Sunday, July 31, 2016

মাদক: এইচআইভিসহ নানা জীবাণু ট্রান্সপারেন্ট হতে পারে


মাদক: এইচআইভিসহ নানা জীবাণু ট্রান্সপারেন্ট হতে পারে
আলী ফোরকান
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন এলাকা চানখারপুল। একদিকে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা অন্যদিকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল। এমন একটি এলাকাই এখন মাদকের হটস্পট হিসেবে চিহ্নিত। সবচেয়ে বেশি মাদক কেনা-বেচা এবং মাদকাসক্ত এ এলাকাতেই রয়েছে। নাজিমউদ্দিন রোড, আনন্দবাজার, নিমতলী, ঢাকা মেডিক্যালের জরুরী বিভাগ এলাকা, ফজলুল হক হল, জগন্নাথ হল সংলগ্ন সড়কে প্রকাশ্যেই মাদক বেচা-কেনা কাজ চলে।চানখারপুলের প্রধান সড়কে অবস্থিত গাড়ির ওয়ার্কশপের কর্মচারীরা জানান, সন্ধ্যার পর দেখা যায় রিকশায় বসে হেরোইন, ডাইল (কোড নাম) বিক্রি করে। আরো জানা যায়, ঢাকা মেডিক্যালের জরুরি বিভাগের গেটে এবং তার উল্টোদিকের খালি জায়গায় গড়ে উঠেছে মাদককেন্দ্রিক নেটওয়ার্ক। এস্থানে সকাল-সন্ধ্যা-রাত যেকোনো সময়েই প্রকাশ্যে চলে মাদক ব্যবসা। আর মাদকসেবীদের স্থায়ী ঠিকানায় পরিণত হয়েছে জরুরি বিভাগের গেট। ঐ পথে যারা নিয়মিত যাতায়াত করেন তারা দেখতে পান এক মাদকাসক্ত কিভাবে অন্যজনকে অভিজ্ঞ হাতে এমপুল থেকে টিডি ভরে সিরিঞ্জ পুশ করছে। গাঁজা, হেরোইন টানছে এমন দৃশ্যও সেখানে বিরল নয়। অথচ ওখানেই ঢাকার সবচেয়ে বড় একটি চিকিৎসালয় দাঁড়িয়ে রয়েছে! ঢাকা মেডিক্যালের গেটের পাশে রয়েছে কয়েকটি ওষুধের দোকান। তারা জানান, এখানে মূলত নিম্নশ্রেণীর ছিন্নমূলরাই মাদকাসক্ত। সারাদিন এ এলাকাতেই ঘোরাফেরা করে। এরা টুকটাক কাজ করে এক এমপুল টিডিজেসির দাম ১০০-১৫০ টাকা যোগাড় করার চেষ্টা করে। সেজন্য ভিক্ষা করে, ময়লা আবর্জনা থেকে পলিথিন, কাগজ, শিশি-বোতল সংগ্রহ করে বিক্রি করে। কেউ কেউ রিকশা চালায় বা কোনো গ্যারেজ, ওয়ার্কশপে আধাবেলা শ্রম দিয়ে আয় করে মাদকের দাম। এক ওষুধ বিক্রেতা জানালেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন ছাত্রও আসে ঘুমের ওষুধ কিনতে। ওগুলোর মিশ্রণ তৈরি করে ‘ককটেল’ ড্রাগস খায়। বকশীবাজার মোড় থেকে টানা পথটি চলে এসেছে একেবারে জগন্নাথ হল মোড় পর্যন্ত। এই পথেও মাদকের ছড়াছড়ি। পুলিশের একটি টহল গাড়ি ওখানে প্রায়ই থাকে। তারাও জানায়, মাদকাসক্তদের আনাগোনা দেখতে পায়। কিন্তু যেহেতু তারা কোনো গুরুতর অপরাধমূলক কাজ করে না তাই আইনত ওদেরকে ধরা যায় না। এক পুলিশ অফিসার আরো জানালেন, রিকশা নিয়ে এক লোক আসে, চট করে বিক্রি করে চলে যায়। চানখারপুলের অন্য পাশে আনন্দবাজার, নিমতলী গেট। এখানেও বেশ জমজমাট মাদকের হাট বসে। আনন্দবাজারের ফুটপাত ধরে ফুলবাড়িয়া, বঙ্গবাজার এলাকা জুড়েই এখন মাদক আক্রান্ত এলাকা নামে চিহ্নিত। লোহার গ্রিল তৈরির কারখানার মালিক মানিক জানান, বহু বছর ধরেই এ এলাকায় চলছে হেরোইন, ডাইল বিক্রি। পুলিশ মাঝে মধ্যে ধরেও বড় সড় চালান, কিন্তু কোনো কাজ হয় না? বরং দিনে দিনে আরো বাড়ছে। তিনি মনে করেন, এলাকায় পুলিশের এ্যাকশন জোরদার হতে হবে। ঢিলেঢালা টহল দিয়ে কাজ হয় না। পুরনো ঢাকার প্রাচীন এবং ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা চানখারপুল নাজিমউদ্দিন রোড। মেডিক্যাল, বকশীবাজার, নিমতলীকেন্দ্রিক যত ছিন্নমূল মাদকাসক্তরা রয়েছে ওরা দিনের বেলায় এ আবাসিক এলাকায় ঢুকে পড়ে। পার্টটাইম কাজ বা খাওয়ার সন্ধানে তারা এলাকায় হোটেল রেস্টুরেন্ট-এর আশেপাশে ঘোরাফেরা করে। আর রাতের বেলায় দোকানের এবং বাড়িঘরের বারান্দায় শুয়ে থাকে। বাকরখানি বিক্রেতা মোসলেম মিয়া বললেন, খাওয়ার জন্য ওরা দোকানে দোকানে হাত পাতে, আবার ৫/১০ টাকাও চায় ভাত খাবে বলে। দেখলে মায়া লাগে কীভাবে নিজের জীবন নিজেই শেষ করছে বিষ খেয়ে। অন্য এক বাসিন্দা মাশুক আহমেদ বলেন, আগে বেশ উপদ্রব মনে হতো, এখন এদের দেখে দেখে অভ্যাস হয়ে গেছে। এলাকাবাসী জানাল, পুলিশকে অভিযোগ করেও লাভ হয়নি। ধরে নিয়ে গিয়ে আবার ক’দিন পর ছেড়ে দেয়। সম্প্রতি এক শুক্রবার জুম্মার নামাজ শেষে গোটা নাজিমউদ্দিন রোডের বাসিন্দারা মাদকাসক্ত এবং মাদক ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে মিছিল বের করে। এলাকা থেকে কীভাবে মাদক ব্যবসাকে নির্মূল করা যায় সে বিষয়ে প্রশাসন এবং এলাকাবাসী মিলে আলোচনা সভাও করেছে। বেশ ক’জন সচেতন বাসিন্দা জানালেন, বর্তমানে এলাকায় মাদক বেচা-কেনা বেড়ে গেছে। অন্যদিকে একদল মাদক ব্যবসায়ী নিজেদের মধ্যে ভাগ-বাঁটোয়ারা নিয়ে ঝামেলা হওয়ায় এই ব্যবসা নির্মূল আন্দোলনে যোগ দিয়েছে। গোটা এলাকাটি ঢাকার দু’টি থানায় ভাগ হয়েছে। কিছু অংশ লালবাগ থানা এবং কিছুটা পড়েছে কোতোয়ালি থানায়। এই দুই থানার কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তারা এ বিষয়ে যথেষ্ট তৎপর এবং মাদক সম্পর্কেও যে অভিযোগ তা জানে। যখনই সংবাদ পায় সে মতো গিয়ে অভিযান চালানো হয়। সাদা পোশাক কিংবা পুলিশের পোশাক পরেই এদের ওপর নজর রাখা হয়। লালবাগ থানা এবং কোতোয়ালী থানা সূত্র জানায়, কাছেই মিটফোর্ড হাসপাতাল এবং ঢাকা মেডিক্যাল হওয়াতে এ এলাকাতে অনায়াসে সহজলভ্য হয়ে গেছে মাদক। অন্যদিকে নিমতলী, আনন্দবাজার, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ এলাকা পড়েছে শাহবাগ থানার অধীনে। এই থানার কর্মকর্তা জানালেন, চানখারপুল তো সামান্য এক মাদক এলাকা, এরচেয়েও বড় মাদকের হাট তো রয়েছে ঢাকার নয়াবাজার এবং মিটফোর্ড এলাকায়। শাহবাগ থানা প্রায়ই অভিযান চালায় তাদের আওতাধীন এলাকায়। ধরা পড়ে মাদকাসক্তরা, পাঠানো হয় মাদকমুক্তি কেন্দ্রে। কিন্তু লাভ হয় না। ওরা ভালো হয়েও আবার এ পথেই চলে আসে। কাজ করছে এনজিও তবুও সমস্যা বাড়ছে। বিশ্বব্যাংক, ইউনিসেফ এবং বাংলাদেশ সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে এনজিও কেয়ার বাংলাদেশ দীর্ঘদিন থেকে মাদকাসক্তদের নিয়ে কাজ করছে। ঢাকার যে ক’টি মাদকের হটস্পট রয়েছে সেখানেই কেয়ার খুলেছে কাউন্সিলিং সেন্টার। এ সেন্টার থেকে কেয়ারের কর্মীরা এলাকার মাদকাসক্তদের তুলে এনে মানসিক ও দৈহিক চিকিৎসার মাধ্যমে এইচআইভি এবং এইডস প্রতিরোধ করার চেষ্টা করছে। চানখারপুল এলাকায় রয়েছে কেয়ারের একটি এইচআইভি হার্ম রিডিউস বা এইডস-এর বিস্তার রোধকরণ প্রকল্প কেন্দ্র। এ প্রকল্পের আওতায় কেয়ার ঐ এলাকার যত ছিন্নমূল ভবঘুরে নিম্নশ্রেণীর মাদকাসক্ত রয়েছে তাদের নিয়ে কাজ করছে। কেন্দ্র থেকে জানা গেল, বর্তমান এ কেন্দ্রের অধীনে প্রায় ৭০০ মাদকসেবী রয়েছে এবং তারমধ্যে ৭.৫ ভাগই এইডস আক্রান্ত। কেয়ারের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে এরা যাতে একজন অন্যজনের সিরিঞ্জ ব্যবহার না করে সেজন্য ওদের মধ্যে সিরিঞ্জ বিতরণ করা এবং তা ফেরত নেয়া। একে বলা হচ্ছে সিরিঞ্জ বিনিময় কার্যক্রম। কেন্দ্র থেকে রেজিস্টার খাতায় নাম লিখিয়ে সিরিঞ্জগুলো মাদকসেবীরা নিয়ে যায় আবার ব্যবহারের পর ফেরত দেয়। ফলে ভাইরাসটি দ্রুত ছড়ায় না। এই ব্যবহৃত সিরিঞ্জগুলো জমা দেয়া হয় আইসিডিডিআরবি-তে। চানখারপুল কেয়ার কাউন্সিলিং কেন্দ্রটি থেকে জানা যায়, এদেশে বেশিরভাগ মাদকই টিডিজেসি গ্রুপের। যা ইনজেকশনভিত্তিক এক ধরনের মাদক। এর বাইরেও অনেকে হেরোইন, ডাইজিপাম, মরফিন, প্যাথেডিনসহ নানারকম ঘুমের ওষুধে আসক্ত। সেই সঙ্গে রয়েছে ফেনসিডিল, ফেনারগান জাতীয় ওষুধ। ক্ষতিকারক এইচআইভি ভাইরাস যেন বেশিসংখ্যক বা বেশি মাত্রায় সমাজে না ছড়ায় সেই লক্ষ্যেই এ প্রোগ্রাম হাতে নেয়া হয়েছে। তারা জানায়, বর্তমানে এর বিস্তার হার কমেছে সিরিঞ্জ বিনিময় কর্মসূচী চালু করায়। আরেকটি মজার বিষয় তারা জানাল, এই সিরিঞ্জ তারা এলাকায় মাদক স্পটে বিলি করায় কোনো না কোনো মাদকাসক্তের মাধ্যমে। তা না হলে ওরা কিনবে না বা বিনা মূল্যে নেবে না। সেজন্য এলাকাবাসীর ধারণা ও অভিযোগ যে, কেয়ার মাদকাসক্তের সংখ্যা বৃদ্ধি করছে সিরিঞ্জ দিয়ে। কেয়ারের কেন্দ্রে দেখা গেল, দিনের বেলায় প্রায় ৪০/৫০ জন মাদকসেবী একটা বড় রুমে বসে টিভি দেখছে। কেউ বা শুয়ে রয়েছে। কেন্দ্রের কর্মকর্তারা জানান, এখানে ওদের জন্য বিশ্রামাগার, বাথরুম সবই রয়েছে। এদের মাদকমুক্ত করার জন্য মানসিকভাবে পরিবর্তন আনার চেষ্টা করা হয়। পরে কেউ কেউ সুস্থ হলে তাকে ক্লিনিক্যালিও চিকিৎসা দেয়া হয়। কেয়ারসহ বেশ কয়েকটি এনজিও মাদকাসক্তদের নিয়ে কাজ করলেও দিনদিন বেড়েই চলেছে মাদকসেবীর সংখ্যা। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কারো কারো অভিযোগ রয়েছে, এনজিওগুলোর তৎপরতা ইতিবাচক দেখা গেলেও আদতে তাদের কার্যক্রমে মাদকে আসক্ত হতে উৎসাহ পায় অনেকে। তাদের কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে অনেকে এইচআইভিসহ নানা জীবাণু ট্রান্সপারেন্ট প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত হতে পারে সহজে। যা সংশ্লিষ্ট বিষয়ে নার্সিং-এর পরিবর্তে বরং উল্টো ক্রিয়া সাধন করে।

0 comments:

Post a Comment