Tuesday, July 5, 2016

খুশিয়া

খুশিয়া

উর্দু সাহিত্যের অনন্য কথাশিল্পী সা’দত হাসান মান্টো। প্রেমচন্দের ‘কাফন’ই আধুনিক উর্দু গল্পের মাইল ফলক। উর্দু ছোট গল্প পূর্ণতা পায় মান্টোর হাতে। মান্টোর গল্প পড়লে মনে হয়, কলমের কালি দিয়ে নয় বরং বুকের গরল মিশ্রিত রক্ত দিয়ে তিনি গল্প লিখেছেন। সামাজিক বৈষম্যের কারণে পতিতার সৃষ্টি কিন্তু সমাজ ওদের গ্রহণ করতে রাজী নয়। কিন্তু সমাজের এই অবহেলিতদের বিষাদময় কাহিনী মান্টোর শক্তিধর লেখনীর মাধ্যমে জীবন্ত হয়ে উঠেছে। পতিতালয়ের সুলতানা এবং খুশিয়া প্রভৃতি চরিত্র মান্টোর গল্পে প্রাণ পেয়েছে। কিন্তু সমাজ এদের বরদাস্ত করতে পারে না। তাই মান্টোর রচনাকে অশ্লীলতার অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়। ‘খুশিয়া’ মান্টোর পতিতাদের নিয়ে একটি বিখ্যাত গল্প তার শ্রেষ্ঠ গল্পগুলোর অন্যতম। খুশিয়া ভাবছিল। সে বানোয়ারীর পানের দোকান থেকে কালো জর্দাওয়ালা এক খিলি পান নিয়ে দোকানের পাশে একটি পাকা চত্বরে গিয়ে বসেছিল। এই পাকা চত্বরটি দিনের বেলা মোটরের পুরনো টায়ার ও যন্ত্রাংশের স্তূপ পড়ে থাকে। রাতে সাড়ে আটটার মধ্যে মোটরের যন্ত্রাংশ এবং টায়ার বিক্রির এই দোকান বন্ধ হয়ে যায়। আর পাকা চত্বরটি খুশিয়ার জন্য খালি হয়ে পড়ে। সে কালো জর্দাওয়ালা পান ধীরে ধীরে চিবোতে থাকে। পানের পিক দাঁতের ফাঁক দিয়ে মুখের চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে আর পান সুপারী দাঁতের চিবুনিতে পিকের সাথে মিশে যায়। তাই সে পানের পিক মুখের বাইরে ফেলতে চায় না। খুশিয়া পানের পিক মুখের ভেতর জিহ্বার নাড়াচাড়া করছিল আর আধঘন্টা আগে সংঘঠিত ঘটনা নিয়ে ভাবছিল। সে এই পাথরের চত্বরে যথারীতি বসার আগে বাগান বাড়ীর পঞ্চম গলিতে গিয়েছিল। মঙ্গুর থেকে কান্তা নামে একজন মেয়ে আমদানী হয়েছে। ঐ গলির শেষ প্রান্তে সে থাকে। খুশিয়াকে কেউ একজন জানিয়েছে যে, কান্তা বাসা বদল করবে। এ ব্যাপারে জানার জন্য সে সেখানে গিয়েছিল। কান্তার বাড়ীর অর্ধখোলা দরজায় সে কড়া নাড়ে। ভেতর থেকে আওয়াজ আসে ‘কে এসেছে?’ খুশিয়া উত্তর দিল, ‘আমি খুশিয়া’। পাশের কামরা থেকে আওয়াজ এসেছে। কিছুক্ষণ পর দরজা খুললে খুশিয়া ভেতরে প্রবেশ করে। দরজা বন্ধ করার পর খুশিয়া মোড় ঘুরে পেছনে তাকায় আর সে কান্তাকে সম্পূর্ণ নগ্ন অবস্থায় দেখে হতবাক। পুরোপুরি নগ্ন বলা যায়। সে সারাদেহ একটি তোয়ালে দিয়ে ঢেকে রেখেছিল। তোয়ালের আড়ালে শরীর ঢাকা হয়েছে তাও বলা যায় না। আসলে যা কিছু আড়াল করার দরকার ছিল তার দেহের সব অঙ্গ প্রত্যঙ্গ খুশিয়ার চোখের সামনে উন্মুক্ত ছিল।কান্তা বলল, ‘খুশিয়া কি জন্য এসেছ? আমি গোসল করতে যাচ্ছিলাম, বসো বসো। বাইরে তোমার জন্য চায়ের অর্ডার দিয়ে আসলে মন্দ হতো না। জানোতো মোয়ারামা এখান থেকে পালিয়ে গেছে। খুশিয়া এর আগে কখনও হঠাৎ এরকম নগ্ন কাউকে দেখেনি। সে দারুণ ঘামড়ে যায়। সে উত্তর কি দেবে খুঁজে পাচ্ছিল না। নগ্ন দৃশ্য দেখে সে হতবাক। এখন নিজেকে কোথাও লুকানোর চেষ্টা করছিল। সে তাড়াহুড়ার মধ্যে শুধু জবাব দিল, ‘যাও যাও, স্নান সেরে এসো’ তারপর সে নির্ভয়ে বলল, ‘যখন তুমি নগ্ন, দরজা খোলার কি দরকার ছিল। ভেতর থেকে জবাব দিলে আমি আবার আসতাম। কিন্তু ঠিক আছে যাও স্নান সেরে এসো।’কান্তা মুছকি হেসে বলল, ‘যখন তুমি জবাব দিলে, আমি খুশিয়া। তখন আমি ভেবেছি, আমাদের খুশিয়া অন্য কেউ নয়, এতে আপত্তির কি আছে, আসুক না ভেতরে। কান্তার মুছকি হাসি খুশিয়ার চিন্তা-ভাবনায় সাঁতার কাটছিল। তখনও কান্তার নগ্ন দেহ মোমের পুতুলের মতো, তার চোখের সামনে ভাসছে আর গানে গানে ভেতরে প্রবেশ করছে। তার দেহ বল্লরী ছিল অপূর্ব। প্রথমবারের মতো, খুশিয়ার মনে হয়েছে, দেহের বেসাতি যারা করে সেসব মহিলার গড়ন এমনিই হয়ে থাকে। সে সবচেয়ে বেশী বিস্মিত ও হতবাক হয়েছে, যখন কান্তা এমন স্টাইলে তার সামনে নগ্ন দেহে দাঁড়িয়েছিল অথচ সে সামান্য লজ্জাও পায়নি। কিন্তু কেন? এর উত্তর কান্তাই দিয়েছে, ‘যখন তুমি বললে আমি খুশিয়া, তখন ভেবেছি, আমাদের খুশিয়াই তো, ঘরের ভেতরে আসুক, আপত্তি কিসের।’ কান্তা ও খুশিয়া একই পেশায় নিয়োজিত। খুশিয়া হল তার দালাল। অতএব সে তার নিজস্ব লোক। এমনি খুশিয়ার সামনে কান্তা নগ্ন হয়ে দাঁড়ালে বিশেষ আপত্তি ছিল না। কিন্তু কান্তার বক্তব্যে খুশিয়া অন্য অর্থ খুঁজে বেড়াচ্ছে। এর মর্মান্ত এতই সুস্পষ্ট ও রহস্যজনক যে, খুশিয়া এ বিষয়ে কোন চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারছে না। ঢোলবকের ঢোলের চামড়ার মতো শক্তভাবে টানটান কান্তার নগ্ন দেহ সে তখনও অবলোকন করছিল। তার উদাস দৃষ্টি ছিল অসংযত। সে তার মোহনীয় দেহের দিকে কয়েকবার হতবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখেছে। কিন্তু তার দেহের লোম পর্যন্ত কেঁপে উঠেনি। সে তার অপূর্ব পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়েছিল, যা অনুভূতি ও আবেগে ক্লান্তি আসে।“ভাই তার সামনে একজন পুুরুষ দাঁড়িয়েছিল। পুরুষের দৃষ্টি পোশাক ভেদ করে নারীর দেহে গিয়ে পৌঁছে। একমাত্র পরমাত্মাই জানে, তার চিন্তা-ভাবনা কোথায় কোথায় গিয়ে উপনীত হয়। সে মোটেই ঘাবড়ায়নি। তার দৃষ্টি দেখে মনে হয়, এক্ষুণি লন্ড্রি থেকে কাপড় ধোলাই হয়ে এসেছে। তার তো সামান্য লজ্জা পাওয়া উচিত ছিল। অন্ততঃ তার চোখে মুখে লজ্জার রক্তিম আভা ফুটতে পারতো। মেনে নিলাম, সে একজন পতিতা, কিন্তু উলঙ্গ অবস্থায় দাঁড়াতে পারে না।”দশ বছর হল খুশিয়া দালালী করছে। এই দশ বছরে সে পেশাদার মেয়েদের রহস্য জেনে গেছে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, সে জানে ধুনকরদের গলির শেষ প্রান্তে একটি মেয়ে একজন যুবক ভাই পরিচয় দিয়ে বাসা ভাড়া থাকে। অছ্যুত কন্যা ছবির ‘কাহে করতা মুরখ পিয়ার পিয়ার পিয়ার’ গানের রেকর্ড ভাঙা কলের গানের মেশিনে বাজায়। সে অশোক কুমারকে দারুণ ভালবাসে। কয়েক দফা তাকে বুড়ো অশোক কুমারের সাথে সাক্ষাতের অঙ্গীকার করে বোকা বানিয়েছে। সে আরও জানে যে, দাদর এ একজন পাঞ্জাবী মেয়ে থাকে। ‘মারাকো ওরফে খুনে তামান্না’ ছবির ইংরেজ নায়িকা ‘মরিস ডেট্রাজ’ এর বলিষ্ট পা দুটি খুবই সুন্দর, আর দুই লাখ টাকার বীমাকৃত ছিল। পাঞ্জাবী মেয়েটির পা দুটি নাকি ঐ ইংরেজ নায়িকার মতো, তাই সে পেন্ট কোর্ট পরা শুরু করে আর পেন্ট কোমরে নিতম্বের উপর টাইট হয়ে লেপটে থাকতো। তার আরও জানা আছে যে, দাক্ষিণাত্যের মজগাঁ এলাকার তরুণীটি শুধু কলেজের স্বাস্থ্যবান সুন্দর যুবকদের ফাঁসাবার উদ্দেশ্য একটি ফুটফুটে শিশুর মা হওয়া। আসলে মেয়েটি ছিল বন্ধ্যা, তার এই আশা কোনদিন পূরণ হবে না। আর মাদ্রাজের মেয়েটির কানে সর্বদা হীরের ফুল শোভা পেত কিন্তু সেও ভালো ভাবে জানে যে, তার গায়ের রং কখনও ফর্সা হবে না। আর ফর্সা হওয়া ঔষধ ব্যবহার করে অযথা সে অর্থ ব্যয় করছে। তার নিয়ন্ত্রণাধীন সব পতিতা মেয়েদের ভেতরের ও বাইরের খবর সংবাদ দিল তার নখদর্পণে। কিন্তু কান্তা কুমারীর আসল নাম ছিল বিদঘুট, তাই তার সেই নাম জীবনেও মনে রাখতে পারেনি। সে ভাবতেও পারেনি। কান্তা তার সামনে নগ্ন অবস্থায় এসে দাঁড়াতে পারে। তার জীবনে এটা ছিল বিস্ময়কর ঘটনা। ভাবতে ভাবতে তার মুখে অনেক পানে পিক জমা হয়েছে, যার ফলে সে ছোট্ট ছোট্ট সুপারির টুকরোগুলো চিবাতে পারছে না, দাঁতের ফাঁক দিয়ে পিছনে যাচ্ছে। তার কপালে ছোট ছোট ঘামের বিন্দু দেখা দেয়। যেন মলমল কাপড়ের উপর পনির হালকাভাবে দাবিয়ে দেয়া হয়েছে। তার পুরুষত্বের আত্মসম্মানের উপরে আঘাত লাগে। যখন কান্তার নগ্ন অবস্থায় তার সামনে উপস্থিত হওয়ার বিষয়টি কল্পনায় আসে, তাকে অপমানিত বোধ করে। সে মনে মনে ভাবে, ‘এটা অপমান নয়তো কি হতে পারে? একটি মেয়ে নগ্ন অবস্থায় সামনে এসে দাঁড়াল আর বলে কিনা এতে আপত্তির কি আছে? তুমি আমাদের খুশিয়া। খুশিয়া নয় যেন সে বিড়ালে পরিণত হয়েছে, যেন তার বিছানায় সারাক্ষণ ঘুমায়। আরো কত কি?’ এখন সে ভাবতে থাকে তার সত্যিই অপমান হয়েছে। সে পুরুষ মানুষ। তার আশা ছিল, মেয়ে সে ভদ্র ঘরের হোক বা পতিতা তাকে পুরুষ হিসেবে মেনে নেবে। তারও ওদের মাঝে পর্দার ব্যবস্থা করবে। দীর্ঘদিন এই রীতিই চলছে। কান্তা কবে তার বাড়ী বদল করবে, কোথায় যাচ্ছে সেটা জানার জন্য সেখানে গিয়েছিল। আর কান্তার কাছে তার যাওয়ার কারণ ছিল সম্পূর্ণ ব্যবসায়িক। খুশিয়া কান্তার বক্তব্য বিশ্লেষণ করতে গিয়ে ভাবছে, দরজায় কড়া নাড়ার পর যদি সে দরজা না খুললে হয়তো ভাবতো সে ভেতরে কি করছে? কান্তা মাথায় ওড়না বেঁধে ঘুমিয়ে আছে। নতুবা বগলের লোম পরিষ্কার করছে।
বগলের লোম পরিস্কারের পাউডার দিয়ে লোম পরিষ্কার করার সময় এমন বিশ্রী গন্ধ ছড়ায়, খুশিয়ার নাকে তা সহ্য করতে পারে না। পালংকে একা বসে তাস ছড়িয়ে খুশিয়া পেসান খেলতে থাকতো। এসব ঘটনা তার মনে পড়ছে। ঘরে তখন কাউকে রাখতো না। খুশিয়া একটি কাজে গেছে, কিন্তু সে ভাবতেও পারেনি হঠাৎ কান্তা এভাবেঃ.পোশাকে ঢাকা কান্তা এভাবেঃঅর্থাৎ কান্তাকে সে সর্বদা জামা-কাপড় পরিহিত অবস্থায় দেখেছে সে কিনা তার সামনে সম্পূর্ণ নগ্ন অবস্থায় এসে হাজির হল। পুরোপুরি উলঙ্গ বলা যায়। একটি ছোট্ট তোয়ালে তো সারা দেহ ঢাকতে পারে না। খুশিয়ার এই দৃশ্য দেখে মনে হয়েছে সে নিজেই নগ্ন হয়ে গেছে। ঘটনার এখানেই ইতি হলে কোন কথা ছিল না। খুশিয়া তার হতবাক হওয়ার বিষয়টি কোন না কোন বাহানায় ভুলে যেতো। বিপদ হল, মেয়েটি মুছকি হেসে বলেছে, ‘যখন তুমি বললে আমি খুশিয়া, তখন ভাবলাম, আমাদের খুশিয়াই তো, ভেতরে আসুক মন্দ কি।’তার এই বক্তব্য খুশিয়াকে কুরে কুরে খাছে। ‘শ্যালী মুচকি হাসছিল। তার বার বার মনে হয়েছে, কান্তা যেমন নগ্ন ছিল, তার মুচকি হাসি খুশিয়ার নিজেকেও নগ্ন মনে হয়েছে। শুধু মুচকি হাসি নয়, কান্তার শরীর এতখানি নগ্ন মনে হয়েছে যেন কাঠের উপর মিস্ত্রি রান্দা মেরে মসৃণ করেছে। বাল্যকালের এক ঘটনা তার বার বার মনে পড়ছে। প্রতিবেশী এক মহিলা তাকে বলতো, ‘খুশিয়া বাবা, দৌড়ে গিয়ে তাড়াতাড়ি এক বালতি পানি ভরে আন।’ যখন সে বালতি ভর্তি পানি নিয়ে আসতো তখন ভদ্র মহিলা ধুতির কাপড়ের পর্দার আড়াল থেকে বলতো, ‘ভেতরে আমার পাশে নিয়ে এসো, আমার মুখে সাবান মেখেছি।’ আমি কিছু বুঝতে পারতাম না। ধুতির পর্দা সরিয়ে বালতি ভেতরে নিয়ে তার কাছে রেখে দিতাম। পর্দার ভেতরে সাবান মেখে নগ্ন মহিলাকে আমার নজরে পড়তো। কিন্তু আমার মনে কোন যৌন চেতনা অনুভূত হতো না।
‘ভাই আমি তো তখন কিশোর। আত্মভোলা ছিলাম। কিশোর আর পুরুষের মাঝে অনেক পার্থক্য। এখন আমার বয়স ২৮-এর কাছাকাছি আর ২৮ বছরের যুবকের সামনে কোন বৃদ্ধা মহিলাও উলঙ্গ দাঁড়াতে পারে না।’কান্তা তাকে কি মনে করে। একজন যুবক পুরুষের কাছে যা থাকে তা কি তার মাঝে অনুপস্থিত? কান্তার নগ্ন দেহ দেখে সে ঘাবড়ে গেছে, এতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু কান্তার দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সে কখনও লুকিয়ে পর্যালোচনা করে দেখেনি, যা দৈহিক ব্যাপারে ব্যবহারের পর আসলরূপে বহাল-তবিয়তে আছে। আশ্চর্যের বিষয় কখনও তার মনে হয়নি, কান্তাকে উপভোগ করার মূল্য দশ টাকা দাম চড়া। শারদীয় পূজার দিনে ব্যাংকের কেরানী দু’টাকা কনসেশান না দেয়ায় ফেরত দিয়েছিল। বেচারীর কপাল মন্দ। সর্বোপরি এক মুহূর্তের জন্যও চেতনায় কোন বিচিত্র অনুভূতি বা আকর্ষণ সৃষ্টি হয়নি। সে এমনভাবে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে মোচড় দিতে চায় না, যা তার দেহের হাড় পর্যন্ত ব্যথা করুক। এরপরও মঙ্গুরের লাবণ্যময়ী মেয়ে তাকে পুরুষ মনে করে না এবং শুধুমাত্র খুশিয়া মনে করে তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দেখতে ছিল।রেগে সে পানের পিক মুখ থু দিয়ে ফুটপাতে নিক্ষেপ করে। ফুটপাতে এর ফলে কয়েকটি বুদবুদের সৃষ্টি হয়। পিক ফেলে সে ট্রামে চড়ে বাড়ীতে চলে যায়। বাড়ীতে গিয়ে স্নান সেরে ধুতি পরে তারই দালানে অবস্থিত সেলুনে গিয়ে হাজির। সেলুনে গিয়ে সে আয়নায় মাথা আচড়ে নেয়। আবার হঠাৎ কি জানি নতুন চিন্তা-ভাবনায় চেয়ারে বসে পড়ে তারপর নাপিতকে তার দাড়ি শেভ করার নির্দেশ দেয়। সেদিন দ্বিতীয় দফা সে দাড়ি শেভের কথা বলছে তাই নাপিত বললো, ‘আরে ভাই খুশিয়া তুমি কি ভুলে গেছ? সকালেই তো তোমার দাড়ি শেভ করে দিয়েছি।’এ কথা শুনে খুশিয়া গাম্ভীর্যের সাথে দাঁড়িতে হাত হাত বুলায় জবাব দিল, ‘দাড়ির শেকড় ভালভাবে কাটা হয়নি।’ ভালভাবে শেভ করে আর মুখে পাউডার দিয়ে সে সেলুন থেকে বের হয়। সামনে ট্যাক্সি স্ট্যান্ড, ট্যাক্সির আড্ডা। বোম্বাই-এর বিশেষ স্টাইলে, সে চিচি শব্দে একটি ট্যাক্সিকে ইঙ্গিতে তার কাছে ডাকে। সে দ্রুত ট্যাক্সিতে চড়ে বসে। ট্যাক্সি ড্রাইভার পেছনে ফিরে তার কাছে জানতে চায়, ‘কোথায় যাবেন সাহেব?’এই তিনটি শব্দের মধ্যে ‘সাহেব’ শব্দটি তাকে বেশী উৎফুল্ল করে। সে বন্ধুত্বসুলভ আওয়াজে উত্তর দিল, ‘বলবো? প্রথমে তুমি অপেরা হাউস যাও। লেমিংটন রোড দিয়ে যাবে বুঝলে? ড্রাইভার মিটারের লাল হাতল ঘুরিয়ে নীচে নামিয়ে দেয় তার যথারীতি ট্যাক্সি লেমিংটন রোডের দিকে যাত্রা করে। রোডের শেষ কোনায় আসলে খুশিয়া ড্রাইভারকে বাঁয়ে মোড় নেয়ার নির্দেশ দেয়। ট্যাক্সি বাঁয়ে মোড় ঘুরায়। তখনও ড্রাইভার গিয়ার পর্যন্ত বদলায়নি, খুশিয়া ড্রাইভারকে সামনে খাম্বার কাছে আসতে বলল। ড্রাইভার রাস্তার ধারে লাইট পোষ্টের পাশে গাড়ী থামায়। খুশিয়া দরজা খুলে গাড়ী থেকে নেমে একটি দোকানের দিকে এগিয়ে যায়। দোকান থেকে এক খিলি পান নিয়ে, দোকানের পাশে দাঁড়ানো লোকটির সাথে আলাপ করল। তারপর লোকটিকে সাথে নিয়ে ট্যাক্সিতে চড়ে বসে আর ড্রাইভারকে নির্দেশ দিল, ‘সোজা সামনে গাড়ী চালাও।’অনেকক্ষণ ট্যাক্সি এগিয়ে যায়। খুশিয়া যেদিকে ইশারা করেছে, ড্রাইভার সেদিকে ট্যাক্সি চালিয়ে এগিয়ে গেছে। অনেক আলো ঝলমল বাজার পেরিয়ে ট্যাক্সি একটি আবছা অন্ধকার গলিতে প্রবেশ করে যেখানে মানুষের আনাগোনা কম ছিল। কিছু লোক সড়কের পাশে শুয়েছিল। এদের মধ্যে কয়েকজন আনন্দের সাথে মাথা মালিশ করাচ্ছে। এদের অতিক্রম করে ট্যাক্সি এগিয়ে যায়। তারপর একটি কাঠের বাংলোর মতো বাড়ীর সামনে পৌঁছলে খুশিয়া ট্যাক্সিওয়ালাকে সেখানে আসতে বলল আরও নির্দেশ দিল, এখানে গাড়ী থামাও।’ ট্যাক্সি থামলে খুশিয়া সঙ্গী লোকটিকে। যাকে পানওয়ালার দোকান থেকে সঙ্গে এনেছিল, তাকে ধীরকক্তে বলল, ‘যাও, আমি এখানে অপেক্ষা করবো। লোকটি বোকার মতো খুশিয়ার দিকে তাকায় তারপর ট্যাক্সি থেকে বেরিয়ে কাঠের তৈরী বাড়ীতে প্রবেশ করে। খুশিয়া ট্যাক্সির ভেতর সিটে আরামে বসেছিল। সে পায়ের উপর পা দিয়ে বসেছিল আর পকেট থেকে বিড়ি বের করে ম্যাচের কাঠি দিয়ে বিড়ি জ্বালায়, তারপর দু’একটি কষে টান দিয়ে বিড়ি রাস্তায় ছুঁড়ে ফেলে দেয়। সে অস্থির অবস্থায় বসেছিল। সে অনুভব করছিল, ট্যাক্সির ইঞ্জিন বন্ধ হয়নি। তার পর বুক ধড়ফড় করে উঠে। সে ভাবছিল, ড্রাইভার মিটারে বিল বাড়ানোর জন্য হয়তো ট্যাক্সির ইঞ্জিন চালু রেখেছে। সে কড়া ভাষায় বলল, ‘অযথা ইঞ্জিন চালু কত বিল বৃদ্ধি করতে পারবে? ড্রাইভার ঘাড় বেঁকিয়ে পেছনে ফিরে তাকায় বলল, শেঠজী ইঞ্জিন তো বন্ধ। খুশিয়া নিজের ভুল বুঝতে পারে আর তার অস্থিরতা আরও বেড়ে যায়। সে আর কিছু বলেনি, বরং নিজের ঠোঁট নিজেই কামড়াতে থাকে। তারপর মাথায় কিস্তি টুপি ঠিকভাবে পরে নিয়ে নিজেকে সামনে নিয়ে সোজা হয়ে বসে। তার ড্রাইভারের কাঁধে ঝাঁকি দিয়ে বলল, ব্যাপার কিন্তু আসলে তা নয়।’কাঠের দোকানের ভেতর থেকে দু’জন লোক বের হয়। একজন খুশিয়ার বন্ধু আর পিছু পিছু কান্তা। নীল প্রিন্ট শাড়ী পরেছে কান্তা। বিশেষ সময়ে কান্তা এই শাড়ী পরিধান করে থাকে। খুশিয়া অন্ধকারের দিকে সরে গিয়ে বসে। খুশিয়ার বন্ধু ট্যাক্সির দরজা বন্ধ করে দেয়। হঠাৎ কান্তা গাড়ীতে খুশিয়াকে দেখে হতবাক আর্তনাদের চীৎকার করে বলল, ‘খুশিয়া তুমি?’ হ্যাঁ,ঃকিন্তু তুমি তো টাকা পেয়ে গেছ তাই না? খুশিয়ার আওয়াজ বন্ধ। খুশিয়া বলল, ‘ড্রাইভার গাড়ী চালাও।’ড্রাইভার সেলফে পা দাবাতেই গাড়ীর ইঞ্জিনে ফরফর শব্দ শুরু হয়। এর ফলে কান্তা যে কথা বলছিল তা শোনা যায়নি। ট্যাক্সি এক ঝটকায় এগিয়ে যায়। খুশিয়ার বন্ধু হতবাক রাস্তায় দাঁড়িয়েছিল আর খুশিয়া গাড়ী নিয়ে আবছা অন্ধকার গলিতে দৃষ্টির আড়ালে দূরে চলে যায়। এরপর খুশিয়াকে মোটর পার্টসের দোকানের সামনে পাথরের পাকা চত্বরে আর কোনদিন দেখা যায়নি। ০
খুশিয়া

উর্দু সাহিত্যের অনন্য কথাশিল্পী সা’দত হাসান মান্টো। প্রেমচন্দের ‘কাফন’ই আধুনিক উর্দু গল্পের মাইল ফলক। উর্দু ছোট গল্প পূর্ণতা পায় মান্টোর হাতে। মান্টোর গল্প পড়লে মনে হয়, কলমের কালি দিয়ে নয় বরং বুকের গরল মিশ্রিত রক্ত দিয়ে তিনি গল্প লিখেছেন। সামাজিক বৈষম্যের কারণে পতিতার সৃষ্টি কিন্তু সমাজ ওদের গ্রহণ করতে রাজী নয়। কিন্তু সমাজের এই অবহেলিতদের বিষাদময় কাহিনী মান্টোর শক্তিধর লেখনীর মাধ্যমে জীবন্ত হয়ে উঠেছে। পতিতালয়ের সুলতানা এবং খুশিয়া প্রভৃতি চরিত্র মান্টোর গল্পে প্রাণ পেয়েছে। কিন্তু সমাজ এদের বরদাস্ত করতে পারে না। তাই মান্টোর রচনাকে অশ্লীলতার অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়। ‘খুশিয়া’ মান্টোর পতিতাদের নিয়ে একটি বিখ্যাত গল্প তার শ্রেষ্ঠ গল্পগুলোর অন্যতম। খুশিয়া ভাবছিল। সে বানোয়ারীর পানের দোকান থেকে কালো জর্দাওয়ালা এক খিলি পান নিয়ে দোকানের পাশে একটি পাকা চত্বরে গিয়ে বসেছিল। এই পাকা চত্বরটি দিনের বেলা মোটরের পুরনো টায়ার ও যন্ত্রাংশের স্তূপ পড়ে থাকে। রাতে সাড়ে আটটার মধ্যে মোটরের যন্ত্রাংশ এবং টায়ার বিক্রির এই দোকান বন্ধ হয়ে যায়। আর পাকা চত্বরটি খুশিয়ার জন্য খালি হয়ে পড়ে। সে কালো জর্দাওয়ালা পান ধীরে ধীরে চিবোতে থাকে। পানের পিক দাঁতের ফাঁক দিয়ে মুখের চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে আর পান সুপারী দাঁতের চিবুনিতে পিকের সাথে মিশে যায়। তাই সে পানের পিক মুখের বাইরে ফেলতে চায় না। খুশিয়া পানের পিক মুখের ভেতর জিহ্বার নাড়াচাড়া করছিল আর আধঘন্টা আগে সংঘঠিত ঘটনা নিয়ে ভাবছিল। সে এই পাথরের চত্বরে যথারীতি বসার আগে বাগান বাড়ীর পঞ্চম গলিতে গিয়েছিল। মঙ্গুর থেকে কান্তা নামে একজন মেয়ে আমদানী হয়েছে। ঐ গলির শেষ প্রান্তে সে থাকে। খুশিয়াকে কেউ একজন জানিয়েছে যে, কান্তা বাসা বদল করবে। এ ব্যাপারে জানার জন্য সে সেখানে গিয়েছিল। কান্তার বাড়ীর অর্ধখোলা দরজায় সে কড়া নাড়ে। ভেতর থেকে আওয়াজ আসে ‘কে এসেছে?’ খুশিয়া উত্তর দিল, ‘আমি খুশিয়া’। পাশের কামরা থেকে আওয়াজ এসেছে। কিছুক্ষণ পর দরজা খুললে খুশিয়া ভেতরে প্রবেশ করে। দরজা বন্ধ করার পর খুশিয়া মোড় ঘুরে পেছনে তাকায় আর সে কান্তাকে সম্পূর্ণ নগ্ন অবস্থায় দেখে হতবাক। পুরোপুরি নগ্ন বলা যায়। সে সারাদেহ একটি তোয়ালে দিয়ে ঢেকে রেখেছিল। তোয়ালের আড়ালে শরীর ঢাকা হয়েছে তাও বলা যায় না। আসলে যা কিছু আড়াল করার দরকার ছিল তার দেহের সব অঙ্গ প্রত্যঙ্গ খুশিয়ার চোখের সামনে উন্মুক্ত ছিল।কান্তা বলল, ‘খুশিয়া কি জন্য এসেছ? আমি গোসল করতে যাচ্ছিলাম, বসো বসো। বাইরে তোমার জন্য চায়ের অর্ডার দিয়ে আসলে মন্দ হতো না। জানোতো মোয়ারামা এখান থেকে পালিয়ে গেছে। খুশিয়া এর আগে কখনও হঠাৎ এরকম নগ্ন কাউকে দেখেনি। সে দারুণ ঘামড়ে যায়। সে উত্তর কি দেবে খুঁজে পাচ্ছিল না। নগ্ন দৃশ্য দেখে সে হতবাক। এখন নিজেকে কোথাও লুকানোর চেষ্টা করছিল। সে তাড়াহুড়ার মধ্যে শুধু জবাব দিল, ‘যাও যাও, স্নান সেরে এসো’ তারপর সে নির্ভয়ে বলল, ‘যখন তুমি নগ্ন, দরজা খোলার কি দরকার ছিল। ভেতর থেকে জবাব দিলে আমি আবার আসতাম। কিন্তু ঠিক আছে যাও স্নান সেরে এসো।’কান্তা মুছকি হেসে বলল, ‘যখন তুমি জবাব দিলে, আমি খুশিয়া। তখন আমি ভেবেছি, আমাদের খুশিয়া অন্য কেউ নয়, এতে আপত্তির কি আছে, আসুক না ভেতরে। কান্তার মুছকি হাসি খুশিয়ার চিন্তা-ভাবনায় সাঁতার কাটছিল। তখনও কান্তার নগ্ন দেহ মোমের পুতুলের মতো, তার চোখের সামনে ভাসছে আর গানে গানে ভেতরে প্রবেশ করছে। তার দেহ বল্লরী ছিল অপূর্ব। প্রথমবারের মতো, খুশিয়ার মনে হয়েছে, দেহের বেসাতি যারা করে সেসব মহিলার গড়ন এমনিই হয়ে থাকে। সে সবচেয়ে বেশী বিস্মিত ও হতবাক হয়েছে, যখন কান্তা এমন স্টাইলে তার সামনে নগ্ন দেহে দাঁড়িয়েছিল অথচ সে সামান্য লজ্জাও পায়নি। কিন্তু কেন? এর উত্তর কান্তাই দিয়েছে, ‘যখন তুমি বললে আমি খুশিয়া, তখন ভেবেছি, আমাদের খুশিয়াই তো, ঘরের ভেতরে আসুক, আপত্তি কিসের।’ কান্তা ও খুশিয়া একই পেশায় নিয়োজিত। খুশিয়া হল তার দালাল। অতএব সে তার নিজস্ব লোক। এমনি খুশিয়ার সামনে কান্তা নগ্ন হয়ে দাঁড়ালে বিশেষ আপত্তি ছিল না। কিন্তু কান্তার বক্তব্যে খুশিয়া অন্য অর্থ খুঁজে বেড়াচ্ছে। এর মর্মান্ত এতই সুস্পষ্ট ও রহস্যজনক যে, খুশিয়া এ বিষয়ে কোন চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারছে না। ঢোলবকের ঢোলের চামড়ার মতো শক্তভাবে টানটান কান্তার নগ্ন দেহ সে তখনও অবলোকন করছিল। তার উদাস দৃষ্টি ছিল অসংযত। সে তার মোহনীয় দেহের দিকে কয়েকবার হতবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখেছে। কিন্তু তার দেহের লোম পর্যন্ত কেঁপে উঠেনি। সে তার অপূর্ব পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়েছিল, যা অনুভূতি ও আবেগে ক্লান্তি আসে।“ভাই তার সামনে একজন পুুরুষ দাঁড়িয়েছিল। পুরুষের দৃষ্টি পোশাক ভেদ করে নারীর দেহে গিয়ে পৌঁছে। একমাত্র পরমাত্মাই জানে, তার চিন্তা-ভাবনা কোথায় কোথায় গিয়ে উপনীত হয়। সে মোটেই ঘাবড়ায়নি। তার দৃষ্টি দেখে মনে হয়, এক্ষুণি লন্ড্রি থেকে কাপড় ধোলাই হয়ে এসেছে। তার তো সামান্য লজ্জা পাওয়া উচিত ছিল। অন্ততঃ তার চোখে মুখে লজ্জার রক্তিম আভা ফুটতে পারতো। মেনে নিলাম, সে একজন পতিতা, কিন্তু উলঙ্গ অবস্থায় দাঁড়াতে পারে না।”দশ বছর হল খুশিয়া দালালী করছে। এই দশ বছরে সে পেশাদার মেয়েদের রহস্য জেনে গেছে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, সে জানে ধুনকরদের গলির শেষ প্রান্তে একটি মেয়ে একজন যুবক ভাই পরিচয় দিয়ে বাসা ভাড়া থাকে। অছ্যুত কন্যা ছবির ‘কাহে করতা মুরখ পিয়ার পিয়ার পিয়ার’ গানের রেকর্ড ভাঙা কলের গানের মেশিনে বাজায়। সে অশোক কুমারকে দারুণ ভালবাসে। কয়েক দফা তাকে বুড়ো অশোক কুমারের সাথে সাক্ষাতের অঙ্গীকার করে বোকা বানিয়েছে। সে আরও জানে যে, দাদর এ একজন পাঞ্জাবী মেয়ে থাকে। ‘মারাকো ওরফে খুনে তামান্না’ ছবির ইংরেজ নায়িকা ‘মরিস ডেট্রাজ’ এর বলিষ্ট পা দুটি খুবই সুন্দর, আর দুই লাখ টাকার বীমাকৃত ছিল। পাঞ্জাবী মেয়েটির পা দুটি নাকি ঐ ইংরেজ নায়িকার মতো, তাই সে পেন্ট কোর্ট পরা শুরু করে আর পেন্ট কোমরে নিতম্বের উপর টাইট হয়ে লেপটে থাকতো। তার আরও জানা আছে যে, দাক্ষিণাত্যের মজগাঁ এলাকার তরুণীটি শুধু কলেজের স্বাস্থ্যবান সুন্দর যুবকদের ফাঁসাবার উদ্দেশ্য একটি ফুটফুটে শিশুর মা হওয়া। আসলে মেয়েটি ছিল বন্ধ্যা, তার এই আশা কোনদিন পূরণ হবে না। আর মাদ্রাজের মেয়েটির কানে সর্বদা হীরের ফুল শোভা পেত কিন্তু সেও ভালো ভাবে জানে যে, তার গায়ের রং কখনও ফর্সা হবে না। আর ফর্সা হওয়া ঔষধ ব্যবহার করে অযথা সে অর্থ ব্যয় করছে। তার নিয়ন্ত্রণাধীন সব পতিতা মেয়েদের ভেতরের ও বাইরের খবর সংবাদ দিল তার নখদর্পণে। কিন্তু কান্তা কুমারীর আসল নাম ছিল বিদঘুট, তাই তার সেই নাম জীবনেও মনে রাখতে পারেনি। সে ভাবতেও পারেনি। কান্তা তার সামনে নগ্ন অবস্থায় এসে দাঁড়াতে পারে। তার জীবনে এটা ছিল বিস্ময়কর ঘটনা। ভাবতে ভাবতে তার মুখে অনেক পানে পিক জমা হয়েছে, যার ফলে সে ছোট্ট ছোট্ট সুপারির টুকরোগুলো চিবাতে পারছে না, দাঁতের ফাঁক দিয়ে পিছনে যাচ্ছে। তার কপালে ছোট ছোট ঘামের বিন্দু দেখা দেয়। যেন মলমল কাপড়ের উপর পনির হালকাভাবে দাবিয়ে দেয়া হয়েছে। তার পুরুষত্বের আত্মসম্মানের উপরে আঘাত লাগে। যখন কান্তার নগ্ন অবস্থায় তার সামনে উপস্থিত হওয়ার বিষয়টি কল্পনায় আসে, তাকে অপমানিত বোধ করে। সে মনে মনে ভাবে, ‘এটা অপমান নয়তো কি হতে পারে? একটি মেয়ে নগ্ন অবস্থায় সামনে এসে দাঁড়াল আর বলে কিনা এতে আপত্তির কি আছে? তুমি আমাদের খুশিয়া। খুশিয়া নয় যেন সে বিড়ালে পরিণত হয়েছে, যেন তার বিছানায় সারাক্ষণ ঘুমায়। আরো কত কি?’ এখন সে ভাবতে থাকে তার সত্যিই অপমান হয়েছে। সে পুরুষ মানুষ। তার আশা ছিল, মেয়ে সে ভদ্র ঘরের হোক বা পতিতা তাকে পুরুষ হিসেবে মেনে নেবে। তারও ওদের মাঝে পর্দার ব্যবস্থা করবে। দীর্ঘদিন এই রীতিই চলছে। কান্তা কবে তার বাড়ী বদল করবে, কোথায় যাচ্ছে সেটা জানার জন্য সেখানে গিয়েছিল। আর কান্তার কাছে তার যাওয়ার কারণ ছিল সম্পূর্ণ ব্যবসায়িক। খুশিয়া কান্তার বক্তব্য বিশ্লেষণ করতে গিয়ে ভাবছে, দরজায় কড়া নাড়ার পর যদি সে দরজা না খুললে হয়তো ভাবতো সে ভেতরে কি করছে? কান্তা মাথায় ওড়না বেঁধে ঘুমিয়ে আছে। নতুবা বগলের লোম পরিষ্কার করছে।
বগলের লোম পরিস্কারের পাউডার দিয়ে লোম পরিষ্কার করার সময় এমন বিশ্রী গন্ধ ছড়ায়, খুশিয়ার নাকে তা সহ্য করতে পারে না। পালংকে একা বসে তাস ছড়িয়ে খুশিয়া পেসান খেলতে থাকতো। এসব ঘটনা তার মনে পড়ছে। ঘরে তখন কাউকে রাখতো না। খুশিয়া একটি কাজে গেছে, কিন্তু সে ভাবতেও পারেনি হঠাৎ কান্তা এভাবেঃ.পোশাকে ঢাকা কান্তা এভাবেঃঅর্থাৎ কান্তাকে সে সর্বদা জামা-কাপড় পরিহিত অবস্থায় দেখেছে সে কিনা তার সামনে সম্পূর্ণ নগ্ন অবস্থায় এসে হাজির হল। পুরোপুরি উলঙ্গ বলা যায়। একটি ছোট্ট তোয়ালে তো সারা দেহ ঢাকতে পারে না। খুশিয়ার এই দৃশ্য দেখে মনে হয়েছে সে নিজেই নগ্ন হয়ে গেছে। ঘটনার এখানেই ইতি হলে কোন কথা ছিল না। খুশিয়া তার হতবাক হওয়ার বিষয়টি কোন না কোন বাহানায় ভুলে যেতো। বিপদ হল, মেয়েটি মুছকি হেসে বলেছে, ‘যখন তুমি বললে আমি খুশিয়া, তখন ভাবলাম, আমাদের খুশিয়াই তো, ভেতরে আসুক মন্দ কি।’তার এই বক্তব্য খুশিয়াকে কুরে কুরে খাছে। ‘শ্যালী মুচকি হাসছিল। তার বার বার মনে হয়েছে, কান্তা যেমন নগ্ন ছিল, তার মুচকি হাসি খুশিয়ার নিজেকেও নগ্ন মনে হয়েছে। শুধু মুচকি হাসি নয়, কান্তার শরীর এতখানি নগ্ন মনে হয়েছে যেন কাঠের উপর মিস্ত্রি রান্দা মেরে মসৃণ করেছে। বাল্যকালের এক ঘটনা তার বার বার মনে পড়ছে। প্রতিবেশী এক মহিলা তাকে বলতো, ‘খুশিয়া বাবা, দৌড়ে গিয়ে তাড়াতাড়ি এক বালতি পানি ভরে আন।’ যখন সে বালতি ভর্তি পানি নিয়ে আসতো তখন ভদ্র মহিলা ধুতির কাপড়ের পর্দার আড়াল থেকে বলতো, ‘ভেতরে আমার পাশে নিয়ে এসো, আমার মুখে সাবান মেখেছি।’ আমি কিছু বুঝতে পারতাম না। ধুতির পর্দা সরিয়ে বালতি ভেতরে নিয়ে তার কাছে রেখে দিতাম। পর্দার ভেতরে সাবান মেখে নগ্ন মহিলাকে আমার নজরে পড়তো। কিন্তু আমার মনে কোন যৌন চেতনা অনুভূত হতো না।
‘ভাই আমি তো তখন কিশোর। আত্মভোলা ছিলাম। কিশোর আর পুরুষের মাঝে অনেক পার্থক্য। এখন আমার বয়স ২৮-এর কাছাকাছি আর ২৮ বছরের যুবকের সামনে কোন বৃদ্ধা মহিলাও উলঙ্গ দাঁড়াতে পারে না।’কান্তা তাকে কি মনে করে। একজন যুবক পুরুষের কাছে যা থাকে তা কি তার মাঝে অনুপস্থিত? কান্তার নগ্ন দেহ দেখে সে ঘাবড়ে গেছে, এতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু কান্তার দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সে কখনও লুকিয়ে পর্যালোচনা করে দেখেনি, যা দৈহিক ব্যাপারে ব্যবহারের পর আসলরূপে বহাল-তবিয়তে আছে। আশ্চর্যের বিষয় কখনও তার মনে হয়নি, কান্তাকে উপভোগ করার মূল্য দশ টাকা দাম চড়া। শারদীয় পূজার দিনে ব্যাংকের কেরানী দু’টাকা কনসেশান না দেয়ায় ফেরত দিয়েছিল। বেচারীর কপাল মন্দ। সর্বোপরি এক মুহূর্তের জন্যও চেতনায় কোন বিচিত্র অনুভূতি বা আকর্ষণ সৃষ্টি হয়নি। সে এমনভাবে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে মোচড় দিতে চায় না, যা তার দেহের হাড় পর্যন্ত ব্যথা করুক। এরপরও মঙ্গুরের লাবণ্যময়ী মেয়ে তাকে পুরুষ মনে করে না এবং শুধুমাত্র খুশিয়া মনে করে তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দেখতে ছিল।রেগে সে পানের পিক মুখ থু দিয়ে ফুটপাতে নিক্ষেপ করে। ফুটপাতে এর ফলে কয়েকটি বুদবুদের সৃষ্টি হয়। পিক ফেলে সে ট্রামে চড়ে বাড়ীতে চলে যায়। বাড়ীতে গিয়ে স্নান সেরে ধুতি পরে তারই দালানে অবস্থিত সেলুনে গিয়ে হাজির। সেলুনে গিয়ে সে আয়নায় মাথা আচড়ে নেয়। আবার হঠাৎ কি জানি নতুন চিন্তা-ভাবনায় চেয়ারে বসে পড়ে তারপর নাপিতকে তার দাড়ি শেভ করার নির্দেশ দেয়। সেদিন দ্বিতীয় দফা সে দাড়ি শেভের কথা বলছে তাই নাপিত বললো, ‘আরে ভাই খুশিয়া তুমি কি ভুলে গেছ? সকালেই তো তোমার দাড়ি শেভ করে দিয়েছি।’এ কথা শুনে খুশিয়া গাম্ভীর্যের সাথে দাঁড়িতে হাত হাত বুলায় জবাব দিল, ‘দাড়ির শেকড় ভালভাবে কাটা হয়নি।’ ভালভাবে শেভ করে আর মুখে পাউডার দিয়ে সে সেলুন থেকে বের হয়। সামনে ট্যাক্সি স্ট্যান্ড, ট্যাক্সির আড্ডা। বোম্বাই-এর বিশেষ স্টাইলে, সে চিচি শব্দে একটি ট্যাক্সিকে ইঙ্গিতে তার কাছে ডাকে। সে দ্রুত ট্যাক্সিতে চড়ে বসে। ট্যাক্সি ড্রাইভার পেছনে ফিরে তার কাছে জানতে চায়, ‘কোথায় যাবেন সাহেব?’এই তিনটি শব্দের মধ্যে ‘সাহেব’ শব্দটি তাকে বেশী উৎফুল্ল করে। সে বন্ধুত্বসুলভ আওয়াজে উত্তর দিল, ‘বলবো? প্রথমে তুমি অপেরা হাউস যাও। লেমিংটন রোড দিয়ে যাবে বুঝলে? ড্রাইভার মিটারের লাল হাতল ঘুরিয়ে নীচে নামিয়ে দেয় তার যথারীতি ট্যাক্সি লেমিংটন রোডের দিকে যাত্রা করে। রোডের শেষ কোনায় আসলে খুশিয়া ড্রাইভারকে বাঁয়ে মোড় নেয়ার নির্দেশ দেয়। ট্যাক্সি বাঁয়ে মোড় ঘুরায়। তখনও ড্রাইভার গিয়ার পর্যন্ত বদলায়নি, খুশিয়া ড্রাইভারকে সামনে খাম্বার কাছে আসতে বলল। ড্রাইভার রাস্তার ধারে লাইট পোষ্টের পাশে গাড়ী থামায়। খুশিয়া দরজা খুলে গাড়ী থেকে নেমে একটি দোকানের দিকে এগিয়ে যায়। দোকান থেকে এক খিলি পান নিয়ে, দোকানের পাশে দাঁড়ানো লোকটির সাথে আলাপ করল। তারপর লোকটিকে সাথে নিয়ে ট্যাক্সিতে চড়ে বসে আর ড্রাইভারকে নির্দেশ দিল, ‘সোজা সামনে গাড়ী চালাও।’অনেকক্ষণ ট্যাক্সি এগিয়ে যায়। খুশিয়া যেদিকে ইশারা করেছে, ড্রাইভার সেদিকে ট্যাক্সি চালিয়ে এগিয়ে গেছে। অনেক আলো ঝলমল বাজার পেরিয়ে ট্যাক্সি একটি আবছা অন্ধকার গলিতে প্রবেশ করে যেখানে মানুষের আনাগোনা কম ছিল। কিছু লোক সড়কের পাশে শুয়েছিল। এদের মধ্যে কয়েকজন আনন্দের সাথে মাথা মালিশ করাচ্ছে। এদের অতিক্রম করে ট্যাক্সি এগিয়ে যায়। তারপর একটি কাঠের বাংলোর মতো বাড়ীর সামনে পৌঁছলে খুশিয়া ট্যাক্সিওয়ালাকে সেখানে আসতে বলল আরও নির্দেশ দিল, এখানে গাড়ী থামাও।’ ট্যাক্সি থামলে খুশিয়া সঙ্গী লোকটিকে। যাকে পানওয়ালার দোকান থেকে সঙ্গে এনেছিল, তাকে ধীরকক্তে বলল, ‘যাও, আমি এখানে অপেক্ষা করবো। লোকটি বোকার মতো খুশিয়ার দিকে তাকায় তারপর ট্যাক্সি থেকে বেরিয়ে কাঠের তৈরী বাড়ীতে প্রবেশ করে। খুশিয়া ট্যাক্সির ভেতর সিটে আরামে বসেছিল। সে পায়ের উপর পা দিয়ে বসেছিল আর পকেট থেকে বিড়ি বের করে ম্যাচের কাঠি দিয়ে বিড়ি জ্বালায়, তারপর দু’একটি কষে টান দিয়ে বিড়ি রাস্তায় ছুঁড়ে ফেলে দেয়। সে অস্থির অবস্থায় বসেছিল। সে অনুভব করছিল, ট্যাক্সির ইঞ্জিন বন্ধ হয়নি। তার পর বুক ধড়ফড় করে উঠে। সে ভাবছিল, ড্রাইভার মিটারে বিল বাড়ানোর জন্য হয়তো ট্যাক্সির ইঞ্জিন চালু রেখেছে। সে কড়া ভাষায় বলল, ‘অযথা ইঞ্জিন চালু কত বিল বৃদ্ধি করতে পারবে? ড্রাইভার ঘাড় বেঁকিয়ে পেছনে ফিরে তাকায় বলল, শেঠজী ইঞ্জিন তো বন্ধ। খুশিয়া নিজের ভুল বুঝতে পারে আর তার অস্থিরতা আরও বেড়ে যায়। সে আর কিছু বলেনি, বরং নিজের ঠোঁট নিজেই কামড়াতে থাকে। তারপর মাথায় কিস্তি টুপি ঠিকভাবে পরে নিয়ে নিজেকে সামনে নিয়ে সোজা হয়ে বসে। তার ড্রাইভারের কাঁধে ঝাঁকি দিয়ে বলল, ব্যাপার কিন্তু আসলে তা নয়।’কাঠের দোকানের ভেতর থেকে দু’জন লোক বের হয়। একজন খুশিয়ার বন্ধু আর পিছু পিছু কান্তা। নীল প্রিন্ট শাড়ী পরেছে কান্তা। বিশেষ সময়ে কান্তা এই শাড়ী পরিধান করে থাকে। খুশিয়া অন্ধকারের দিকে সরে গিয়ে বসে। খুশিয়ার বন্ধু ট্যাক্সির দরজা বন্ধ করে দেয়। হঠাৎ কান্তা গাড়ীতে খুশিয়াকে দেখে হতবাক আর্তনাদের চীৎকার করে বলল, ‘খুশিয়া তুমি?’ হ্যাঁ,ঃকিন্তু তুমি তো টাকা পেয়ে গেছ তাই না? খুশিয়ার আওয়াজ বন্ধ। খুশিয়া বলল, ‘ড্রাইভার গাড়ী চালাও।’ড্রাইভার সেলফে পা দাবাতেই গাড়ীর ইঞ্জিনে ফরফর শব্দ শুরু হয়। এর ফলে কান্তা যে কথা বলছিল তা শোনা যায়নি। ট্যাক্সি এক ঝটকায় এগিয়ে যায়। খুশিয়ার বন্ধু হতবাক রাস্তায় দাঁড়িয়েছিল আর খুশিয়া গাড়ী নিয়ে আবছা অন্ধকার গলিতে দৃষ্টির আড়ালে দূরে চলে যায়। এরপর খুশিয়াকে মোটর পার্টসের দোকানের সামনে পাথরের পাকা চত্বরে আর কোনদিন দেখা যায়নি। ০

0 comments:

Post a Comment