Tuesday, July 5, 2016

পাগলা হাওয়া


পাগলা হাওয়া
ফোরকান আলী
দিঘীর মনে হচ্ছে মেঘের ওপর দাঁড়িয়ে আছে এখন। মেঘ ভেসে যাচ্ছে, সেও ভেসে যাচ্ছে। এ যেন কল্পনা নয়, বাস্তব। মেঘ থেকে বৃষ্টি ঝরে, মুষলধারে বৃষ্টির পর মেঘখন্ড মিলিয়ে যায়, পরিচ্ছন্ন আকাশ দেখা যায়।
শেফালীর জীবনে পরিছন্ন আকাশ কি আর দেখা যাবে ? মনের আকাশের মেঘ কি দূর হবে?
ফিল্ম, নাটক, এ্যাড, কার্টুন সব কিছুর স্বাদ বদলে দিয়েছে কম্পিউটার জেনারেটেড এনিমেশন। বাংলাদেশেও এ ধরনের প্রযুক্তির চাহিদা বেড়েছে। এ্যাড বা সিনেমাতে কম্পিউটার গ্রাফিক্সের ব্যবহার হচ্ছে, মেঘের ওপর দাঁড়িয়ে নায়িকা উড়ে যাচ্ছে দূরে, ঠোঁট মেলাচ্ছে রোমান্টিক গানের সাথে, বর্ষার মাঝে দুবাহু ছড়িয়ে বিস্তীর্ণ আকাশ বুকে পুরে নিচ্ছে, দেখতে ভালোই লাগে।
এনিমেশনের চিত্র আর জীবনের চিত্র কি এক হতে পারে ?
শেফালী জানে না কোথায় যাচ্ছে সে। বাস্তব জীবনের মেঘের ঘূর্ণি অনিশ্চয়তার পথে ঠেলে দিচ্ছে তাকে।
উড়ন্ত মেঘের ঘূর্ণি থেকে নিরাপদে দাঁড়াতে চায় সে স্থির মাটিতে।
একা দাঁড়াবে?
কে বাড়াবে হাত?
দাঁড়াতে হলে কি কারো হাত ধরতেই হবে ?
বাইশ বছরের অভিজ্ঞতায় বুঝে গেছে, অসংখ্য হাত এগিয়ে আসবে। বোকার মতো বাড়ানো হাতে হাত রাখলে ঝলসে যেতে পারে নিজের হাত। নির্ভরতা আর বিশ্বাসের বড়ই অভাব। চারপাশে গুণগ্রাহীর অভাব নেই। অভাব কেবল বিশ্বাসের । দ্বিধাগ্রস্থ মনে ভালোবাসার রঙিন ফানুস ওড়ে। ফানুস সহজে ফুটো হয়ে যায়, চুপসে যায়। শেফালী স্থায়ী সম্পর্ক চায়। স্থায়ী মাটি চায়। স্থায়ী ভালোবাসা চায়। চাওয়া পূরণ হয় না। স্থায়ী কিছু পেতে হলে কি তবে কম্পিউটার এনিমেশনের হেলপ নিতে হবে ? ইচ্ছে-পূরণ যন্ত্র কোথায় পাবে সে ?
এ সময় টুং করে শব্দ হয়।
টুং শব্দের অর্থ হচ্ছে, মোবাইলে এসএমএস এসেছে। বালিশের পাশে ছিল সেলফোন।
বালিশ থেকে মাথা টেনে তুলে শরীর ঘুরিয়ে অলস হাত বাড়ায় বালিশের পাশে। ফোনসেট হাতে নিয়ে চোখের সামনে তুলে ধরে। ডিসপ্লেতে শোভা পাচ্ছে ‘নিউ মেসেজ’। শব্দটির দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকে।
কে পাঠাল মেসেজটি?
কী আছে মেসেজে?
প্রশ্ন জাগে মনে। আগ্রহ জাগে না, দেখার লোভ হয় না।
সেলফোন রেখে দেয় শেফালী।
আবার টুং করে শব্দ হয়। আবার এসেছে মেসেজ।
এবারও সেট তুলে নেয় হাতে।
একই মেসেজ ? নাকি দুজনের পাঠানো দুটি মেসেজ ?
প্রশ্ন জাগার সাথে সাথে এবার মেসেজটি পড়ার জন্য ডিসপ্লেতে যায় সে। এ মেসেজটি পাঠিয়েছে রিনেট, দিঘীর ফ্রেন্ড। ফোনবুকে রিনেটের নাম আছে। তাই নাম ফুটে আছে। অদ্ভূত মেসেজ পাঠিয়েছে সে। একবার কাছ থেকে আবার দূর থেকে দেখে বোঝার চেষ্টা করে মেসেজটির অর্থ। অর্থ বুঝতে পারে না দিঘীর । হঠাৎ বুঝতে পারে সেটের ডিসপ্লেতে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছে কুড়িটি ল্যাংটো পুরুষ।
ল্যাংটো পুরুষ! কুড়িটি ? কেন ? এ কান্ড কেন করল রিনেট ?
দিঘী এখন আর কল্পিত মেঘের ওপর দাঁড়িয়ে নেই। আছে নিজের ঘরে। অনাগ্রহী মনে নাড়া টের পায় সে। মৃদু হেসে ওঠে। রিনেটের দুষ্টুমি ভালোই লাগে। সবার মনে খোঁচা দিতে জানে সে। খোঁচা দিয়ে আনন্দ জাগিয়ে তুলতে পারে। শেফালীর মনে আনন্দ জাগেনি, তবে একটু আগের মনের অবস্থা বদলে গেছে।
মেসেজ অপশন থেকে কলবেক এ আসে, ইয়েস বাটনে টিপে কানেক্ট করে রিনেটকে।
ফোন রিসিভ করে খলবলিয়ে হাসতে থাকে রিনেট। হাসতে হাসতে বলে, কীরে, কী বুঝলি ?
শেফালী বলে, ল্যাংটো পুরুষ পাঠিয়েছিস কেন ?
রিনেট আবার হাসিতে লুটিয়ে পড়ে। হাসতে হাসতেই বলে, তুই ল্যাংটো পুরুষ দেখেছিস ?
হ্যাঁ তাই তো দেখলাম।
আমি তো ল্যাংটো পুরুষ সেন্ড করিনি। একসারি ইংরেজি বর্ণ ছোট হাতের র্‘’ পাঠিয়েছি।
বলিস কি ? আমি তো ঃ. ।
তুই তো ল্যাংটো পুরুষই দেখবি, তোর মন ওটাই দেখতে চেয়েছে, চোখ বোধ হয় দেখেছে ওই রকম পুরুষ। তাই তো ওভাবে দেখেছিস । ভালো করে দেখ মেসেজে আছে কুড়িটি ইংরেজি ছোট হাতের বর্ণ ঃ ঃ ঃ ঃ ঃ ঃ ঃ ঃ ঃ ঃ ঃ ঃ ঃ ঃ .
 শেফালী হাসতে হাসতেই বলে, ফাজিল কোথাকার!
শোন্, ফাজিল আমাকে বলিস না। ফাজিল বল্ আননোন নম্বর থেকে মেসেজ পাঠানো অদৃশ্য প্রেরককে।
মানে?
মানে সহজ। একটু আগে অজানা নম্বর থেকে আমার কাছে মেসেজটি এসেছে। সেটিই আমি তোর কাছে ডাইভার্ট করে দিয়েছি।
তাই নাকি? প্রশ্ন করেই থেমে যায়  শেফালী। একটু আগে তার নম্বরেও একটি মেসেজ এসেছিল। সেটি পড়া হয়নি।
রঞ্জনের সাথে কথা শেষ করার আগেই লাইন কেটে দেয়, মেসেজ অফশনে গিয়ে আনরিড মেসেজটি ডিসপ্লেতে ফুটিয়ে তোলে।
হ্যাঁ, মন যা বলেছিল তাই হয়েছে। একই মেসেজ পাঠানো হয়েছে তার কাছে। অর্থাৎ একই প্রেরক দু’জনের কাছে একই সিম্বলিক মেসেজ পাঠিয়েছে। একবার ইচ্ছে হলো ‘কলবেক’ করে শাসিয়ে দেবে প্রেরককে। একটু ভেবে নেয়। ভেবে ঠিক করে, এখন নয়। পরে ঠাণ্ডা মাথায় জবাব দেবে এই বিটলামির।
বিছানা থেকে উঠেই আয়নার সামনে আসে। আয়নায় নিজের মুখ দেখতে ইচ্ছে করে না। তবুও একবার থমকে দাঁড়ায়। নিজের চুলের ওপর দিয়ে হাত বোলায়। চুলে সাজ নেয় না বললেই চলে। কোনো ধরনের ঝামেলায় না গিয়ে চুলগুলো পেছনে টেনে নিয়ে পাঞ্চক্লিপে আটকে দেয়। এটাও একটা সাধারণ ফ্যাশন। তবে নিজেকে ফ্যাশনেবল ভাবে না সে। সালোয়ার-কামিজ পরে বেরোনের সময় মাঝেমাঝে ফ্রেঞ্চরোল করে নেয়। কখনও পাঞ্চক্লিপে স্টোন সেটিং আটকে বের হয়। সবগুলোই দ্রুততার সাথে সেরে নিতে অভ্যস্ত শেফালী এখন দ্রুততা নেই বললেই চলে। বর্তমান মুহূর্তে নিজের ভেতরের গতি আটকে গেছে। কোথায় নট লেগেছে বুঝতে পারে না। তবে অঙ্কনের পাঠানো ‘ডাইভারটেড’ মাসেজটি বোধ হয় সামান্য গতি দিয়েছে।
সেলফোনে আবারও শব্দ হয় ‘টুং’।
 শেফালী আয়নার সামনে থেকে বিছানার কাছে আসে। সেলফোন হাতে নিয়েই দেখে ‘নিউ মেসেজ’। অঞ্জনের নাম ভেসে আছে। মেসেজটি পড়ে নেয় সে- একলাইনে সারিবদ্ধ কুড়িটি ইংরেজি বর্ণ শ শ শ শ শ শ শ শ শ শ শ শ শ শ ।
মানে কি ? এটাও কি ডাইভারটেড এসএমএস ? কে পাঠায় ?
বিশটি শ পাঠানোর সাংকেতিক অর্থ কী? ভাবনা শেষ হয় না। আবার টুং করে শব্দ হয় সেলফোনে। আবার মেসেজ এসেছে। অজানা নাম্বার থেকে এসেছে মেসেজটি। পূর্বের অজানা একই নাম্বার থেকেই কি এসেছে মেসেজটি ?
এই মেসেজও বিশটি শ, প্রেরকের একই নাম্বার।
উদ্দেশ্য কি ?
মেসেজ অপশন থেকে কলব্যাকে আসে শেফালী। ইয়েস বাটনে চাপ দিয়ে অপেক্ষা করে। কয়েক সেকেন্ডের মাঝেই সেকেন্ডের ধাবমান সিগনাল ভেসে ওঠে। লাইন কানেক্ট হয়ে গেছে।
শেফালী ভনিতা ছাড়া জোরাল স্বরে বলে, বলুন কে কথা বলছেন?
অপর পক্ষ থেকে উত্তর নেই।
আবারও শাসায় শেফালী, বলুন কে কথা বলছেন ?
এবার উত্তর আসে, কথা বলিনি। এসএমএস পাঠিয়েছিলাম। চুপ করেছিলাম। এই মাত্র মুখ খুললাম।
মুখ বন্ধ করে দেব। শেফালীর কণ্ঠে জোর আসে। সাহস আসে।
মুখ বন্ধই আছে। বন্ধ করার প্রয়োজন নেই।
শেফালীর রাগ বেড়ে যাচ্ছিল। নিজের ওপর থেকে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলছিল, উত্তপ্ত হয়ে যাচ্ছিল মন। অপর পক্ষের নিয়ন্ত্রিত স্বাভাবিক স্বর থমকে দেয় তাকে। থমকানোর সাথে সাথে নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে শীতল স্বরে বলে, এ ধরনের এসএমএস পাঠাচ্ছেন কেন?
আমার ইচ্ছে।
ইচ্ছে মানে?
ইচ্ছে মানে ইচ্ছা, আগ্রহ, অভিলাষ, অভিপ্রায়, আকাঙ্খা কামনা, বাসনা।
বাঁদরামি করবেন না।
বাঁদরামি না, মনরামি করছি।
মনরামি! সে আবার কি ?
মানে, মনের রঙে রাঙানি।
কজনকে রাঙাচ্ছেন?
কোনো রকম জড়তা নেই, ভনিতা নেই, কণ্ঠে আছে সজীবতা। সজীবতা ঢেলেই উত্তর দেয় ছেলেটি, দুজনকে। একজন শেফালী অন্যজন অঞ্জন, দুইবান্ধবী।
ওঃ। তাহলেঃ.
কথা লুফে নেয় ছেলেটি, আমার নাম অয়ন। আমার দুজনকেই পছন্দ। তাই দুজনের কাছেঃ।
শেফালী বলে, অঞ্জনতো একজনকে পছন্দ করে।
জানি, অঞ্জনের পছন্দ নোয়েল।
শেফালী আবার বলে, আমারও পছন্দের মানুষ আছে।
জানি আপনার পছন্দ আপনারই এক হ্যান্ডসাম ম্যারিড টিচার।
তাতে আপনার অসুবিধে কোথায় ?
আমার অসুবিধে নেই। সুবিধা আছে।
সুবিধা কি ?
সুবিধা হচ্ছে, আমি একাই দুজনকে পছন্দ করব। দুজনের কেউ আমাকে পছন্দ করবে না। একা একা একসাথে দুজনকে মনে পুরে আমি সুখ পাব।
আপনি অসুস্থ।
হা হা হা ঃ আপনি কি সুস্থ ?
অবশ্যই সুস্থ। শেফালীর জোরালো স্বর।
সুস্থ হলে ম্যারেড টিচারের সাথে হাবুডুবু খাচ্ছেন কেন ?
আমার ইচ্ছা।
আমারও ইচ্ছা, আপনাদের দুজনের কাছে এসএমএস পাঠাব।
শেফালীর কথা থেমে যায়। দুর্বল পয়েন্টে টোকা দিয়েছে অয়ন। ‘ম্যারেড টিচার’ শব্দটি ব্লক করে দিয়েছে ব্রেইন। থেমে গেলে চলবে না। অ্যাটাকিং এটিচুড নিয়ে ফোন করেছে নিজে। এ্যাটাক উইথড্র করা যাবে না। এগোতে হবে। আঘাত হানতে হবে। আঘাত না হানলে ভবিষ্যতে অয়নের জ্বালাতন থেকে রেহাই পাওয়া যাবে না। টিচারের সাথে সম্পর্ক করা যাবে না এমন কোনো সামাজিক রীতি নেই। ম্যারিড আনম্যারিড দিয়ে সম্পর্কের মাঝে দেয়াল তোলা যায় না। তবে আনম্যারেড মেয়েদের অনেক সাবধানী হতে হয়, কেবল আবেগ দিয়ে চলতে গেলে ঝামেলায় জড়াতে হয়। শেফালী ঝামেলায় জড়িয়েছে। নাটক করতে গিয়ে বিজয় স্যারের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে মিশেছে। মেলামেশায় ছিল শ্রদ্ধার রঙ, নির্ভরতার রঙ। রঙ বদলে গেছে। শ্রদ্ধার ফাঁক-ফোকর দিয়ে মনে এসেছে ভালোলাগা। ভালোলাগা সামাল দিতে পারছে না। নিজে পারছে না, বিবজয় স্যারও না। কোথায় যাচ্ছে, জানে না সে। মনে জেদ এসে নাড়িয়ে দেয় তাকে। অয়নের যুক্তিতে ধরাশায়ী হওয়া চলবে না।
গলায় জোর ফিরিয়ে এনে শেফালী বলে, ব্রেইন একসাথে দুজনের জন্য ভালোলাগা তৈরি করতে পারে না। আমাদের দুই বান্ধবীকে পছন্দের অজুহাত হচ্ছে ভন্ডামি। আপনি ভন্ড। এজন্য অন্যের দুর্বলতা খুঁজে ঢিল মেরে মজা কুড়ানোর চেষ্টা করছেন।
তাহলে স্বীকার করছেন আপনার দুর্বল পয়েন্ট আছে ?
প্রত্যেকের জীবনে দুর্বল পয়েন্ট থাকতে পারে। আমারও থাকতে পারে। তবে আপনি যেটাকে দুর্বলতা হিসেবে মেপেছেন সেটা মোটেই আমার দুর্বল বিষয় নয়। মনের শ্রদ্ধার জোরাল অংশটাকে দুর্বল পয়েন্ট ভেবে ভুল করছেন !
তাহলে বিজয় স্যারের সাথে কি ভদ্রমেয়ের খেলা খেলছেন? আপনি কি শ্রদ্ধার খেলুড়ে?
সাবধানে কথা বলুন। ভদ্রতা বজায় রাখুন।
ভন্ডরা তো ভদ্রতা বজায় রাখবে না, এটাই স্বাভাবিক। ভন্ডরাই একসাথে দুজনকে পছন্দ করবে, এটাও স্বাভাবিক। তবে কেউ দুজনকে পছন্দের কথা স্বীকার করে, যেমন আমি। কেউ স্বীকার করবে না, যেমন আপনি।
মানে?
মানে সহজ। বিজয় স্যারের সাথে চললেও, বিজয় স্যারকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেন না আপনি, স্বপ্ন দেখেন নিত্যকে নিয়ে। নিত্য মেধাবী, নিত্য বড়লোকের ছেলে, নিত্য  হ্যান্ডসাম।
দপ্ করে নিভে যায় শেফালী। ‘ নিত্য’ শোনার সাথে সাথে আচমকা ঝাঁঝাঁ শব্দে কানের মধ্যে ঝড় শুরু হয়। এ ছেলে সবই জানে। ও কি নিত্য’র অন্তরঙ্গ কেউ? মনে প্রশ্ন আসার সাথে সাথে জমে যায় সে। অ্যাটাকিং এটিচুড নিয়ে ফোন করেছিল, নিজেই এখন আক্রান্ত হয়েছে। কী করবে, কী বলবে বুঝতে পারছে না। চট করে লাইন কেটে দেয় সে।
কান গরম হয়ে গেছে। মাথা জ্যাম হয়ে গেছে। হাঁসফাঁস লাগছে। দম বন্ধ হয়ে আসছে। একবার বড় করে শ্বাস টেনে নেয় শেফালী। শ্বাস ছেড়ে বেডরুমের সাথে বারান্দার দিকে পা বাড়ায়। মরা বিকেলের ম্লান রোদে আশ্রয় খোঁজে। এক চিলতে বারান্দার দেয়ালে আছে উজ্জ্বল রং। উজ্জ্বল রং ম্লান লাগছে। মনের ঔজ্জ্বল্যে ছায়া পড়ে গেছে, এ কীসের ছায়া, জানে না সে।
টুং করে মোবাইলে আবার শব্দ হয়।
আবার এসএমএস এসেছে:
ঃ মানে ল্যাংটো বিজয়, যার সাথে চলে ঃ।
শ মানে নিত্য যাকে দেওয়া যায় করংংঃ অয়ন।  শেফালীর বুকে এসে আঘাত করে স্কাড। চট করে একদম চুপ হয়ে যায়। শান্ত মনে মেসেজটি আবার পড়ে সে। অয়নের প্রতি রাগ কমে যায়। নিজেকে একবার ব্যবচ্ছেদ করে, নিজেকে দেখার চেষ্টা করে। সক্রেটিসের কথা মনে পড়ে, ‘নো দাইসেলফ।’ নিজেকে জানা কি এত সহজ?
টিভিতে দেখানো ব্ল্যাক ফাইটার কয়েল এর বিজ্ঞানটি এনিমেশন নির্ভর। টিভি খুললেই বিজ্ঞাপনটি চোখে পড়ে। ব¬্যাক বেল্টধারীর সামুরাই অ্যাকশনে তরবারীর ক্ষিপ্র আঘাতে ক্ষুদ্র মশা বিদ্ধ হয়। অয়নের ক্ষিপ্র শব্দবুলেটেও যেন বিদ্ধ হয়েছে শেফালী। সামুরাই একশনের এ্যাডটি শুটিং এ সময় লেগেছে ৪ ঘন্টা, চিত্র ধারণ করা হয়েছে ডিভি ৪০০ ও জেভিসি ২৪ পি এইচডি ক্যাম দিয়ে। ফ্ল্যাক্স ট্রাক ব্যবহার করে ৯০ ডিগ্রি মাট্রিক্স ধরনের শটটি তৈরিতে সফটওয়্যার ব্যবহার করা হয়েছে থ্রিডি স্টুডিও ম্যাক্স, এডবি প্রিমিয়ার, সেফায়ার ও স্টেডি মুভ প্লাগ ইন, পার্টিকাল ইলিউশন ইত্যাদি। এই টেকানোলোজির কথা ম্যাগাজিনে পড়েছে শেফালী। এ অসাধারণ প্রযুক্তি নির্ভর বিজ্ঞাপনটি সাকসেসের কথা বলে, মশার বিরুদ্ধে বিজ্ঞানীদের বিজয়ের কথা বলে। অয়নের শব্দবুলেট কী মেসেজ নিয়ে এসেছে? এই বুলেট কি মুহূর্তেই নিজেকে ছিন্নভিন্ন করে দেয়নি?  শেফালী ৯০ ডিগ্রীতে ছিন্নভিন্ন এক রমণীকে দেখার সুযোগ পাচ্ছে। মর্ডানাইজেশনের যুগে কোন্ পথে যাচ্ছে সেঃ. ভাবতে গিয়ে কেঁপে ওঠে, ঃ এবং শ এর ওপর আবার চোখ বোলায়ঃ. যেন পার্টিকেল ইলিউশন ছড়িয়ে গেছে বর্ণ দুটির ওপর দিয়ে, থ্রিডি স্টুডিও ম্যাক্স সফটওয়ারের চালে ভেসে ওঠে সত্যিকার ল্যাংটো পুরুষ, কেউ যেন ক্ষিপ্র তরুণীকে চুমু দিয়ে ফালা ফালা করে দিচ্ছে।
চোখ বন্ধ করে শেফালী ।
বন্ধ চোখের গলি পেরিয়ে মনের পর্দায় চিত্রটি বার বার ভেসে উঠছে যেন ডিভি ৪০০ ও জেভিসি ২৪ পি এইচডি ক্যাম বিভিন্ন কৌণিক বিন্দু থেকে চিত্রটি ঢুকিয়ে দিচ্ছে নিউরনের ডিএনএ-এর গোপন ঘরে।
ভেতর থেকে অস্থিরতা জেগে ওঠে। একদম গভীর থেকে ধেয়ে আছে অশান্তি। একবার মনে পড়ে বিজয় স্যারের কথা, আবার মনে ভাসে নিত্যর মুখ। দুজনকেই মন চায়। কেন চায়?
অয়ন কি সব জেনেই এমন কান্ড করছে ? এজন্যই কি দুজনকে পছন্দের কথা বলছে? অঞ্জন এবং  শেফালীকে কি তবে সে সাংকেতিক অর্থে ব্যবহার করছে, বিজয় স্যার এবং নিত্যকে তুলে ধরেছে।
বারান্দা থেকে ফিরে আসে সে বেডরুমে।
আয়নার সামনে দাঁড়ায়।
নিজেকে চেনা যাচ্ছে না। অচেনা লাগছে। দ্বৈত সত্তা কাজ করে নিজের মনে। একসত্তায় আছে বিজয় স্যার, অন্য সত্তায় নিত্য। প্রায় দ্বন্দ্বে ভুগতে হতো। এখন আর দ্বন্দ্ব নেই। স্পষ্টই দৃশ্যমান হয়েছে দুজন। একের ভেতর দুয়ের চাষাবাদ কি সম্ভব?
নিত্য না বিজয় স্যার? প্রশ্ন করে নিজেকে। উত্তর পায় না। উত্তর পাওয়ার আগেই মন চলে যায় পেছনে। পেছনের একটি ঘটনায় ডুবে যায় শেফালীঃ
খুলনা ভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছে শেফালী, অয়ন এবং নিত্য।
মেয়েদের হলের সামনে বিকেলে আড্ডা দেয় ওরা। ছেলে মেয়ে চার পাঁচ জনের একেকটা গ্র“প একেক দিকে বসে থাকে। হইচই করে। বাদাম চিবোয়, পাকা কলার ছাল ছড়িয়ে কলার নরম মাংসে কামড় সবায়। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে, আড্ডা থামে না। কেউ কেউ উঠে যায়। কেউ কেউ বসে থাকে। সামনে ছোটছোট টিনের ছাউনি, ছোট স্টল, চা-বিস্কুট, কলা বিক্রি হয়। সামনে ছোট খুঁটিতে বসানো চিকন তক্তার বেঞ্চি। বেঞ্চিতে বসে আড্ডা চলে। শুকনো মৌসুমে অনেকে দূরে লেকের পাড়ে ঝোপের পাশে বসে। সুকনো লতাপাতা ঝোপঝাড় পেরিয়ে লেকের পানি, লেকের পাড়ের কাছে পানিতে ভসে থাকে ডুবানো শাপলা, মাঝে মাঝে ফুটে থাকে শাপলা ফুল। চিকন সূতোর মতো দাগ কেটে ক্ষিপ্র গতিতে ছুটে চলে পানিতে ভাসমান পোকামাকড়।
একদিন বসে আছে শেফালী, নিত্য, অয়ন ।
অয়ন বলে ওঠ শেফালী, কাল জরুরী ক্লাস আছে। ক্লাসের পড়া রেডি করতে হবে।
বোস্ ে শেফালী বলে, আর একটু বোস্।
অয়ন বলে, তুই থাক। নিত্য’র  সাথে আড্ডা দে।
নিত্য বলে বোস্ না অয়ন। নিত্য, বলে বসতে, বলার জন্য ধন্যবাদ। আর একদিন বেশিক্ষণ থাকব। আজ যাই।
অয়ন চলে যায়।
শেফালী বসে থাকে। নিত্য  বসে থাকে। বসে থাকতে ভালো লাগে। কথা বলতে ভালো লাগে। দু’জনেরই ভালো লাগে। কেন ভালো লাগে জানে না শেফালী । জানে না কিসলু।
নাদিয়ার মনে হয় নিত্য  তার বন্ধু।
নিত্য’র   মনে হয় শেফালীও তার ফ্রেন্ড/বন্ধু।
কে ছেলে কে মেয়ে সেটা নিয়ে মাথাও ঘামায় না তারা। বসে থাকতে ভালো লাগে, উঠতে ইচ্ছে করে না।
এভাবে চলে প্রায় প্রতিদিন।
ওইদিন ঘটে ভিন্ন রকম কান্ড।
নিত্য   উঠতে চায় না। প্রায় ন’টা বেজে গেছে।
শেফালী বলে, আজ উঠি নিত্য।
নিত্য  বলে, আর একটু বোস্।
শেফালী বসে।
আর কী বলবি, বল্।
বলব না। করব।
করব মানে ?
মানে ঃ দেখ. ঃ বলেই আচমকা নিত্য ে শেফালীর মুখ টেনে নেয় দু’হাতে, ঠোঁটে আলতো চুমু বসিয়ে দেয়।
 শেফালী কেঁপে ওঠে ।
শেফালী শরীর কাঁপে, মন কাঁপে। লেকের পানি কাঁপে। ঝোপঝাড় কাঁপে। পায়ের তলার মাটি কাঁপে। কাঁপতে কাঁপতে আবার বসে পড়ে মাটিতে।
নিত্য চুমু দিয়েই ঘুরে দাঁড়ায়। হাঁটতে থাকে সামনে। পেছন ফিরে তাকাতে পারে না, তাকানোর প্রয়োজনও বোধ করে না।
পৃথিবী আপন নিয়মে চলছে।
ছাত্র-ছাত্রীরা আপন নিয়মে ঘরে ফিরে যাচ্ছে।
সন্ধ্যার ঝিঁঝিঁ অন্ধকার বাড়ছে।
প্রকৃতির কোথাও কোনো পরিবর্তন ঘটেনি । পরিবর্তন ঘটে গেছে  শেফালীর জীবনে।
প্রথম চুমুর স্পর্শ পেয়েছে। ইচ্ছায় নয়। অনিচ্ছায়। ক্ষিপ্রগতিতে কান্ডটি ঘটিয়েছে নিত্য।
কেমন লাগছে। জানে না সে। বোঝে না সে। ফ্যাল ফ্যাল করে নিত্য চলে যাওয়া দেখছে।
লাইন কেটে দিলেও সেলফোনটি অফ করে দেয়নি নাদিয়া।
আবার বেজে ওঠে ফোন। অতীতের নিত্যর ঘটনা থেকে ফিরে আসে সে বর্তমানে, নিজের অজান্তেই ইয়েস বাটনে টিপ দিয়ে কানের কাছে ধরে সেট।
অঞ্জন বলে, তাহলে ফোন ধরলেন?
কল্পনার জগৎ থেকে এইমাত্র ফিরে, স্বাভাবিক গলায় শেফালী বলে, ওঃ আপনি !
জি। আমি অঞ্জন।
আবার কী বলবেন?
কিছু বলব না।
ফোন ব্যাক করলেন কে?
যাচাই করে দেখতে।
কী যাচাই করলেন?
যা বলেছিলাম, ঠিক বলেছি না?
হ্যাঁ, ঠিক বলেছেন।
সত্য বলার জন্য ধন্যবাদ। বলেই অঞ্জন লাইন কেটে দেয়।
 শেফালী চুপ হয়ে যায়। নিজেকে আর চিনতে পারে না। অঞ্জন মোবাইল সেটে ভর করে ঢুকে গেছে মস্তিষ্কে, খোঁচা দিয়েছে। দেখিয়ে দিয়েছে নিজেকে, ব্যবচ্ছেদ করার সুযোগ পেয়েছে নিজের মন।
নিজের মনে দুটো কর্নার আছে। নাকি এক কর্নারে দুজনের বসবাস? একসাথে কি দুজনকেই ভালো লাগা সম্ভব? নাকি একজনকে ভালোবাসে সে? অন্যজন কি তবে আরোপিত? শেকড়বিহীন কি তার অবস্থান? টান ছাড়া কি আরেক টান? শেকড় ছাড়া টান কি সম্ভব?
প্রশ্ন আসছে মনে। কিছু উত্তর পাচ্ছে সে, কিছু উত্তর পাচ্ছে না, কিছু উত্তর মিশ্রভাবে নাড়া দিচ্ছে, রহস্যময়ী মনের রহস্যের কূল পায় না সে, কিনার পায় না। মন খারাপ হতে থাকে। ভালো মন খারাপ হওয়া ঠেকাবে কীভাবে ?
এক মনস্তত্ত্ববিদের লেখা পড়েছিল সে, মন খারাপ হতে থাকলে কেবল নেতিবাচক ভাবনা আসতে থাকে, স্্েরাতের মতো ছুটে আসে খারাপ চিান্তা। অথচ দুঃসময়ে দশটা ভালো চিন্তা করা উচিত। নিজ জীবনের সাফল্য নিয়ে ভাবা উচিত। খারাপ মন তখন ভালো হতে থাকবে। আত্মবিশ্বাসে ফাটল তৈরি হবে না। বিশ্বাস তখন মজবুত হবে। সেদিন বিজয় স্যারই বলেছিলেন, মানুষ ভুল করবে, একটা দুটা ভুল হতেই পারে। ভুল করে ভেঙে পড়া চলবে না। ভুল করে শেখা যায়। নতুন অভিজ্ঞতা আসে ভুলের সিঁড়িতে চড়ে। ভুলের ওপর দাঁড়িয়ে জানা যায় নিজের দুর্বলতার কথা। নিজের দুর্বলতা জানা সহজ হলে আত্মবিশ্বাস দ্বিগুণ বেড়ে যায়। আত্মবিশ্বাসই সাফল্যের চাবিকাঠি। আত্মবিশ্বাস বাড়ছে না। ভেঙে যাচ্ছে নিজের বিশ্বাসের প্লাটফর্ম। মনের উপলব্ধিতেই কেবল নয়, দেহের ভাষাও বদলে যাচ্ছে। ভেঙে যাচ্ছে। নিজেকে শক্ত রাখতে পারছে না  শেফালী।
এ সময় কাজের মেয়ে ফরিদা এসে রুমের চলমান ফ্যানের সুইচ অফ করে দেয়।  শেফালী বলে, ফ্যান অফ করলি কেন? ঘর ঝাড়ু দিমু আফা।
সুইচ দে। ভাগ এখান থেকে। ঝাড়ু দেওয়া লাগবে না এখন।
ফরিদা ধমক খেয়ে চোখ তুলে তাকায়। বুঝতে পারে আপার মন ভালো নেই। সাধারণত ধমক দিয়ে কথা বলে না। মন খারাপ হলে আপার রাগ বেড়ে যায়। রাগ বেড়ে গেলে আমসত্ত্ব খায় আপা। ফরিদা  ফিরে আসে ফ্রিজের কাছে। একটা নিজের জন্য নিয়ে কোমরে গুঁজে নেয়। একটা আমসত্ত্ব নিয়ে ফিরে এসে  শেফালীর হাতের দিকে বাড়িয়ে বলে, নেন, আফা এইডা খানতো। মন ভালা হইব।  শেফালী ক্ষ্যাপে যাচ্ছিল। ক্ষ্যাপাটে রাগ সামলে নেয়। আমসত্ত্বটি হাতে নেয় সে। এ সময় আবার ফোন বেজে ওঠে। আমসত্ত্ব মুখে দেওয়ার সুযোগ পায় না সে। ডিসপ্লেতে দেখে শ অর্থাৎ নিত্য ফোন করেছে। শ বর্ণটি দেখার সাথে সাথে মন আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠে। শক্ত মটিতে দাঁড়িয়ে যায় মন। ইতস্ততার খোলস ঝেড়ে পরিষ্কার স্পষ্ট ভাষায়  শেফালী বলে, বলো, কী বলবে?
কী বলবো মানে? কিছু বলতেই হবে নাকি?
 শেফালীর দেহের ভাষা জোরালো হয়ে যায়। মনের গিঁট শক্ত হয়ে ওঠে। শক্ত মন বলে ওঠে, প্রয়োজন ছাড়া ফোন করবে কেন?
 শেফালীর স্বর শুনে একটু ভড়কে যায় নিত্য। তবুও হাসি মুখে বলে, ফোন করব, কারণ তোমাকে আমি ভালোবাসি।
একটু সময় নেয়  শেফালী। ঠান্ডা গলায় বলে, আমি তোমাকে বোধ হয় ভালোবাসি না। নিত্য হো হো করে হেসে দেয়। হাসতে হাসতে বলে, তাহলে আমাদের এতদিনের সম্পর্কটার ভিত্তি কী? ভিত্তি জানি না। জানি, আমি তোমাকে ভালোবাসি না? বন্ধুভাবি। ঠাস করে এ সময় একটা শব্দ হয়। ফরিদার পানির গ্লাস নিয়ে আসছিল। গ্লাসের ওপর প্লেট ছিল। প্লেট পড়ে গেছে। ভেঙে গেছে। ভাঙার শব্দে আচমকা পেছনে ফিরে তাকায়  শেফালী। ফরিদা গ্লাস হাতে অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে আছে।
নিত্য বলে, কীসের শব্দ হলো? শেফালী বলে প্লেট ভাঙার শব্দ।
নিত্য বলে, তুমি ভাংলে? শেফালী বলে, না, কাজের মেয়েটি ভেঙেছে।
নিত্য বলে, যাক, বাঁচালে। শেফালী বলে, কীভাবে বাঁচলে?
তুমি ভাঙোনি বলে। আমি ভাংলে কী হতো? মন ভেঙে যেত আমার। মন তোমার ভাংতেই হবে। কারণ আমি তোমাকে ভালোবাসি না। তুমি ইচ্ছের বিরুদ্ধে জোর করে চুমু খেয়েছিলে আমাকে। এমন জোরালোভাবে বলছ কেন? বলছি, কারণ বুঝতে পারছি নিজেকে।
কাকে ভালোবাস? বিজয় স্যারকে। স্পষ্টভাবে আত্মবিশ্বাসী গলায় বলল শেফালী।
বিজয় স্যারকে ভালোসাসো? অসুবিধা কি? অসুবিধে আছে। এক সাথে দুজনকে ভালোবাসা যায় না।
নিত্য বলে, যায়। বিজয় স্যারকে আমিও ভালোবাসি, শ্রদ্ধা করি। তোমার ভালোবাসা হচ্ছে শ্রদ্ধার ভালোবাসা, বিজয়া স্যারের জন্য শ্রদ্ধা।
না। শ্রদ্ধা না। আরও বেশি কিছু। বেশি কিছু মানে? বেশি কিছুর অর্থ হচ্ছে তোমার চেয়েও বেশি ভালোবাসি তাঁকে। আমাকে অল্প ভালোবাসলেই হবে। নিত্য এসব কথায় ভেঙে যাচ্ছে না। শক্ত থাকছে। বিজয় স্যারকে ভালোবাসো, আপত্তি নেই। আমাকে বিয়ে কোরো। বিয়ে করলেই চলবে। শেফালী ক্ষেপে গিয়ে বলে, চলবে মানে? নিজের বউকে অন্যেকে ভালোবাসতে দেবে? দেব।  শেফারী বলে, পারবে না। মিথ্যা বলছ।
পারব। একশোভাগ পারব। বিষয়টা হেঁয়ালির না। আমি সিরিয়াসলি বলছি, বিজয় স্যারকেই আমি ভালোবাসি। নিত্য এখনো টলছে না, ভাংছে না। সহজ থেকেই বলছে, বিজয় স্যারের বউ আছে। বাচ্চা আছে। স্যার সুখী মানুষ। তোমাকে বিয়ে করবে না। শেফালী শক্ত অবস্থানে থেকেই বলে, স্যার সুখী না। স্যারের ওয়াইফ এর সাথে ঝামেলা চলছে। ঝামেলা মিঠে যাবে। স্যার সুখেই আছেন। তবুও আমি স্যারকেই চাই। নাদিয়ার মনের জোর কমে না। নিত্য বলে, আমি তোমাদের বাসায় যাব। খালাম্মা-খালুর কাছে প্রোপোজাল দেব। বিয়ের প্রস্তাব পাঠাব। আমিই তোমাকে বিয়ে করব। আমি বিজয় স্যারকেই ভালোবাসি। বিজয় স্যার বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে তোমাদের বাসায় যাবে না। গেলেও তোমার বাবা-মা আস্বাভাবিক রিলেশনশীপ মেনে নেবে না। তারা আমাকে পছন্দ করবে। আমিই জয়ী হব। কথা শেষ করেই লাইন কেটে দেয় নিত্য। শেফালী আর কোনো যুক্তি দেখানোর সময় পেল না। তবে নিত্যর সাথে সরাসরি সব কথা বলতে পেরে স্বস্তি পাচ্ছে। নিত্য সব বিশ্বাস করতে পারছে না। তাই পিছ পা হয়নি। বুঝতে পারে  শেফালী। শেফালী অনড়। নিত্যকে কিছুতেই বিয়ে করবে না। অনড় থাকবে নিজের সিদ্ধান্তে।
নিজেকে হালকা লাগছে। ভারমুক্ত লাগছে। মনের দ্বৈতসত্তা গুড়িয়ে গেছে। এক সত্তা জেগে উঠেছে। আনন্দ আসছে মনে। ঘর গোছানোর কাজে মন দেয় সে। বিছানা ঝাড় দেয়। এলোমেলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কাপড়গুলো গুছিয়ে লকারে ঢুকিয়ে রাখে। বেডসাইড টেবিলে আছে ডেকসেট। একটি রবীন্দ্র সঙ্গীতের সিডি ঢুকিয়ে অন করে সে।
হালকা ভলিউমে বেজে ওঠে-চোখের আলোয় দেখেছিলেম চোখের বাহিরেঃ.।
 শেফালী নিজেকে আরও গভীরভাবে আবিষ্কারের চেষ্টা করে। ভাবে সফল সে। সফল ভাবে বুঝেছে নিজেকে তবুও মনে দ্বিধাও আসে। অসম ভালোবাসা আদৌ কি সম্ভব ? নিত্য সিগারেট টানে। ওইদিন জোর করে যখন চুমু খেল ওর মুখের সিগারেটের গন্ধে বমি এসে গিয়েছিল। নিজের মনের বিতৃষ্ণা কীভাবে সামাল দিয়েছিল সে! বুঝে উঠতে পারে না এখন। জোঁকের মতো লেগে আছে নত্য। জোঁক আলগা করতে পারছে না, ঝেড়ে ফেলতে পারছে না। সেতো মিথ্যা বলেনি, বিজয় স্যার নিয়ে সত্য কথা বলেছে। বিজয় স্যারের জন্য অন্যরকম ফীল করে। অন্যান্য শিক্ষকদের কঠোর সমালোচনা করলেও, স্যারের কোনো ত্র“টি চোখে পড়ে না, স্যারের বিরুদ্ধে কোনো সমালোচনাও মানতে পারে না। সব সময় স্যারকে দেখতে ইচ্ছে করে। উনি ছুটিতে থাকলে ক্লাসে মন টেকে না, বোর লাগে ক্যাম্পাস। বিজয় স্যারের জন্য এতো ফিলিংস আসে কোত্থকে?
এটা কি শ্রদ্ধা না ভালোবাসা? নিত্য তাকে বিয়ে করতে চায়। সে ফিরিয়ে দিতে চায়। কেবলই বিজয় স্যারের জন্য? রবীন্দ্র সঙ্গীত বাজছে।
আর একটা গান শুরু হয়েছে ঃ আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়েছিলে দেখতে আমি পাইনি তোমায়ঃ। গান শুনতে শুনতে আবারও নাদিয়া নিজের মন দেখার চেষ্টা করে। মন দেখা কি সহজ ? অবচেতন মনে কত কিছু আসন গেঁড়ে থাকে? সবাই কি বুঝতে পারে অবচেতন মনের খেলা?
আগে নিত্যকে বলতো তুই করে। নিত্যও তুই সম্বোধন করতো। এখন উভয়ে তুই থেকে তুমিতে উঠে এসেছে। নিজেকে বুঝতে পারে না সে। তবে শেফালী এতটুকু বুঝছে, বিজয় স্যার ছাড়া চলবে না। স্যারের চোখ দেখলে কেমন যেন হয়ে যায় মন। এমন হয় কেন? এটাই কি ভালোবাসা? আর একজনের স্বামীকে কি এভাবে ভালোবাসা আদৌ সম্ভব ? অসম্ভব কেন সম্ভবের দুয়ারে টোকা দেয়? কেন নাড়া খায় সে?
কেন?
কষ্ট হচ্ছে এখন। ভেতর থেকে কষ্ট টের পাচ্ছে। ঘরের পরিছন্ন আসবাব ম্লান লাগছে। গানও ভালো লাগছে না। ডেকসেটের পাওয়ার অফ করে বিছানায় শুয়ে পড়ে। কতক্ষণ এভাবে কেটেছে জানে না সে। হঠাৎ চোখ খুলে দেখে লাকী অবাক চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে।
 শেফালী তাকায় ফরিদার দিকে। ফরিদা বলে আফা, কাঁদেন ক্যাঁ ?
 শেফালী জানতে চায়, কাঁদি মানে ? আমি কি কাঁদছিলাম ?
হ আফা। চোখ বন্ধ করে আফনে কাঁনছিলেন। চোখের কোনায় পানি জইমা আছে। আঙুল দিয়া দেখেন।  শেফালী বাম হাত চোখের নিচ থেকে টেনে আনে। বুঝতে পারে ভেজা লাগছে।  বালিশের দিকে তাকায় সে। চোখের পানিতে ভিজে আছে বালিশের একাংশ।
 শেফালী বলে, তুই যা। একা থাকি এখন।  চট করে কারেন্ট চলে গেছে। একবার উপরের দিকে তাকায়  শেফালী। ফ্যানের ঘূর্ণি দেখে। ঘূর্ণায়মান ফ্যান শ্লো হয়ে গেছে।  শেফালীর মনে হচ্ছে নিজের দেহটাও শ্লো হয়ে গেছে। দেহের ভেতর মনটার অস্তিত্ব¡ শূন্য হয়ে গেছে।
মন কি তবে পাগলা হাওয়ায় উড়াল দিয়েছে ? মেঘের দেশে ভেসে গেছে ? চোখ বন্ধ করে কল্পনার চোখে নিজেকে দেখার চেষ্টা করে। দেখতে পাচ্ছে না। চারপাশে জেগে উঠছে ধু-ধু শূন্যতা। শূন্যতার সীমা নেই।। পাগলা হাওয়ায় উড়াল মন শূন্যতা কেবলই বাড়িয়ে দিচ্ছে।ঃ.
পাগলা হাওয়ায় মন উড়ে যাচ্ছেঃ. উড়ে যাচ্ছে , পাগলা হাওয়ায়, দূরে, বহু দূরে।

লেখক: ড.ফোরকান আলী
০১৭১১৫৭৯২৬৭
ঊসধরষ- ফৎ.ভড়ঁৎশধহধষর@মসধরষ.পড়স



0 comments:

Post a Comment