Saturday, July 2, 2016

পরিবেশ: বৈশ্বিক উষ্ণতার অশনি সংকেত

পরিবেশ: বৈশ্বিক উষ্ণতার অশনি সংকেত
আলী ফোরকান
বাংলাদেশ ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণেই দুর্যোগপ্রবণ। ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, বন্যা, খরা প্রভৃতি প্রাকৃতিক দুর্যোগ বাংলাদেশে নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। প্রতিবছর এইসব প্রাকৃতিক দুর্যোগ ফসল এবং গাছপালার ব্যাপক ক্ষতিসাধন করে, গৃহপালিত পশুপাখিসহ কেড়ে নেয় অসংখ্য মানুষের প্রাণ। গত কয়েক দশকে দুর্যোগের মাত্রা এবং তীব্রতা আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে গিয়েছে। ছয় ঋতুর এই বাংলাদেশে যে নিয়মতান্ত্রিকতা মেনে ঋতুগুলো আবর্তিত হত, এখন সেটা লক্ষ্য করা যায় না। এমনকি বাংলাদেশের জলবায়ুকে এখন আর ‘নাতিশীতোষ্ণ’ বিশেষণে বিশেষায়িত করাও দুঃসাধ্য। একদিকে যেমন প্রচন্ড শীত, অন্যদিকে চরম গরম এবং গ্রীষ্মকালের দীর্ঘস্থায়িত্ব ‘চরমভাবাপন্ন’ বৈশিষ্ট্যকেই নির্দেশ করে। বছরের অন্যান্য ঋতুগুলো এখন আর স্পষ্টত অনুভব করাও সম্ভব নয়। এমনকি বছরের যে সময়টাতে যে ধরনের প্রকৃতিগত বৈশিষ্ট্য অথবা উপসর্গ চোখে পড়ার কথা, সেই সময়ে সেই ধরনের উপসর্গ লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। ফলে একটা ঋতুর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য সম্পূর্ণ বিপরীতভাবে প্রতিভাত হচ্ছে। বলা বাহুল্য, বাংলাদেশের এই পরিবর্তনের মূলে রয়েছে বৈশ্বিক উষ্ণায়নের সরাসরি প্রভাব।
বৈশ্বিক উষ্ণতার বৈশ্বিক সতর্কবাণী, গোটা পৃথিবীতে মূর্তিমান আতঙ্ক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। গত কয়েক শতাব্দীর উষ্ণতা বৃদ্ধির যে হার, সাম্প্রতিক সময়ের উষ্ণতা বৃদ্ধির হারের তুলনায় তা কয়েক গুণ বেশি। উষ্ণতা বৃদ্ধির প্রধান কারণ হিসেবে বাতাসে কার্বন-ডাই-অক্সাইড-এর পরিমাণ বৃদ্ধিকেই দায়ী করা হয়। অবশ্য মিথেন, নাইট্রাস অক্সাইড, ক্লোরোফ্লুরো কার্বন প্রভৃতি গ্যাসও (বিশেষ করে মিথেন) উষ্ণায়নে ভূমিকা রাখে। দু’শ বছর আগে বাতাসে কার্বন ডাই অক্সাইডের মাত্রা ছিত্র ২৮০ পিপিএম। ১৯৭২ সালের মাঝামাঝিতে এই মাত্রা গিয়ে দাঁড়ায় ৩২৫ পিপিএম-এ। আর এই শতাব্দীর শুরুতে এর পরিমাণ ৩৭৫ ভাগের কাছাকাছি। আশঙ্কা করা হচ্ছে, বৃদ্ধির এই হার অব্যাহত থাকলে ২০৩৫-৪০ সালে দাঁড়াবে ৪৫০ পিপিএম এবং ২১০০ সালের মধ্যে তাপমাত্রা ১.৫-৪.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পাবে, যেখানে ১৮৬০ সালের পর বিশ্বের তাপমাত্রা বেড়েছে ০.০৬ থেকে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তাপমাত্রা বৃদ্ধির প্রভাব আমরা ইতিমধ্যেই টের পেতে শুরু করেছি। গত ২ মে যশোরের তাপমাত্রা ছিল ৪১ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং ঢাকার তাপমাত্রা ছিল ৩৯.৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস যা গত তিন চার দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ। গত ১৪ মে একটি শীর্ষ দৈনিকে একটা খবর চোখে পড়ল, মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জে কয়েক দিন ধরেই ঘন কুয়াশা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, আবহাওয়ার বিরূপ প্রভাবের কারণে প্রকৃতি এ ধরনের অসময়োচিত আচরণ করছে। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলা বাগেরহাটের বিস্তীর্ণ এলাকা জোয়ারের বর্ধিষ্ণু পানির আওতার মধ্যে চলে এসেছে। ফলে লবণের প্রভাবে কয়েক প্রজাতির গাছপালার অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়েছে। ইকোসিস্টেমেও ঘটেছে লক্ষণীয় প্রভাব। এ অঞ্চলের কয়েক প্রজাতির মাছ এবং পাখির অস্তিত্বও প্রায় বিলুপ্তির পথে। সিলেটের ভূ-প্রকৃতিতেও ইদানিং যে পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে তা আশঙ্কাজনক। আবহাওয়া বিষয়ক এক গবেষণায় দেখা গেছে, গত এগার বছরে সিলেটের তাপমাত্রা রাজধানী ঢাকার চেয়েও বেড়েছে। তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে সবচেয়ে বড় যে ক্ষতিটা হবে তা হল, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যাওয়া। বিগত কয়েক শতকে তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে মেরু অঞ্চলের জমানো বরফ গলে গিয়ে ইতিমধ্যেই সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বিপদসীমাকে অতিক্রম করতে শুরু করেছে, যা সমগ্র পৃথিবীকে এক ভয়াবহ পরিণতির দিকে ঠেলে দিচ্ছে। গত ১০০ বছরে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়েছে ১০-২০ সে.মি। বাৎসরিক এই বৃদ্ধির হার গড়ে ১-২ সে.মি এবং গত ৩০০ বছরের বৃদ্ধির দশ গুণ। এক হিসেবে দেখা যায়, ১৮৬০ সালে বেড়েছিল ০.৬ সি.মি, এবং ১৯৯৮ সালে বেড়েছিল ৯ সে.মি। এভাবে বাড়তে থাকলে ২০৩০ সালে বাড়বে ১২ সে.মি, ২০৫০ সালে বাড়বে ৩২ সে.মি এবং ২১০০ সালে বাড়বে ৮৮ সি.মি। যুক্তরাষ্ট্রের স্টানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের জলবায়ু বিজ্ঞানের অধ্যাপক ক্রিস ফিল্ড বলেছেন, ২০০০ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত যে তথ্য পাওয়া গেছে তা এই হিসেবের থেকেও অনেক বেশি। জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক আন্তঃসরকার প্যানেল (আই,পি,সি,সি) এক প্রতিবেদনে প্রকাশ করেছিল, জলবায়ুর এই পরিবর্তনের ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধিসহ মরুকরণ ও প্রলয়ংকারী ঝড় বৃদ্ধি পাবে এবং উদ্ভিদ প্রজাতির তিরিশ শতাংশ বিলুপ্ত হয়ে যাবে। অতিরিক্ত পানি গ্রাস করবে জনবসতিপূর্ণ ভূ-ভাগ। বেড়ে যাবে বন্যার প্রকোপ। লবণাক্ততা বৃদ্ধিতে ফসলের উৎপাদন কমে যাবে আশংকাজনক হারে। আর সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে পৃথিবীর যেসব দ্বীপ ও নিম্নাঞ্চল পানির নিচে তলিয়ে যাবে বাংলাদেশ ও মালদ্বীপ তার মধ্যে অন্যতম। তাই বাংলাদেশকে এই বিষয়গুলোকে মাথায় রেখে এখনই সম্ভাব্য ভয়াবহ পরিণতি থেকে নিজেদের রক্ষা করার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। কেননা, বাংলাদেশের প্রায় অর্ধেক জনসংখ্যাই বাস করে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে মাত্র দশ সেন্টিমিটার উচ্চতার মধ্যে। একে তো বাংলাদেশ ঘনজনবসতিপূর্ণ অতি ক্ষুদ্র আয়তনের একটি দেশ, তার উপর পানি বৃদ্ধির ফলে এই জনগোষ্ঠী উদ্বাস্তু হলে বাংলাদেশের পক্ষে তাদের পুনর্বাসন একেবারেই অসম্ভব হয়ে পড়বে। ইতিমধ্যেই মালদ্বীপের নবনির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দিয়েছেন, বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি হলে উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য অস্ট্রেলিয়া অথবা ভারতের ভূ-খন্ড কেনার কথা ভাবা হচ্ছে। বাংলাদেশকেও মালদ্বীপের মত আগে থেকেই এমনভাবে পরিকল্পনা নিতে হবে। যাতে উদ্ভূত পরিস্থিতি সহজেই সামাল দেয়া যায় এবং এখন থেকেই পরিকল্পনা মোতাবেক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। আর সেজন্য মালদ্বীপ বাংলাদেশের জন্য বড় একটা উদাহরণ হতে পারে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট বিপর্যয় মোকাবিলা করা বাংলাদেশের মত দরিদ্র দেশের একার পক্ষে সম্ভব নয়। এ কারণে যাতে বহির্বিশ্বের বিশেষ করে উন্নত দেশগুলো বাংলাদেশের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়ায় সেজন্য সরকারকে আশু পদক্ষেপ নিতে হবে। ইতিমধ্যেই এই জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সৃষ্ট দুর্যোগ এবং বিপত্তি মোকাবিলায় সার্বিক সহযোগিতার জন্য বাংলাদেশ সরকারকে মার্কিন যুক্তরাজ্য আশ্বস্ত করেছে। সম্প্রতি সুইজারল্যান্ডের উন্নয়ন সহযোগিতা বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী মার্টিন ডাহিনডেন আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রীর সঙ্গে এক বৈঠকে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় সহযোগিতা করার আশ্বাস দিয়েছে। বাংলাদেশ সরকারকে এই সুযোগগুলো হাতছাড়া করলে চলবে না।একটা বিষয় লক্ষণীয় যে, জলবায়ু পরিবর্তনের এবং এই সম্ভাব্য বিশাল বিপর্যয়ের প্রধান নিয়ামক কার্বন-ডাই-অক্সাইড নির্গমনের জন্য দায়ী বিশ্বের শিল্পোন্নত দেশগুলো। কিন্তু প্রাথমিকভাবে সেইসব দেশ এই বিপর্যয়ের শিকার হবে, বাতাসে কার্বন-ডাই-অক্সাইড ছড়ানোতে যাদের অবদান নিতান্তই কম। তদুপরি এই ধরনের দুর্যোগ মোকাবিলার জন্য যথাযথ আর্থিক সঙ্গতি এইসব দরিদ্র দেশের নেই বললেই চলে। অতএব, জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী দেশগুলোকেই এই ধরনের সমস্যা সমাধানের জন্য এগিয়ে আসতে হবে। আর সেজন্য এই মুহূর্তে বাংলাদেশের কর্তব্য হবে ক্ষতির সম্মুখীন অন্য দেশগুলোকে সাথে নিয়ে সংঘবদ্ধভাবে যাতে উন্নত দেশগুলো কার্বন-ডাই-অক্সাইড নির্গমন নিয়ন্ত্রিত রাখে সেজন্য চাপ প্রয়োগ করা এবং ইতিমধ্যেই যে ক্ষতি সাধিত হয়েছে তার জন্য ক্ষতিপূরণ দাবি করা। পাশাপাশি তাদেরকে বোঝাতে হবে যে, এর প্রভাব শুধুমাত্র উপকূলীয় দেশগুলোর উপরই পড়ছে তা নয়, সমগ্র পৃথিবীতেই একটা বিরূপ প্রভাব ফেলছে। সেইসঙ্গে বাংলাদেশকে অভ্যন্তরীণভাবে কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে, যাতে করে অপরিকল্পিত নগরায়ণ, বন ধ্বংস, নির্বিচারে বন্যপ্রাণী নিধন, যত্রতত্র বাঁধ নির্মাণ, পাহাড় কাটাসহ অন্যান্য পরিবেশ বিপর্যয়কারী কার্যকলাপ রোধ করা যায়। মোদ্দাকথা হল, গত কয়েক বছরের কথা আমলে নিয়ে এ বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যায় যে, বাংলাদেশের জলবায়ুতে ইতিমধ্যেই একটা নেতিবাচক পরিবর্তন সংঘটিত হয়েছে। এ বিষয়ে কালক্ষেপণের আর কোন সুযোগ নেই। সরকারকে এখনই এই ব্যাপারে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। এ বিষয়টিকে গুরুত্বের সাথে বিবেচনায় না আনলে অথবা অবহেলার চোখে দেখলে তা হবে গোটা জাতির জন্য আত্মঘাতী।

0 comments:

Post a Comment