পরিবেশ: স্তন্যপায়ী প্রাণী বাদুড়
আলী ফোরকান
বাদুড় সামাজিক প্রাণী। দলবদ্ধভাবে বড় গাছের মগডালে ঝুলে থাকে। এরা রাতে শিকার ধরতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। এ বাদুড় নিশাচর ও বেশিরভাগই পতঙ্গ ও ফলভোগী। ভ্যাম্পায়ার বাদুড় ভয়ংকর হলেও এরা মানুষের প্রাণ বাঁচাতে পারে। ব্রেন স্ট্রোকের চিকিৎসায় এর লালার এনজাইম থেকে ওষুধ তৈরি করেছে একদল গবেষক। পরীক্ষামূলকভাবে যুক্তরাষ্ট্রের ১৫টি হাসপাতালে রোগীদের ওপর প্রয়োগ করা হয়েছে এ ওষুধ। বাদুড় বিপন্ন অবস্থায় টিকে আছে। সম্প্রতি আইইউসিএন বাংলাদেশ তাদের গবেষণা রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করে ১১৩টি প্রজাতির স্তন্যপায়ীর প্রাণীর তালিকা রেডবুকে প্রকাশ করেছে। এর মধ্যে ১০টি প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে গেছে। আবাসস্থলের অবস্থা ও প্রকৃতিতে জনগোষ্ঠী বা পপুলেশন সংখ্যার বিচারে বেশি শংকায় এই স্তন্যপায়ী প্রাণীরা। মানুষ কর্তৃক স্তন্যপায়ী প্রাণীর বসতি ব্যাপকহারে ধ্বংস হওয়ার ফলে বন্যপ্রাণীর মধ্যে এরাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। রেডবুকে ১৪টি প্রজাতির স্তন্যপায়ীর মধ্যে ১১টি অভ্যন্তরীণ ও ৩টি সামুদ্রিক। যদিও বাদুড় গাছে ঝুলে থাকে এবং বেশিরভাগ বাদুড়ই পতঙ্গভোগী। কিন্তু এ বাদুড়ও স্তন্যপায়ী প্রাণীদের অধিভুক্ত। এরা বর্তমানে বিপন্ন অবস্থায় পরিবেশে টিকে আছে। আমার দেখা বসন্ত পোলের গোরা থেকে পিরোজপুর শহরের শেখ পাড়ায় ৩টি বিশাল আকৃতির শিরিশ গাছে যেন এরা নির্বিঘেœ অভয়ারণ্য গড়ে তুলেছে। পাশাপাশি ৩টি শিরিশ গাছের ডালে হাজার খানেক বাদুড় তার ঠিকানা খুঁজে নিয়েছে। এদের সহাবস্থান দেখে মনে হয়েছে, এরা খুবই সামাজিক প্রাণী ও দলবদ্ধভাবে রাতে শিকারে অংশগ্রহণ করে। বর্তমানে আমার জানা মতে, বাংলাদেশে ২৯টি প্রজাতির বাদুড় রয়েছে। এরা বেশিরভাগই পতঙ্গভোগী ও নিশাচর। বিভিন্ন ধরনের কীট-পতঙ্গ এদের আহারের তালিকায়। তবে প্রজাতির বসতির ভিন্নতার ওপর ভিত্তি করে এদের খাদ্য পতঙ্গে কিছুটা বৈচিত্র্য থাকতে পারে। উদাহরণস্বরূপ যেসব প্রজাতির বাদুড় বেশি উঁচুতে উঠে কীট-পতঙ্গ ধরে তাদের খাদ্য তালিকায় ওইসব পতঙ্গ থাকবে যাদের শক্তিশালী ডানা আছে এবং বারবার উঁচুতে উঠতে পারে। যেসব প্রজাতি বনে-বাদাড়ে বাস করে অর্থাৎ কৃষক খামারের নিকটবর্তী থাকে এরা মূলত জলজ কীট শিকার করে। শিকারী প্রাণীর মতো বাদুড় প্রজাতিরা কীট-পতঙ্গের নাড়াচাড়াকে অনুসরণ করে শিকার করে। আবার ডাইনি বাদুড় সাধারণত রক্তচোষা হয়। যেমন ভ্যাম্পায়ার বাদুড় ভয়ঙ্কর প্রাণী। শিকারের সন্ধানে রাতে বের হয়। সবচেয়ে ভয়ঙ্কর প্রাণী, এর লালায় আছে এমন ক্ষতিকর উপাদান যা শিকারের রক্ত জমাট বাঁধতে দেয় না। এর ফলে রক্তচোষা বাদুড়টি অনায়াসে শিকারের শরীরে রক্ত প্রবাহ চুষে নিতে সক্ষম। বর্তমানে গবেষকরা দাবি করেছেন, ভয়ঙ্কর এ প্রাণীর লালা নিঃসৃত এনজাইম ব্রেন স্ট্রোকের চিকিৎসায় কাজে লাগতে পারে। ফলে এটি মানুষের প্রাণ বাঁচাতেও সক্ষম। স্ট্রোকে আক্রান্ত রোগীর প্রধান চিকিৎসা হলো জমাট বাঁধা রক্ত বা ক্লটগুলো ভেঙে ফেলা। গবেষকদের ধারণা, রক্তচোষা বাদুড়ের লালায় যে উপাদান রয়েছে তা রক্ত জমাট বাঁধতে দেয় না সেই এনজাইম উপাদানকে কাজে লাগিয়ে মস্তিষ্কের জমাট অংশ ভেঙে ফেলা যায়। এতে আক্রান্ত রোগীর রক্ত চলাচল স্বাভাবিক হলে রোগী সুস্থ হয়ে উঠবে। এ উপাদান দিয়ে ওষুধ তৈরি হয়েছে। ইতিমধ্যে অ্যামেরিকার ১৫টি হাসপাতালে এ ওষুধ ব্যবহার হয়ে আসছে। প্রাথমিকভাবে এ পরীক্ষা ইঁদুরের ওপর চালানো হয়েছিল। সফলতা শতভাগ পাওয়া গেছে। বাদুড়ের মুখম-লের অন্যতম আর একটি বৈশিষ্ট্য হলো এদের মুখের অগ্রভাগ বেশ লম্বা ও সুঁচালো। এর সাহায্যে এরা পাতার নিচে বসবাসকারী পতঙ্গ, লার্ভা বা ওয়ার্ম ইত্যাদি খাদ্য খুঁজে পায় সহজেই। অদ্ভুত এ প্রাণীকূল সত্যিই মানুষের দৃষ্টির অন্তরালে থাকে। আজকাল এটি তেমন চোখে পড়ে না। বাদুড় খুবই শান্তপ্রিয়। সামাজিক এই প্রাণীটিকে রক্ষা করতে হলে বড় বড় বৃক্ষ, উদ্যান পরিশেষে শ্যামলী নিস্বর্গকে টিকিয়ে রাখতে হবে। উড়ন্ত এ স্তন্যপায়ী অন্যান্য স্তন্যপায়ীর মতো বাচ্চা প্রসব করে এবং বাচ্চাগুলো মায়ের দুগ্ধ পান করে। এরা নিশাচর বটে, তবে গাছের ডালে দুপায়ে ঝুলে থাকে। বাদুড় খুবই দ্রুতগামী স্তন্যপায়ী। ফলভোজী বাদুড়ের পেশনদাত বেশ লম্বা ও মসৃণ। ক্রাউন লম্বালম্বি একটা খাঁজ বা চ্যানেল দ্বারা বিভক্ত, ফলে খাবার সময় এদের খাবার রস ওই চ্যানেল দ্বারা সহজেই মুখে চলে যায়। ফলভোজী বাদুড় প্রজাতি যেমন- বাদুড়, কলা বাদুড় , বোঁচা কলা বাদুড় প্রজাতিরা বিভিন্ন ধরনের ফল খেতে বড্ড উন্মাদ। বিশেষ করে আবাদি ও বনকলা, পেয়ারা, খেজুর, ডুমুর, বট গাছের ফল এরা দারুণ পছন্দ করে। ফলভোজী বাদুড় প্রজাতিরা কোনো ফলজ বৃক্ষের সন্ধান পেলে প্রতিরাতেই ওই বৃক্ষের ফল খেতে হানা দেয়। সাধারণত বাদুড়রা রাতের বেলায় আশ্রয়স্থল বা জড়ংঃঃরহম ঞৎবব ত্যাগ করে শিকারে নেমে পড়ে সারারাত খাদ্যের অন্বেষণ করে আবার ভোর হওয়ার আগেই দিবাকালীন বাসায় ফিরে যায়। খেচর স্তন্যপায়ী বাদুড়ের প্রজননকাল ও স্বভাব সাধারণত আবহাওয়া ও ঋতুর ওপর নির্ভরশীল। এদের প্রজনন ঋতু শুরু হয় শরতের শেষ দিকে। বেশিরভাগ পরিপক্ব বাদুড় এদের নিষেক সম্পন্ন করে। তবে অন্যান্য স্তন্যপায়ী থেকে এরা প্রজননিক দৃষ্টিকোণে একটু ব্যতিক্রম আর তা হলো নিষেকের পর পুরুষ বাদুড় কর্তৃক নিঃসৃত শুক্রাণু কোনরকম নিষেক ছাড়াই স্ত্রীর গর্ভাশয়ে সারা শীতকাল জুড়ে অবস্থান করে। কারণ ওই সময় স্ত্রী ডিম্বাশয় অনুৎপাদনশীল থাকে। শীতনিদ্রা শেষ হলে এরা প্রজননে তৎপর হয়। অতঃপর নিষেক সম্পন্ন হয় এবং ভ্রƒণ বৃদ্ধি পেতে থাকে। গবেষণায় দেখা গেছে, পতঙ্গভুক বাদুড় বছরের দুটি সময় প্রজনন সম্পন্ন করে । এ গোত্রের বাদুড় মার্চ থেকে মে মাসের মধ্যে তাদের প্রজনন সম্পন্ন করে। অন্যান্য পতঙ্গভুক প্রজাতি বছরের দ্বিতীয়ার্ধে বাচ্চা প্রসব করে। প্রাণী জগতে প্রজননকালের সঙ্গে পরিবেশের খাদ্যের পর্যাপ্ততা বিষয়টি বিশেষভাবে পরিলক্ষিত হয়। বাদুড়ের ক্ষেত্রে এটি বিশেষ ভাবে লক্ষণীয়। বছরের কোনো সময়ে পর্যাপ্ত খাদ্য সুবিধা থাকবে বা খাদ্যের অভাব হবে না তা বিচার বিশ্লেষণ করে বাদুড় বাচ্চা প্রসব করে। সে কারণে মার্চ-মে মাসে এরা বাচ্চা দেয়। যখন প্রকৃতিতে প্রচুর ফল, পর্যাপ্ত কীট-পতঙ্গ পেয়ে থাকে। ফলভোজী বাদুড়েরাও একই পথ অবলম্বন করে বাচ্চা দিয়ে থাকে। এরা সাধারণত একটি বাচ্চা প্রসব করে থাকে। তবে এর ব্যতিক্রমও হতে পারে। গায়ে কোনো লোম থাকে না, আবার থাকতেও পারে। বাচ্চা প্রসবের পর বাচ্চা মায়ের বুকের কাছে চলে আসে এবং হাতপায়ের নখর দ্বারা এরা পেটের লোম আঁকড়ে ধরে। এসময় বাচ্চাগুলো মায়ের স্তনে একটি বোটায় মুখ লাগিয়ে থাকে। মাতৃবাদুড় স্তনদানের সঙ্গে সঙ্গে বাচ্চার নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করে। ফলে মায়ের খাদ্য খোঁজার সময় সহজে বাচ্চা মায়ের কাছ থেকে আলাদা হওয়ার সুযোগ থাকে না। বড়ই বিচিত্র ও রহস্যপূর্ণ এই উড়ন্ত স্তন্যপায়ী বাদুড়ের জীবনকাল। পরিবেশে একমাত্র উড়ন্ত স্তন্যপায়ী প্রাণীটিকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে আমাদের একটু জনসচেনতাই কাম্য। প্রত্যেকেই একটু প্রাণীপ্রেমী মনোভাব নিয়ে এদের রক্ষায় এগিয়ে আসতে হবে। তবেই আমাদের পরিবেশে প্রাণীবৈচিত্র্য ও ভারসাম্যতা টিকে থাকবে।
0 comments:
Post a Comment