Saturday, July 2, 2016

পরিবেশ: দূষণের শিকার জলজ প্রাণীকুল

পরিবেশ: দূষণের শিকার জলজ প্রাণীকুল 
আলী ফোরকান
বর্তমান সময়ে তিমি, ডলফিন, শুশুক প্রজাতির মাছগুলো সংকটাপন্ন। অনেক প্রজাতির মাছও বিলুপ্তির পথে। ভয়াবহ পানি দূষণ ও শব্দ দূষণ এর অন্যতম কারণ। পৃথিবীতে ৮০ টিরও বেশি প্রজাতির ডলফিন, তিমি ও পরপয়েস রয়েছে। যাদের একত্রে সেটেসান বলা হয়। আমাদের জলাভূমি জলজ স্তন্যপায়ীর বসবাসের জন্য অবাধ বিচরণকেন্দ্র। বর্তমানে ১১৩টি প্রজাতির স্তন্যপায়ীর মধ্যে ১১০টি অভ্যন্তরীণ ও স্থলজ এবং বাকি ৩টি সামুদ্রিক। আমাদের দেশে মোট আয়তনের দুই তৃতীয়াংশ জুড়ে রয়েছে নদ-নদী অর্থাৎ জলাভূমি। এখানে রয়েছে জলজ স্তন্যপায়ীর এক বিপুল সম্ভাবনা। দুঃখের বিষয় হলো এই বিশাল জলসম্পদ নিয়ে গবেষণা জরিপ চালানো হয়েছে খুবই কম পরিমাণে। তাই জলজ প্রাণী রক্ষায় আমাদের ভেতর এখনো তেমনভাবে জনসচেতনতা গড়ে ওঠেনি। প্রতিবছর আমাদের অবহেলার কারণে আর সরকারি নানা উদ্যোগের অভাবে জলজ সম্পদ এই বিপন্ন প্রাণীকুল আমাদের নদ-নদী বিধৌত জলাভূমির পরিবেশ হতে নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছে। যত্রতত্র জেলেদের জালে আটকে পড়ছে অতি বিপন্ন শুশুক, তিমি ও ডলফিনের মতো জলজ স্তন্যপায়ী প্রাণীগুলো। বর্তমানে বিশ্বের সমুদ্র উপকূলবর্তী পরিবেশ দূষণ ও বিপর্যয়ের কারণে হুমকির মুখে বৃহত্তম প্রাণী তিমি। আমাদের অবহেলা ও উদাসীনতার কারণে বার বার জেলেদের জালে  তিমি, শুশুক আটকা পড়ার পর তারা তাদের স্বাভাবিক জলজ পরিবেশে ফিরে যেতে পারেনি। তার ফলশ্রুতিতে ঘটেছে এর অকল্পনীয় মৃত্যু। এই জাতীয় প্রাণী Ñ সম্প্রতি ২০০৮ সালের মে মাসে পদ্মায় বেশ বড় আকারের একটি শুশুক ধরা পড়েছিল। ২০০৫ সালে ভোলার দক্ষিণে মেঘনা বঙ্গোপসাগর মোহনা অঞ্চলে ৩০ ফুট দীর্ঘ একটি মৃত তিমি উদ্ধার করা হয়েছিল। ২০০৭ এর জুলাই মাসে চট্টগ্রামে কট্রলি উপকূলীয় এলাকা থেকে ৩৬ ফুট মৃত তিমি উদ্ধার করা হয়। সবার ধারণা ছিল এটি বড় কোনো শিপের সঙ্গে আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে মারা যায়। এই তিমিটির কঙ্কাল পরে ঢাকায় নিয়ে আসা হয়। তবে কোনো তিমিই সঠিকভাবে শনাক্তকরণ বা এ নিয়ে গবেষণা করা হয়নি। মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের গবেষকরা এ ক্ষেত্রে তেমন অগ্রসর হয়নি। অবশ্য পৃথিবীর সমুদ্র উপকূল থেকে তিমি হারিয়ে যাচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের ধারণা পৃথিবীতে আজ থেকে ৫০ বছর আগেও ১ লাখ ২৫ হাজার হামব্যাক তিমির অস্তিত্ব ছিল। বর্তমানে এর ৯৫ ভাগ তিমির অস্তিত্ব সংকটাপন্ন। জীববৈচিত্র্য রক্ষার্থে জলজ স্তন্যপায়ীদের একটা বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। এ কারণে বিলুপ্ত হবার আগে এদের যথাযথ সংরক্ষণ ও এর উপর গবেষণা চালানো দরকার। বিশ্বে ৮০টির ও বেশি প্রজাতির ডলফিন, তিমি, পরপয়েস সব সাগর-মহাসাগরে কম-বেশি দেখা যায়। একত্রে এদেরকে সেটেসান বলা হয়। এই সব জলজ স্তন্যপায়ী আবার স্থলজ স্তন্যপায়ীদের মতো বাতাসের সাহায্যে শ্বাস-প্রশ্বাস নেয়। এরাও অন্যান্য স্তন্যপায়ীর মতো বাচ্চা প্রসব করে। এই বাচ্চারা মাতৃগর্ভে বেড়ে ওঠে এবং প্রসব যন্ত্রণা প্রাপ্ত জলজ স্তন্যপায়ী জীবন্ত বাচ্চা দেয়। ফিজিক্যাল গঠন ও আকৃতিতে তিমি, ডলফিন, পরপয়েস ভিন্ন রকমের হলেও এদের বাচ্চা লালন পালনের ভূমিকা একই রকম। অবশ্য এই সেটেসানদের বাচ্চাগুলোকে সাবক বলা হয়। জন্মের সময় সাবকের ফুসফুসে যাতে পানি প্রবেশ না করে এর জন্য বাচ্চার প্রথমে লেজ বের হয় এবং সর্বশেষ শ্বাস-প্রশ্বাসের ছিদ্র বের হয়। মা সেটেসান পানির খুব কাছাকাছি থাকে বলে প্রসবের পর সবকটি পানির উপরে এসে শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে পারে। সেটেসানদের স্তন লেজের কাছাকাছি। সাবক জন্মের পর পরই মা সেটেসান বাচ্চাকে দুগ্ধ পান করায়। নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে মা সেটেসান বাচ্চার কাছাকাছি থাকে। এরা খুবই সামাজিক। এদের মধ্যে সোস্যাল বিহেবিয়ার পরিলক্ষিত হয়। কারণ এরা শিকার করে, মাছ ধরে, গান গায় ও বাচ্চা লালন পালন করে, সঙ্গী খোঁজে এবং খেলা করে। সেটেসান ও মাছের মধ্যে পার্থক্য হলোÑ মাছের লেজ খারা ও ডানে বামে ছড়ায় কিন্তু সেটেসানের লেজ আড়াআড়িভাবে উপরে নিচে নড়াচড়া করে। মাছ তার নিজস্ব গিল রেকারের সাহায্য পানি থেকে অক্সিজেন নেয়। সেটেসান বাতাস অর্থাৎ এয়ার থেকে অক্সিজেন নেয়। এদের গিল রেকার নেই। দাঁত ও দাঁত বিহীন দু’ধরনের সেটেসান সচরাচর দেখতে পাওয়া যায়। ডলফিনের দাঁত চোঙ্গাকৃতি এবং পরপয়েসের দাঁত কোদালের মতো হয়ে থাকে। সেটেসান পুরো জীবনটা এদের পানিতে কাটিয়ে দেয়। বাতাস থেকে অক্সিজেন নেয়ার জন্য এদের পানি থেকে উপরে উঠতে হয় সংস্পর্শের জন্য। এরা খুব ভালো সাঁতারুও বটে। এর একটি উদাহরণ হলো হামব্যাক তিমি ৩০ দিনে হাওয়াই থেকে আলাস্কা পর্যন্ত ২৬ হাজার মাইল পথ পাড়ি দেয়, ঘটনাটি স্যাটেলাইটে ধারণ করা হয়েছিল। এরা ঘণ্টায় প্রায় ৩৭ মাইলবেগে সাঁতার কাটে। এরা কখনো পুরোপুরি ঘুমায় না এবং এদের মস্তিষ্কের অর্ধেক অংশ সবসময় সজাগ থাকে। যা দিয়ে শ্বাস-প্রশ্বাস গতিবিধি ও সন্তানদের খেয়াল রাখতে পারে। এদের দৃষ্টিশক্তি প্রখর। গভীর সমুদ্রের পানি স্বচ্ছ বলে এদের চলতে সুবিধা হয় না। তবে যারা নদীতে বাস করে তাদের ঘোলা পানিতে চলতে হয়। নদীতে এরা শব্দের প্রতিধ্বনি সৃষ্টি করে মস্তিষ্কে প্রতিচ্ছবি তৈরি করে চলাচল করে। এই সিস্টেমকে ইকোলোকেশন বলা হয়। পৃথিবীর সর্ববৃহৎ প্রাণী তিমি গানও গাইতে পারে। এদের সংগীত পরিবেশনের সময় সীমা ১৫-৬০ মিনিট পর্যন্ত হয়ে থাকে। ইলিয়াড তিমির গানের বিট ১০ লাখ। ১৯৭০ সালে ড. রজার পাইন ও তার স্ত্রী কেটি পাইন তিমির গানের একটি দীর্ঘ রেকর্ড ধারণ করেন। যুক্তরাষ্ট্রের কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ক্লিস্টোফার ক্লার্কের এক গবেষণায় দেখা গেছে তিমির গান হাজার মাইল পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়তে পারে এবং এর মাধ্যমে তারা নিজ প্রজাতির মধ্যে যোগাযোগ রক্ষা করে চলে। ভয়াবহ আকারে সাগরে শব্দদূষণ ও পানি দূষণের ফলে এদের যোগাযোগ বাংলাদেশে হ্রাস ঘটেছে। ফলে সঙ্গী খুঁজতে বা নিজ প্রজাতি খুঁজতে বেশ বেগ পেতে হয়। যদিও আমাদের দেশে সেটেসানদের অবাধ বিচরণ কেন্দ্র। এক সময় আমাদের দেশের বেশির ভাগ নদ-নদীতে শুশুক দেখা যেত। এখনো পদ্মা, মেঘনা ও যমুনায় এদের দেখা মেলে। অন্য সেটেসানদের মতো ইন্দোপ্যাসিফিক বটল নোজ ডলফিন, ইন্দোপ্যাসিফিক, ইম্পেব্যাকড ডলফিন, স্পিনার ডলফিন, প্যানট্রোফিক্যাল স্পটেড ডলফিন, ফিনলেস পরপয়েস, ব্রিডিস তিমি, ফিন তিমি, বাংলাদেশের বিভিন্ন নদ-নদী ও গভীর সমুদ্রে কম বেশি দেখা যায়। সেটেসানদের মতো অবশ্য শুশুকই বেশি দেখা যায়। এরা দৃষ্টিশক্তি ছাড়া ইকোলোকেশন শক্তি ব্যবহার করে চলে। এর দৈর্ঘ্যে ২.৫ মিটার এবং ওজনে ১০০ কেজি পর্যন্ত হয়। নীল তিমি বেলিন তিমির অন্তর্ভুক্ত এবং পৃথিবীর সর্ববৃহৎ প্রাণী, এরা ৩০ মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়। এদের হৃৎপি- প্রায় একটা বেবীট্যাক্সির মতো। সামুদ্রিক ডলফিন সাঁতার কাটতে পটু। এরা দলবদ্ধভাবে শিকার ধরে। ইরাবতি ডলফিন দিয়ে মায়ানমারের জেলেরা বহুকাল থেকে মাছ ধরে আসছে। ওখানকার জেলেরা ছোট্ট একটা ডিঙ্গি নৌকায় করে ঘণ্টা বাজায় আর ইরাবতি ডলফিন তাদের ওই শব্দ শুনে তাদের কাছে চলে আসে। আস্তে আস্তে এভাবে ডলফিনগুলোকে নদীর কিনারায় নিয়ে আসে এবং একসময় ডলফিন মাছগুলোকে ঘিরে ফেলে। তখন জেলেরা ঝোপ বুঝে জালফেলে মাছধরে এবং ডলফিনও প্রচুর মাছ খেতে পারে। কয়েকশত বছরের এই বন্ধুত্বসুলভ আচরণ মানুষ ও ডলফিনের মধ্যে সখ্যতা গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে। অনেক সময় ডলফিন মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীকে হাঙ্গরের হাত থেকে রক্ষা করে। এই সেটেসানদের বহু প্রজাতি আজ বিপন্ন। অনেক প্রজাতি আজ সংকটাপন্ন অবস্থায় আছে এর একটাই অন্যতম কারণ পানি ও শব্দ দূষণের মাত্রা বৃদ্ধি পাওয়া। এছাড়াও নদ-নদী ও গভীর সমুদ্রে এদের খাদ্য উপাদেয় সামগ্রী মাছের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পাওয়ার জন্য। জেলেদের জালে হরহামেশা ডলফিন শুশুক মারা পড়ছে। গভীর সমুদ্রের ইঞ্জিন চালিত নৌযান চলাচলে এরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এবং এক শ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী এদের ধরে পাচারও করে থাকে। ফলে হারিয়ে যাচ্ছে জলজ স্তন্যপায়ী সেটেসানরা। পরিবেশ হারাচ্ছে তার স্বাভাবিক ভারসাম্যতা। তাই জনসচেতনতা গড়ে তুলতে হবে সমাজের প্রতিটি স্তরে এই প্রাণীকুল রক্ষায়। 


0 comments:

Post a Comment