পরিবেশের মারাত্মক চ্যালেঞ্জ: জলবায়ুর উষ্ণতা
আলী ফোরকান
পরিবেশজনিত সমস্যা নতুন নয়। পারিপাশ্বর্কি অবস্থা অনুকূল, উপকারী ও সহনীয় পর্যায় থেকে প্রতিকূল। ক্ষতিকারক ও অসহনীয় পর্যায়ে রূপান্তরিত হতে যথেষ্ট সময় লাগে। যদিও ১৯৮০ -এর দশকের শেষভাগ থেকে আমরা পরিবেশের উপর গুরুত্ব আরোপ করে আসছি। আমরা এ যাবৎ পরিবেশ সংরক্ষণের জন্য তেমন কোন কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারিনি। বাংলাদেশ একটি জনবহুল দেশ। যার অধিকাংশ লোক দরিদ্র। প্রাকৃতিক এবং কৃত্রিম (মানবসৃষ্ট) উভয়বিধ কারণে বাংলাদেশ মারাত্মকভাবে পরিবেশজনিত হুমকির সম্মুখীন। অতি সাম্প্রতিককালে শহর এলাকায় বায়ু দূষণ, ভূগর্ভস্থ পানি সংক্রমণ (আর্সেনিক ও অন্যান্য উপাদানজনিত), ভূবহিঃস্থ পানির দূষণ, নদী ও অন্যান্য পানির উৎসমূহের উপর প্রতিবন্ধকতা স্থাপন। শিল্পজাত পণ্য, গৃহস্থালী কর্মকান্ড ও ওষুধ তৈরীজনিত বর্জ্য নির্গমন, বন-নিঃশেষকরণ উন্মুক্ত স্থান সঙ্কোচন। জীব-বৈচিত্র্য হ্রাস এবং শব্দ দূষণ প্রভৃতির ফলে বাংলাদেশে পরিবেশজনিত সমস্যা প্রকট হয়ে উঠেছে। দূষিত বাতাস, যত্রতত্র ময়লা-আবর্জনার স্তুপ, খোলা বা উন্মুক্ত স্থানের অভাব। দূষিত ও সংক্রমিত পানি, অতি ঘন লোকবসতি, শব্দ দূষণ ও পরিবহন যানজট প্রভৃতির কারণে নগর জীবন দুর্বিসহ হয়ে উঠেছে। যদিও সাইক্লোন, টর্নেডো, বন্যা প্রভৃতি প্রাকৃতিক কারণজনিত পরিবেশগত হুমকি বা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা আমাদের জন্য সহজসাধ্য নয়, মানবসৃষ্ট কারণে উদ্ভূত পরিবেশজনিত সমস্যাগুলোর সমাধান আমাদের সম্পূর্ণ আয়ত্তের মধ্যেই রয়েছে। এরজন্য প্রয়োজন পরিবেশ সম্পর্কিত জ্ঞান এবং সচেতনতা। বলা বাহুল্য, কৃত্রিম বা মানবসৃষ্ট কারণগুলোই পরিবেশজনিত সমস্যার জন্য বেশীরভাগ ক্ষেত্রে দায়ী। অর্থ ও বিত্তশালী এবং পেশীশক্তিসম্পন্ন অনিয়ন্ত্রিতভাবে বেড়ে উঠা রিয়েল এ্যাস্টেট কোম্পানিগুলো তথাকথিত আবাসন সমস্যা সমাধানের নামে সকল প্রকার উৎপাদনশীল এবং বিনোদনমূলক ভূমিগুলো দিনের পর দিন গ্রাস করে চলেছে। ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা,কক্্রবাজার শহরে আকাশচুম্বী ফ্ল্যাট বাড়ি নির্মাণের জমজমাট ব্যবসা পরিবেশের উপরে মারাত্মক প্রভাব ফেলে চলেছে। গাছ কেটে ফেলা, পাহাড় কেটে ফেলা, নিচু জমি ফাইলিং করা, হাওর, বাঁওড় ও বিল ভরাট করা ইত্যাকার ফ্ল্যাট বাড়ি নির্মাণজনিত কর্মকান্ডের ফলে পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এবং জনদুর্ভোগ বাড়ছে। এ সকল রিয়েল এ্যাস্টেট কোম্পানিগুলো সামাজিক সার্থেও প্রতি তোয়াক্কা না করে নিজেদের ব্যবসায়িক স্বার্থকে বড় করে দেখে। এদের উপর কার্যকরী সরকারী নিয়ন্ত্রণ অতীব জরুরী। বিশাল জনগোষ্ঠীও পরিবেশের উপর বিরাট চাপ সৃষ্টি করছে। অধিক লোকের জন্য অধিক ভূমির প্রয়োজন। ফলে চাষযোগ্য জমি ও বনায়ন হ্রাস পাচ্ছে। ভূমির পরিমাণ বাড়ছে না, অথচ মানুষের পরিমাণ বা সংখ্যা বেড়েই চলেছে। ফলে পরিবেশ রক্ষাকারী সম্পদগুলো যথা: বন, পাহাড়, খোলা মাঠ প্রভৃতি হ্রাস পাচ্ছে এবং সীমিত ভূমির উপর অধিক মানুষের চাপ পড়ার দরুন ভূমিক্ষয় বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ প্রসঙ্গে গ্যারেট হারডিন রচিত পরিবেশজনিত প্রবন্ধ। গণদ্রব্যের দুর্দশা শীর্ষক লেখা থেকে উদ্ধৃতি দেয়া সমীচীন মনে করছি। হারভিন লিখেছেন, "একদল মেষপালক সরকারই চারণ ভূমিতে মেষের পাল চরাত। তাদের নিজ নিজ মেষের পালে তারা একটি একটি করে ক্রমান্বয়ে মেষের সংখ্যা বৃদ্ধি করে চলল। কিন্তু চারণভূমির আয়তন বাড়ল না। ফলশ্রুতিতে চারণভূমিতে মেষ চরানোর জন্য তার কোন ঘাসই থাকল না।" আমাদের দেশে জনাধিক্যের দরুন পরিবেশের অবস্থাও হয়ে পড়েছে তদ্রুপ; জীবন ধারণের জন্য প্রতিকূল। মানুষের চাপে অতিষ্ঠ। শিল্প বর্জ্য নির্গমন ও আমাদের দেশের টেকসই পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। বেশীরভাগ শিল্প-কারখানা নদীর তীরে অবস্থিত। পরিবেশ দূষণের কথা চিন্তা না করে কল-কারখানাগুলো তাদের বর্জ্যগুলো সরাসরি নদীতে ফেলে দেয়। বেশীর ভাগ (৪৯ শতাংশ) শিল্প-কারখানা দেশের উত্তর কেন্দ্রীয় অঞ্চলে অবস্থিত। উত্তর কেন্দ্রীয় অঞ্চলের ৩৩ শতাংশ শিল্প হচ্ছে বস্ত্র শিল্প, তৈরি পোশাক শিল্প এবং চামড়া শিল্প। এ সকল শিল্পের প্রায় পঞ্চাশ শতাংশ হচ্ছে ঢাকা জেলায় এবং ৩২ শতাংশ হচ্ছে নারায়ণগঞ্জে। দেশের মোট রাসায়নিক দ্রব্য, প্লাষ্টক ও পেট্রোলিয়াম শিল্পের ৬৫ শতাংশ ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুর জেলায় অবস্থিত। পরিবেশের জন্য সবচেয়ে ক্ষতিকর শিল্প হচ্ছে বস্ত্র শিল্প, চামড়া শিল্প, কাগজের কল, সার কারখানা, রাসায়নিক শিল্প এবং তৈল শোধনাগার। এ সকল শিল্পের বর্জ্যসমূহ নদীর পানিতে সরাসরি নির্গমন করা হয়। ফলে পরিবেশ হয়ে যায় মারাত্মকভাবে দূষিত। সার এবং কীটনাশক দ্রব্যের ব্যবহার পরিবেশের জন্য খুবই ক্ষতিকর। কৃষকেরা ফসলকে পোকা-মাকড়ের আক্রমণ থেকে রক্ষা করার জন্য কীটনাশক ওষুধ ব্যবহার করে থাকে। কিন্তু এ কীটনাশক ওষুধ কেবলমাত্র পোকা-মাকড় ধ্বংস করে না। ভূমির উর্বরতা শক্তি বৃদ্ধির জন্য সহায়ক অণুজীবগুলোকে ধ্বংস করে দেয়। ফলে জমির উর্বরতা শক্তি ক্রমাগতভাবে হ্রাস পাওয়ার দরুন জমির ভবিষ্যৎ উৎপাদনশীলতা হ্রাস পায়। ক্রমাগতভাবে বনের গাছ উৎপাটন ও পরিবেশকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। অতি বৃষ্টির সময় বনায়ন চাঁদোয়া হিসাবে কাজ করে। বনায়ন হ্রাস পেলে অতিবৃষ্টি সরাসরি মাটিকে আঘাত করে এবং মাটির পলি সরে যায়। যা বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে নদীতে চলে যায় ও নদী ভরাট হয়ে যায়। প্রকৃতপক্ষে উপরের সকল সমস্যাগুলো একে অপরের সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। অতি জনসংখ্যা, অনিয়ন্ত্রিত রিয়েল এস্টেট কোম্পানী, অপরিকল্পিত নগরায়ন ও শিল্পায়ন বনায়নকে হ্রাস করে এবং বনায়ন হ্রাসের ফলে কার্বন-ডাই অক্সাইডের স্তর বৃদ্ধি পায়। যা জলবায়ুর উষ্ণতা বৃদ্ধির অন্যতম প্রধান কারণ। বলাবাহুল্য, জলবায়ুর উষ্ণতা বৃদ্ধি হচ্ছে টেকসই পরিবেশের জন্য মারাত্মক চ্যালেঞ্জ। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য আমাদেরকে বাস্তবমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। বাংলাদেশে পরিবেশকে রক্ষা করার জন্য অনেক আইন আছে। কিন্তু আইনগুলোর বাস্তবায়ন হয়েছে অতি সামান্য। অতি সম্প্রতি প্রণীত পরিবেশ সংরক্ষণ আইনটি অভিনন্দনযোগ্য একটি পদক্ষেপ। আমরা এর দ্রুত ও কার্যকরী বাস্তবায়ন এবং প্রয়োগ আশা করছি। আমাদের মনে রাখতে হবে যে, আমাদের পরিবেশকে রক্ষা করতে হবে। পরিবেশের প্রয়োজনে নয়, বরঞ্চ আমাদেরকে সুখ, শান্তি ও সন্তুষ্টির জন্য। আমাদের ও আমাদের আগামী প্রজ¤œদের জন্যই পরিবেশকে রক্ষা করতে হবে।
0 comments:
Post a Comment