Thursday, June 9, 2016

প্রসঙ্গ: সড়ক দুর্ঘটনা: প্রিয়জন হারানোর বেদনা কীভাবে বুঝবে?

প্রসঙ্গ: সড়ক দুর্ঘটনা: প্রিয়জন হারানোর বেদনা কীভাবে বুঝবে?
আলী ফোরকান
 প্রায় প্রতিদিন খবরের কাগজের শিরোনাম হচ্ছে সড়ক র্দুঘটনা। সচেতনভাবে হোক আর সঠিক তথ্য না জানার কারণেই হোক সড়ক দুর্ঘটনার প্রধান কারণটি সামনে আসবে না। মহাসড়ক যদি মৃত্যুফাঁদ হয় তাহলে সেই ফাঁদে যে কোনো মুহূর্তে যে কেউ পড়তে পারে। দক্ষতা কিংবা সচেতনতা সেখানে মূল্যহীন হয়ে যায়। 
মহাসড়কে সরকারের দু’জন সচিব মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন। সেই সড়কের কথাই সবার আগে বলি। সবার নিশ্চয়ই মনে আছে, দশ-বারো বছর আগেও ঢাকার গাবতলী থেকে সাভার অংশে প্রায় প্রতিদিনই দুর্ঘটনা ঘটত। কিন্তু ২০০২ সালের পর মহাসড়কের ঢাকা-সাভার অংশে আর কোনো বড় দুর্ঘটনা দেখা যায়নি। এর কারণ হচ্ছে, মহাসড়কের এই অংশে সড়ক প্রশস্ত করে মাঝখানে ডিভাইডার দেওয়া হয়েছে। গাবতলী থেকে নবীনগর পর্যন্ত হাইওয়ে নির্মাণও হয়েছে খুবই পরিকল্পনামাফিক। কিন্তু নবীনগরের পর মহাসড়ক যতই এগিয়েছে, ততই বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে। মানিকগঞ্জের যে এলাকায় দুর্ঘটনা ঘটেছিল, সেই উথলীতে মহাসড়কের চিত্র দেখলে শিউরে উঠতে হয়। বিভিন্ন স্থানে খানা-খন্দকে ভরা এই মহাসড়ক যেন দুর্ঘটনার জন্যই প্রস্তুত রেখেছে কর্তৃপক্ষ। ধামরাইয়ের নয়াবাজার থেকে পাটুরিয়া পর্যন্ত পুরো মহাসড়কটিই ভয়াবহ মৃত্যুফাঁদ। এবার ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-সিলেট এবং ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের প্রসঙ্গ। প্রতিটি মহাসড়কই ভয়াবহ ঝুঁকিপূর্ণ। মেঘনা-গোমতী সেতু পার হওয়ার পর থেকে এটি আর মহাসড়কের পর্যায়ে নেই, একটি শাখা সড়কের মতো চট্টগ্রাম পর্যন্ত চলে গেছে। টানাটানি করে দুই লেনে শতসহস্র যানবাহন শাঁ শাঁ করে ছুটে যাচ্ছে। আর মহাসড়কে রয়েছে অপ্রত্যাশিত বাঁক। কুমিলল্গার চৌদ্দগ্রাম থেকে ফেনী পর্যন্ত বিভিন্ন স্থানে মহাসড়কের চেয়ে কম আয়তনের সেতু রয়েছে একাধিক। জানি না এ সড়ক কবে চার লেন হবে। বাজেটের আকার বাড়ে প্রতি বছর অথচ কাজ শুরু হয় না। ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের সংস্কার কাজ হয়েছে বছর ছয়েক আগে। এতে সড়ক মসৃণ হয়েছে, আবার দুর্ঘটনাও বেড়েছে। এর কারণ রোড ডিভাইডার নেই। ঢাকা-টাঙ্গাইল হয়ে উত্তরাঞ্চলগামী মহাসড়কের একই অবস্থা। শুধু রোড ডিভাইডার দেওয়া হলে মহাসড়কগুলোতে দুর্ঘটনার ঝুঁকি ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ কমে যাবে। দেশের সবচেয়ে ব্যয়বহুল রাজশাহী-নাটোরগামী বনপাড়া মহাসড়ক নির্মাণের মাত্র এক বছরের মাথায় ভেঙে চৌচির হয়ে গেছে। পরে আবার নামকাওয়াস্তে সংস্কার হয়েছে; কিন্তু এর জন্য শুধু চীনের নির্মাণ প্রতিষ্ঠানকে কালো তালিকাভুক্ত করে অন্যদের দায়মুক্তি দেওয়া হয়েছে। দেশের নিরপেক্ষ বিশেষজ্ঞরা বারবার বলেছেন, বনপাড়া মহাসড়কের নির্মাণকাজ ছিল ভয়াবহ ত্রুটিপূর্ণ। বিশেষ করে, রোড ব্যাংকিংয়ের স্বাভাবিক সূত্র মানা হয়নি। সম্প্রতি ডেমরা হয়ে ঢাকা-সিলেট সংযোগ সড়কে সুলতানা কামাল সেতু উদ্বোধন করা হয়েছে। এটি কাঁচপুর সেতুর বিকল্পও ভাবা হয়। কিন্তু এই গুরুত্বপূর্ণ সেতুটি খুবই অপ্রশস্ত, এর মাঝেও কোনো ডিভাইডার নেই। যানবাহন একটু বেশি চললেই দৃষ্টিনন্দন এই সেতুটি মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠবে, সন্দেহ নেই। কেন এই সেতুটি বাস্তবতা এবং ভবিষ্যৎ চিন্তা না করে এভাবে নির্মাণ করা হলো! 
অদক্ষ চালক দুর্ঘটনার বড় কারণ। আর রোড ডিভাইডারবিহীন মহাসড়কে বাস-ট্রাকচালকরা যেভাবে ওভারটেক করেন, দেখলে মনে হয় এখানে রেস চলছে। এসব বাস-ট্রাকের মালিক-শ্রমিক কারা? সবাই জানে পরিবহন খাত যখন যে সরকার আসে, তাদের একদল মাস্তানের হাতে জিম্মি থাকে। প্রতিটি সরকারের আমলে দীর্ঘদিনে পরিবহন সন্ত্রাসীদের অনেকেই রাতারাতি বড় বড় পরিবহন কোম্পানির মালিক বনে যায়। সংবাদমাধ্যমের রিপোর্ট অনুযায়ী, মর্মান্তিক দুর্ঘটনাও দ্রুতি পরিবহন চালকের বেপরোয়া ওভারটেকিংয়ের কারণেই হয়েছে বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন। ক্যাডার বাস চালকদের এই ওভারটেকিং নামের এই মরণ রেস বন্ধ করবে কে? পরিবহন সন্ত্রাসীরা পুলিশের তোয়াক্কা করে না। কারণ তাদের সঙ্গে অনেক বড় হোমরা-চোমরার লেনদেনের সম্পর্ক থাকে। আর পুলিশের সঙ্গে লেনদেনের বিষয় তো বলাই বাহুল্য। বিগত বিএনপি সরকারের সময়ে তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রী নাজমুল হুদার সামনেই বৈঠকে উপস্থিত পুলিশ কর্মকর্তাদের দিকে আঙুল তুলে পরিবহন মালিকরা পুলিশের চাঁদাবাজি ও মাসোয়ারার হিসাব দিয়েছিলেন। এখন কি সে অবস্থা বদলেছে? বাস্তব অবস্থা কী বলে? যে সময়  যে সরকারের আসে কিছু সুবিধাভোগী লোক আঙুল ফুলে কলাগাছ হওয়ার নিয়ম আমাদের দেশে বিদ্যমান। পরিবহন সেক্টর ও তার বাইরে নয়। সেই সুবিধাভোগীরাই দাপটের সঙ্গে পরিবহন খাত নিয়ন্ত্রণ করছেন। শুধু রাজধানীর ঢাকা সড়ক পরিবহন সমিতির নামে চাঁদাবাজির দখল নিয়েছেন বর্তমান সরকারের কিছু প্রভাবশালী অনুগত ক্যাডার। বাস-ট্রাক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন বলুন আর বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতি বলুন, সব সে নিয়ন্ত্রণেই চলছে। আর দুর্ঘটনার জন্য আইনে নামমাত্র শাস্তির বিধান তো আছেই। পুলিশ যদি এখন খুব কর্তব্যপরায়ণ হয়ে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে চায়, তাহলে তো ওই তিন বছরের সর্বোচ্চ শাস্থি। আর জামিনের বিধানও আছে। এই দুর্বল ফৌজদারি আইনে কী ব্যবস্থা নেবে পুলিশ! কোনো সরকারই পরিবহন সন্ত্রাসীদের ধর্মঘট আন্দোলনের ভয়ে আইন কঠোর করার উদ্যোগ নেয়নি। বর্তমান সরকারের আমলেও তার কোনো লক্ষণ নেই। চালকদের আরেকটি বিষয় লক্ষণীয়। যারা বাস-ট্রাকচালক, তাদের বেশিরভাগই পরিবারবিহীন যাযাবরের জীবন কাটান। বেতন কম দেওয়ার কৌশল হিসেবে চালকদের যাযাবর জীবনে অভ্যস্ত করে তোলেন মালিকরা। এই চালকরা নিজেদের জীবনের প্রতি কোনো মায়া অনুভব করে না, এরা অন্যের জীবনের মূল্য কীভাবে বুঝবে? যারা পরিবারের ¯েœহ-মমতা পায়নি, তারা প্রিয়জন হারানোর বেদনা কীভাবে বুঝবে? যে চালকরা নিজেরাই প্রচন্ড রকম অসহায়, তাদের ভুলে অনেক পরিবার অসহায় হলে তাদের কী-বা আসে যায়! রাজধানীর ভেতরে যেসব বাস চলে, লক্ষ্য করলে দেখা যায়থ কিছু চালক কিশোর বয়সী। এরা অনেকে গাড়িতে ঘুমায়, উচ্ছৃ´খল জীবনের কারণে নেশাসক্ত হয়, যারা বেপরোয়া জীবনে অভ্যস্ত তাদের কাছ থেকে দায়িত্বশীলতা আশা করা বোকামি। শিশু হামীমকে চাপা দেওয়ার পর আটক চালকের মন্তব্য এর বড় প্রমাণ। তার মন্তব্য ‘ব্রেক ফেল হলে তো দু’চারডা মরতেই পারে আর মালিক তো এক ঘণ্টা পরেই ছাড়াইয়া নিব।’
প্রতি বছর সড়ক দুর্ঘটনায় বারো হাজার কেন, আরও বেশি মানুষ মারা যাবে- এটা আমাদের মেনে নিতে হবে। যে কোনো সময় যে কোনো প্রিয়জনকে হারানোর জন্য মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে থাকতে হবে। কারণ আমরা জানি, বড় বড় দুর্ঘটনার পর লেখালেখি হবে, মন্ত্রণালয়ে দু’চারটি মিটিং হবে, রাস্তায় মানববন্ধন হবে, সভা-সেমিনার হবে; কিন্তু সরকার কিংবা দায়িত্বে থাকা সরকারি দফতরগুলোর তাতে কিছুই আসে যাবে না। অসহায়ত্ব যে দেশের মানুষের বড় সান্তনা, সে দেশে ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ শ্লোগানের মূল্য কোথায়? 

0 comments:

Post a Comment