীবনটা নষ্ট হয়ে যায় আর বিয়ে করলেই সেই নষ্টের হাত থেকে বাঁচা যায়? জগতে বিয়েই কী সব?
না, জগতে বিয়েই সব নয়। তবুও আমরা মানুষ, বিয়ে করে সংসার ধর্ম পালন করাÑ এটা মানবধর্ম। এরমধ্যে মানুষের জীবনের পূর্ণতা আসে। অবশ্য সবার আসে না একথাটাও সত্যি। আমিও তো বিয়ে করলাম কিন্তুÑ না, থাক।
তৃপ্তির কথার মোড় অন্যদিকে ঘোরাতে চাইল। বলল, হাসপাতাল থেকে তো আরো দুদিন আগেই ছেড়ে দিতে চেয়েছিল কিন্তু আমি বলে কয়ে একটু সময় চেয়ে নিয়েছি। আগামীকালের পরে হয়ত এখানে আর রাখতে চাইবে না। আচ্ছা, সেদিনও জিজ্ঞেস করেছিলাম আপনি বলেননি। এ অবস্থা নিয়ে আপনি কি জন্যে একা একা কক্্রবাজারে এসেছিলেন?
Ñ এমনিই।
Ñ এমনিই কেউ আসে? সেই ঢাকা থেকে এই কক্্রবাজার পর্যন্ত এই অবস্থা নিয়ে কেউ এমনিই আসে? বলেন না কি জন্যে এসেছিলেন, কোথায় যাবেন। আমি আপনাকে সহযোগিতা করব। আমি ঝুঝতে পারছি যে, আপনি আমাকে এড়িয়ে চলতে চাইছেন বলে কিছু বলছেন না।
না তৃপ্তি না। তোমার কথা ঠিক না। আমি আসলে কোথায় যাব, কিজন্যে বেছে বেছে এই কক্্রবাজারে আসলাম জানি না। হয়ত তোমার সাথে দেখা হবে বলেই এসেছি।
Ñ কি বলছেন আমি তো কিছুই বুঝছি না। ভাবির সাথে ঝগড়া বাধিয়েছেন বুঝি?
Ñ ঝগড়াতো অনেক ছোট ব্যাপার, আরো বড়কিছু হয়েছে।
Ñ মানে?
Ñ ছাড়াছাড়ী হয়ে গেছে।
Ñ কী বললেন। ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে!! সত্যি বলছেন তো?
Ñ এতবড় কথাটা কী জীবনে কেউ মিথ্যে বলে?
Ñ না, তা অবশ্য বলে না। কিন্তু কী করে কী হলো? এমন হলো কেন?
Ñ সে অনেক কথা। সে বড় লজ্জার কথা; তুমি শুনতে চেওনা। আমি সে কথা বলতে পারব না। সেসব কথা বলার মতো না।
Ñ তবুও আমি শুনব। আপনাকে বলতেই হবে। এই আপনার হাত ধরে অনুরোধ করছি, আমাকে সব বলেন।
Ñ সে অনেক কথা। এই হাসপাতালে এত লোকের মধ্যে সেসব কথা বলা যাবে না। আমাকে একটা নিরিবিলি জায়গায় নিয়ে চল।
ঠিক আছে, আমার ডিউটি শেষ হোক, তখন সব শুনব। এখন আমি একটু কাজ করি।
তৃপ্তি কোন কাজে মন বসাতে পারল না। সে ছুটি নিয়ে হাসপাতাল থেকে ঘুটুকে ছাড়িয়ে তার বাসায় নিয়ে গেল। বাসায় নিয়ে ঘুটুকে তার মার কাছে রেখে তৃপ্তি কাপড় পাল্টাতে গেল। ঘুটু তৃপ্তির মার সাথে কথা বলে জানতে পারল যে তৃপ্তি তার সব কথাই মাকে বলেছে।
তৃপ্তি ফিরে এসে বলল, এখন কোন ব্যস্ততা নেই, চারপাশে লোকজন নেই, আপনি ধীরে সুস্থে বলেন।
Ñ কী বলব বলো? এসব তো বলার কথা না। কিন্তু তোমাকে বলতে হবে। এই কক্্রবাজারে এলাম, এর পেছনে কী উদ্দেশ্য ছিল আমি জানি না। হয়ত তোমাকে সব বলার জন্যেই নিয়তি আমাকে এখানে এনে ঠিক তোমার সাথে সাক্ষাৎ করিয়ে দিয়েছে। তাহলে শোন ঃ
Ñ সেই যে বিয়ের পর তোমাদের বাসায় এসেছিলাম, তখন কিন্তু মিমকে তুলে নেইনি। ও তখন ওর বাপের বাড়িতে ছিল। সত্যি কথা বলতে কি বিয়ের পরে আমি ওর প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম। হয়ত ও অসাধারণ সুন্দরী ছিল বলেই, নয়ত অন্য কিছু যা আমি জানি না। যাহোক, বিয়ের পরে ওকে তুলে নিয়ে ঢাকায় আমার কাছে নিয়ে গেলাম। ঢাকায় মাঝারি ধরনের একটি বাসা ভাড়াকরে সেখানে সুখের সংসার সাজালাম। মিম সত্যিই আমাকে সুখী করতে পেরেছিল। ও আমাকে এত ভালোবাসত যে আমি নিজেকে পৃথিবীর সবচে ভাগ্যমান স্বামী মনে করতাম। আমার মাঝে মাঝে তোমার কথা মনে পড়ত। কিন্তু ও আমাকে সুখী করার জন্যে এতই ব্যস্ত থাকত যে আমি কোন বিষয় নিয়ে বেশী ভাবতে বা মন খারাপ করতে সুযোগ পেতাম না। ও আমার মনে কখনও কালোমেঘ জমতে দিত না। আমিও ওকে ঠকাইনি। ওকে আমিও ভালোবাসা দিয়েছি। ও প্রায়ই বলত যে আমাকে পেয়ে ও সুখী, ভাগ্যবতী। তার চেয়ে স্বামী-সোহাগী ভাগ্য নিয়ে নাকি খুব কম নারীই জগতে এসেছে। জানো ও আমাকে এতটা দিত যে, আমি যা পেতাম তার চেয়ে বেশি চাইতাম কিনা ভাবতেও পারিনি। ওকে নিয়ে আমি বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গা, পাহাড় পবর্তে, সাগর-সৈকতে, সাগরে, উপজাতি অধ্যুষিত এলাকায় বিভিন্ন দর্শনীয় জায়গায় ঘুরেছি। জীবনটাকে উপভোগ করেছি।
এমনি করে পাঁচটি বছর যে কীভাবে কেটে গেল বুঝতেই পারিনি। আসলে সুখের দিনগুলি বড় তাড়াতাড়ি চলে যায়। আহ্! সেসব দিনগুলিকে যদি ধরে রাখা যেত! কিন্তুনা, সুখ মানুষের কপালে চিরদিন সয়না। আমি যুগ-যুগের সুখ হয়ত ঐ পাঁচটি বছরেই ভোগকরে নিয়েছিলাম। তাই একদিন আমার সুখের দিনের অবসান হলো। নেমে এলো ঘোর অমানিশা। অন্ধকারে ছেয়ে গেল আমার পৃথিবী। বখাটেদের ছোড়া এসিড়ে আমার দুটো চোখই নষ্ট হয়ে গেল। অনেক চিকিৎসা চালানো হলো কিন্তু চোখ আর ভালো হলো না। তারপর থেকে অন্ধই আছি।
সৃষ্টিকর্তা যখন আমার চোখ কেড়ে নিল, তখন শুধু ওটা নিয়েই ক্ষান্ত হয়নি; সাথে সাথে আমার অনেক কিছুই নিয়ে গেল। আমার চাকির চলে গেল। সংসারে আয়ের পথ বন্ধ। বাবা-মা দুজনেই তখন পরপারে। ভাইদের স্মরণাপন্ন হলাম, কিন্তু তাদের কাছ থেকে তেমন কিছুই পেলাম না। বড়ো আশা করেছিলাম তাদের ওপর। সুখের সময় অনেককে পাওয়া গেলেও দুঃখের সময় কাউকে পাওয়া যায় না। মার পেটের ভাই আমার কাছে পর হয়ে গেল। সংসারের মাল জিনিস বিক্রি করে সংসার চালাতে লাগলাম। কিন্তু বসে বসে মালজিনিস বিক্রি করে আর কয়দিনই বা চালানো যায়। একসময় মিমের সোনার গহনায় হাত পড়ল। গহনা বিক্রি করতে ওর মনটা ছিড়ে গেল তা বুঝতে পরতাম। মেয়েদের কাছে গহনার চেয়ে প্রিয় জিনিস সংসারে খুব কমই আছে। যা হোক, গহনা বেচে সংসার চলতে লাগল। মিম লেখাপড়া জানত। সে চাকরির চেষ্টা চালিয়ে গেল। এ বাজারে চাকরি পাওয়া কত কষ্টের কাজ তা ভুক্তভোগীই জানে। অনেক চেষ্টার পর একটা প্রাইভেট ফার্মে টাইপিস্টের কাজ পেল। আমি অন্ধ হয়ে যাবার পরে ও টাইপটা শিখে নিয়েছিল প্রয়োজনের তাগিদেই।
এবার খাওয়া পরার চিন্তা ঘুচল কিন্তু অশান্তি ঘুচল না। আমার চোখে তখন পৃথিবী অন্ধকার। চোখ না থাকার মতো দুঃখের কারণ হয়ত দুনিয়ায় দ্বিতীয়টি নেই। আমার মনে তখন সেই দুঃখ। আর মিমের মনের দুঃখও কম না, তাও বুঝতে পারতাম। স্বামী অন্ধ হওয়া কী একজন নারীর জন্যে কম দুঃখের কারণ! তারপরে মেয়ে মানুষ হয়ে সংসারের হাল তাকেই ধরতে হয়েছে। সারাদিন অফিসে চাকরি তারপর বাসায় ফিরে অন্ধস্বামীর দেখা শোনা রান্না-বান্না আরো কত কি। ওর বেতন খুব বেশী ছিল না। তা দিয়ে ঢাকার মতো জায়গায় বাসা ভাড়া, বাজার খরচ, মেটাতেই হিমশিম খেতে হতো। তাই কাজের লোক রাখা সম্ভব হতো না। মিমই সব সামলাতো। অবশ্য আমিও ওকে সহযোগিতা করতাম। প্রথম প্রথম পারতাম না কিন্তু পরে ধীরে ধীরে আমি অনেক কাজ আয়ত্ব করে ফেলেছিলাম। এই ধরো-কাপড় কাঁচা, ঘরদোর ঝাড়– দেয়া, জামা-কাপড়, বিছানা-পত্র গোছানো, তরকারি কোটা- এরকম-টুকিটাকি অনেক কাজে আমি ওকে সহযোগিতা করতাম।
আমাদের ভালোবাসার দিনগুলি আস্তে আস্তে ফুরিয়ে যেতে লাগল। মিমের মুখের হাসি ভালোবাসার কথা- সব হারিয়ে যেতে লাগল। নিজেকে মিমের কাছে খুব ছোট এবং অপরাধী মনে হতো। তাই ওর কষ্ট লাঘব করার জন্যে, ওকে সুখী করার জন্যে আমি প্রানপণ চেষ্টা করতাম। কিন্তু সবই বৃথা যেত। আমি ওর মুখে হাসি ফোটাতে পারতাম না, ওকে স্বাভাবিক করতে পারতাম না, ওকে দিয়ে তেমন কথা বলাতে পারতাম না। তবুও আমি চেষ্টা করতাম ঠিক একজন অতি অযোগ্য স্ত্রী তার অতি যোগ্য স্বামীর মন রক্ষার জন্যে, তাকে খুশী করার জন্যে যে রকম করে, সে রকম।
এত করেও কোন ফল হলো না। ক্রমে ক্রমে এমন হলো যে, সারাদিন রাত মিলিয়ে হয়ত দু চারটি নিতান্ত প্রয়োজনীয় কথা আমাদের মধ্যে হতো, এর বেশী নয়। আমি অবশ্য কথা বলতে চাইতাম, ওর মনের ভার লাঘব করতে চাইতাম কিন্তু ও কোন কথা বলত না। প্রয়োজন মতো একটা হ্যাঁ, না বা এক কথায় জবাব দিয়ে চুপ করে থাকত। মাঝে মাঝে দীর্ঘশ্বাস ফেলত। আমি বেশী কথা বলতে গেলে আমাকে থামিয়ে দিত। বলত যে তার মাথা ধরেছে, কথা বলতে বা শুনতে তার ভালো লাগছে না। আমি ওর মথা টিপেদিতাম। এভাবে চলে গেল বহুদিন। মাঝে-মাঝে আমার মরে যেতে ইচ্ছে করত। মাঝে মাঝে পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করত। ওর করুনায় বেঁচে থাকতে আমার ভালো লাগত না।
এক সময় মিম দেরি করে বাসায় ফিরতে শুরু করল। কোনদিন সন্ধ্যায়, কোনদিন রাতে, কোনদিন অনেকরাতে বাসায় ফিরতে লাগল। আমি ওর করুনায় বেঁচে ছিলাম তাই কৈফিয়ত নেয়ার সাহস হতো না। কিন্তু ভেতরে ভেতরে যে কতটা জ্বলে মরতাম তা বোঝাতে পারব না। আমি বুঝতে পারতাম ও কেন দেরি করে ফেরে। ওর গায়ে আমি অন্য পুরুষের গন্ধ পেতাম। একজন ওকে মটর সাইকেলে করে প্রায়ই পৌঁছে দিয়ে যেত তা ও টের পেতাম। কিন্তু আমার কিছুই করার ছিল না। আমি বুঝতাম মিম আমার কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে ও ভুল পথে পা বাড়িয়েছে। অন্ধকার পথে পা বাড়িয়েছে; কিন্তু  প্রতিরোধ করার কোন ক্ষমতা আমার ছিল না। শুধু বেশী করে ওকে খুশি রাখার, সুখী করার চেষ্টা করতে থাকলাম।
একদিন ও অনেক রাত করে বাসায় ফিরল। কিছু না খেয়েই শুয়ে পড়ল। ও প্রায়ই রাতে বাইরে থেকে খেয়ে আসত, বাসায় খেতনাÑ তাই এটা নতুন কিছু নয়। আমিও সাধাসাধি করলাম না। ও বারে বারে এপাশ ওপাশ করল আর একটার পর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। প্রায়ই ও ওরকম করত কিন্তু ঐদিন অনেক সময় ধরে করে করল। আমি ওর মনের কষ্ট লাঘবের জন্যে বললাম, মিম ঘুমিয়ে পড়ো। দুঃখ করে আর কী হবে বলো। জানি আমাকে নিয়ে তোমার অনেক কষ্ট আমি তোমার জীবনটা নষ্টকরে দিলাম। কিন্তু আমার কী দোষ বলো। এটা আমাদের দু’জনেরই নিয়তি। নিয়তিকে তো মেনে নিতেই হবে। তোমার কষ্টটা আমি বুঝি কিন্তু আমার কষ্টও কী কিছুটা কম?
মিম জোরে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। বলল, এভাবে জীবন চলে না। এভাবে আমি আমার জীবনটা নষ্ট করে দিতে পারি না। এ দুর্বিসহ বোঝা আমি আর বইতে পারছি না। আমাকে তুমি মুক্তি দাও। প্লিজ, আমাকে তুমি মুক্তি দাও।
মিমের অনেক কিছুই সহ্য করলেও একথাটা সহ্য করতে পারলাম না। বুকের ভেতর একটা প্রচণ্ড মোচড় দিয়ে উঠল। মনে হলো আমার হৃৎপিণ্ড বন্ধ হয়ে যাবে। এতদিন মিম অন্যের সাথে যাচ্ছে-তাই করলেও এই  অচল আমি অন্তত বেঁচেছিলাম তার দয়ায়। কিন্তু আশ্রয়টুকু ও বুঝি আর থাকবে না। বুকের ভেতর হাহাকার করে উঠল। বললাম, মিম, এমন কথা বল না। আমি তোমার স্বামী। আমাকে তুমি সাগরে ভাসিয়ে দেবে? আমি কী করে বাঁচব? কে আছে তুমি ছাড়া আমার? আর কিছু না দাও, অন্তত একটু খেতে পরতে দিও। আমার প্রতি এতটুকু সদয় হও। তুমি কী চাও আমি রাস্তায় রাস্তায় ভিক্ষে করে খাই? মিম আর কোন কথা বলল না, অনেক সময় ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদল।
আমার মরে যেতে ইচ্ছো হলো। পুরুষ মানুষ হয়ে স্ত্রীর পরকিয়া প্রেম মেনে নেয়া, স্ত্রীর করুনা ভিক্ষা করার জন্যে আমার ভাগ্যকে, আমাকে শত শত ধিক্কায় দিলাম। কয়েকবার আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নিলাম। কিন্তু আত্মহত্যা মহাপাপ তাই মন থেকে মুছে ফেললাম। মনে প্রানে আল্লাহর কাছে মৃত্যু কামনা করলাম। অখাদ্য-কুখাদ্য খেলাম যাতে কঠিন ব্যাধি হয়, শরীরের উপর চরম অত্যাচার করলাম যাতে কঠিন কোন অসুখ হয়, রাস্তায় বেরিয়ে অত্যাচার ইচ্ছে মতো চললাম যেন এ্যাকসিডেন্টে মারা যাই। অবশ্য এভাবে মরলেও সেটি আত্মহত্যারই শামিল হতো কিন্তু তখন ভাবতাম এভাবে মরলে হয়ত আত্মহত্যার পাপ থেকে রেহাই পাবো। কিন্তু এতকরেও মরতে পারলাম না। এখন মনে হয় যারা মনে প্রাণে মরতে চায়, তারা সহযে মরে না কিন্তু যারা মরতে চায় না, বেঁচে থাকতে চায় শতাধিক বছর তারা হুট করে মরে যায়। এটিও সৃষ্টিকর্তার একধরনের খেলা হয়ত।
মিম তার প্রেমিককে বাসায় নিয়ে আসতে লাগল। তারা সাথে বাসায় বসেও হাসিতামাসা চলত। মাঝে মাঝে আমি টের পেতাম যে ওরা চোখে চোখে কথা বলছে, একে অন্যের গায়ে হাত রাখছে। আমার মনের চোখ দিয়ে আমি আরো অনেক কিছুই দেখতে পেতাম যা অতি নিকৃষ্ট, জঘন্য। সেসব আমি তোমার কাছে বলতে পারব না। আমার ইচ্ছে করত ঐ লোকটাকে গলাটিপে মেরে ফেলি। ইচ্ছামতো দাদিয়ে ওদের দুজনকে এককোপে দুভাগ করে ফেলি।
লোকটি আমাকে টিটকারি মারত, বার বার অন্ধ বলে আমার মনে আঘাত দেয়ার চেষ্টা করত। এ নিয়ে একদিন লোকটির সাথে আমার ঝগড়া বাধল। ঝগড়া চরমে পৌঁছুলে আমি এক পর্যায়ে ওকে বেরিয়ে যেতে বললাম। মিম তার মুখ খুলল। বলল ও বেরিয়ে যাবে কেন? বাসাটা কী তোমার না আমার? বের যদি হতে হয় তো তুমি বেরিয়ে যাও। আর এও জেনে রাখÑ দু’চারদিনের মধ্যে স্বপ্নকে আমি বিয়ে করছি।
মিমের প্রতি ঘৃণায় মনটা ভরে উঠল। ওর সাথে ঝগড়া করতেও ঘৃণা হলো। এরপরে আর ঐ বাসায় থাকতে পারলাম না। মিম যে মুক্তি চেয়েছিল। আমি ওকে সেই মুক্তি তখনই দিয়ে দিলাম। ও আঘাত পেল না, খুশি হলো। আমি বেরিয়ে পড়লাম রাস্তায়। তখন আমার মধ্যে চরম উত্তেজনা। মাথাটা ঠিক ছিল না। গাড়ির নিচে পড়ে মরতে খুব ইচ্ছে হলো। খুব জোরে জোরে হাঁটতে লাগলাম কিন্তু কেউ দয়া করে আমাকে গাড়ি চাপা দিল না। গাড়ীকে আমি ধাক্কা দিতে চাইলেও গাড়ি আমাকে এড়িয়ে গেল। ঐ উত্তেজনার মাথায় হঠাৎ কি যেন মনে এলোÑ অমনি একটি রিক্সা ঠিক করলাম। সায়েদাবাদ পৌঁছে রিক্সা অলাকে বললাম আমাকে যে কোন একটি বাসে উঠিয়ে দিতে। সে জানতে চাইল যে আমি কোথাকার বাসে যেতে চাই। আমি বললাম, কোথায় যাব জানি না। তোমার ইচ্ছে মতো যে কোন বাসে তুলে দাও। আমি এখান থেকে অনেক দূর চলে যেতে চাই। অনেক দুরের কোন বাসে আমাকে তুলে দাও।
রিক্সাঅলা আমাকে একটি বাসে উঠিয়ে দিল। আমি জানলামও না কোন জায়গার বাসে উঠলাম। পরে জানতে পারলাম কক্্রবাজোরের বাসে উঠেছি। বিশ্বাস কর, তখনই তোমার কথা খুব মনে পড়ল। চলে এলাম কক্্রবাজারে। কিন্তু তোমার সাথে দেখা করব বা অন্য কিছু ভাবিনি। আমি কোথায় যাব, কী করব, কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলাম না। অনেক ইচ্ছের পরে হলো একটা এ্যাকসিডেন্ট, কিন্তু তুমি মরতে দিলে না। কী হবে বেঁচে থেকে? এ জীবনের চেয়ে যে মরণ আমার কাছে অনেক ভালো।
Ñনা স্যার ও কথা বলবেন না। এখনও সব শেষ হয়ে যায়নি। আপনি মরতে চাইছেন কেন? আমি আছি না? আমি আপনাকে বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা যোগাবো। আপনি বেঁচে থাকবেন। আপনার মতো অবস্থায় লোক বেঁচে আছে না?
Ñ না তৃপ্তি, তুমি বুঝতে পারছ না কী জ্বালা বুকে নিয়ে এখনও বেঁচে আছি।
Ñ আমি বুঝতে পারছি, কিন্তু তবুও আপনাকে আমি শেষ হতে দেব না। আপনার সবকষ্ট আমি দূর করে দেব।
Ñকী বলছ তুমি তৃপ্তি!
Ñ হ্যাঁ, ঠিকই বলেছি। আপনাকে আর অন্য কোথাও যেতে হবে না। আপনি এখন থেকে আমার কাছেই থাকবেন। আপনার সব কষ্ট আমি দূর করে দেব।
Ñ কিন্তু তৃপ্তি আমি তোমাকে চিরটাকাল অবহেলা, অনাদর আর দুঃখ ছাড়া কিছু দিলাম না আর তুমি আমার জন্যে এতটা করতে চাচ্ছ? তুমি এতো মহৎ। কিন্তু তুমি দিতে চাইলেও আমি নিতে পারি না। যাকে কিছুই দিলাম না, তার কাছ থেকে এতটা নেই কী করে?
Ñ আমি আপনার জন্যে জয় করতে চাই, তা প্রতিদান নয়, ভালোবাসার দান।
Ñ আমাকে এখন আর ভালোবাসা যায় না, করুনা করা যায়। পুরুষ মানুষ হয়ে অন্যের করুনায় বেঁচে থাকা যে কতটা কষ্টকর তা তুমি বুঝবে না।
Ñ আমি একদিন বলেছিলাম না, সুসময়ে, সুদিনে না হলেও দুর্দিনে, অসময়ে যেন আপনার জন্যে কিছু করতে পারি? আজ সেই দিন এসেছে। আমাকে আপনি বঞ্চিত করবেন না।
Ñ না তৃপ্তি, তা হয় না।
Ñকেন হয় না? অবশ্যই হবে। হয়ত আমি আপনার প্রয়োজনে আসব বলেই অন্যের সাথে জড়িয়ে যাইনি। অন্যের সাথে জড়িয়ে গেলে আপনার জন্যে কিছুই করতে পারতাম না। আমি আপনার কোন কথাই শুনব না। আপনাকে আমার এখানে থাকতেই হবে। ঘুটু বলল, ঠিক আছে আমি পরে বলব।
Ñ তৃপ্তির মাও ঘুটুকে থেকে যাবার জন্যে অনেক অনুরোধ করল। তাদের দুজনের অনুরোধ ফেলতে না পেরে ঘুটু তৃপ্তির বাসায় থেকে গেল।
তৃপ্তির মা বুড়ো মানুষ। প্রায় অচল। তবুও ঘুটুর জন্যে সে অনেক করে। তৃপ্তি হাসপাতালে যাবার আগে ঘুটুর খোঁজ খবর নেয়, হাসপাতাল থেকে ফিরে এসে খোঁজ খবর নেয়, সেবা যতœ করে গল্প-গুজব করে। ঘুটুর কোন অসুবিধা হয় না কিন্তু নিজের কাছে খুব খারাপ লাগে। যাকে জীবনে অনেক কাঁদিয়েছে, যার জীবনটা নষ্ট করে দিয়েছে, তার কাছ থেকে এতটা নিতে তার বিবেকে বাধে। তাছাড়া সে এভাবে পড়ে থাকবে লোকেও নানান কথা বলবে। সে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।
একদিন রাতে হাসপাতাল থেকে ফিরে তৃপ্তি ঘুটুর ঘরে গিয়ে বসল। অনেকক্ষণ নানান কথাবার্তা হলো। একসময় ঘুটু বলল, তৃপ্তি অনেক দিনতো হলো। তোমার এখানে আছি। এবার আমাকে যাবার অনুমতি দাও। তোমাকে আর কত কষ্ট দেব? আর আমি যে এখানে এভাবে পড়ে আছি, তুমি এভাবে আমার দেখাশুনা করছ, এতে লোকে নানান কথা বলবে। তাতে তোমার ক্ষতি হবে। আমাকে যেতে দাও। আমার জন্যে তোমার ক্ষতি হোক তা আমি চাই না। অনেক ক্ষতিতো করেছি, আর  কত?
Ñ ক্ষতি আর কী হবে? আমি ওসবকে ভয় পাইনা।
Ñ তৃপ্তি, তবুও তুমি একজন নারী। সমাজে তোমাকে দশজনের সাথে থাকতে হয়।
তৃপ্তি কিছু সময় নিরব থেকে তারপর বলল স্যার, একটা সত্যি কথা বলবেন? যদি সে সত্যি কথাটি আমার মনে আঘাত দেয় তবুও সত্যি কথাটি বলবেন?
Ñ কী কথা, শুনিই না?
Ñ না, আগে বলেন বলবেন? কথা দিন।
Ñ ঠিক আছে, বলব। কথা দিলাম।
Ñ আপনি এখনও কী আমাকে অবহেলা করেন? ঘৃণা করেন?
Ñ না তৃপ্তি না। এখন আর আমি তোমাকে ঘৃণা বা অবহেলা করি না। আর শুধু তোমাকে কেন, কাউকেই করি না। সে যোগ্যতা আমি হারিয়ে ফেলেছি। এখন তো আমিই অন্যের অবহেলার পাত্র, ঘৃনার পাত্র। আমার মধ্যে যে আমিত্ব, অন্ধ হয়ে যাবার পর তার মরণ হয়েছে। আমি তোমাকে বলতে চাইনি, বলতাম ও না কারণ যাকে কোনদিন কিছু দেইনি, তাকে যদি বলিÑ আমি তোমাকে মনে রেখেছিলাম, আজো রেখেছি তাহলে তা শুনতে খারাপ শোনাবে বিশেষ করে আমার এই অসহায় অবস্থায়। কিন্তু তুমি শুনতে চাইলে বলে বলতে বাধ্য হলাম। না তৃপ্তি, আমি তোমাকে অবহেলা করি না। বিশ্বাস কর, তোমাকে আমি ভুলে যাইনি কখনও। আমার সবসময় মনে হয়েছে যে, আমি তোমার প্রতি অন্যায় করেছি। আমি মর্মপীড়ায় ভুগেছি অনেক। ঐ যে তুমি একরাতে আমার একটি আঙ্গুলে মেহেদি লাগিয়ে দিয়েছিলে, দেখ সেই আঙ্গুলটায় আজো মেহেদি লাগানো আছে। এটি আমি তেমার স্মৃতি চিহ্ন স্বরপ রেখে দিয়েছি এই এতটি বছর। কিন্তু কেন তা জানি না। মিমকে নিয়ে আমি সুখী হয়েছিলাম সত্যি, কিন্তু তবুও তোমার কথাও আমার মনে পড়ত। মনে হতো আমি জীবনে মস্ত বড়োÑ একটা ভুল করেছি। অবশ্যÑ সুখের দিনগুলিতে তোমার জন্যে খুব বেশি কষ্ট হয়েছে বা তোমার কথা খুব বেশি মনে পড়েছেÑ এমন যদি বলি তবে মিথ্যে বলা হবে। ঐ যে বললাম মাঝে মাঝে মনে পড়েছে, কষ্ট ও হয়েছে। সুখের দিনে হয়ত মানুষের অতীত স্মৃতি কম মনে পড়ে তাই। কিন্তু যখন অন্ধ হয়ে গেলাম, আমার জীবনে নেমে আসতে লাগল সীমাহীন দুঃখ, তখন থেকেই তোমার কথা খুব বেশি মনে পড়তে লাগল। আমার দুঃখের মাত্রাটা যত বাড়তে লাগল, তোমার জন্যে কষ্টটাও ততো বাড়তে লাগল। তখন নিজের কষ্ট দিয়ে আমি তোমার কষ্ট উপলব্ধি করতে পারলাম। সবসময় একটা অনুতাপের আগুনে আমি জ্বলে পুড়ে মরতাম। আমার মনে হতো তোমাকে অনেক কাঁদিয়েছি বলে আমাকেও এমন করে কাঁদতে হচ্ছে। কাউকে দুঃখ দিয়ে সুখী হওয়া যায় না-এটা তখন বুঝতে পেরেছি। মিমের মন থেকে যখন আমার জন্যে ভালোবাসা একেবারে উঠে গেল, তখন বুঝতে পালাম যে, মানুষ একদিন যা হেলায় হারায়, আরেকদিন শত কাঁদলেও তা পায় না। আমার ভুলের জন্যে ক্ষমা চেয়ে আমি তোমাকে ছোট করতে চাই না। কারণ তোমার বিরাট ঔদার্য দিয়ে আমাকে তুমি ক্ষমা করে দেবে জানি। শুধু এটুকু বলতে চাই, তোমাকে কাঁদিয়ে আমিও কম কাঁদিনি, তোমাকে ঠকিয়ে আমিও কম ঠকিনি।
তৃপ্তি চুপ করে রইল, ঘুটুও চুপ করে রইল। ঘুটুর মনে হলো তৃপ্তি কিছু বলবে। সে অপেক্ষা করতে লাগল। অনেক সময় কেটে গেল। ঘুটু বলল, তৃপ্তি, তুমি কিছু বলতে চাচ্ছ মনে হচ্ছে? বলে ফেল। তৃপ্তি বলল, আচ্ছা আমাদের সব কিছুতো শেষ হয়ে যায়নি। আমরা কী এখন ঘর বাধতে পারি না?
Ñ তৃপ্তি, এ তুমি কী বলছ?
Ñ ঠিকই বলছি।
Ñ তুমি ভেবে দেখেছ?
Ñ হ্যাঁ, ভেবেছি।
Ñ না, তা হয় না।
Ñ কেন হয় না?
Ñ আমার সুসময়ে যাকে গ্রহণ করতে পারিনি, অসময়ে তার বোঝাহব এতটা স্বার্থপর আমি হতে পারি না।
Ñ এতে স্বার্থপরতার কিছু নেই। তবুও যদি স্বার্থপরতার কথাই তোলেন তাহলে আমিও তো কম স্বার্থপর নই। এই যে আপনি চোখে দেখতে পান না, এজন্যে যে আমার কতটা কষ্ট তা আপনাকে বোঝাতে পারব না। তবু ও মাঝে মাঝে মনে হয় ভালোই হয়েছে। আপনার এ অবস্থা না হলে তো আপনাকে কোনদিন পেতাম না। বলেন, এটা কী স্বার্থপরতা নয়? সত্যি কথা বলতে কী সব সার্থপরতার উর্ধে উঠতে সাধারণ মানুষ পারে না, অতি মানুষেরা পারে।
Ñ কিন্তু তৃপ্তি, এ হয় না। এভাবে আমি তোমার জীবনটাকে নষ্ট করে দিতে পারি না।
Ñ নষ্ট জীবনকে আপনি আর কী নষ্ট করবেন? আমার জীবনটা কী নষ্ট হতে এখনও বাকি আছে?
Ñ না, তা অবশ্য না। কিন্তু ...............।
আর কোন কিন্তু নয়। আসেন আমরা অতীতকে ভুলে যাই, অতীতের ভুলত্র“টিকে বর্তমান দিয়ে ঢেকে দেই।
Ñ তুমি ভালোকরে ভেবে দেখ তৃপ্তি। পরে কিন্তু দুঃখ করবে।
Ñ আমি অনেক ভেবেছি। আমার ভালোবাসা এক খণ্ড ছিল না যে আজ আপনার চোখ নেই বলে আপনাকে ভালোবাসাবো না। মিম ভাবির ভালোবাসা ছিল খন্ড ভালোবাসা। তাই সে আপনার অসহায় অবস্থায় আপনাকে ভালোবাসতে পারেনি। কিন্তু প্রকৃত ভালোবাসাতো এই নয় যে তা শুধু সুখের সময় দেয়া যাবে, দুঃখের সময় নয়। নিজের স্বার্থে দেয়া যাবে, ভালোবাসার মানুষটির স্বার্থে নয়। খাঁটি ভালোবাসা এত ছোট নয়। আমি এটা ভালো করে জানি যে, আমার ভালোবাসা স্বার্থপর নয়, নিখোঁদ।
Ñ তৃপ্তি, তুমি আরো ভালো করে ভেবে দেখ।
Ñ ভেবেছি। ভালো করেই ভেবেছি। অবশ্য না ভাবলেও চলত। ভালোবাসায় অত ভাবলে চলে না, লাভক্ষতির হিসেব করলে চলে না।
Ñ তৃপ্তি আমার এখন আর মরতে ইচ্ছে হচ্ছে না; বাঁচতে ইচ্ছে হচ্ছে। মনে হচ্ছে আমার সবকিছু এখন ও শেষ হয়ে যায়নি।
Ñ আপনার আর কোনদিন মরতে ইচ্ছে করবে না। আমি আপনার সব কষ্ট দূর করে দেব।
ঘুটুর দৃষ্টিহীন চোখ দিয়ে ফোঁটা ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ল। এ পানি বেদনার নয়, আনন্দের। ব্যর্থতা আর হতাশার নয়, আশার।
তৃপ্তি তার আচল দিয়ে ঘুটুর চোখের পানি মুছে দিল। ঘুটুকে নিজের করে পাবার আনন্দে তার চোখও পানিতে ভিজে গেল।  অব শেষে দষ্টিহীন ঘুটুর আশ্রয় হলো ।
ঃ সমাপ্ত ঃ


0 comments:

Post a Comment