Friday, June 17, 2016

জাপানীদের দেশপ্রেম, সততা ও শ্রম

জাপানীদের দেশপ্রেম, সততা ও শ্রম
আলী ফোরকান
একবার জাপানের এক দল পরিবেশ কর্মী নিয়ে প্রায় তিন মাস বাংলাদেশে কাটাতে হয়েছিল। তার মধ্যে এক মাসই কেটেছিল টেকনাফে। এখানে থাকার সময় জাপানিরা বেশ ক‘টি টেকনাফ বা চিটাগাংয়ের আঞ্চলিক ভাষা শিখে ফেলেন। তার মধ্যে একটা ছিল ‘ভাই তাড়াতাড়ি...’। ঢাকার অদূরেই শিল্প এলাকায় এক জুতার ফ্যাক্টরিতে একজন জাপানি মাঝে মধ্যে যান এবং কাজ দেখাশোনা করেন। তিনি নাকি বাংলাদেশের বেশ কয়েকটা আঞ্চলিক ভাষার কিছু কথা বলতে পারেন। লুঙ্গি পরে ঘুরে বেড়ান। শুধু ভাষা বা আঞ্চলিক ভাষাই নয়। জাপানিরা যাদের সঙ্গে কমবেশি সম্পৃক্ত হয়। তখন সে তাদের দেশ এবং সে দেশের লোকজনের আচার-আচরণ সম্পর্কে যথাসম্ভব জানার চেষ্টা করে। একজন জাপানির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে ওঠবস করলে একসময় সে এমন সুন্দরভাবে বাংলাদেশের ম্যাপ আঁকা শিখে ফেলে। যা আমাদের দেশের অনেক ভূগোলের শিক্ষকও আঁকতে পারবেন কি-না সন্দেহ। সব চেয়ে আমাকে আর্শ্চয করেছে গত বই মেলায়। আমার বই যে স্টলে সে স্টলে জাপানী এক নারীর শিশুতোষ সচিত্র বাংলা বই দেখে। লেখিকা জাপান থেকে এসেছে বই মেলায় তার বই নিয়ে অংশ গ্রহণ করতে। কথা হচ্ছে, লোক তো বটেই, ভিন্ন কোনো দেশের সঙ্গে বন্ধুত্ব, কাজকর্ম, ব্যবসা-বাণিজ্য যা-ই গড়ে তোলা হোক না কেন। সে দেশ সম্পর্কে অল্পবিস্তর ধারণা থাকা দরকার। সে দেশের লোকজনের আচার-আচরণ, নীতি-আদর্শ, পছন্দ-অপছন্দের ওপর যত বেশি ধারণা নেওয়া যায়, তত বেশি কাজ করে সুবিধা অর্জন করা সম্ভব।
বরাবরই জাপান বাংলাদেশের সামাজিক এবং অর্থনৈতিক অবকাঠামো গড়ে তোলার ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে এবং কিছু সঙ্গত কারণে আগামীতে বাংলাদেশে জাপানের বিনিয়োগ ও আর্থিক সাহায্য-সহযোগিতা পাওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার যেসব দেশ উন্নতির একটা বিশেষ পর্যায়ে আছে সেই তাইওয়ান, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম প্রভৃতি দেশ মূলত জাপানের বিনিয়োগ ও সার্বিক সহযোগিতায় এ পর্যায়ে আসতে পেরেছে। বাংলাদেশ থেকে চীনকে যত উন্নত দেশ মনে করা হোক না কেন, সেই চীন সম্পর্কে শুধু একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। পৃথিবীর উন্নয়নশীল দেশকে ধনী দেশ নানা রকম সাহায্য দেয়। এর মধ্যে একটা আছে ওডিএ (ওভারসিজ ডেভেলপমেন্ট অ্যাসিস্ট্যান্স)। জাপান চীনকে প্রতি বছর ৮১০ বিলিয়ন ইয়েন এই ওডিএ সাহায্য দেয়। জাপান যতবারই এই সাহায্য বন্ধ করে দিতে চায়, চীন ততবারই তাকে এই সাহায্য দেওয়ার জন্য অনুরোধ করে।
যে কোনো দেশ উন্নতির একটা পর্যায়ে আসার পর বিনিয়োগের সুযোগ কমে আসে। কারণ, অনেক বেশি প্রতিযোগিতা হয়, শ্রমিকের বেতন বেড়ে যায়, কাঁচামালে টান পড়ে, বাজার ছোট হয়ে আসে ইত্যাদি। বিনিয়োগ কম বা বেশি করার ক্ষেত্রে কূটনৈতিক সম্পর্কও একটা বিশেষ ভূমিকা রাখে। কাজেই এসব বিষয় বিবেচনা করে বলা যায়, বাংলাদেশে এখন জাপানি বিনিয়োগের উপযুক্ত সময়। ইদানীং জাপানিদের সঙ্গে কথা বলে বোঝা যায়, এদের সে রকম একটা মনোভাব কাজ করে। এখন এটা নির্ভর করছে বাংলাদেশ এ সুযোগ কতটা কাজে লাগাতে পারবে, তার ওপর। বেশ আগে একটা লেখায় বলেছিলাম, কোনো দেশ অন্য দেশে বিনিয়োগ করার সময় সে দেশের আর্থ-সামাজিক অবকাঠামোর ওপর গুরুত্ব দেয় বটে। আবার এটাও ঠিক যে, এই অবকাঠামো গড়ার ক্ষেত্রেও বিনিয়োগ করে লাভবান হতে পারে এবং বিনিয়োগ করে। জাপানিরা উন্নত হওয়ার পেছনে এদের অন্যতম হাতিয়ার হচ্ছে দেশপ্রেম, সততা ও শ্রম। জাপানি বিনিয়োগ পেতে হলে বা এদের সঙ্গে ব্যবসা করতে চাইলে এসব থাকার পাশাপাশি আর যেটা একান্ত দরকার তা হচ্ছে, সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা থাকা এবং কমিটমেন্ট ঠিক রাখা। কোনো কারণে যদি কমিটমেন্ট ঠিক রাখা সম্ভব না হয় তবে অবশ্যই সেটা আগেভাগে জানিয়ে দিতে হয়। আরও কিছু বিশেষ দিক আছে। যেমন- এরা আমাদের মতো স্পষ্টভাবে বা দৃঢ়তার সঙ্গে কোনো কথা বলে না। এমন দুর্বলভাবে হ্যাঁ বা না বলে যে, মনে হতে পারে মত পরিবর্তন হতে পারে। কিন্তু হয় না। জাপানিরা প্রশংসা শোনা পছন্দ করে। প্রশংসা শুনে এরা গদগদ না হয়ে বরং বিনয়ের সঙ্গে প্রতিপক্ষের প্রশংসা করে থাকে। প্রশংসার বিষয় ব্যক্তি বা দেশ দুটিই হতে পারে। জাপানিরা সাধারণত সরাসরি সিরিয়াস আলোচনায় যাওয়ার আগে অন্য কোনো বিষয়ে হালকা কিছু কথা বলে নেয়। যেমন- আজ আবহাওয়া খুব ভালো, আজ বেশ গরম বা শীত অথবা আসার সময় কোনো সমস্যা হয়নি তো ইত্যাদি। এদের সঙ্গে কথা বলার সময় অত্যন্ত মনোযোগী হতে হয় এবং একটা বিশ্বস্ততা গড়ে তোলা একান্ত প্রয়োজন।
দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই জাপানিরা শিষ্টাচারমূলক কথা ব্যবহার করে। যেমন- সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর পরিবারের সদস্য সবাই সবাইকে সুপ্রভাত জানায়। ছোট ছেলে তার মাকে একটা চামচ এগিয়ে দিলেও মা ছেলেকে ধন্যবাদ (আরিগাতো) বলে। খুব ছোট কারণেও জাপানিরা দুঃখিত (সুমিমাছেন), ধন্যবাদ (আরিগাতো), ভুল করলে ক্ষমা করুন (গোমেন নাছাই), কিছু চাওয়ার ক্ষেত্রে (অনিগাইসি মাছ) কথাগুলো ব্যবহার করে। কোনো বিদেশি এসব জাপানি ভাষা না জানা থাকলে ক্ষতি নেই। ইংরেজিতে বললেও চলে। কিন্তু কিছু না বললে এরা মনে মনে খুব রাগ হয় এবং মনে করে শিষ্টাচার জানে না। বাংলা, আরবি, ফারসি বা যে ভাষাই হোক না কেন, এ রকম আদব বা শিষ্টাচারের ভাষা ও রীতি আমাদের দেশেও আছে। কিন্তু আমরা অনুশীলন করি না। জাপানি সমাজে উপহার দেওয়া ও নেওয়া খুব গুরুত্ব বহন করে। উপহার দিলে নিতে হয়। দেওয়ার ব্যাপারটা অবশ্য পরিবেশ-পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে। কাজেই ছোটখাটো কিছু উপহার সবসময় সঙ্গে রাখা ভালো। এরা গোত্র বা জাতিগত বিষয়কে অধিক গুরুত্ব দিয়ে থাকে। কাজেই যে কোনো ভালো বা খারাপ কাজের জন্য কোনো ব্যক্তির চেয়ে তার দেশ বা জাতির প্রতি দায়দায়িত্ব বেশি বর্তায়।
জাপান সরকারের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বেশ কয়েক বছর বাংলাদেশে ছিলেন এবং প্রয়োজনে এখনও যান। তিনি বাংলাদেশের গত হাজার বছরের ইতিহাস-ঐতিহ্য, সাহিত্য-সংস্কৃতি, স্বাধীনতা যুদ্ধ, সমাজ ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের ওপর ৫৪০ পৃষ্ঠার জাপানি ভাষায় এক বই লিখেছেন। বইটির দাম সাড়ে পাঁচ হাজার টাকা। তার অনেক কথার মধ্যে একটা কথা এ রকম ছিল যে, প্রধানমন্ত্রী জাপানে কী নিয়ে এসেছেন? গত শতকের মাঝামাঝি সময়ের দিকে জাপানের প্রধানমন্ত্রী আমেরিকা সফরে গেলে সেখানকার পত্রপত্রিকায় সংবাদ হতো যে, জাপানের রেডিওর সেলসম্যান আমেরিকায় আসছে। ভদ্রলোক হয়তো তেমন কিছুই ইঙ্গিত করেছেন। জাপানিদের কাছে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আরেকটা পরিচয় আছে। রাহামান সান নো মুছুমে (মি. রহমানের কন্যা)। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নামের শেষের রহমান জাপানি ভাষায় উচ্চারণ হয় রাহামান। সান শব্দের অর্থ হচ্ছে মিস্টার বা মিসেস, মুছুমে মানে কন্যা। যেটা আমরা বাংলাদেশের স্বার্থে কাজে লাগাতে পারি।

0 comments:

Post a Comment