Tuesday, June 7, 2016

প্রসঙ্গ শিক্ষার্থী: সমস্যা ও ভাবনা নিয়ে গবেষণা দরকার

প্রসঙ্গ শিক্ষার্থী: সমস্যা ও ভাবনা নিয়ে গবেষণা দরকার
আলী ফোরকান
বয়স্কদের কাছে শিক্ষার্থীদের ইচ্ছের কোন মূল্য নেই। কারণ তারা শিশু, বয়স কম। এ বিষয়ে কোন গবেষণা’ও চোখে পড়েনি। গবেষণা থাকার কথাও নয়। কারণ শিশুদের এ ধরনের ভাবনা কেউ আসলে জানতে চায় না। কিংবা এটা যে ভালো এটা বিষয় হতে পারে, তা হয়তো প্রাপ্তবয়স্করা উপলব্ধিই করতে পারেন না। 
প্রাপ্তবয়স্করা চাইলে যে কোন সময় নিজেদের মূল কাজ বদলে ফেলতে পারে। আজকে এই কোম্পানির চাকরি ভালো না লাগলে অন্য কোম্পানির চাকরি খুঁজতে পারে। এ ব্যবসা ভালো না লাগলে অন্য ব্যবসা বা ব্যবসা বাদ দিয়ে চাকরির খোঁজে লেগে যেতে পারে। এই মালিকের শ্রমিক না থাকতে চাইলে অন্য মালিকের সন্ধান করতে পারে। বেকার থাকতে থাকতে অতিষ্ঠ হয়ে উঠলে নিজের যোগ্যতায় চাকরিও নিয়ে নিতে পারে। এই পরিবর্তনের ইচ্ছেটা যদিও অবস্থান-সময়-অর্থ ইত্যাদি নানা বিষয়ের ওপর নির্ভরশীল। তবে এক্ষেত্রে ব্যক্তির নিজের ইচ্ছেটাই মুখ্য হয়ে ওঠে। যেখানে মন টিকে না, সেখান থেকে সরে এসে তুলনামূলক ভালো অবস্থানে যাওয়ার চেষ্টা চালায় সবাই। 
প্রাপ্তবয়স্কদের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের অন্যতম পার্থক্য হল, শিক্ষার্থীদের এ ধরনের ইচ্ছের কোন মূল্য নেই তাদের কাছে। কারণ তারা শিশু ও বয়স কম। তারা চাইলেই পড়ালেখা বাদ দিয়ে অন্য কিছু শুরু করে দিতে পারে না। পড়ালেখা বাদ দিয়ে দিতে পারে না বা বিদ্যালয় পছন্দ না হলে অন্য বিদ্যালয়ে চলে যেতে পারে না। অর্থনৈতিক বা অন্য কারণে কোন শিশুর পড়ালেখা বাদ দিতে হলে বা বিদ্যালয় বদলাতে হলে সেটা অভিভাবকই নির্ধারণ করে দেন।
একজন শিক্ষার্থীর যদি বিদ্যালয় ছেড়ে অন্য কিছু করতে বা বিদ্যালয় বদলাতে ইচ্ছে করে, তাহলে সেটাকে অনধিকার চর্চা হিসেবেই দেখা হয়। অভিভাবকদের মনে হতে পারে সনন্তান পাগলামো শুরু করেছে, অতএব ধরে শক্ত মার দেয়া দরকার। বকাবকি তো চলবেই। কিন্তু প্রাপ্তবয়স্করা যদি বয়স বা অভিভাবকসুলভ প্রেজুডিস বাদ দিয়ে শিক্ষার্থীদের পড়ালেখা করা বা না করা সম্পর্কিত সিদ্ধান্ত নেয়ার স্বাধীনতা দেয় কিংবা না দিলেও অন্তত তাদের স্বাধীন মতামত শুনতে চায়। তাহলে পরিস্থিতিটা কেমন হতে পারে? 
আজকে যদি শিক্ষার্থীদের বর্তমান বিদ্যালয় বাদ দিয়ে অন্য একটি পছন্দমতো বিদ্যালয় বেছে নিতে বলা হয়, তাহলে তাদের কতজন বর্তমান বিদ্যালয়ে যাবে? কিংবা তাদের যদি পড়ালেখা বাদ দিয়ে যা ইচ্ছে করতে বলা হয়, কতজন শিক্ষার্থী পড়ালেখা চালিয়ে যাবে? নাট্যকার হুমায়ূন আহমেদের একটি নাটকে দুটো শিশুকে এ ধরনের স্বাধীনতা দেয়া হয়েছিল। তারা অবশ্য কিছুদিন পরে এই ‘স্বাধীনতা’ চায় না বলে জানিয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে এ ধরনের পরীক্ষা করা হলে তার ফলাফল কী হতে পারে?
এখনও এ বিষয়ে কোন গবেষণা অবশ্য আমরা দেখিনি। গবেষণা থাকার কথাও নয়, কারণ শিশুদের এ ধরনের ভাবনা কেউ আসলে জানতে চায় না। কিংবা বলা ভালো এটাও যে জানার বিষয় হতে পারে, তা হয়তো প্রাপ্তবয়স্করা উপলব্ধিই করতে পারেন না। বিভিন্ন গবেষণায় শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে যে ধরনের তথ্য বা মতামত জানতে চাওয়া হয়, সেগুলোও মূলত একটা কাঠামোর মধ্য থেকেই জানতে চাওয়া হয়। শিশুকে বিদ্যালয়ে যেতেই হবে, এটা ধরে নিয়ে’ই গবেষকরা শিক্ষার্থীদের ‘আর কী কী করা হলে তোমাদের কাছে বিদ্যালয় ভালো লাগবে’ জাতীয় প্রশ্ন করে শিশুদের মনোভাব বোঝার চেষ্টা করেন। কিন্তু সুযোগ বা স্বাধীনতা দেয়া হলে কতজন শিক্ষার্থী নিজের ইচ্ছায় বিদ্যালয়ে যেত কিংবা বিদ্যালয়ে গেলেও বর্তমান বিদ্যালয়ে যেত, তা নিয়ে সন্দেহ থেকে যায়।
আমাদের দেশের বিদ্যালয়গুলো শিক্ষার্থীদের কাছে আকর্ষণীয় নয়। বিদ্যালয়ের লেখাপড়া তাদের কাছে আনন্দদায়ক’ও নয়। সামান্য কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া এমনই হচ্ছে শিক্ষার্থীদের কাছে বিদ্যালয়ের অবস্থান। তার মানে কি এটা হতে পারে, বয়সজনিত কারণে শিক্ষার্থীদের কাছে পড়ালেখাটাই উপভোগ্য নয়? এ সময় তারা গান গাইতে পছন্দ করে, খেলাধুলা করতে পছন্দ করে, দুষ্টুমি করতে পছন্দ করে কিংবা ছবি আঁকতে পছন্দ করে, কিংবা পড়ালেখা করতে চায় না? 
আজকে যদি সব শিক্ষার্থীকে বলে দেয়া হয়, কাল থেকে তাদের বাধ্যতামূলকভাবে বিদ্যালয়ে আসতে হবে না, আসলেও ইচ্ছে না হলে পড়ালেখা করতে হবে না বা বিদ্যালয়ে এসে তারা তাদের খুশিমতো গান গাইতে পারবে, খেলাধুলা করতে পারবে, তাহলে নিজ ইচ্ছায় কতজন শিক্ষার্থী পড়ালেখা করবে? এ ধরনের একটি গবেষণা হওয়া দরকার।
সেক্ষেত্রে অন্তত ৫০ শতাংশ শিক্ষার্থীরও যদি পড়ালেখার প্রতি আগ্রহ দেখা যায়, তাহলেও সেটি হবে বিরাট খুশির খবর। কিন্তু ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা এতটা আশাবাদী হতে দেয় না। অথচ বিদ্যালয়ে যাওয়া কিংবা পড়ালেখার জন্য শিশুমন বা তাদের বয়স যে কোন বাধা নয়, তা অনেক আগেই প্রমাণিত। অনেক দেশেই শিশুরা বিদ্যালয়ে যাওয়ার জন্য ব্যাকুল থাকে। কারণ, শুরু থেকেই বিদ্যালয়গুলোকে তাদের কাছে আকর্ষণীয় করে তোলা হয়। সেখানে পড়ালেখার জন্য তারা উদগ্রীব থাকে। কারণ, এই পড়ালেখা তাদের দৈনন্দিন আনন্দদায়ক কর্মকান্ডের একটি অংশ। প্রশ্ন হচ্ছে, তাহলে আমাদের শিক্ষার্থীদের কাছে বিদ্যালয় কেন আকর্ষণীয় হয়ে উঠতে পারছে না? কেন পড়ালেখাটা তাদের দৈনন্দিন আনন্দদায়ক কর্মকান্ডের অংশ হচ্ছে না?
প্রশ্নগুলো আসলে অনেক পুরনো। বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্নভাবে এসব প্রশ্ন করা হয়েছে। সরকারি বা বেসরকারি পর্যায়ে যারা শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করেন, তারা নানাভাবে এসব প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার চেষ্টা করেছেন। গবেষকরা নানান গবেষণায় প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজেছেন। কিন্তুু ঠিক উত্তর কি পাওয়া গেছে? পাওয়া গেলে এর কোন ফলাফল দেখা যাচ্ছে না কেন? এর একটা সম্ভাব্য উত্তর হতে পারে, প্রশ্নগুলোর উত্তর যেখানে খোঁজার কথা সেখানে না খুঁজে অন্য জায়গায় চেষ্টা করা হয়েছে কিংবা যে উপায়ে জানা দরকার সেটি ছাড়া বাদে অন্যসব উপায়ে তার জবাব জানার চেষ্টা করা হয়েছে। সাধারনত: এ সংক্রান্ত প্রশ্নের উত্তর সাধারণত বিদ্যালয়ের শিক্ষক, অভিভাবক, ম্যানেজমেন্ট কমিটি, শিক্ষাবিদ প্রভৃতি মানুষের কাছ থেকে জানার চেষ্টা করা হয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে অবশ্য শিক্ষার্থীদের কাছ থেকেও জানার চেষ্টা হয়, কিন্তুতা খুবই বিরল। 
শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে এসব প্রশ্নের উত্তর জানা এবং তাদের ভাবনাচিন্তা জানার মধ্যে একটা বড় পার্থক্য’ও রয়েছে। গবেষণার কাঠামোবদ্ধ প্রশ্নের উত্তরে নির্দিষ্ট কিছু বিষয়ে হয়তো শিক্ষার্থীর মতামত জানওত পারা যায়, কিন্তুতাদের সার্বিক চিন্তা বা মনোভাবের প্রতিফলন এতে মেলে না। শিক্ষা ক্ষেত্রে নীতিনির্ধারকদের কাছে শিক্ষার্থীর ভাবনা জানাটা এখনও জরুরি হয়ে উঠতে পারেনি।
বর্তমানে যে বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর উপস্থিতি বেশি, শিক্ষার্থীর ফলাফল তুলনামূলক ভালো, সে বিদ্যালয়কে আদর্শ ধরে অনেকে তার পরিচালনা পদ্ধতি দেখে এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে চেষ্টা করেন। কিন্তু বাধ্যতামূলকভাবে সব শিক্ষার্থীর নিয়মিত বিদ্যালয়ে আসার সঙ্গে বিদ্যালয় ও পড়ালেখার প্রতি নিজ থেকে আকৃষ্ট হয়ে বিদ্যালয়ে আসার মধ্যে মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। কোচিং, টিউশনি ইত্যাদির মাধ্যমে মুখস্থবিদ্যাকে সম্বল করে ভালো ফল করার সঙ্গে বিষয়বস্ত উপলব্ধি করার মাধ্যমে নিজের অর্জিত অভিজ্ঞতা, জ্ঞান ও দক্ষতা প্রকাশের গুণগত পার্থক্য রয়েছে। ওপর থেকে চাপিয়ে দেয়া পদ্ধতির মাধ্যমে বিদ্যালয় ও শিক্ষার্থীর বাহ্যিক উন্নতি ঘটানো সম্ভব। বাস্তবিকপক্ষে শিক্ষার্থীদের ভেতরের আগ্রহ ও উদ্দীপনাটাকে সম্বল করতে না পারলে অদূর ভবিষ্যতে সব মানুষকে হয়তো ডিগ্রিধারী করা যাবে, কিন্ত শিক্ষিত মানুষ হিসাবে কতজন পাওয়া যাবে, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ থেকে যায়।
বাংলাদেশ শিক্ষা ক্ষেত্রে অনেক জায়গাতেই বেশ সফলতা অর্জন করতে পেরেছে। কিন্ত শিক্ষার গুণগত মান এখনও উদ্বেগজনক পর্যায়েই রয়ে গেছে। গুণগত মান নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে সম্প্রতি নেয়া হচ্ছে নানা উদ্যোগ। এসব উদ্যোগের মূল ফোকাসে শিক্ষার্থীরা থাকলেও তাদের চিন্তা-ভাবনা বা মতামত কন্ত অপ্রতিফলিতই থেকেই যাচ্ছে। 
আমাদের দেশে সাধারণত ‘টপ টু বটম’ অ্যাপ্রোচে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় ও তার বাস্তবায়ন ঘটে। যেখানে যাদের কেন্দ্র করে কর্মকান্ড আবর্তিত হয়, সেখানে তাদের মতামত থাকে উপেক্ষিত। কী করলে শিশুরা বিদ্যালয়ে যেতে উৎসাহী বা পড়ালেখার প্রতি আগ্রহী হবে, সে সমাধান শিশুদের কাছ থেকে পাওয়া সম্ভব কিনা? তা নিয়ে হয়তো অনেকের দ্বিধা থাকতে পারে। কিন্ত শিকার করতেই হবে যে, শিশুরাই সবচেয়ে ভালো জানে কোন কাজ করলে সেটা তাদের কাছে ভালো লাগবে। সেই কাজ বাস্তবায়নের কৌশল নিয়ে হয়তো বড়রা ভাবনা-চিন্তা করতে পারেন। কিন্ত পড়ালেখার সঙ্গে শিশুদের আন্তরিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে চাইলে শিশুদের ভাবনা জানার বিকল্প নেই। 
শিক্ষার্থীদের সমস্যা নিয়ে বা তাদের কোন ভাবনা জানার রেওয়াজ বা আগ্রহ আমাদের নেই। তাই, লেখাপড়া করাটাকে যদি সত্যিই জোর-জবরদস্তির কর্মকান্ড না বানিয়ে শিক্ষার্থীদের দৈনন্দিন প্রয়োজনে বা অভ্যাসে পরিণত করতে চাই, তাহলে তাদের ভাবনা জানার কোন বিকল্প নেই। আমাদের শিশুদের,দেশের আগামী ভালো ভবিষ্যৎ চাইলে আমাদের এসব ভেবে দেখতে হবে। 
 লেখক:  গবেষক ও কলামিষ্ট
১৭১১৫৭৯২৬৭ 

0 comments:

Post a Comment