Saturday, July 2, 2016

পরিবেশ নিয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি কাম্য নয়

পরিবেশ নিয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি কাম্য নয় 
আলী ফোরকান
বাংলাদেশ ২০২১ সালের মধ্যে অর্থনীতির পরিভাষায় মধ্য আয়ের দেশে পরিনত হবে। আমাদের স্বপ্নের চাওয়ায়। সমৃদ্ধ ডিজিটাল বাংলাদেশে রূপান্তরিত হবে। যে জনসংখ্যাকে কখনো-বা মনে হয় সকল সমস্যার মূল, সেই জনসংখ্যাই জনসম্পদে রূপান্তরিত হয়ে দেশের সবচেয়ে বড় সম্পদ ও গর্বের কারণ হয়ে উঠবে। সুন্দরবনের রয়েল বেংগল টাইগার লুপ্ত হয়ে যেতে পারে, কিন্তু বাংলার বীর সন্তানেরা ক্রমেই বেশি বেশি হারে বিশ্বসভায় মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে থাকবে। দেশকে নিয়ে এরকম স্বপ্ন ও সাহস-যোগানো কথাবার্তার অভাব নেই। দেশ যারা চালান, সমস্যা-কাতর দেশবাসীকে সুদিনের স্বপ্ন দেখিয়ে সামনে এগোনোর প্রেরণা দেওয়াটা তাদের মহৎ দায়িত্বও বটে। এই দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে কারো কথায় ও কল্পনায় ভবিষ্যতের স্বদেশ সমৃদ্ধ সোনার বাংলা হয়ে উঠলে আপত্তির কিছু থাকতে পারে না। সুন্দর স্বপ্নের বিপরীতে আছে ধ্বংসের ভয়ও। ভয় ধরানো কারণেরও কমতি নেই। জলবায়ুর পরিবর্তনে ডুবে যাবে বাংলাদেশ। নদ-নদী শুকিয়ে মরুভূমি হবে অনেক অঞ্চল। জনসংখ্যার ভারে অচল ও পরিত্যক্ত ঘোষিত হবে দেশের রাজধানী। প্রাকৃতিক কারণ ছাড়াও এ সমাজে ভয় জাগানো উৎসের অভাব নেই যেন। স্বপ্ন আর নিরাপত্তা দেয় কতটুকু! বর্তমানের নানা সমস্যায় জেরবের হয় মানুষের জীবন। সমস্যাক্রান্ত মানুষকে ভয় সহজেই কাবু করে। আর গরিব এ দেশটায় বাঁচা-মরার সমস্যা বেশি বলে ভয়ের জন্ম ও বিস্তারও ঘটে সহজে। এই ভয়ের উপরেই আজকের কলামে খানিকটা আলোকপাত করা যাক। পরিবেশ-সাংবাদিকদের কল্যাণে জলবায়ুর পরিবর্তনজনিত কারণে বিশ্বের ক্ষয়ক্ষতি ইতিমধ্যে বিশ্বময় যথেষ্ট জনসচেতনতা তৈরি করেছে। খবরের কাগজ খুললেই পরিবেশ বিষয়ে ধ্বংসাত্মক খবরের ছড়াছড়ি। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে প্রাকৃতিক দুর্যোগের হার, তীব্রতা ও ধ্বংসযজ্ঞ বৃদ্ধি পাওয়ায় বাংলাদেশ এক ভয়াবহ পরিস্থিতির শিকার হতে চলেছে। ‘ইন্টারন্যাশনাল স্ট্র্যাটেজি ফর ডিজাস্টার রিডাকশন’ বাংলাদেশকে বন্যার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ, সুনামির ক্ষেত্রে তৃতীয় এবং ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষেত্রে ষষ্ঠ ঝুঁকিপূর্ণ দেশ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। এসব ধ্বংসযজ্ঞের ঝুঁকি নয় শুধু, সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশ ডুবে যাওয়ার আশঙ্কাটিও প্রকাশ করা হচ্ছিল জোর গলায়। গ্লোবাল ওয়ার্মিং- বা বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে হিমবাহ গলছে, স্ফীত হচ্ছে সমুদ্র বক্ষ। বিজ্ঞানীরা নানা তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে বলেছিল, ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের এক-পঞ্চমাংশ ডুবে যাবে। এসব কথাবার্তা যখন বিশ্বজলবায়ু নিয়ে কর্মরত ও জাতিসংঘের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আন্তর্জাতিক সংস্থার কর্তাব্যক্তিদের কণ্ঠে উচ্চারণ হয়, তখন ভয়ের কার্যকারিতা বেশি হওয়াই স্বাভাবিক। 
ডেনমার্কের রাজধানী কোপেনহেগেনে বিশ্ব জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক সম্মেলনের উদ্বোধনী বক্তৃতায় জাতিসংঘের ইন্টারগভর্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ (আইপিসিসি)-এর সভাপতি রাজেন্দ্র পচৌরি গ্লোবাল ওয়ার্মিং ও হিমবাহ গলে যাওয়া বিষয়ে যে উদ্বেগজনক তথ্য প্রকাশ করেছিলেন, তাতে বিশ্বের মানচিত্র থেকে কয়েকটি দেশ ও অঞ্চলের হারিয়ে যাওয়াটা অবধারিত হয়ে উঠেছিল বলা যায়। বিশ্ব জলবায়ু পরিবর্তনের অন্যতম ভিকটিম হিসেবে উপস্থাপন করা হয় বাংলাদেশকেও। কারণ আইপিসিসি-এর গবেষণা সমীক্ষায়, ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের এক-পঞ্চমাংশ বঙ্গোপসাগরে নিমজ্জিত হবে বলে দাবি করা হয়। রাজেন্দ্র পচৌরি আবেগসঞ্চারি কণ্ঠে বাংলাদেশের পাশে দাঁড়ানোর জন্য বিশ্ব সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বানও জানিয়েছিলন। কিন্তু বিরুদ্ধ মতাবলম্বীরা প্রশ্ন তুলেছেন আইপিসিসি ও পচৌরির উত্থাপিত বৈজ্ঞানিক তথ্যের সত্যতা নিয়ে। বিরুদ্ধবাদীদের পাল্টা যুক্তি ও দাবি দেখে সচেতন মানুষের মনে সংশয় জাগা স্বাভাবিক, আসলেই কি বাংলাদেশ ডুববে, নাকি বাংলাদেশকে কাল্পনিক ভিকটিম হিসেবে উপস্থাপন করা হচ্ছে বিশেষ কোনো ফায়দা হাসিলের জন্য?
গ্লোবাল ওয়ার্মিং বা ক্রমশই উষ্ণ হয়ে ওঠা পৃথিবীর ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন-আলোচনা চলে আসছে অনেক দিন ধরে। ১৯৯৭ সালে কিয়োটা প্রটোকল, ২০০৯-এর কোপেনহেগেনের বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন, উন্নত ও উন্নয়নশীল প্রতিটি দেশের সামনে কার্বন ডাইঅক্সাইড নির্গমন হ্রাসের একটা লক্ষ্যমাত্রা বেধে দেওয়ার জোর দাবি।।এসবের বিপরীতে বিরুদ্ধবাদীরাও মাঝেমধ্যে প্রশ্ন তুলেছেন, গ্লোবাল ওয়ার্মিং- এর সঙ্গে বাতাসে প্রতিনিয়ত বাড়তে থাকা কার্বন ডাইঅক্সাইড নিঃসরণের যুগসূত্র নিয়েও। বৈশ্বিক উষ্ণতা কি আসলে মহা বিপর্যয় ঘটানোর মতো পর্যায়ে যাবে শিগগির? বাতাসে মিশে কোটি কোটি টন কার্বন ডাইঅক্সাইড কি আসলেই বৈশ্বিক উষ্ণতা বাড়াচ্ছে? কোপেনহেগেন আন্তর্জান্তিক সম্মেলনের আগে ইন্টাগভর্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ (আইপিসিসি)-এর চেয়ারপার্সন রাজেন্দ্র পচৌরির হিমালয়ের হিমবাহের দ্রুত গলে যাওয়া সংক্রান্ত মন্তব্যে এ সংক্রান্ত সংশয় আপাতত বিতর্কের চেহারাও নিয়েছে। সম্মেলন চলাকালীন আইপিসিসির বক্তব্যের বিশ্বাসযোগ্যতার বিরুদ্ধে সরব হয়ে ওঠেন বিরুদ্ধ মতাবলম্বীরা। বিশ্ব উষ্ণায়নের সমর্থনে আইপিসিসির দেওয়া তথ্যপ্রমাণে সন্তুষ্ট নন তারা। বরং এ বিষয়ে তাদের উপস্থাপিত তথ্যপ্রমাণ ও যুক্তি ভিন্ন কথা বলেছে। পচৌরিকে পদত্যাগ করার জন্য চাপ দেয়া হয়েছে, কিন্তু তিনি পদত্যাগ করবেন না বলে জানিয়ে দিয়েছেন। এই বিতর্কে ইন্ধন জুগিয়েছে কোপেনহেগেন সম্মেলনের মুখে ‘ক্লাইমেটগেট কেলেঙ্কারি’। যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অফ ইস্ট অ্যাংলিয়া-এর ক্লাইমেট রিসার্চ ইনস্টিটিউট জাতিসংঘের হয়ে এ বিষয়ে গবেষণা ও তথ্য-উপাত্ত সরবরাহ করেছে। সেই ইনস্টিটিউট থেকে বেশকিছু ই-মেইল এবং চিঠি ফাঁস হয়ে যায়। পচৌরি বিরোধীরা বলেছেন, ফাঁস হয়ে যাওয়া চিঠি ও ইমেইল-এর তথ্য থেকে স্পষ্ট যে, শিল্প কারখানার কার্বন দূষণের ফলে তাপমাত্রা বৃদ্ধির গল্প তারা ইচ্ছা করেই তৈরি করেছেন। পৃথিবীর ইতিহাসে তাপমাত্রা বৃদ্ধির এবং কমে যাওয়ার নজির আছে। আইপিসিসি তাদের বক্তব্যের সমর্থনে ইচ্ছা মতো তথ্য সাজাচ্ছে, আবার অনেক তথ্য গোপন করছে। উপরন্তু উপস্থাপিত তথ্যের সমর্থনে আইপিসিসির হাতে কোনোও অকাট্য প্রমাণ নেই। জানা যায়, বাতাসে প্রতিদিন জমতে থাকা কোটি কোটি টন কার্বন ডাইঅক্সাইড-এর সঙ্গে বিশ্বের তাপমাত্রা বৃদ্ধির একটা সোজাসুজি সম্পর্ক আছে, এমন একটা ধারণা নিয়ে কাজ শুরু করেছিল আইপিসিসি। অন্যদিকে এ নিয়ে সংশয় ছিল একদল বিজ্ঞানীর। ভারতীয় কিছু বিজ্ঞানীর মতে, পৃথিবীর গত ২০০০ বছরের ইতিহাসে ১০০ বছরের স্কেলে উষ্ণায়ন এবং শীতলীভবন পর্যায়ক্রমে ঘটেছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতার হ্রাস-বৃদ্ধি বা উপকূলের ক্ষয় তারই ফলশ্রুতি। সমুদ্র উপকূলের সাম্প্রতিক অধিক ক্ষয়ের মূল কারণ ম্যানগ্রোভ অরণ্য কমে আসা এবং নদীর প্রবাহ কমে যাওয়ায় নদীবাহিত পলিতেও ঘাটতি পড়া। পচৌরির বিতর্কিত ‘হিমবাহ’ মন্তব্যকে খন্ডন করে হিমালয়ের হিমবাহ নিয়ে এক রিপোর্টে দাবি করা হয়েছে, ২০০০ সাল অবধি গঙ্গোত্রী বছরে ২০ মিটার করে কমেছে, তারপর তার ক্ষয় শ্লথ হয়েছে এবং ২০০৭ সালের সেপ্টেম্বর মাস থেকে ক্ষয় আর প্রায় হয়নি বললেই চলে। কাজেই পচৌরির দাবি অযৌক্তিক। অপর এক ভারতীয় বিজ্ঞানী দাবি করেছেন, গঙ্গোত্রী হিমবাহ যদি বছরে ৪০ মিটার করেও কমতে থাকে, তাহলেও ৩০ কিমি দৈর্ঘ্যরে একটি হিমবাহ গলতে ৭০০ বছর লাগবে। পাল্টা যুক্তির এখানেই শেষ নয়। দাবি করা হয়েছে, কোপেনহেগেন সম্মেলনে নিজ বক্তব্যের সমর্থনে পচৌরির পেশ করা উষ্ণতা বৃদ্ধির লেখাচিত্রটিও নাকি ছিল উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। গত ১৫০ বছরের তাপমাত্রা বৃদ্ধির যে হার তাতে দেখানো হয়েছে, সেখানে ১৯৭৫ থেকে ১৯৯৮-এর মধ্যে তাপমাত্রা বৃদ্ধির হার সর্বোচ্চ। বিরোধীরা বলছেন, ওই লেখাচিত্রটি থেকেই প্রমাণ করে দেওয়া যায়, ১৮৬০-৮০ এবং ১৯১০-৪০ সময়কালে তাপমাত্রা উল্লিখিত সর্বোচ্চ মাত্রায় পৌঁছেছিল। অর্থাৎ , গত ১০০ বছরের মধ্যে পৃথিবী আজকের মতো তাপমাত্রায় দু’একবার পৌঁছেছে এবং নিজগুণেই পুনরায় শীতলও হয়েছে। তার মানে উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে পৃথিবীতে তেমন কোনো ধ্বংসযজ্ঞ সাধন হয়নি। কাজেই আইপিসিসি-র সমীক্ষার দাবি অনুযায়ী, ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের এক-পঞ্চমাংশ বঙ্গোপসাগরে নিমজ্জিত হওয়ার বিষয়টি কতটা গ্রহণযোগ্য ও বিশ্বাসযোগ্য? বরং ৩০ বছর ধরে কৃত্রিম উপগ্রহ মারফত পাওয়া ও ছবির ভিত্তিতে দেশেরই সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল অ্যান্ড জিওগ্রাফিক্যাল ইনফরমেশন-এর বিজ্ঞানীরা বলছেন, প্রতি বছর বাংলাদেশের স্থলভাগ ২০ বর্গকিমি বৃদ্ধি পাচ্ছে। 
দেশ-বিদেশের পত্রপত্রিকায় গ্লোবাল ওয়ার্মিং এবং এর সঙ্গে বাতাসে কার্বন ডাইঅক্সাইডের পরিমাণ বেড়ে যাওয়া, হিমালয়ের হিমবাহ গলে যাওয়া এবং বঙ্গপোসাগরের বক্ষ স্ফীত হওয়া বিষয়ে বিজ্ঞানীদের এসব যুক্তি-তথ্য এবং পাল্টা যুক্তি-তথ্য সম্বলিত খবর পড়ে সচেতন পাঠকদের বিভ্রান্ত বোধ করা স্বাভাবিক। কে বলে দেবে কোনটা সত্য আর কোনটা নির্ভরযোগ্য? এ প্রশ্নের জবাবে আপাতত এটুকু বলা যায়, বিজ্ঞানের বিষয়ে এসব বিতর্কের সঠিক উত্তর আসবে বিজ্ঞানীদের কাছ থেকেই। সকল বিভ্রান্তি ও ধোঁয়াশা দূর করার দায়িত্বও নেবে তারা। তবে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রভাব ও ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে বিজ্ঞানীদের বহু পর্যবেক্ষণ ও তথ্য সত্য প্রমাণিত হয়েছে ইতোমধ্যে। বাংলাদেশে সমুদ্রে নিম্নচাপ বা বড় ধরনের ঘূর্ণিঝড় হলে আবহাওয়া বিজ্ঞানীরা নির্ভুলভাবে কয়েকদিন আগে ভবিষ্যদ্বাণী করে থাকেন। আবহাওয়া বিজ্ঞানীদের সেই সতর্কতা মিথ্যে ভেবে সতর্ক না হলে কী পরিণতি ও ধ্বংসযজ্ঞ হতে পারে, সেটাও দেশে বহু প্রাকৃতিক ঘূর্ণিঝড় প্রমাণ করেছে। কাজেই জলবায়ুর পরিবর্তনসংক্রান্ত বিজ্ঞানভিত্তিক সঠিক তথ্য জানার ও সেই মতে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেয়ার চেষ্টা করা প্রত্যেক দেশেরই বড় দায়িত্ব হয়ে উঠেছে, সেটা অস্বীকার করার উপায় নেই। একই সঙ্গে ধ্বংসের ভয় দেখিয়ে বা জনমনে আতঙ্ক ছড়িয়ে যারা বিশেষ ফায়দা লুটতে চায়, তাদের সম্পর্কেও বিশেষ সতর্ক হওয়ার প্রয়োজন আছে। 

0 comments:

Post a Comment