Saturday, July 2, 2016

পরিবেশ : হুমকির মুখে বিশ্ব প্রকৃতি

পরিবেশ : হুমকির মুখে বিশ্ব প্রকৃতি
আলী ফোরকান
বনভূমি উজাড় করে শিল্পের কাঁচামাল জোগানো হচ্ছে। ফলে সুনামি, ক্যাটরিনা, সিডর, নারগিস প্রভৃতি শব্দের সঙ্গে আজ বিশ্ববাসী ব্যাপকভাবে পরিচিত। কারণ গত দু-এক বছর ধরে বিশ্বব্যাপী যে হারে প্রাকৃতিক দুর্যোগ আঘাত হেনেছে, তা গত শতাব্দীতেও পরিলক্ষিত হয়নি। অথচ বিজ্ঞানীদের মতে, পরিবেশের ভারসাম্যহীনতাই এর একমাত্র কারণ। তারা আরো হুঁশিয়ার করে দিয়েছেন বর্তমান অবস্থা চলতে থাকলে আগামী দিনে পৃথিবী নামক এ গ্রহটির অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়তে পারে। তাই আজ বিশ্বব্যাপী পরিবেশ রক্ষার তাগিদে সবার মধ্যে একই সুর পরিলক্ষিত হচ্ছে।  পরিবেশকে বাঁচানোর তাগিদে প্রথম বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় সুইডেনের স্টকহোমে ১৯৭২ সালে। এ বৈঠকে গৃহীত পদক্ষেপগুলো কাগজে-কলমে থাকায় এবং বিশ্বব্যাপী এর কোনো বাস্তব প্রয়োগ না হওয়ায় অচিরেই পরিবেশ বিপর্যয়ের মুখে পতিত হয়। উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে বিশ্ববাসী। এর ফলে ‘পৃথিবীকে বাঁচাও এবং পরবর্তী প্রজন্মের জন্য অত্যধিক নিরাপদ পৃথিবী গড়ে তোলো’Ñ এ শ্লোগানকে সামনে রেখে ব্রাজিলের রিও ডি জেনিরোতে ১৯৯২ সালের ৩ থেকে ১৪ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত হয় দ্বিতীয় বিশ্ব পরিবেশ সম্মেলন। যা ধরিত্রী সম্মেলন নামে পরিচিত। ওই সম্মেলনে পৃথিবীর ১৭৮টি দেশের প্রতিনিধি এবং বিশ্বের প্রতিষ্ঠিত এনজিও সংস্থার প্রতিনিধিরা অংশগ্রহণ করে। এ সম্মেলনে ও পশ্চিমা দেশগুলোর অবাধ্য আচরণ সুস্পষ্ট রূপে বিশ্ববাসীর সামনে ফুটে ওঠে। ওই সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট মি. জর্জ বুশ সম্মেলনে গৃহীত প্রস্তাবমালায় স্বাক্ষর করতে অনীহা প্রকাশ করেন। কারণ পরিবেশ সংরক্ষণের জন্য ধরিত্রী সম্মেলনে গৃহীত প্রস্তাবগুলো মেনে চললে নাকি তাদের দেশের অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব পড়বে। রিও আয়োজকরা পরিবেশ ও পৃথিবীর উন্নয়নকল্পে ৭০ লাখ মার্কিন ডলার বরাদ্দের প্রস্তাব রেখেছেন। কিন্তু শোষণকারী বিশ্বের মোড়ল দেশগুলো তার চরম বিরোধিতা করেছিল। অথচ বিশ্বের পরিবেশ দূষণের জন্য ৮০ শতাংশ তারাই দায়ী। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, তারা এ ব্যাপারে এতোটুকু ছাড় দিতেও নারাজ। পশ্চিমা দেশগুলোর শিল্পের কাঁচামাল জোগানোর ফলে বিশ্বের ‘ফুসফুস’ বলে খ্যাত রেইনফরেস্ট আজ বিলীন প্রায়। প্রত্যেক বছর ৪০ লাখ হেক্টর রেইনফরেস্ট উজাড় করা হচ্ছে, এর মধ্যে এশিয়ার রয়েছে সিংহভাগ অর্থাৎ পায় ২০ লাখ হেক্টর। ফাও-এর মতে একটি দেশের পরিবেশ স্থিতিশীল থাকার জন্য মূল ভূখ-ের অন্তত ২৫ শতাংশ বনভূমি প্রয়োজন। অথচ আমাদের এ সুজলা সুফলা দেশের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, বাংলাদেশ ছিল বনাঞ্চলে ভরপুর। যেখানে ১৯৬৫ সালে দেশের বনভূমির পরিমাণ ছিল প্রায় ১৬ শতাংশ, তা বর্তমানে এসে দাঁড়িয়েছে ৭-৮ শতাংশে। বনখেকো ওসমান গনির মতো বন কর্মকর্তারা যে কি পরিমাণে বন উজাড় করেছে তা সম্প্রতি দেশব্যাপী আলোচিত হয়েছে। পানির দরে নিলামে বিক্রি করে দিয়েছে দেশের গর্ব, পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবনের বিখ্যাত গাছগুলো। বিগত সিডরের সময় এ ম্যানগ্রোভ বন আরো ল-ভ- হয়ে যায়। পরিবেশ ও আবহাওয়া বিজ্ঞানীদের মতে, সুন্দরবন না থাকলে সিডর আরো মারাত্মকভাবে আঘাত হানতো এবং এর ফলে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কয়েকশ গুণ বেড়ে যেতো। এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, পৃথিবীর প্রায় ৯৭ ভাগ পানি ব্যবহার ও খাওয়ার অনুপযোগী। মাত্র তিন ভাগ পানির মধ্যে বরফ জমাকৃত অংশে মাত্র পৌনে দুই শতাংশ পানি পৃথিবীর ৬-৭ কোটি মানুষ পান করে থাকে। আগামীতে পানি নিয়ে দেশে দেশে যুদ্ধ বেঁধে যাবে বলে ইতিমধ্যে পানি বিশেষজ্ঞরা হুশিয়ার করে দিয়েছেন। মরু অঞ্চল বাদে যেসব এলাকায় পানি সহজেই পাওয়া যেতো সেসব অঞ্চলেও পানির তীব্র সঙ্কট দেখা দিয়েছে। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ক্রমান্বয়ে নিচের দিকে নেমে যাওয়ায় ঘন ঘন ভূমিকম্প পরিলক্ষিত হচ্ছে বিশ্বজুড়ে। সুনামির শোক ভোলার আগেই সম্প্রতি নার্গিসের আঘাতে মিয়ানমারে প্রায় এক লাখ এবং চীনে ভূমিকম্পে প্রায় অর্ধ লাখ লোক নিহত হয়। বাংলাদেশেও পানির সঙ্কট আজ ব্যাপকভাবে পরিলক্ষিত হচ্ছে। উজানের দেশÑ এ দেশের নদীর গতি পরিবর্তন করে ও বাঁধ দিয়ে ইতিমধ্যে বাংলাদেশের ছোট বড় প্রায় আশিটি নদীর স্বাভাবিক গতিধারা নষ্ট করা হয়েছে। যে পদ্মা এক সময় খরস্রোতা নামে পরিচিত ছিল তাতে আজ কালের বিবর্তনে হাজার হাজার মাইল চর জেগে উঠেছে। শুধু খুলনা, রাজশাহী অঞ্চলের অর্ধ শতাধিক নদী মরে গেছে। পানির লেয়ার নিচে নেমে যাওয়ায় পানির পরিমাণ প্রচ- আকারে হ্রাস পাচ্ছে এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেশের অনেক নলকূপ আর্সেনিকের বিষ দ্বারা আক্রান্ত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূ-তত্ত্ব বিভাগ কর্তৃক আয়োজিত এক সেমিনারে প্রকাশ করা হয়, দেশের প্রায় এক কোটি টিউবওয়েল অর্সেনিকযুক্ত এবং তিন কোটি লোক আর্সেনিকযুক্ত পানি পান করছে। তদুপরি ফারাক্কা আজ জাতির গলার কাঁটা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।  বাংলাদেশের প্রধান সমুদ্র বন্দর আজ পরিবেশ দূষণের জন্য প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে দায়ী। অন্য এক সমীক্ষায় দেখা যায়, চট্টগ্রামের বন্দর পথে বছরে প্রায় ১৫০০-এর বেশি জাহাজ, ৭০০-এর বেশি ইঞ্জিন বোট, ট্রলার বোট, কার্গো বোট, স্টিমার ইত্যাদি থেকে সমুদ্রপৃষ্ঠে বর্জ্য নিক্ষেপ করা হয়। তাছাড়া সীতাকু- এলাকায় গত ত্রিশ বছরে প্রায় ২০ কিলোমিটার জুড়ে বৃহত্তর শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ড গড়ে তোলা হয়েছে। এ ইয়ার্ডে প্রতিবছর ৬০-৭০টি শিপ ভাঙা হয়। যার মধ্যে অধিকাংশ জাহাজে তেলবাহী ট্যাংকার রয়েছে। এর ফলে প্রায় ১৫০ মেট্রিক টন বর্জ্য ও তেল গভীর সমুদ্র্রে নিক্ষেপ করা হয়। বর্জ্যরে দ্বারা বেপরোয়া এ দূষণের ফলে যে সীতাকু- মাত্র ত্রিশ বছর আগেও ছিল মাছ শিকারিদের তীর্থস্থান, সেখানে আজ সময়ের বিবর্তনে ওই এলাকা মৎস্যশূন্য এলাকায় পরিণত হয়েছে। বিশ্ব ব্যাংকের হিসাবমতে, বর্তমান বিশ্বের ৮০ দেশের নিজস্ব সেচের পানি নেই অথচ বিশ্বের ৪০ শতাংশ মানুষ বসবাস করে এসব এলাকায়। তাই ২০২৫ সাল নাগাদ বিশুদ্ধ পানি নিশ্চিত করতে ঘোষিত হয়েছে এজেন্ডা ২১। গ্রিনহাউস প্রতিক্রিয়া এবং সিএফসি গ্যাসের অত্যধিক ব্যবহার বিশ্বব্যাপী পরিবেশের জন্য প্রচ- হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে। বিজ্ঞানীদের আশঙ্কামতে, ২০৩০ সাল নাগাদ সমুদ্রের পানির স্তর ৩০-৪০ মিটার বৃদ্ধি পাবে। আর জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে মেরু অঞ্চলের বরফ গলে সমুদ্রস্তরের উচ্চতা এক ফুট বাড়লে বিশ্বের প্রায় ২১ শতাংশ লোক ক্ষতির সম্মুখীন হবে। এর ফলে বাংলাদেশের সমুদ্র উপকূলবর্তী ৩ লাখ বিশ হাজার এলাকা প্লাবিত হবে। এতে ১৩.৪৭ শতাংশ আবাদি জমি, ২৮.৭০ শতাংশ বনভূমি ধ্বংস হয়ে যাবে। খুলনা, বরিশাল, পটুয়াখালী, ফরিদপুর, নোয়াখালীর ৫৬ লাখ একর জমি পানিতে তলিয়ে যাবে। এর ফলে প্রায় দেড় থেক দুই কোটি লোক শরণার্থী হয়ে পড়বে। বিশ্বের অন্যতম মেগাসিটি ঢাকার বাতাস আজ ক্ষতিকারক সিসা দ্বারা মারাত্মকভাবে দূষিত। ট্যানারি শিল্পের বর্জ্য এবং ঢাকার আশপাশের কলকারখানার বর্জ্য বুড়িগঙ্গা নদীতে ফেলার ফলে এ ঘনবসতি সিটি বহু আগেই পরিত্যক্ত নগরীর তকমা পরিধান করেছে। পরিবেশ দূষণকারী বিশ্বের ১৫টি দেশের মধ্যে ১৩টি দেশই এশিয়ায় অবস্থিত। হু এবং বিশ্ব ব্যাংকের এক গবেষণায় দেখা যায়, শুধু এশিয়ায় বায়ু দূষণের কারণে বছরে প্রায় ১৫ লাখ লোক মারা যায়। তাই আগামী প্রজন্মের জন্য দূষণমুক্ত পরিবেশ গড়ার জন্য বিশ্বব্যাপী পরিবেশের প্রতি যতœশীল হওয়ার কোনো বিকল্প নেই। খরা, বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, ভূমিকম্প থেকে বাঁচতে হলে সবুজ বনায়নের যথাযথ বাস্তব প্রয়োগ করতে হবে। পাশাপাশি ধরিত্রী সম্মেলনে গৃহীত পদক্ষেপগুলোর যথাযথ বাস্তবায়ন পারে পৃথিবীকে অনাকাক্সিক্ষত বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা করতে। 



0 comments:

Post a Comment