পরিবেশ বিপর্যয় : ফলপ্রসূ পদক্ষেপ চাই
আলী ফোরকান
পরিবেশ হচ্ছে আমাদের চারপাশের অবস্থা। যা আমাদের জীবনকে পরিবর্তিত বা প্রভাবিত করে। মার্সটন বেট্সের মতে, পরিবেশ হলো ‘সে সকল বাহ্যিক অবস্থার সমষ্টি যা জীবনের বৃদ্ধি ও সমৃদ্ধিকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে।’ মূলত মানুষের সমৃদ্ধির পরিমাণ অনেকাংশে নির্ভর করে পরিবেশ ভালো কি মন্দ তার ওপর। একটি শিশু যদি উন্নত পরিবেশে বেড়ে ওঠে তবে সে হবে সুস্থ, সুরুচিসম্পন্ন ও সুশিক্ষিত। অন্যদিকে মন্দ পরিবেশ তার মধ্যে জš§ দেবে স্বার্থপরতার, নিচতার ও অসামাজিক মনোভাবের। পরিবেশের বিভিন্নতার জন্যই একেক অঞ্চলের মানুষের জীবন প্রণালী একেক রকম। পরিবেশের উপাদানগুলো ঠিকমতো থাকলে জীববৈচিত্র্য বজায় থাকে, নইলে তা হুমকির মুখে পড়ে। তাই পরিবেশকে সুস্থ ও জীবনধারণের উপযোগী করে গড়ে তোলার জন্য আমাদেরকে আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। ঘন ঘন ঘটে যাওয়া প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে বোঝা যায়, পরিবেশ আজ মারাত্মক বিপর্যয়ের সম্মুখীন। এ বিপন্ন পরিবেশের জন্য আমরাই দায়ী এবং এর থেকে উত্তরণের চেষ্টা আমাদেরকেই করতে হবে। জনসংখ্যা বৃদ্ধি, কলকারখানা স্থাপন, উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার প্রভৃতি বিষয় পরিবেশ বিপর্যয়ের জন্য দায়ী। জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেলেও জমির পরিমাণ কিন্তু বাড়ছে না। ফলে আবাদি জমিতে এবং বনাঞ্চল পরিষ্কার করে মানুষ বসতি স্থাপন করছে। কল-কারখানার বর্জ্য ও কালো ধোঁয়া বাতাসকে বিষাক্ত করে তুলছে। অত্যধিক গাছ কাটার দরুন এবং ফুয়েল পাওয়ারের জন্য পেট্টোলিয়ামের মতো জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানোর ফলে প্রধান গ্রিন হাউস গ্যাস কার্বন-ডাই-অক্সাইড তৈরি হচ্ছে প্রচুর পরিমাণে, যা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। আজ বিশ্বে যে পরিবেশ বিপর্যয় দেখা দিয়েছে তার জন্য বায়ুমন্ডলে গভীর পরিবর্তন সূচিত হয়েছে। পানির বাষ্প, কার্বন-ডাই-অক্সাইড, নাইট্রাস অক্সাইড, মিথেন ও সিএফসি গ্যাস ও ভূ-পৃষ্ঠের কাছাকাছি অঞ্চলে তাপ ধরে রাখার মাধ্যমে গ্রিন হাউস প্রতিক্রিয়ায় ব্যাঘাত সৃষ্টি করছে। ফলে ওজোন স্তরে ফাটল দেখা দিয়েছে। এতে তাপমাত্রা বাড়ছে, বৃষ্টিপাতের বৈশিষ্ট্য ও বিশ্বের জলবায়ুতে পরিবর্তন আসছে। ইতিমধ্যেই বিশ্বের উষ্ণতা বৃদ্ধির দরুন মেরুর বরফ গলা শুরু হয়েছে এবং সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে। যদি জলবায়ু পরিবর্তনের প্রবণতা বন্ধ করা না যায় তবে ২০২৫ সালের মধ্যে ২০-২৫ ভাগ প্রাণী ও উদ্ভিদ পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে পারে- এমনটাই ধারণা পরিবেশবিজ্ঞানীদের। বিশ্বের তাপমাত্রা ২০৮০ সালের মধ্যে ১.৫-২.৫ সেলসিয়াস বৃদ্ধি পেতে পারে।পরিবেশ বিপর্যয়ের জন্য মোটামুটি সব দেশই দায়ী। যেমন আমাদের দেশের কথাই ধরা যাক। এখানে শতকরা ২৫% বনভূমি থাকা প্রয়োজন। অথচ সে পরিমাণ বনভূমি এখানে নেই। আবার যত্রতত্র ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠছে ইটভাটা, কল-কারখানা। ইটভাটাগুলোতে প্রতিদিন পুড়ছে হাজার হাজার মণ কাঠ। কল-কারখানার বর্জ্য পানিতে মিশে পরিবেশকে দূষিত করছে। তবে পরিবেশ দূষণের জন্য বেশি দায়ী ধনী দেশগুলো। বায়ুমন্ডলে মোট যে পরিমাণ কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্যাস নির্গত হয় তার শতকরা ৪০ ভাগ বা তারও বেশি হয়ে থাকে উত্তর আমেরিকা ও পশ্চিম ইউরোপের সাতটি ধনী দেশে। অথচ এসব দেশ এর দায়ভার নিতে নারাজ। পরিবেশ বিপর্যয়ে সবচেয়ে হুমকির মুখে পড়বে মালদ্বীপ, বাংলাদেশ, ভারত, ভুটান, নেপালের মতো অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলো। তাই এর থেকে উত্তরণের উপায় খুঁজতে হবে। সকল রাষ্ট্রকে আন্তরিকতার সঙ্গে একযোগে কাজ করতে হবে। শুধু সভা-সেমিনারের আলোচনার মধ্যে তা সীমাবদ্ধ রাখলে পরিবেশের বিরূপ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া অসম্ভব। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সম্মেলন, চুক্তি, কনভেনশনের মাধ্যমে বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। প্রতিটি রাষ্ট্রকে পরিবেশ রক্ষার জন্য গৃহীত ব্যবস্থা মেনে নিতে হবে এবং তা বাস্তবায়নে একনিষ্ঠভাবে কাজ করতে হবে। প্রতিটি দেশের অভ্যন্তরে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে এবং ব্যক্তি পর্যায়ে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। সরকারকে প্রথমেই আইন-শৃঙ্খলার প্রতি নজর দিতে হবে। কারণ ভালো আইন-শৃঙ্খলা সামগ্রিক উন্নতিকে ত্বরান্বিত করে। পাশাপাশি সরকারি পর্যায়ে বনায়ন প্রকল্পের মাধ্যমে একদিকে যেমন পরিবেশকে রক্ষা করা সম্ভব অন্যদিকে তা জনগণকে স্বাবলম্বী করে তুলতে পারে। তবে পরিবেশ রক্ষার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হচ্ছে সর্বস্তরের জনগণের সচেতনতা। সাধারণ মানুষ যদি সচেতন না হয় তবে কোনো পদক্ষেপই ফলপ্রসূ হবে না। সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে কাজ করতে পারে পরিবার, শিক্ষক, শিক্ষিত সমাজ, রাষ্ট্রীয় প্রচারণা তথা গণমাধ্যম। প্রতিটি মানুষ যদি নিজ জায়গা থেকে সচেতন হয়ে উঠি এবং পরিবেশ রক্ষায় অংশ নেই তবেই বিরূপ প্রভাব থেকে আমরা মুক্ত হতে পারবো এবং নিঃশ্বাস নিতে পারবো মুক্ত বাতাসে।
0 comments:
Post a Comment