পরিবেশ: আমাদের ও আমাদের নতুন প্রজম্মের ভবিষ্যৎ
আলী ফোরকান
বিভিন্ন দৈনিকে প্রতিদিনই খবর প্রকাশিত হচ্ছে। যা পড়লে একজন সচেতন মানুষ বিচলিত না হয়ে পারবে না। এ কি হচ্ছে? এ ও কি সম্ভব! ”সুন্দরবন জ্বলছে” ‘বন কর্মকর্তার করাতকল’ বনের পাশেই, অনুমোদনও নেই’, ‘মুমূর্ষু শালবনের নতুন বিপদ’, ‘বৈচিত্র্য হারাচ্ছে সুন্দরবন’, ‘বনদস্যুদের কবলে লাউয়াছড়া - হুমকির মুখে জীববৈচিত্র্য’, ‘শালবনে রহস্যজনক আগুন’ ইত্যাদি। কক্সবাজার ও বান্দরবানের ১১টি উপজেলায় প্রায় ৪৫ হাজার একর জমিতে তামাকের চাষ হয়েছে। এসব তামাকপাতা পোড়াতে চুল্লি তৈরির হিড়িক পড়েছে। সংরক্ষিত বনের গাছ কেটে তৈরি হচ্ছে এসব চুল্লি। একটি চুল্লি তৈরিতে বড় ধরনের ৬-৮টি গাছ লাগে। প্রতিটি চুল্লিতে গড়ে সাতটি করে ধরলে ১৬ হাজার চুল্লি তৈরি করতে লাগে ১ লাখ ১২ হাজার গাছ। আবার প্রতিটি চুল্লিতে জ্বালানি কাঠের প্রয়োজন হয় প্রায় ৬০০ মণ করে। সে হিসাবে ১৬ হাজার চুল্লিতে লাগে ৯৬ লাখ মণ কাঠ। এসব গাছ ও কাঠের সিংহভাগ জোগান আসে স্থানীয় সংরক্ষিত বনাঞ্চল থেকেই। বিশ্ব ঐতিহ্যের অন্তর্ভুক্ত হওয়া বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল সুন্দরবন। বাংলাদেশের পর্যটনের অন্যতম আকর্ষণ। অথচ বন রক্ষার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ না নেয়ায় দিনে দিনে বৈচিত্র্য হারাচ্ছে এ বন। লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাওয়া, নদীর ভাঙ্গন, প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঘনঘটা, সুন্দরবনের নদী-খালগুলোর নাব্যতা কমে যওয়া, বনের ভিতরকার প্রাকৃতিক জলাধার যা মিঠা পানির আধার তা ভরাট হয়ে যাওয়া ইত্যাদি প্রাকৃতিক বিরূপতার সাথে দুর্বল প্রশাসনিক ও রক্ষণাবেক্ষণ ব্যবস্থা, বন ব্যবস্থাপনায় স্থানীয় জনগণকে সম্পৃক্ত না করা এবং সুন্দরবনের উপর নির্ভরশীল লোকের সংখ্যা বৃদ্ধি যোগ হয়ে ঐতিহ্যবাহী এ বন জৌলুস হারাচ্ছে। এর সাথে আরও যোগ হয়েছে বনদস্যু আর পাচারকারীদের দৌরাত্ম্য। ২০০৫ সালে নীলকমল বিট অফিস থেকে আগ্নেয়াস্ত্র ডাকাতি হবার পর বনরক্ষীরা আগেয়াস্ত্র রাখার অনুমতি হারায়। এরপর থেকে তারা সশস্ত্র দস্যুদের বিরুদ্ধে বলতে গেলে খালি হাতে মুখোমুখি হয়। তাদের সম্বল থ্রিনট থ্রি রাইফেল আর শর্টগান। জনবলের অভাব তো আছেই। ছয় হাজার সতের বর্গকিলোমিটার আয়তনের সুন্দরবন রক্ষার জন্য সরকারের মঞ্জুরিকৃত জনবলের সংখ্যা ১ হাজার ১৬৭ জন। এর মধ্যে অনেক পদ দীর্ঘদিন ধরে খালি রয়েছে। একজন বনকর্মী প্রায় ৭ বর্গকিলোমিটার এলাকার বনজসম্পদ পাহারার দায়িত্ব পালন করেন। তাদের আবাসনসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধাও অপ্রতুল। সাইক্লোন সিডর বনবিভাগে ১২৬টি অফিস, আবাসন ধ্বংস করেছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আরও ৯৩টি অফিস এবং আবাসন। সেইসাথে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বন বিভাগের ৫৯টি জলযান, ২১টি জেটি। জনবল না বাড়ানো, জলযান, জেটি ও পল্টুন ইত্যাদির অপ্রতুলতা এবং এসবের রক্ষণাবেক্ষণ খাতে বাজেট স্বল্পতা, জ্বালানি তেলের অপর্যাপ্ততা, বনরক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ন্যায্য সুযোগ-সুবিধার অভাব ও আবাসন সংকট, বনাঞ্চলে কার্যকর টহলের ব্যবস্থা না থাকা, পৃথক বন আদালত গঠন না করা, ডাকাতের উৎপাত বেড়ে যাওয়া, সুন্দরবনের জন্যে স্বতন্ত্র ইকো-ট্যুরিজম নীতিমালা না থাকা, বনরক্ষীদের আধুনিক আগ্নেয়াস্ত্রের অভাব, সোর্সমানির ব্যবস্থা না থাকা ইত্যাদি সুন্দরবনের অন্যতম প্রশাসনিক ও রক্ষণাবেক্ষণ সমস্যা। মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান এলাকা সংরক্ষিত বনাঞ্চলের মূল্যবান গাছ কাটায় বিরানভূমি হতে চলেছে। নিজেদের আবাসস্থল হারিয়ে বন্যপ্রাণীগুলো লোকালয়ে বেরিয়ে মানুষের হাতে ধরা পড়ে প্রাণ হারাচ্ছে। এতে হুমকির মুখে পড়েছে জাতীয় উদ্যানের জীববৈচিত্র্য। এই জাতীয় উদ্যানের সংরক্ষিত বনাঞ্চল থেকে কাঠ পাচারকে ব্যবসা ও পেশা হিসাবে বেছে নিয়েছে কমলগঞ্জ ও শ্রীমঙ্গল উপজেলার সংঘবদ্ধ কয়েকটি গাছচোর চক্র। এ চক্রে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রভাবশালী নেতা-কর্মীরা রয়েছেন। প্রতিনিয়ত কাঠচোর চক্রের প্রায় দেড় শতাধিক সশস্ত্র লোক বিভিন্ন দলে ভাগ হয়ে বনাঞ্চলে প্রবেশ করে সেগুন, চাপালিশসহ মূল্যবান গাছ কেটে নিচ্ছে। গহীন অরণ্যের সরু রাস্তার পাশে কচুউনি, জোড়া সাইনবোর্ড, হরিত কিরতল, লতু উনিনেহ বিভিন্ন স্থানে আগে যেখানে ছিল শুধুই সেগুন গাছ এখন সেখানে পড়ে আছে গাছের মোথা। শক্তিশালী গাছচোর চক্রের হাতে লাঞ্ছিত এবং নিহত হওয়ার ভয়েও কেউ প্রতিবাদ করার সাহস পাচ্ছে না। ঢাকার ভাওয়াল গড়ের শালবন এক সময় ছিল উপমহাদেশে খ্যাত। ৬৫ হাজার একরের এই বনভূমির প্রধান গাছ শাল। এছাড়া আমলকী, হরিতকী, বহেড়া, বাজনা, হরগাজা, কাইকা, অশ্বত্থ, বট, জাম, বনবড়ই, বাঁশ, পটি, উলট চন্ডাল, আসামলতাসহ নানা বৃক্ষ-লতা-গুল্ম জšে§ এ বনে। অষ্টাদশ শতকে এ বনে বাঘের উপদ্রত এত বেড়েছিল যে, সরকার বাঘ মারার জন্যে পুরস্কার ঘোষণা করেছিলেন। এছাড়া ছিল বুনো মোষ, শম্বর, প্যারা হরিণ, চার ধনের বানর, হলুমান ও নানা ধরনের সরীসৃপ। আর আজকে এ বনের সবচেয়ে বড় প্রাণী হচ্ছে পাতি শিয়াল। ১৯৫০ সালের রাষ্ট্রীয় বিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইনে ভাওয়াল বন অধিগ্রহণ করা হয় এবং জেলা প্রশাসনকে বন এলাকা ফরেস্ট অ্যাক্ট ১৯২৭-এর ৩ থেকে ১৯ ধারা অনুসারে বন বিভাগকে বুঝিয়ে দিতে বলা হয় যা ৬০ বছরেও জেলা প্রশাসন করতে পারেনি। অথচ এই জেলা প্রশাসনই বিভিন্ন সময় বনের জমি বিভিন্ন ব্যক্তির নামে বন্দোবস্ত দিয়েছে, যা পরবর্তীতে ব্যক্তি মালিকানায় নথিভুক্ত হয়েছে। পরে জেনারেল সেটেলমেন্ট অপারেশনের আরএস জরিপে এসব ভূমি ব্যক্তির নমে রেকর্ড করা হয়। এই রেকর্ডের জোরেই শুরু হয় ভূমি দখলের সূত্রপাত। রাজেন্দ্রপুর জাতীয় উদ্যানের মধ্য দিয়ে ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়ক তৈরি করার পর থেকে এই দখলপর্ব জমে ওঠে। আর এখন শুরু হয়েছে অপরিকল্পিতভাবে সংযোগ সড়ক তৈরির খেলা। বন বিভাগ সেই যুক্তিই দেখিয়েছে আইনি জটিলতা। টঙ্গীর শিল্পনগরীতে জ্বালানি সরবরাহের জন্যে বন বিভাগ তিন ফুট ব্যাসের গাছ নিলাম শুরু করলেও চুরি করে এর চেয়েও কম ব্যাসের গাছ কাটা হয়েছে। বন ধ্বংসের আরেকটি প্রক্রিয়া চাষের জন্যে আগুন দেয়া এবং গাছের গোড়ায় গরম পানি ঢেলে গাছ মেরে ফেলা।
একই অবস্থা মধুপুরের শালবনের। মধুপুরের আড়নখোলা ইউনিয়নের ২৫০ একর বনের কয়েকশত শালবন গত এক বছরে কেটে ফেলা হয়েছে ফল বাগান করার জন্যে। এ এলাকার আনারস, কলার বাগানগুলোর মালিকেরা প্রভাবশালী এবং রাজনৈতিক মদদপুষ্ট। তাদের কল্যাণেই ৪৫,০০০ একরের শালবন এসে দাঁড়িয়েছে ৮,০০০ একরে। ৪০ বছর আগেও এই শালবন ছিল জীববৈচিত্র্যের আধার। শাল ছাড়াও গজারি, কড়ই, বহেড়া, হরিতকী, অর্জুন, সোনালু, জিগা, কাইক্কা, আমলকি, লালমনিয়া, তমাল, ডুমুর, কুর্চি, মহুয়াসহ নানা ধরনের বৃক্ষ ও ভেষজ গাছের সমাহার ছিল। অথচ এখন বিচ্ছিন্নভাবে শাল সমাহারের সাথে বন বিভাগেরই রোপণ করা ইউক্যালিপটাস আর আকাশমনির জঙ্গল ।উপরের ঘটনাগুলো একটিও আমার নিজস্ব মস্তিষ্কপ্রসূত নয়। গত কয়েকমাসের পত্রিকায় খবর হয়ে আসা ঘটনা প্রবাহের কিছু অংশবিশেষ। আমরা কিছুতেই মনে আনতে পারছি না যে, বন ধ্বংস করে আমরা আপত লাভবান হলেও আমরা আসলে নিজ হাতে ধ্বংস করছি আমাদের পরিবেশ, আমাদের সন্তানের ভবিষ্যৎ। তাদের জন্যে এই দেশটা আর বাসযোগ্য থাকবে না। উন্নত দেশের ভোগ-বিলাসের খেসারত দিতে আমাদের যা ক্ষতি হয়েছে তার ক্ষতিপূরণ হয়ত তারা দিবে। কোপেনহেগেনে না পারলেও কিছু আদায় করার ইচ্ছা আমাদের। কিন্তু আমরাই যে নিজের ঘরে নিজে আগুন জ্বালিয়ে ঘুমাচ্ছি -এই আগুন নিভাবে কে? শুধু সরকারের দিকে তাকিয়ে থেকে কি আমরা পুড়ে মরব? আমাদের নিজেদের কি করার কিছু নেই? দেশের প্রতিটি মানুষ যদি সচেতন না হয় তবে তো ধ্বংস হওয়া ছাড়া আমাদের আর গতি নেই। দেশের যুবসমাজ কিন্তু এ জায়গায় নেতৃত্ব দিতে পারেন। দেশের মানুষ সচেতন হলে যে সব সম্ভব তার প্রমাণ পাই যখন পত্রিকায় আসে বন্ধু-বান্ধব বা শিক্ষক বা সমাজের প্রভাবশালী কারো সহায়তায় বাল্যবিবাহ বন্ধ হয়। বেঁচে “যায় কোন কিশোরীর ভবিষ্যৎ।” আমরা যদি না জাগি মা কেমনে সকাল হবে/তোমার ছেলে উঠলে মাগো রাত পোহাবে তবে।’
0 comments:
Post a Comment