দারিদ্র বিমোচন ও জনসংখ্যা দিবসের “প্রত্যাশা”
আলী ফোরকান
১১ জুলাই বিশ্বজনসংখ্যা দিবস। বাংলাদেশেও যথারীতি সরকারি-বেসরকারি সংস্থা আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে দিবসটি পালন করে থাকে। এদিবস উপলক্ষে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কমাতে বিভিন্ন বিষয়ের উপর গুরুত্বারোপ করা হয় । রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে শ্রেষ্ঠ পরিবারকর্মী ও সেবা প্রদানকারী সংস্থাগুলোর মধ্যে পুরস্কার বিতরণ করা হয়। কিন্তু বাস্তবে বাংলাদেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ও পরিবার পরিকল্পনা পরিস্থিতি যে অবস্থায় বিরাজ করছে, তা নিয়ে খুব একটা উদ্বেগ চোখে পড়ে না। বিশ্বজনসংখ্যা দিবসের একটি প্রতিবেদনে দেখা যায়, বর্তমানে পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রমের দ্বাদশ পর্যায় পরিচালিত হলেও দেশের প্রায় ১১ দশমিক ৩ শতাংশ মানুষের পরিবার পরিকল্পনা বিষয়ক ধারণা নাই। অন্যদিকে সর্বশেষ সরকারি তথ্যমতে, বর্তমানে দেশের জনসংখ্যা প্রায় ১৬ কোটি এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১ দশমিক ৪৩। অর্থাৎ প্রতি বৎসর দেশের জনসংখ্যায় যোগ হচেছ ১৮ লক্ষ মানুষ। বর্তমান হারে জনসংখ্যা বাড়তে থাকলে আগামী ৫০ বছরে দেশের জনসংখ্যা হবে দ্বিগুণ । বৃদ্ধির এ হার ১-এ নামাতে সক্ষম হলেও ২০২০ সালে দেশের জনসংখ্যা দাঁড়াবে ১৭ কোটি ২০ লক্ষ। অপরিকল্পিতভাবে ক্রমবর্ধমান এ জনসংখ্যার চাপ দেশের জন্য ভয়াবহ ঝুঁকি হয়ে দাড়াচ্ছে। কিন্তু এ ব্যাপারে আমরা যথেষ্ট গুরুত্ব সহকারে ভাবছি না। বাংলাদেশে জনসংখ্যা কার্যক্রম অনেকটাই ঝিমিয়ে পড়ছে। গত ১৫ বৎসরে দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার শূন্য দশমিক ৫৮ শতাংশ কমিয়ে আনা সম্ভব হলেও সার্বিক বিবেচনায় এ সফলতা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হতে চলেছে। এর কারণ বেশ কয়েক বৎসর যাবৎ জনসংখ্যা বিষয়ক কর্মসূচিগুলো আর আগের মতো কার্যকর হচ্ছে না। অথচ ইতিমধ্যেই বিরাটসংখ্যক প্রজননক্ষম জনগোষ্ঠী নতুনভাবে যোগ হচেছ। দেশে সরকারিভাবে পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রম শুরু হয়েছিল ১৯৬৫ সালে। ১১টি পর্যায় শেষ করে বর্তমানে দ্বাদশ পর্যায়ে কার্যক্রম চলছে। এ কর্মসূচির আওতায় ২০০৩ সাল থেকে পরিবার কল্যাণ কর্মীরা কাজ করছে। কিন্তু সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাবে এ কর্মসূচিতে ও সাফল্য আসেনি । তিন বৎসরে নতুন কোনো জন্ম নিয়ন্ত্রণ সামগ্রীও সরবরাহ হয়নি। দেশের বহু এলাকায় এ কার্যক্রমের কোনো মনিটরিং ব্যবস্থা নাই। এ অবস্থায় দেশের জনসংখ্যা ক্রমেই দেশের জন্য ভয়াবহ বিপজ্জনক হয়ে উঠছে। পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রমের বর্তমান ধারা অব্যাহত থাকলে দেশের জনসংখ্যা বিস্ফোরণ গড়বে। আর আগামী এক দশকেই শিক্ষা, স্বাস্থ্য, আশ্রয়সহ মানুষের মৌলিক অধিকারের প্রতিটি ক্ষেত্রে জনসংখ্যার চাপ ভয়াবহ রূপ নেবে। এ চাপ জাতীয় উন্নয়ন ব্যাহত করা ছাড়াও সৃষ্টি করবে নতুন নতুন সঙ্কট। বাংলাদেশের আয়তনের দিক থেকে এমনিতেই বিশ্বের অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ দেশ। দেশের জনসংখ্যাকে জনসম্পদে রূপান্তরিত করার আশানুরূপ সফলতা নাই। ফলে জনসংখ্যা দেশের উন্নয়নের অন্তরায় হয়ে দাড়াচ্ছে। তার উপর আগামীতে জনসংখ্যার চাপ বেড়ে যাওয়ার বিষয়টিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া উচিত। এ কারণে জনসংখ্যা কার্যক্রমে গতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে হবে। এ ক্ষেত্রে চলমান সরকারি কর্মসূচিগুলোর সফল বাস্তবায়ন এবং লক্ষ্যমাত্রা পূরণ নিশ্চিত করা জরুরি। গ্রাম পর্যায়ে নিম্নবিত্ত জনগোষ্ঠীর মধ্যে মাতৃস্বাস্থ্য সেবা ও জন্ম নিয়ন্ত্রণের আগ্রহ বৃদ্ধি করতে হবে। গ্রাম ও বস্তির দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কমিয়ে আনা অবশ্যই সম্ভব। জন্ম নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি জনসংখ্যাকে দক্ষ জনসম্পদে পরিণত করা ছাড়া দেশের দারিদ্র্য বিমোচন অসম্ভব। সম্পদের সীমাবদ্ধতায় মানব সম্পদই আমাদের জাতীয় জীবনে বড় সম্পদ হয়ে উঠতে পারে। ইতিমধ্যে দেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের ক্ষেত্রে জনশক্তি রফতানি খাতটি গুরূত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে । কাজেই জাতির অগ্রযাত্রা ও দেশের উন্নয়নকে নিশ্চিত করতে হলে পরিবার পরিকল্পনার মাধ্যমে জন্মহার বৃদ্ধিকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। আর বর্তমান জনসংখ্যাকে দক্ষ জনসম্পদে রূপান্তরিত করার শর্ত দু’টি পূরণ করতে হবে সর্বাগ্রে।
জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ ও দারিদ্র্য বিমোচন: ইদানীং বাংলাদেশ দারিদ্র্য বিমোচন করতে নিবিড়ভাবে মনোনিবেশ করেছে। লোকসংখ্যা না কমিয়ে দারিদ্র্য বিমোচন সম্ভ¢ব করা যাবে না। লোকসংখ্যা কমিয়ে আনার কোনো পরিকল্পনা বাংলাদেশে নেই। ভাবতে হবে, ১০-২০ বছর পর লোকসংখ্যা কত হবে। কোথায় হবে তাদের বাসস্থান। আমাদের অবশ্যই জাপান, ফিলিপাইন এবং ইতালির সঙ্গে আলোচনায় বসতে হবে। যারা জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কমাতে সক্ষম হয়েছে। এ আলোচনা বৈঠকে অংশগ্রহণকারীরা হবেন জনসংখ্যাবিদ, জীববিজ্ঞানী ও অর্থনীতিবিদ। আমাদের জš§নিয়ন্ত্রণ কৌশল কার্যকর হয়নি। এক সন্তানের পরিবার ৭০ বছরে ™ি^গুণ করতে পারে লোকসংখ্যা। আমরা তো এখনো দুই সন্তানের সুখী পরিবারের অকার্যকর প্রক্রিয়াও মানতে চাই না। চীন পরীক্ষা করে দেখেছে, এক সন্তানের পরিবার ৭০ বছরে ™ি^গুণ হয়। বাংলাদেশের জনসংখ্যা সম্পর্কে আরো অনেক কথা। জনসংখ্যার ১০ ভাগ নানাভাবে বিকলাঙ্গ। তাদের মধ্য থেকে বেছে কিছুসংখ্যককে কাজে লাগানোর প্রচেষ্টা নেই। প্রায় ১০ ভাগ নানা ব্যাধিতে আক্রান্ত। উৎপাদন করবে কে? মেধাবী ও অন্য অনেকে বিদেশগামী। এ সত্যটুকু মানতে হবে। একটি পঙ্গু জাতিকে উন্নয়নের পথে এগিয়ে নিতে হলে প্রথম তার পঙ্গুবাসীকে যথাসম্ভব কর্মক্ষম করতে হবে। মেধাবীদের বিদেশে চলে যাওয়ার পথ বন্ধ করতে হবে। জাতিকে শিক্ষিত, সুশৃংখল করতে হবে। তাদের দিয়ে শুরু করতে হবে দেশের লোক-উন্নয়ন প্রক্রিয়া।
বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতি ও বেকারের সংখ্যা : বাংলাদেশ বিজনেস ফোরামের (এসবিবিএফ) এক পরিসংখ্যানে দেখাযায়,বাংলাদেশের অর্থনীতি একটি বিপজ্জনক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে। দেশে প্রায় ৩ থেকে ৪ কোটি মানুষ বেকার। বর্তমানে বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ৪০ শতাংশই যুবক। আবার এদের মধ্যে বেকারের সংখ্যা ৮৬ শতাংশ। একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, সুগঠিত যুব সমাজই গড়তে পারে একটি সমৃদ্ধ দেশ। তাই যুব শক্তিকে কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে যুব সম্পদে পরিণত করাই হচ্ছে রাষ্ট্রের দায়িত্ব। তাদের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে আয় বৃদ্ধি করতে না পারলে পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ হবে। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে এসবিবিএফ’র প্রতিবেদনে বিকল্প বিপণন ব্যবস্থা গড়ে তোলার কথা বলা হয়েছে। তাদের পরিসংখ্যান মতে, সরকারি হিসাবে বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি ৭ শতাংশ বলা হয়েছে। এটা ঠিক নয়। কারণ যেসব পণ্যের ভিত্তিতে মূল্যস্ফীতি নির্ধারণ করা হয়েছে তা দেশের ৮০ থেকে ৮৫ ভাগ লোক ব্যবহার করে না। মোটা চাল, আটাসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ভিত্তিতে মূল্যস্ফীতি নির্ধারণ করা হলে প্রকৃত অর্থে বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি হবে ১২ থেকে ১৬ শতাংশ। নিরাপত্তা খাতে ব্যয়ের সঙ্গে মানুষের সরাসরি কোনো সম্পর্ক নেই। মানুষের নিরাপত্তার প্রধান কার্যক্রম হলো জ্ঞান, দক্ষতা ও আয় বৃদ্ধি করা। এসবিবিএফ’র মতে, নিরাপত্তা খাতে মাথাপিছু ব্যয় হচ্ছে ৬ ডলার অথচ স্বাস্থ্য খাতে মাথাপিছু ব্যয় হচ্ছে মাত্র ৩ ডলার। আর তথ্যপ্রযুক্তির এযুগে ও কিন্তু বিশ্বের প্রায় ১৩০কোটি মানুষ এখনো হতদরিদ্র। পৃথিবীতে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অভূতপূর্ব বিকাশ ঘটেছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির এ বিকাশকে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ ও দারিদ্র্য বিমোচনের কাজে লাগানো গেলে যুগ-যুগান্তের সমস্যাটি দূর করা অনেকটাই সহজ হবে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিকাশ সৃজনশীলতাকেও অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে। নতুন নতুন সম্ভাবনারও সৃষ্টি হচেছ। বিজ্ঞানমুখী বিশ্ব তার এ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জ্ঞান যদি জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ ও দারিদ্র্য বিমোচনের লক্ষ্যে নিয়োজিত করে। তবে সকল মানুষের জন্য অবারিত হবে সুযোগ ও সম্ভাবনা। তাতে বিশ্বব্যাপী এ দারিদ্র্য বিমোচনের কাজ আরো ত্বরান্বিত হবে। জনসংখ্যা বিস্ফোরণ হ্রাস হবে আর সত্যি সত্যি আমাদের এ পৃথিবী অভাব ও দারিদ্র্যমুক্ত হবে। আমরা এ আশা তো করতেই পারি।
লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট
মোবাইল:০১৭১১৫৭৯২৬৭
0 comments:
Post a Comment