Friday, July 1, 2016

পরিবেশ: বিপন্ন জীববৈচিত্র্যের এক-চতুর্থাংশ প্রাণী ও উদ্ভিদ

পরিবেশ: বিপন্ন জীববৈচিত্র্যের এক-চতুর্থাংশ প্রাণী ও উদ্ভিদ
আলী ফোরকান 
পরিবেশ দূষণের নির্মম শিকারে বিপন্ন হতে চলেছে দেশের জীববৈচিত্র। পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে ও সংরক্ষণের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। এর মধ্যেও সময়োচিত সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ ও নিলে এগুলো রক্ষ করা সম্ভব । অথচ মানুষের জন্য অতি প্রয়োজনীয় সামগ্রী ও সেবার উৎস হচ্ছে বিভিন্ন জীবের জিন প্রজাতি ও প্রতিবেশ ব্যবস্থা তথা ইকো সিস্টেমগুলোর প্রকারভেদ। পৃথিবীর ক্রমবর্ধমান জনগোষ্ঠীর খাদ্য, ওষুধ ও অন্যান্য প্রয়োজন মেটাতে জীববৈচিত্র্যের প্রতি মানুষের বিরূপ কর্মকা- যে হারে বৃদ্ধি পেয়েছে তাতে বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা করছেন। আগামী ১৫ বছরের মধ্যে প্রায় ২৫ শতাংশ প্রাণী ও উদ্ভিদ পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। দেশের বরেণ্য প্রাণী, উদ্ভিদ ও পরিবেশ বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার আবাসন সঙ্কট মোকাবেলায় প্রতিনিয়ত উজাড় হচ্ছে বনভূমি, জলাশয়সহ প্রাণীকুলের অপরাপর বাসস্থান। এতে প্রাকৃতিক উৎস থেকে প্রাণীদের খাদ্য যোগান অসম্ভব হয়ে পড়েছে। ফলে এক সময় আমাদের চারপাশে সদম্ভে বিচরণকারী অনেক প্রাণীই এখন আর দেখা যায় না। বিশেষজ্ঞদের মতে, যদিও জীববৈচিত্র্য ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের জন্য দেশে সরকারিভাবে ২ লাখ ৪১ হাজার ৭৪৪ হেক্টর এলাকাকে ‘অভয়ারণ্য’ ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু বাস্তব অবস্থা হলো ‘কাজীর গরু কিতাবে আছে গোয়ালে নেই’। সততা ও আন্তরিকতার অভাবে সরকারের এসব বিধি-নিষেধ দেশে যথেষ্ট উপেক্ষিত। আর এ কারণে জীববৈচিত্র্য সমৃদ্ধ ও বিশ্ব ঐতিহ্যম-িত স্থান সুন্দরবন এখন অনেকটাই প্রাণীশূন্য হয়ে পড়েছে। আমাদের গর্বের ধন রয়াল বেঙ্গল টাইগার সংখ্যায় আশঙ্কাজনক হারে কমছে। গত ১০০ বছরের ব্যবধানে সুন্দরবন থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে অনেক মূল্যবান প্রাণী এবং বিলুপ্ত হতে চলেছে আরো অনেক প্রাণী। বিশিষ্ট পাখি বিশেষজ্ঞ, প্রকৃতি প্রেমিক ও কথাশিল্পী শরীফ খান জানান, ইতিমধ্যেই আমাদের দেশ থেকে হারিয়ে গেছে শেখ ফরিদ নামে খ্যাত কালো তিতির, জলা তিতির, কাঠময়ূর, বালি হাস, লাল মাছরাঙা, চন্দনাসহ ৪১ প্রকার দৃষ্টিনন্দন পাখি। পাহাড়ি ঘুঘু, হরিয়াল, রাজ শকুন দেখা যেতো মাত্র কয়েক বছর আগেও। বর্তমানে এগুলোর দেখা পাওয়া বিরল। একই অবস্থা গাঙচিল, হাড়গিলা, কোরাল ও খুন্তি বকের বেলাও। শরীফ খান আরো বলেন, গ্রামবাংলার যেসব নদীতে এক সময় শুশুক দেখাটা ছিল অতি সাধারণ নৈমিত্তিক ঘটনা, এখন ওইসব নদীর পাড়ে দিনের পর দিন বসে থেকেও একটিবারের জন্য শুশুকের ভেসে ওঠার দৃশ্য চোখে পড়ে না। এ রকম আরো অনেক প্রাণীই আমাদের চারপাশ থেকে হারিয়ে গেছে। এখন যা আছে সেগুলোও হারিয়ে যেতে বসেছে। অথচ আমাদের পরিবেশের জন্য, আমাদের সুস্থভাবে বেচে থাকার জন্য এগুলোর বিশেষ প্রয়োজন। তার মতে, মানুষের অজ্ঞতা, লোভ আর নির্বিচার পরিবেশ দূষণের কারণে প্রাকৃতিক পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য আজ হুমকির সম্মুখীন। বন দিবস উপলক্ষে রাজধানীতে অনুষ্ঠিত এক সেমিনারে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলেন, মানুষ কখনো তার লোভে আবার কখনো জীবন-জীবিকার প্রয়োজনে গাছপালা, পশুপাখির প্রাকৃতিক আবাসভূমি ধ্বংস করে, নির্বিচারে বৃক্ষ নিধন করে এবং বেআইনিভাবে পশুপাখি শিকারের মাধ্যমে এ পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। যতো বেশি সংখ্যায় মানুষ বাড়বে, এ নিধনযজ্ঞও ততোই বাড়বে। সেমিনারে উপস্থাপিত ‘বন্যপ্রাণীর ব্যবসা’ শীর্ষক এক প্রবন্ধে বলা হয়, প্রতি বছর ১৮৫ কোটি আমেরিকান ডলারের সমমূল্যের জীবন্ত প্রাণীর ব্যবসা হয়। এসব প্রাণীর মধ্যে রয়েছেÑ হনুমান, বানর, খাচার পাখি, রঙিন মাছ, সাপ, কুমিরসহ অন্যান্য সরীসৃপ ও উভচর প্রাণী। এর সঙ্গে আরো রয়েছেÑ বাঘ, হরিণ, সাপ ও কুমিরের চামড়া, হাতির দাত, বাঘের হাড় প্রভৃতি। সেমিনারে বিশেষজ্ঞরা বলেন, বর্তমানে বিশ্বব্যাপী মাদকদ্রব্যের পর এটিই হচ্ছে দ্বিতীয় বৃহত্তম অবৈধ ব্যবসা। ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর নেচার কনজারভেশন সোসাইটি (আইইউসিএন) বাংলাদেশের প্রাণী জগতের ওপর পরিচালিত এক গবেষণা রিপোর্টে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে স্থানীয় পাখির প্রজাতির সংখ্যা ৩৮৮ এবং বিভিন্ন দেশ থেকে এসে এ দেশে বসবাস করছে এমন পাখির প্রজাতির সংখ্যা ২৪৪টি। এর মধ্যে ১২ প্রজাতির পাখি ইতিমধ্যেই বিলুপ্ত হয়ে গেছে, আরো ৩০ প্রজাতির পাখি দ্রুত বিলুপ্তির পথে। উভচর প্রাণীর মধ্যে ২২টি প্রজাতিকে শনাক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে ৮টি প্রজাতি বিলুপ্ত হতে চলেছে। মোট ১২৬ প্রজাতির সরীসৃপের মধ্যে (সামুদ্রিক সরীসৃপও অন্তর্ভুক্ত) ১৪টি বিলুপ্তির পথে, ২৮ প্রজাতি বিপন্ন এবং প্রায় ২০ প্রজাতি অরক্ষিত অবস্থায় রয়েছে। স্তন্যপায়ী প্রাণীর সংখ্যা মোট ১২০টি, (সারা বিশ্বে এ সংখ্যা ৪ হাজার ৪০০টি) এর মধ্যে বর্তমানে ২২ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী বিলুপ্তপ্রায়, ১৩ প্রজাতি বিপন্ন এবং বাকি ৮ প্রজাতি বিপন্ন হওয়ার পথে। ওই গবেষণা অনুযায়ী, বাংলাদেশের জলসীমায় আছে বা থাকে এমন মাছের প্রজাতির সংখ্যা মোট ৭০৮টি। এর মধ্যে মিঠা পানির প্রজাতি ২৬৬ এবং সামুদ্রিক পানির প্রজাতি ৪৪২। তন্মধ্যে ৫৪ প্রজাতির মাছ বিলুপ্তপ্রায়। এদের বিপন্ন ও অরক্ষিত হিসেবে শনাক্ত করা হয়েছে। প্রাণী বিজ্ঞানী ও প্রাণী বিষয়ক লেখক গাজী এস এম হাসমত তার ‘বাংলাদেশের বিলুপ্ত বন্যপ্রাণী’ গ্রন্থে যেসব স্তন্যপায়ী প্রাণীকে বিলুপ্ত হিসেবে উল্লেখ করেছেন সেগুলো হচ্ছেÑ ডোরাকাটা হায়েনা, নেকড়ে, সুর ভাল্লুক, বড় একশিঙি গ-ার (ইনডিয়ান), ছোট একশিঙি গ-ার (জাভাদেশীয়), এশীয় দ্বিশিঙি বা সুমাত্রাগান গ-ার, বনগরু, বান্টেং, বুনো মোষ, কৃঞ্চষাড়, নীলগাই, জলার হরিণ (বার শিঙি) ও বামন শূকর। তিনি বিলুপ্ত পাখি হিসেবে গোলাপি শির হাস, ইনডিয়ান ময়ূর, বর্মি ময়ূর, বড় অ্যাডজুটান্ট, বাংলার ফ্লোরিকান, চিত্রিত বক ও রাজশকুনের কথা উল্লেখ করেছেন।পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, বাংলাদেশ ভূখ-ে এক সময় ১১০ প্রজাতির পশুর বিচরণ ছিল। এর মধ্যে আইইউসিএনের জরিপে ৪০ প্রজাতিকে তাদের ‘রেড ডেটা বুক’-এ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে ৩ প্রজাতির গ-ার, বুনো মোষ, নীলগাই, জল হরিণ, শূকর হরিণ, নেকড়ে প্রভৃতি একেবারে বিলুপ্তির পথে। অস্তিত্ব বিপন্ন হওয়ার মুখে রয়েছে বনরুই, রামকুত্তা, লাজুক বানর, উল্লুক, ধূসর হনুমান, উল্টোবাজি বানর, চশমাপরা হনুমান, সোনালি বিড়াল, মেছো বাঘ, মধুখেকো ভাল্লুক, হাতি, সাম্বার হরিণ প্রভৃতি। এছাড়া ১২ প্রজাতির সরীসৃপ এবং ৮ প্রজাতির উভচর প্রাণীর অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে পড়েছে। এর মধ্যে মিঠা পানির কুমির, ঘড়িয়াল, কয়েক প্রজাতির কচ্ছপ, উড়ন্ত টিকটিকি, তক্ষক, রক্তচোষা, গুইসাপ, পানা ব্যাঙ, চন্দ্রধোড়া ও গুলবাহার অজগর সাপ প্রায় বিলুপ্ত হয়ে এসেছে। বাংলাদেশ ন্যাশনাল হার্বেরিয়াম সূত্রে জানা গেছে, দেশে ঠিক কতো প্রজাতির গাছপালা রয়েছে এখন পর্যন্ত তার পূর্ণাঙ্গ তালিকা না থাকলেও ওষুধি, বনজ ও ফলদসহ পাচ হাজারেরও বেশি গাছপালা ছিল বলে দেশি-বিদেশি অনেক গবেষকের গ্রন্থে উল্লেখ রয়েছে। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, ইতিমধ্যে এর ১০ শতাংশ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। তবে আইইউসিএন বাংলাদেশে ১০৬ প্রজাতির গাছপালাকে তাদের রেড ডেটা বুকে অন্তর্ভুক্ত করেছে। অর্থাৎ এ প্রজাতিগুলোর অস্তিত্ব বিপন্ন। এর কোনো কোনো প্রজাতি ইতিমধ্যে বিলুপ্তও হয়ে যেতে পারে। বিলুপ্ত বৃক্ষ প্রজাতির মধ্যে রয়েছেÑ হিজল, তমাল, হেতাল, ধুপ, আগর, হরিতকি, বহেরা, উড়ি আম, বৈল আম, লক্ষ্মী আম, সন্ধি বেত, সর্পগন্ধা, অশ্বগন্ধা, হাতিশুড়, কেয়া, নীল নিশিন্দা, কুর্চি, তিতরাজ, হরগোজা, পানি কর্পূর, ঘৃতকুমারি প্রভৃতি। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইন্সটিটিউট সূত্রে জানা গেছে, এক সময় দেশে ১৬৬ প্রজাতির মিঠা পানির এবং ৪৪২ প্রজাতির সামুদ্রিক মাছ পাওয়া যেতো। আইইউসিএন এখানকার ৫৪ প্রজাতির মাছকে তাদের রেড ডেটা বুকে অন্তর্ভুক্ত করেছে। এর মধ্যে ভাঙনবাটা, মানদি, মহাশোল, তিলা শোল, ঘাউরা, রিঠা বাঘা আইড়, ঘোড়ামুখো, সরপুটি, চান্দা, তেলোটাকি, গাঙ মাগুর, প্রভৃতি ১২টি প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এছাড়া নাপিত কৈ, ঘইন্যা, ঢেলা, তিতপুটি, মধু পাবদা, গজার প্রভৃতি জাতিও ব্যাপকভাবে বিপন্ন হয়ে পড়েছে। মাছের বৈচিত্র্য ধ্বংস হলে জীবচক্রের এবং প্রতিটি জীবের খাদ্যচক্রের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে বিপর্যয় ডেকে আনবে বলে পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন। আমরা আশাকরি বিপন্ন জীববৈচিত্র্য রক্ষায় জিও এনজিও সহ সংশিলষ্ট সবাই এগিয়ে আসবে।

0 comments:

Post a Comment