Saturday, July 2, 2016

পরিবেশ: ছয় ঋতুর ছন্দেও ছেদ পড়ছে

পরিবেশ: ছয় ঋতুর ছন্দেও ছেদ পড়ছে
আলী ফোরকান
আমাজান রেইন ফরেস্ট বিশ্বের হাজারো জাতের জীবজন্তু ও উদ্ভিদের অন্যতম আবাসভূমি। বিশ্বের অর্ধেকের মত উদ্ভিদ, বন্যপ্রাণী ও কীটপতঙ্গ এ বনের বাসিন্দা। বিশ্বের উষ্ণতা বৃদ্ধি আর জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে আজকাল যে এত কথা হচ্ছে সে উষ্ণতা ও জলবায়ুর পরিবর্তনের লড়াইয়ে অন্যতম প্রধান অস্ত্র এ আমাজান বনাঞ্চল। কিন্তু বিশ্বের খ্যাতনামা বিজ্ঞানীদের মতে, এ আমাজান চিরতরে হারিয়ে যেতে পারে। কারণ আমাজান প্রতিবছর বায়ুমন্ডলের ২০০ কোটি টন কার্বন মনোক্সাইড শোষণ করে থাকে। তাই আমাজান বনের অনুপস্থিতি কী ভয়াবহ পরিণতি বয়ে আনবে, কল্পনা করতেও ভয় হয়। শুধু আমাজান নয়, এ শতাব্দীর মধ্যে অনেক বৃষ্টি প্রধান চিরহরিৎ বন হারিয়ে গেলে পৃথিবী ও জীবমন্ডলের জন্য মারাত্মক বিপর্যয় ডেকে আনার আশঙ্কা করছেন বিজ্ঞানীরা। বলা বাহুল্য, এ বিপর্যয়ের জন্য জলবায়ু পরিবর্তনের বিশ্বময় নীরব ঘাতক হিসেবে কাজ করছে। বৈশ্বিক তাপমাত্রা এখন যে হারে বাড়ছে, তা চলতে থাকলে এ শতাব্দীর মধ্যেই আমাজান বনটি যে ধ্বংস হয়ে যাবে, তার একটি আগাম চিত্র বিজ্ঞানীরা কম্পিউটারের সহায়তায় তুলে ধরেছেন। বিশ্বে উষ্ণায়ন বৃদ্ধির সঙ্গে জলবায়ুর অনেক উল্টোপাল্টা আচরণ আমাদের দেশের সাধারণ মানুষও এখন টের পেতে শুরু করেছেন। ছয় ঋতুর ঋতু বৈচিত্র্যের চিরচেনা ছন্দেও ছেদ পড়ছে। শীতকালে তেমন শীত নেই, গরমের মৌসুমে কখনওবা অতি গরম, বর্ষাকালেও নেই বৃষ্টি। আবার কখনওবা অতিবৃষ্টি ও ঝড়, জলোচ্ছ্বাস-এর মতো প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মধ্যেও জলবায়ু পরিবর্তনের কুফল সাধারণ মানুষের দৃষ্টিতেও ক্রমে স্পষ্ট হয়ে উঠছে। এ দেশের অভিজ্ঞ কৃষকের সবাই জানেন, তাদের দেখা অনেক প্রজাতির স্থল ও জলজ প্রাণী বা কীটপতঙ্গ ইতিমধ্যে প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এ বিলুপ্তির হার যে অতীতের তুলনায় আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে এবং এসবের জন্য দায়ী মূলত আমরাই, এটা হয়তো সাধারণ মানুষের অভিজ্ঞতা-উপলব্ধিতে ধরা পড়বে। টাইম ম্যাগাজিন এক নিবন্ধে বিজ্ঞানীদের দৃষ্টিতে নানা তথ্য এবং চিত্রসহকারে বিষয়টি তুলে ধরে বলেছে, পৃথিবী নামক এ গ্রহে ৮ মিলিয়ন প্রজাতির প্রাণী রয়েছে এবং প্রাণীকুলের প্রায় সবই মাদাগাস্কারের রেইন ফরেস্ট আন্দাসিব-এ দেখতে পাওয়া যাবে। আফ্রিকান দ্বীপ-দেশ মাদাগাস্কারের রেইন ফরেস্টকে ভিত্তি করে রচিত টাইম ম্যাগাজিনের তথ্যবহুল প্রতিবেদনটি। এ বনের ভেতর দিয়ে হাঁটাটা অনেকটা প্রাণীকুলের লাইব্রেরির ভেতর দিয়ে হাঁটার মতো। মাদাগাস্কারের শতকরা ৯০ ভাগ উদ্ভিদ এবং প্রায় ৭০ ভাগ প্রাণীই দেশজ, অর্থাৎ এগুলো একমাত্র এ দ্বীপেই দেখতে পাওয়া যায়। কিন্তু দ্বীপের উদ্ভিদ ও জীব বৈচিত্র্য যে হারে ধ্বংস হচ্ছে, তা অতীতের যে কোন সময়ের তুলনায় বহুগুণ বেশি। মাদাগাস্কারের প্রাণীজগৎ আগের যে-কোন সময়ের তুলনায় ধ্বংসের ঝুঁকির মধ্যেও রয়েছে অধিক মাত্রায়। এক সময়ের গহীন নিরবচ্ছিন্ন বনে আচ্ছাদিত মাদাগাস্কারে এমনিতে গত ১৫০০ বছর থেকে মানুষের বসতি বিস্তারের প্রয়োজনে শতকরা ৮০ ভাগ বন কাটা কিংবা পোড়ানো হয়েছে। ফলে বনে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা অনেক প্রাণী ও পশু এখন গৃহহীন। মানুষের অনিয়ন্ত্রিত শিকার বৃহৎ প্রজাতির অনেক পশুপাখি নিশ্চিহ্ন করেছে ইতিমধ্যে। প্রতিবেদনটিতে দশ প্রজাতির প্রাণীর চিহ্ন ছাপা হয়েছে। এ বিশ্বে যাদের কোনোটির সংখ্যা এখন ৬০-৭০ টির চেয়েও কম, কোনোটির সংখ্যা এক-দু’ হাজারের বেশি নয়। বাস্তবে অনেকেই আমরা এ বিরল প্রজাতির প্রাণীগুলো দেখিনি, তবে ছবির দিকে তাকিয়ে থাকলে মন খারাপ হয়ে যায়। কারণ এত সুন্দর এ জীবগুলো এ গ্রহ থেকে চিরতরে লোপ পেয়ে যাবে এবং আর কোনোদিনই ফিরে আসবে না তারা। বর্তমান মাদাগাস্কারে টিকে থাকা অবশিষ্ট প্রাণীকুলের জন্য দেশটিতে সরকারিভাবে খনিজ সম্পদ ও জ্বালানি অনুসন্ধান এবং জলবায়ুর পরিবর্তন মারাত্মক বিনাশের হুমকি তৈরি করেছে। বিজ্ঞানীদের মূল্যায়নে, এ পৃথিবীতে মানব সভ্যতার গোড়াপত্তনের পূর্বে ইতিহাসে বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণীকুলের বিলোপ-সাধন যে-হারে ঘটেছে, সে তুলনায় বিনাশের হার এখন হাজারগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশ্বের ইতিহাসে এ যাবৎ পাঁচটি বিনাশ বা ধ্বংস তরঙ্গের খবর জানা যায়। ২৫০ মিলিয়ন বছর পূর্বের আদিম ধ্বংস তরঙ্গে স্থলভাগের প্রক্রিয়া ঘটেছে, তাতে ডাইনোসরের রাজত্ব শেষ হয়েছে বলে জানা গেছে। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, বিলোপের মহা ৬ষ্ঠ তরঙ্গ হিসাবে যা চিহ্নিত হবে, আমরা এখন সে যুগে প্রবেশ করেছি। এ দফায় নানা প্রজাতির জীবকুলের ধ্বংস সাধনের জন্য ভূমিকম্প বা আগ্নেয়গিরির উদগীরণের মতো বড়ো প্রাকৃতিক বিপর্যয় দায়ী হবে না, এর জন্য প্রধানত দায়ী হব আমরা, মানব প্রজাতি। প্রকৃতপক্ষে এখন যে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি ও জলবায়ু পরিবর্তনের কথা বলা হচ্ছে, তা মানুষের মাত্রাতিরিক্ত বৃক্ষ কর্তন ও বনভূিম ধ্বংস, অতিরিক্ত পরিমাণে পেট্রোল-কয়লাসহ জীবাশ্ম জ্বালানি আহরণ ও ব্যবহার, গ্রিন হাউস এফেক্ট এবং ওজোন স্তরে ক্ষয়ের কারণে পৃথিবীতে অধিকমাত্রায় সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মির প্রবাহ বৃদ্ধি পাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। বিশ্বের উষ্ণায়ন ও জলবায়ুর অবাঞ্ছিত ও অপরিণামদর্শী এ পরিবর্তনের জন্য উন্নত বিশ্বের দেশগুলোকে প্রধানত দায়ী করেছেন বিজ্ঞানীরা। যেহেতু যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের শিল্পোন্নত দেশগুলো অধিক পরিমাণে গ্রিন হাউস গ্যাস উদগীরণের জন্য দায়ী এবং প্রধানত এ কারণেই বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাই এর দায়ভাগও উন্নত বিশ্বকেই অধিকহারে বহন করার জন্য বিশ্ব জনমতের চাপ বাড়ছে। উন্নত দেশসহ সবাই সম্মিলিতভাবে পদক্ষেপ নিলে বিশ্বের উষ্ণায়ন তথা জলবায়ুর পরিবর্তন রোধ করা সম্ভব হবে বলেও বিজ্ঞানীরা আশা করছেন। কিন্তু আতঙ্কের আর একটি বড় কারণ হল, আমাদের পরিবেশ সচেতনতার অভাব ও প্রাকৃতিক সম্পদের লোভের কারণে এমন এক বিশ্ব আমরা গড়ে তুলছি, যে বিশ্ব জীববৈচিত্র্যের দিক থেকে ভয়াবহ রকম দরিদ্র হয়ে উঠছে। আন্তর্জাতিক প্রকৃতি সংরক্ষণ আইনে ২০০৮ সালের মূল্যায়ন অনুসারে বিশ্ব জুড়ে এখন ৪টি স্তন্যপায়ী প্রাণীর মধ্যে ১টি ভয়াবহ ধ্বংসের ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। অতিরিক্ত মাচ শিকার এবং সমুদ্রে অম্লত্ব বৃদ্ধির ফলে সামুদ্রিক প্রাণীদের মধ্যেও বিলোপ সংঘটনের প্রক্রিয়া মারাত্মক রূপ নিতে শুরু করেছে। এক দল মেরিন বিজ্ঞানী জানিয়েছেন, জলবায়ু পরির্বতনের কারণে বিশ্বের মৎস্য ভান্ডারে বড় ধরনের পরিবর্তন আবশম্ভাবী। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে সমুদ্রের তাপমাত্রা বেড়ে যাচ্ছে। একই কারণে সামুদ্রিক ধারাও পাল্টে যাচ্ছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে কড, হেরিং ও চিংড়িসহ কয়েক হাজার প্রজাতির মাছ দুই মেরুর দিকে ধাবিত হবে। সে কারণে আগামী ২০৫০ সাল নাগাদ আটলান্টিক মহাসাগরের মৎস্যভান্ডার দ্রুত হ্রাস পেলে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের অর্থনীতি ও জীবনধারাতেও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে বাধ্য।পরিবেশ সংরক্ষণবিদদের আতঙ্ক সত্ত্বেও প্রশ্ন জাগে, এই ধ্বংসযজ্ঞ চলা সত্ত্বেও আমরা যারা অবশিষ্টরা বেঁচে থাকব, তাদের জন্য সামান্য পশুপাখি বা কীট-পতঙ্গের মৃত্যুতে কি বা আসে যায়? এটা টিক যে, বিবর্তনবাদে নানা প্রজাতির প্রাণীর বিলোপ সাধন স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। অসংখ্য প্রজাতির প্রাণী ইতিমধ্যে বিলুপ্ত হয়ে এখন শুধুই ইতিহাসের অংশ। মানুষের সভ্যতার ইতিহাসে প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই করে করে মানবজাতি আজকের পর্যায়ে বিকশিত হয়েছে। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকেও মানুষ যেহেতু সৃষ্টির সেরা জীব, প্রাণীজগতের বিলোপ বা সংহার প্রক্রিয়াকে এড়িয়ে মানুষ হয়তো নিজেকে ঠিকই রক্ষা করতে পারবে। সাধারণ জ্ঞানেও এমন বিশ্বাস অনেক মানুষের মনে কাজ করা স্বাভাবিক, আর করছে বলেই অনেকেই আশঙ্কা প্রকাশ করেন, তখন প্রশ্ন জাগতেই পারে তাতে আমাদের কী আসে যায়? মানুষের গড়ে তোলা সমাজ-সভ্যতার মধ্যে বিলিয়ন ডলারের কত শিল্প-কারখানা অচল বা ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। যেখানে সমাজে মানুষের জীবন-যাপনের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত হাজারো রকম সমস্যা নিয়ে আমরা হাবুডুবু খাচ্ছি, তখন কোথাকার কোন বনের এক কচ্ছপ বা সামুদ্রিক মাছের বিলুপ্তি নিয়ে মাথাব্যথা কেন? পরিবেশ বিজ্ঞানী ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণবাদীরাও এ প্রশ্নের জবাব দিয়ে মানুষের স্বার্থবোধকে প্রসারিত করাবার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। জীববৈচিত্র্যের বিনাশ সাধনের ফলে আমাদের কত ধরনের যে সমস্যা তৈরি হচ্ছে, তারও অসংখ্য দৃষ্টান্ত দেয়া হচ্ছে। একটা সত্য ভুলে যাওয়ার উপায় নেই যে, অসংখ্য প্রজাতির প্রাণীর মতো আমরাও এ বিশ্বের প্রাণী এবং বাঁচার জন্য অন্য প্রাণীর মতো আমরাও এ বিশ্বের উপর নির্ভরশীল। বিজ্ঞানীদের মতে, যত বেশিসংখ্যক প্রজাতির প্রাণী এ গ্রহে এমন এক অচ্ছেদ্য পরিবেশগত ভারসাম্যের মধ্যে বসাবস করবে, ততই সেটা স্বাস্থ্যকর ও উৎপাদনশীল হয়ে উঠবে। আমরা সবুজ বনে কিংবা কংক্রিটের জঙ্গলে বাস করি না কেন-যে বিশুদ্ধ পানি, বায়ু, অবিকৃত ভূমি বা অকর্তিত বন বণ্যপ্রাণীকে রক্ষা করে, তা আমাদেরকেও রক্ষা করে। আমরা এমন এক বিশেষ গ্রহে বাস করি-যা আমাদের অভিজ্ঞতায় একমাত্র প্রাণের আবাসভূমি। এ গ্রহের প্রাণীদের সংরক্ষণ চূড়ান্তভাবে মানুষের একটি নৈতিক বাধ্যবাধকতাও বটে। মনে রাখা দরকার, সবুজায়নের মাধ্যমে হারানো বন অনেকটা ফিরে আসতে পারে, বায়ু ও পানির দূষণ রোধ করাও সম্ভব হবে, কিন্তু অনেক প্রজাতির প্রাণী যা দ্রুত বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে তা আর কোনদিনই ফিরে আসবে না। তবে আশার কথা হল, আমরা মানবসৃষ্ট এমন এক মহাধ্বংসযজ্ঞের যুগে প্রবেশ করেছি, যেখানে মানুষই সিদ্ধান্ত নিতে পারে কোন প্রজাতির প্রাণীকে আমরা রক্ষা করাবার চেষ্টা করব, আর কোন প্রজাতির প্রাণীর সংহারকের ভূমিকা নেব। কাজেই দিকে দিকে ধ্বংসের পদধ্বনি শুনে আতঙ্কিত হওয়াটাই শেষ কথা নয়। বিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করেন, মানুষের কারণে যে সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে, একমাত্র মানুষই দিতে পারে তার সর্বোৎকৃষ্ট সমাধান।


0 comments:

Post a Comment